অন্ততপক্ষে দুটো প্রজন্মের টেনিসপ্রেমীদের কাছে, ফেডেরার ছিলেন নেস্লে চকোলেটের মতো মিষ্টি, ওমেগা ঘড়ির মতো নির্ভুল, আর আল্পস পর্বতমালায় তাঁর জন্মভূমি বাসেলের মতো শান্ত এবং নিরুদ্বিগ্ন। সত্যি বলতে, ফেডেরারকে ভালবাসার হাজার-একটা কারণ রয়েছে! কিন্তু ফেডেরার ঠিক কোথায় অনন্য? কেন তাঁর ভক্তরা তাঁকে পাগলের মতো ভালবাসে? আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি কি সত্যিই ততটা ভাল? ফেডেরার-প্রেমীদের এই রহস্য খোলসা করা প্রয়োজন।
২০০১ সালে, বড়ি-খোঁপার মতো পনিটেল আর মাধ্যমিক-পড়ুয়ার মতো রুখুসুখু দাড়ি নিয়ে একটা ছেলে সেকালের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় পিট সাম্প্রাসকে হারিয়েছিল। ফেডেরারের বয়স তখন ছিল মাত্র উনিশ বছর। আমি সেই খেলাটা লাইভ দেখেছিলাম, যার কয়েকটা র্যালি আর শট আজও মনে আছে। মনে আছে, যখন সাম্প্রাস ম্যাচটা বাঁচানোর জন্য সার্ভ করছিলেন, তাঁর দ্বিতীয় সার্ভের কী রিটার্নটা দিয়েছিলেন ফেডেরার! ফেডেরারের খেলাতেও আলাদা একটা ব্যাপার ছিল, আর খেলার শেষে তাঁর প্রতিক্রিয়াতেও। যেন শ্রেষ্ঠত্বের একটা ব্যাটন এক হাত থেকে চলে এল অন্য হাতে, আর গোটা দুনিয়া টেনিসের এক নতুন যুগের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ফেডেরার এমন খেলোয়াড়, যিনি গোটা কোর্টটা নিয়ন্ত্রণ করবেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে পয়েন্ট তুলতে প্রতিপক্ষদের ঘাম ঝরে যাবে। ফেডেরার কতদিন টিকবেন সেটা তখনও বোঝা যাচ্ছিল না, কেননা তিনি খুব কেঁদেছিলেন, পরাজিত অথচ নির্বিকার সাম্প্রাসের থেকে অনেক বেশি। আর তা থেকেই আমরা যাব এই লেখার পরের পর্যায়ে।
ফেডেরারের যুগ শুরু হল ঠিক এমন সময়ে, যখন সব অর্থেই একটা নতুন শতাব্দী শুরু হচ্ছে, আর ছেলেরাও আবেগপ্রবণ হতে এবং সারা পৃথিবীর সামনে সেই আবেগ প্রকাশ করতে এতটুকু লজ্জা পাচ্ছে না। মোটামুটি ধরে নেওয়াই যায়, ফেডেরার যে দশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম হেরেছেন তার পাঁচটাতে, আর যে কুড়িটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন তার আঠারোটাতেই কেঁদেছিলেন। কেন তিনি কাঁদেন? অনেক তত্ত্ব হাওয়ায় ওড়ে। উনি কি প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েন, না কি দর্শকাসনে তাঁর পরিবারকে দেখে আপ্লুত হয়ে যান, না কোনও প্রাক্তন বড় খেলোয়াড়ের (রড লেভার, বিয়র্ন বর্গ, ক্রিস এভার্ট— কেউ একজন হলেই হল) উপস্থিতি তাঁকে কাঁদায়, না কি স্রেফ নিজের র্যাকেটটা দেখেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন? যে কোনও কিছুই তাঁর কান্নার কারণ হতে পারে, আর ফেডএক্স-এর সেই ব্যাপারটা দেখেই আমরা উদ্বেল হয়ে উঠি।
২০০৩ সালে ফেডেরার যখন প্রথম বারের জন্য উইম্বলডন ফাইনালে জেতেন, সৌরভ গাঙ্গুলি তখন ভারতের অধিনায়ক। আবার সৌরভ যখন বিসিসিআই-এর সভাপতি, সেই ২০১৯-এ ফেডেরার হৃদয়বিদারক ভাবে উইম্বলডন ফাইনালে হারেন। পাশাপাশি, ‘দি অ্যাপ্রেন্টিস’ রিয়েলিটি টিভি শো-য় ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন সবে আবির্ভূত হচ্ছেন, ২০০৪ সালে ফেডেরার প্রথমবার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেন। আবার ২০১৮ সালে ফেডেরারের মেলবোর্নে ষষ্ঠ খেতাব পাওয়ার সময়ে, ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ, এই পৃথিবী বহুবার ওলট-পালট হয়েছে, বদলেছে, কিন্তু ফেডেরার থেকে গেছেন ধ্রুব, স্থির— এক রুচিমান, আশ্বাসময় প্রেরণা। তাঁকে দেখে কোনও কোনও মধ্যবয়সি নিজেকে তরুণ বলে ভাবার সাহস পান। কারও কাছে তিনি— কীভাবে চিরকাল মান ধরে রাখতে হয়— তার প্রতীক। তাঁর প্রথম জয়ের সময় যেসব ছেলেমেয়ের টেনিস বোঝার বয়সই হয়নি, তারাই এখন তাঁর অন্ধ ভক্ত, তাঁর অসম্ভব জয় আর অভাবনীয় ভুলগুলোর মধ্যেই তাদের বাঁচা-মরা।
ফেডেরারের একজন মহান প্রতিপক্ষ ছিলেন, ফেডেরারের কেরিয়ারের বেশির ভাগ সময়টাই যিনি সমানে-সমানে টক্কর দিয়েছেন। ফেডেরার যদি হন লুক স্কাইওয়াকার, তবে রাফায়েল নাদাল হলেন ডার্থ ভেডার। ফেডেরার রবিশঙ্কর হলে, নাদাল বিলায়েত। যতই আপনি ওঁদের যে-কোনও একজনের ভক্ত হোন না কেন, (নাদালের ভক্তসংখ্যা বিপুল!) আপনি নিশ্চিত জানেন, অন্যজনও খুব পছন্দের যোগ্য, আর বহুদিন ধরে অসামান্য চ্যাম্পিয়ন। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাই অনেককে এই খেলায় আকৃষ্ট করেছে, এই খেলাটাকে বুঝতে উৎসাহী করেছে, যার ফলে এই দুজন থাকলেই একটা টুর্নামেন্ট একেবারে সুপারহিট হয়ে গেছে। আজ, তাঁদের লড়াই প্রায় দাবার মতোই, যেখানে দুজন খেলোয়াড়ই একে অপরের খেলার সঙ্গে এতটাই পরিচিত যে, আগে থেকেই অনুমান করতে পারছেন, পরের চাল কী হবে।
আন্দ্রে আগাসি একবার বলেছিলেন, টেনিস হচ্ছে নিঃসঙ্গতম খেলা। এমনকী তোমার প্রতিপক্ষও যেখানে একটা নেট-এর ও-পারে, প্রায় ২৫ মিটার দূরে। ফেডেরারকে দেখে এ-বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন মনে হয়, এবং মাঠের বাইরে তিনি পুরোমাত্রায় এই অভাব পূরণ করে নেন। বেশির ভাগ খেলাতেই তিনি বাবা-মা, স্ত্রী, আর চার সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যান, যে-কারণে তিনি একজন সংসারী পুরুষ হিসেবে পরিচিত। তাঁর ব্যক্তিত্বটাই এমন, যেন তিনি পুরনো মূল্যবোধেও বিশ্বাসী, আবার একই সঙ্গে, যাঁরা জীবনকে অন্যভাবে দেখেন, তাঁদের সঙ্গেও স্বচ্ছন্দ।
কেউ হয়তো তর্ক করবেন, ফেডেরার নানান সামাজিক ঘটনায় দৃঢ় অবস্থান নিতে পারতেন। মনে রাখতে হবে, একজন ক্রীড়া-প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সমগ্র আফ্রিকায় দুঃস্থদের জন্য টাকা তোলায় সাহায্য করেছেন, এমনকী তাঁর যখন বয়স খানিকটা কম, সেই ২০০৪ সালে সুনামির ত্রাণকার্যে অংশ নিয়েছিলেন।
গোটা পৃথিবী জুড়ে একটা সমীক্ষা হয়েছিল, কোন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব সকলের চোখে সম্মাননীয় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন। সেটা ছিল ২০১১ সাল, স্বাভাবিক ভাবেই নেলসন ম্যান্ডেলার নাম ছিল শীর্ষে। একটা জাতির জনক, শান্তির বাহক, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহুজাতি সমন্বয়ের ধারণা দিয়েছিলেন— সেই মাডিবা’র চেয়ে বড় আর কে-ই বা হতে পারে? কিন্তু যেটা দেখে খুব ভাল লেগেছিল— দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ফেডেরার। তবে, আজ সেরকম কোনও সমীক্ষা হলে এই সুইস চ্যাম্পিয়নই হয়তো সম্মান এবং বিশ্বাসযোগ্যতার শীর্ষে থাকবেন। তাঁর গল্প, তাঁর সাফল্য যে শিক্ষাগুলো দেয়, তা খুব সহজ: ভাল লোক হলেই সে যুগের প্যাঁচ-পয়জারে হেরে যাবে তার কোনও মানে নেই। সত্যিকারের জয়ের মধ্যে হিংস্রতা বা বিদ্বেষ থাকে না, বরং শ্রী থাকে, প্রসন্নতা থাকে। আর, অধিকাংশ সময়েই, তুমি ক’টা ট্রফি জিতছ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— খেলার সময় তুমি কতটা আনন্দ দিলে।