একভাবে দেখতে গেলে গোটা বিশ্বের মানুষ করোনায় আক্রান্ত। বহু মানুষ সরাসরি ভাইরাসে আক্রান্ত, আর অসংখ্য মানুষ ভাইরাসের জন্য লকডাউনের প্রভাবে আক্রান্ত। মানুষের তো ব্যক্তিগত স্তরে নানা সমস্যা থাকবেই, কিন্তু একটা সমাজ বা গোষ্ঠীর ওপর সার্বিক প্রভাব পড়েছে কি?
অবশ্যই পড়েছে। আমি এমন কোনও মানুষ দেখিনি যাঁর ওপর এই লকডাউনের প্রভাব পড়েনি, ভাইরাসের আতঙ্ক ছড়ায়নি। এবং সেই ব্যক্তিগত আতঙ্ক আর মানসিক সমস্যা একটা গোষ্ঠীর ওপরেও প্রভাব বিস্তার করে।
আমরা প্রথম দিকে কিন্তু মানতে চাইনি যে এই করোনাভাইরাস আমাদের দেশে এসেছে এবং আমরা আক্রান্ত হতে পারি। আমরা ভাবতাম ওটা চাইনিজ ভাইরাস, আমাদের ধরবে না। এর পর যখন আমরা দেখলাম বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন সবার মধ্যে একটা তীব্র উদ্বেগ, প্রচণ্ড ভয় গেড়ে বসেছিল। সেখানে কোনও উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত বিভাজন ছিল না। পুরো ব্যাপারটাই ছিল অজানা। ভাইরাসও অজানা, তার চিকিৎসাও অজানা। সেই সঙ্গে নানা রকম কথা শুনছিলাম। মানুষজন চারিদিকে মারা যাচ্ছে, কেউ দেখা করতে পারছে না প্রিয়জনদের সঙ্গে। কবে দেখা হবে, সে-সবও বোঝা যাচ্ছে না। এই ভাইরাসের প্রভাব কত দিন থাকবে, আদৌ এর কোনও চিকিৎসা হবে কি না, টিকা আবিষ্কার করা যাবে কি না, গেলেও তা কতটা কার্যকর, কবে সেই টিকা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে? এসব নিয়ে খুব আশঙ্কা ছিল। হয়েছিল কী, প্যানডেমিকের সঙ্গে সঙ্গে একটা ইনফোডেমিক হয়েছিল। এত রকমের তথ্য, বেশির ভাগ সময় ভুল তথ্য, অদ্ভুত তথ্য— ডিম খাব কি না, চাইনিজ খাবার খাওয়া উচিত নয়— এসব নিয়ে একটা সার্বিক আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। মানুষের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তথ্যের অভাব এবং বাহুল্য, দুইয়ের মিশেলে কেউ কাউকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল না। এই সবরকম ব্যবহারই কিন্তু একটা সমাজের মানুষদের প্রভাবিত করে। এবং এই প্রভাব যে ভাইরাস চলে গেলেই চলে যাবে, তা না-ও হতে পারে।
মানুষ কি সচেতন হয়ে এখন অযৌক্তিক ব্যবহার বন্ধ করেছে বলে মনে হয়?
প্রথম কথা হচ্ছে, মানুষ এখন দায়ে পড়ে, দেখেশুনে স্বীকার করছেন যে করোনা ব্যাপারটা সত্যি। এক ধরনের রিজাইনড অ্যাকসেপ্টেন্স এসেছে। না চাইলেও মানতে হচ্ছে। তবে এটা বুঝতে হবে যে করোনার সত্যিটাকে গ্রহণ করতে না-চাওয়াটা একটা ডিফেন্স মেকানিজম। অনেকে নিজেকে বোঝাতে চাইছিলেন যে এই রোগটা নেই, বা থাকলেও তাঁর হবে না। যেমন, গ্রামের দিকে অনেক মানুষ আমায় বলেছেন, এই রোগ শহরের রোগ, আমাদের গ্রামের দিকে নেই, আমাদের হয়ও না, আর সেজন্য আমাদের জীবনে বাধানিষেধও নেই। আমার কাছে যদিও কোনও তথ্য নেই, কিন্তু সত্যিই দেখেছি, গ্রামের দিকে কম মানুষের হয়েছে। এবার, যাঁরা গ্রামের দিকে থাকেন, তাঁদের আপনি কী যুক্তিতে বোঝাবেন? সুতরাং, তাঁদের অযৌক্তিক কথাবার্তা থাকবেই। শহরের লোকজন এখন অনেক সচেতন হয়েছেন এবং ভয় থাকলেও সেটা আতঙ্কের পর্যায়ে পৌঁছয়নি।
আপনি বলছেন লকডাউনে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর মধ্যে কি কম-বেশি আছে?
সে তো আছেই। তবে আমাদের সাধারণ ধারণায় যে ছিল একবারে গরিব লোকেরা খুব বিপদে পড়েছেন, তাঁরা খুব খারাপ আছেন, তা কিন্তু নয়। তাঁরা কিন্তু আলাদা করে কিছু খারাপ থাকেননি। তাঁদের আগের জীবনযাপনও খুব কষ্টের ছিল। আর তাঁরা এমন জায়গায় থাকেন, সেখানে দূরত্ব বজায় রেখে থাকারও তাঁদের উপায় নেই। বরং, তাঁদের মধ্যে চিন্তা, আতঙ্ক, এমনকী সংক্রমণও কম দেখেছি।
যাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁরা বরং অর্থনৈতিক এবং মানসিক দু’ভাবেই খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর্থিক সংস্থান অনেকেরই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। অনেকের তো চাকরিই চলে গিয়েছে। যাঁরা ছোট ব্যবসায়ী তাঁদেরও অর্থের জোগান কমে গিয়েছে বা প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছে। অথচ এই শ্রেণির মানুষজনদের সমাজে এক রকম সচ্ছল অবস্থান ছিল। সেখান থেকে হঠাৎ এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়াটা তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়েছে। কেউ হয়তো ছেলেমেয়েদের স্কুলে মাইনে দিতে পারছেন না, কেউ মা-বাবার ওযুধপত্র কিনে দিতে পারছেন না। ফলে, লোকলজ্জা বাড়ছে, এবং তা থেকেই মানসিক অবসাদ গ্রাস করছে। ভবিষ্যৎ এত অনিশ্চিত যে সেই অনিশ্চিত আতঙ্কের পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা। কোভিডের সময় অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এমনকী কলকাতা পুলিশের বর্ষীয়ান আধিকারিকরা বলছেন, এত কম সময়ে এত বেশি সংখ্যক আত্মহত্যা তাঁরা কখনও দেখেননি।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম— এর ফল কি ভাল হয়েছে না মন্দ?
যদি মালিক পক্ষের দিক থেকে দেখা যায়, তা হলে লাভ হয়েছে তাঁদের। অফিস চালানোর নানাবিধ খরচ কমে গিয়েছে। কিন্তু যাঁরা কাজ করছেন বাড়ি থেকে, তাঁরা প্রথম প্রথম ভেবেছিলেন ব্যাপারটা ভারি আরামের। কিন্তু যত সময় গেছে, ততই মালুম হয়েছে যে বাড়ি থেকে কাজ করার ব্যাপারটা সোজা নয়। অফিসে থাকলে বোর্ডরুমে বসে যে মিটিংটা সবাই মিলে করে নিলে সময় লাগত আধ ঘণ্টা, এখন অনলাইনে সেই মিটিং-এ সময় লাগছে অন্তত দু’ঘণ্টা। কেবল তা-ই নয়। অফিস থেকে বেরিয়ে এলে আর অফিসের কাজে তেমন ভাবে নিযুক্ত থাকতে হত না। এখন কিন্তু অফিস-আওয়ার্স বলে কিছু নেই। সব সময়ই ল্যাপটপ খুলে কাজ করে যেতে হচ্ছে। তার সঙ্গে থাকছে বাড়ির কাজ। কর্মরত মহিলাদের ক্ষেত্রে তো বাড়ি থেকে কাজ করাটা একটা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের বাড়ি, বাচ্চা, অভিভাবক, শ্বশুর, শাশুড়ি— সবাইকে দেখতে হচ্ছে। বাড়ির সিংহভাগ কাজ করতে হচ্ছে, সঙ্গে অফিসের কাজ সামাল দিতে হচ্ছে। এবং সবচেয়ে দুঃখজনক হল, তাঁদের কাজের কোনও স্বীকৃতি নেই। বাড়িতে কাজের লোক যে ছিল, সে না এলে বাড়ির বউটিকেই যে বেশির ভাগ কাজ করতে হবে, তা আমাদের মনে ও যাপনে গেঁথে গেছে। ফলে, বাড়ির পুরুষটি যতই সাহায্য করুন না কেন, বেশি খাটনি কিন্তু মেয়েদের ওপরই পড়ে। হ্যাঁ, এর কিছু ব্যতিক্রম তো আছেই। অনেক ছেলেই এই লকডাউনে বাড়ির কাজে সাহায্য করেছেন। এটা নিশ্চয়ই মানসিক বদলের একটা ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সেটা কত শতাংশ, সেটাও কিন্তু আমাদের যাচিয়ে দেখতে হবে।
মেয়েদের প্রসঙ্গ যখন উঠল, তখন প্রশ্ন ওঠে, মেয়েদের কি আলাদা রকম মানসিক সমস্যা বা চাপ হয়েছে এই লকডাউনে?
যাঁরা তরুণী তাঁদের ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে বলার কিছু নেই, তাঁদের সমস্যা গোটা তরুণ প্রজন্মের সমস্যা। কিন্তু যাঁরা গৃহবধূ বা কর্মরত মহিলা, তাঁদের ক্ষেত্রে একটা অসীম চাপ তৈরি হয়েছে। তাঁদেরও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ভাবাচ্ছে, তার সঙ্গে কাজের লোকের অনুপস্থিতিতে বাড়ির কাজ, বাচ্চার দেখাশোনা, বয়স্কদের দেখাশোনা, সব করতে হচ্ছে। যাঁরা অফিসে কাজ করছেন, এগুলোর সঙ্গে তাঁদের অফিসের কাজও করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোথাও ভুলচুক বা দেরি হয়ে গেলে, বলা হচ্ছে, মেয়েদের যোগ্যতা নেই বা ফাঁকিবাজ তাঁরা। যখন বাড়িতে কোনও পুরুষ কাজ করেন, তখন কী করে যেন সবাই জেনে যায় যে তাঁকে বিরক্ত করা চলে না। কিন্তু বাড়িতে কোনও মহিলা যখন কাজ করেন, তখন কিন্তু তাঁকে অবলীলায় বিরক্ত করা যায়, তাঁর মিটিং-এর মধ্যে ঢুকে পড়ে হাজার কথা জিজ্ঞেস করা যায়। তাঁর কাজকে গুরুত্ব না দিলেও চলে।
শুধু তা-ই নয়, বাড়ির পুরুষরা, যাঁরা মদ-সিগারেট খাওয়ায় অভ্যস্ত, তাঁদের অবস্থা খুব সঙ্গিন হয়েছিল এই লকডাউনের সময়। কারণ সিগারেট বা মদ পাওয়া যাচ্ছিল না। দোকান বন্ধ ছিল। ফলে তাঁদের উইথড্রয়াল সিনড্রোম শুরু হয়েছিল। এবং তার বহিঃপ্রকাশ কী? স্ত্রী-র প্রতি নির্যাতন। মারধর, অশান্তি, অশ্রাব্য গালিগালাজ। এক্ষেত্রে অবশ্য গৃহবধূ ও কর্মরত মহিলা, দু’ধরনই একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমি এমনও ফোন পেয়েছি, যেখানে মহিলাটি বলছেন, কোথায় মদ বা সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে বলতে পারেন, তা হলে বাড়িতে অন্তত একটু শান্তি থাকে।
তবে, কেবল নেশার কারণে পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে এমন নয়। আরও কারণ আছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট একটা প্রধান কারণ এর মধ্যে। পরিসংখ্যানও বলছে, লকডাউনের সময় পারিবারিক নির্যাতন বেড়েছে।
শিশুদের ওপর কী প্রভাব পড়েছে?
আমি তো বলব, সবচেয়ে মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিশু ও কিশোররা। যাদের বয়স একেবারে ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে, তাদের সার্বিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লকডাউনের জন্য। তারা এই সময় নানা মানুষের সঙ্গে মেশে, এ কোলে নেয়, সে আদর করে, নানা রকম আওয়াজ বের করে খেলা করে। শিশুরা দাদু-দিদিমা, ঠাকুমা-ঠাকুরদাকে দেখে, রাস্তায় বেড়াতে যায়, নতুন নতুন জিনিস দেখে— লকডাউনে এসব কিছুই হয়নি। ফলে তাদের কথা বলতে, হাঁটতে দেরি হচ্ছে। বাচ্চাদের স্ক্রিনটাইম বেড়ে গেছে, ফলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধা পাচ্ছে। তাদের মনোনিবেশে সমস্যা হচ্ছে। এর প্রভাব বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী হতেই পারে। কারণ স্ক্রিনটাইম কমানোর কোনও ব্যবস্থাই তো করা যাচ্ছে না। না তারা বাইরে খেলতে যেতে পারছে, না স্কুলে যেতে পারছে। আর ওদেরও তো ভয় করে। ওরাও ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু সব যুক্তি দিয়ে বোঝার বয়সও ওদের হয়নি। ফলে বাচ্চাদের অবস্থাটা বেশ চিন্তাজনক।