বিষ্ণুর সবচেয়ে বিতর্কিত অবতারগুলোর মধ্যে একটি হলেন ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম। এ কারণেই তাঁর খুব বেশি মন্দির আমরা দেখি না, যেগুলো আছে সেগুলোও কোঙ্কন উপকূল বা কর্নাটকে পরশুরামের মা রেণুকার মন্দিরের আনুষঙ্গিক অংশ। তাঁকে নিয়ে এই বিতর্কের দুটি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণটি হচ্ছে, মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। গল্পে আছে, রাজকুমারী রেণুকা বিবাহ করেছিলেন জমদগ্নিকে, তাঁর ঔরসে তিনি জন্ম দেন পাঁচ পুত্রসন্তানের। একদিন নদীতে জল তুলতে গিয়ে রেণুকা জলে এক গন্ধর্বের প্রতিবিম্ব দেখতে পান। কারও কারও মতে, এই গন্ধর্ব ছিলেন রাজা কার্তবীর্যার্জুন। সেই গন্ধর্বের প্রতি ক্ষণিকের জন্য রেণুকার মনে কামনা জাগে। তাঁর সতীত্ব এবং পতির প্রতি আনুগত্যের প্রসাদে রেণুকার এমন মায়াবী শক্তি ছিল যে, তিনি কাঁচা মাটির পাত্রেও জল সংগ্রহ করে আনতে পারতেন। এই কামনার ফলে সে-শক্তি তিনি হারিয়ে ফেলেন। স্ত্রীর এই ক্ষণিকের ব্যভিচারের কথা জানতে পেরে জমদগ্নি আদেশ দেন, রেণুকার মাথা কেটে ফেলতে হবে। ক্ষণস্থায়ী কুচিন্তার প্রভাবে রেণুকা যে কোনও অন্যায় কাজ করেননি, তা জেনেও জমদগ্নি তাঁকে ক্ষমা করতে রাজি হন না। চার বড় ছেলে এই আদেশ অমান্য করেন এবং পিতার অভিশাপে নপুংসক হয়ে যান। কনিষ্ঠ পুত্র পরশুরাম বাবার আদেশ মেনে নেন এবং কুঠার তুলে তার আঘাতে কেটে ফেলেন নিজের মায়ের মাথা। এরপরে তিনি বাবার কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি যেন মন্ত্রবলে মৃত মা’কে আবার বাঁচিয়ে তোলেন।
পরশুরামের এই দিকটা নিয়ে হিন্দুত্বে সচরাচর আলোচনা চলে না, সেখানে জোর দেওয়া হয় দ্বিতীয় একটি উপাখ্যানের উপর। সেই গল্পে, কার্তবীর্যার্জুন পরশুরামের বাবার গরু চুরি করতে যান। এই চুরি নিয়ে বচসা করতে করতে কার্তবীর্যার্জুন জমদগ্নির মাথা কেটে ফেলেন। অপরাধের প্রতিশোধ নিতে পরশুরাম শুধু কার্তবীর্যার্জুনকেই বধ করেন না, তাঁর পুত্রদের, এবং তাদের সমর্থনে যে ক্ষত্রিয় রাজারা এসেছিল, সবাইকেই হত্যা করে পাঁচটি সরোবর লাল করে দেন তাদের রক্তে। এই ভয়ানক হত্যালীলার ফলে দেখা যায়, সমস্ত বিপক্ষকে পরাজিত করে পরশুরাম হয়ে উঠেছেন সমস্ত আর্যভূমির প্রভু। সে-সমস্ত জমি তিনি দান করে দেন ব্রাহ্মণদের এবং শেষে তার কুঠার ছুঁড়ে ফেলে দেন সমুদ্রে। সে অস্ত্র দেখে আতঙ্কে সমুদ্র সিঁটিয়ে গিয়ে পিছনে সরিয়ে নেয় নিজেকে, যে সমুদ্রের সরে আসায় সৃষ্টি হয়েছে আজকের কোঙ্কন উপকূলের।
শোনা যায়, ব্রাহ্মণেরা পরশুরামকে সমাজ থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। তাঁর নিজের ক্ষমতায় উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় পরশুরাম অস্ত্রবিদ্যায় পটু একদল যোদ্ধা সন্ন্যাসী তৈরি করেছিলেন, অত্যাচারী রাজাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। বলা হয়, কোনও ব্রাহ্মণ পরশুরামের দলে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি মন্ত্রবলে মৃত ব্রাহ্মণদের বাঁচিয়ে তুলে গঠন করেন তাঁর সম্প্রদায়। চিতা থেকে তুলে তাঁদের শুদ্ধ (পাবন) করা হয়েছে, এ কারণে তাঁদের নাম হয় চিতপাবন ব্রাহ্মণ, মরাঠা সাম্রাজ্যের গঠনে এঁদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কেরালার নায়ার সম্প্রদায়কেও পরশুরাম যুদ্ধপদ্ধতি বা মার্শাল আর্টে প্রশিক্ষণ দেন। কিছু রাজপুতদের বিশ্বাস, তিনি যজ্ঞ বা ‘হাভন’ করে সেই আগুন থেকে জন্ম দেন রাজবংশীয় অগ্নিকুল রাজপুতদের, যাঁরা পূর্ববর্তী ক্ষত্রিয়দের ছেড়ে যাওয়া স্থান অর্জন করেন।
গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে হিন্দুত্ববাদীরা তুলেছে পরশুরামের পেশিবহুল, বীরপুরুষের মতো সব মূর্তি, হাতে উদ্যত কুঠার। এ কুঠারেই ছিন্ন হয়েছে কার্তবীর্যার্জুন এবং রেণুকা দুজনেরই মাথা— এ হয়তো মানুষের প্রতি সাবধানবাণী, পুরুষ হও বা নারী হও, হিন্দুত্বের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অমান্য কোরো না।
পরশুরামের সহিংসতাকে মাহাত্ম্য দেওয়া হয় ধার্মিক হিংসা বা ন্যায়ের পক্ষে লড়ার অস্ত্র হিসেবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেটা বলা হয় না, সেটা এই— ভীষ্ম, দ্রোণ বা কর্ণের মতো পরশুরামের সকল ছাত্রই বিষ্ণুর অষ্টম অবতার কৃষ্ণের বিচারে অধার্মিক। পাণ্ডবদের ন্যায়সম্মত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখেন যে কৌরবেরা, তাঁদের প্রতি আনুগত্যের অপরাধে এঁদের প্রত্যেকেরই বিনাশ হয়।