ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • মন্ত্রপূত শরবত আর একটি বেঁটে লোক


    সুদেষ্ণা রায় (March 7, 2021)
     

    আমার বয়স তখন হবে ১১+। বই পড়তে ভালবাসি। আর কমিক্স, আজকের দিনে যার নাম হয়েছে গ্রাফিক নভেল, তা পড়তে আরও ভালবাসি। সে সময় টিভি ছিল না কলকাতায়। সিনেমা দেখাটা ছিল এক বিরল সৌভাগ্য। ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’, ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’, ‘দ্য গ্রেট রেস’, ‘ইটস আ ম্যাড ম্যাড ম্যাড ওয়ার্ল্ড’ ও স্পেশাল শো-তে ‘লোরেল হার্ডি’, ‘চার্লি চ্যাপলিন’ বা ‘টারজান’ এর কিছু সিনেমা দেখেছি। ন’মাসে ছ’মাসে একটা কি দুটো। কমিকই ছিল আমাদের জীবনের অন্যতম আনন্দ। যদিও বড়রা অনেকেই মনে করতেন, কমিক বই প্রকৃত শিক্ষার পরিপন্থী। আমার মা তাঁদের দলে ছিলেন না। তাই কমিক-ওয়ালার থেকে প্রতি শুক্রবার নেওয়া হত, একদিনের জন্য পাঁচটি কমিক বই। রিডিং চার্জ ২৫ পয়সা। গোগ্রাসে গিলতাম পড়ার ফাঁকে কমিকগুলো। রিচি রিচ, আর্চিস, ম্যানড্রেক, এমনকী টিনটিনও পড়েছি এভাবে কমিক লাইব্রেরি মারফত। আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম, কিন্তু কমিক পড়ে আমি ঝরঝরে ইংরেজি শিখেছিলাম। যাকে বলে স্পোকেন ইংলিশ।

    একদিন হঠাৎ কমিক-ওয়ালা নিয়ে এল নতুন এক চরিত্রের কমিক। অ্যাসটেরিক্স দ্য গল। বলল, এই একটা কমিক পড়ার দামই ২০ পয়সা। কেন? ‘ফেরান্স থেকে আংরেজি হয়ে এসেছে তো, তাই!’ মা’র সঙ্গে চলল দরাদরি, ইতিমধ্যেই আমি বইটা খুলে পড়তে শুরু করেছি। যতক্ষণে মা’র সঙ্গে ১৫ পয়সায় রফা হল, ততক্ষণে আমি অন্তত ৫ পয়সার পড়ে ফেলেছি। মা তা দেখে বললেন, ‘এই দ্যাখো ও তো প্রায় অর্ধেক পড়েই ফেলেছে… তুমি বরং নিয়ে যাও… ।’ মাকে ভালবাসতাম, ভয়ও করতাম, কিন্তু সেই বয়সেও আমার সাহস ছিল রুখে দাঁড়ানোর। ‘আমি তো মাত্র ৫ পয়সার পড়েছি মা, আর তুমি তো ওর থেকে ৫ পয়সা কমিয়ে নিয়েছ। এবার আমি বাকি ১৫ পয়সাটা ধীরেসুস্থে পড়ি?’ মা হতবাক! আর কমিক-ওয়ালা রহমত আলি আমাকে ঝুড়ি ঝুড়ি আশীর্বাদ করে বলে, ‘আপনার খোঁকি ডাগতার, ইঞ্জিনিয়ার বা বাকিল জরুর বানবে।’ মা গজগজ করে বললেন, ‘ছাই হবে।’ তবে কমিকটা নেওয়া হল। আর সেই থেকে আমার অ্যাসটেরিক্স-প্রেম শুরু। ওই একদিনে আমি প্রায় চারবার কমিকটা পড়ে ফেললাম। ১১ বছর বয়সে আমি খুবই ক্ষীণকায়া ক্ষুদ্রাকৃতি ছিলাম। অন্যান্য বন্ধুদের থেকে সাইজে ছোট। হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। অবশ্য এখন কেউ বুঝবে না সেইসব দিনের কথা। সে যাকগে দুঃখের কথা। অ্যাসটেরিক্স এক শুক্রবার রাতে আমার জীবনে নতুন দিশা আনিয়ে দিল। ‘স্মল ইস অলসো স্ট্রং!’ এটা পরিষ্কার হয়ে গেল। মাত্র পাঁচ ফুট শূন্য মানুষটি, তার থেকে ডবল মাপের রোমান সৈনিকদের পটাপট কাবু করছে। অবশ্যই ড্রুইড গেটাফিক্স-এর তৈরি ম্যাজিক পোশন বা মন্ত্রপূত শরবত খেয়ে। মনে মনে আমিও ওই শরবত বানানোর পদ্ধতি খুঁজতে থাকি। 

    অ্যাসটেরিক্স জীবনে আসার আগে অবধি আমি ঠিক করেছিলাম, বিয়ে করলে বাবার মতো লম্বা কাউকেই করব। অ্যাসটেরিক্স আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ক্ষুদ্র পুরুষ। অ্যাসটেরিক্স ইতিহাস, ভূগোল, সমাজতত্ত্ব ও সেই সঙ্গে কূটনীতিও আমাকে শেখাতে শুরু করে। শিবাজি যেমন আওরঙ্গজেবের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধরেন, তেমনি অ্যাসটেরিক্সও এক ফেরিওয়ালার গাড়িতে লুকিয়ে রোমানদের শিবিরে ঢুকে পড়ে, জাদুকর গেটাফিক্সের সন্ধানে। জাদুকরকে প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল, ও বুঝি গুপী গাইন বাঘা বাইনের বরফি। ছবিটা সদ্য সদ্য দেখেছিলাম তো। কিন্তু কমিক যত পড়তে থাকলাম, বুঝলাম এই জাদুকর অন্য ধাঁচের। এ তো অ্যাসটেরিক্স ও প্রতিবাদী গল অর্থাৎ ফরাসিদের অদম্য স্পিরিট বা শক্তি। অ্যাসটেরিক্স পড়ে ঔপনিবেশিকতা, কূটনীতি, আগ্রাসনের মনোভাব সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা গড়ে ওঠে। ইতিহাস, বিশেষত গ্রিক ও রোমান, সেই সঙ্গে মিশরীয় ইতিহাস, ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে উঠল। অ্যাসটেরিক্স যখন যেখানে যেত, সেই দেশটার পটভূমি, সেই দেশের পরিবেশ সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠত। তবে অ্যাসটেরিক্স আমার মন-প্রাণ-হৃদয় জুড়ে ছিল ওর বুদ্ধি, শক্তি ও কূটকচালির জন্য। কী দারুণ অভিনয়-ক্ষমতা! রোমানদের টর্চার বা থার্ড ডিগ্রির মুখে এমন অতি নাটকীয় ভাবে ভেঙে পড়ে, যে গেটাফিক্স রোমানদের জন্য কাজ করতে রাজি হয়ে যায়। অ্যাসটেরিক্সের মধ্যে যেমন পৌরুষ আছে, তেমনই তার মধ্যে নারীসুলভ চটুলতা ও চাতুরিও আছে। রোমানদের দৌড় করাতে, অসময়ে স্ট্রবেরি চেয়ে বসে। আর ম্যাজিক শরবতের লোভে, বোকা রোমানরা পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। ওরা প্রাণপণ খুঁজেপেতে স্ট্রবেরি আনে, আর অ্যাসটেরিক্স আর গেটাফিক্স সেটা ঠিক স্বাদের কি না, চেখে দেখতে দেখতে সব নিঃশেষ করে দেয়। সত্যের জয়ের জন্য মিথ্যার ব্যবহার কোন কোন ক্ষেত্রে কার্যকর ও উচিত, তা অ্যাসটেরিক্সই আমার মনে প্রোথিত করে। ‘হোয়াইট লাই’, অর্থাৎ সাদা বা স্বচ্ছ মিথ্যা সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অ্যাসটেরিক্সের প্রথম গল্পের পরই আমি পরেরটার জন্য অপেক্ষা করি। কোথায় গেল হারকিউলিস বা ভীম— যে দু’জন এতদিন ছিল আমার মনের মানুষ। কিন্তু অ্যাসটেরিক্স এই দু’জনকে আমার হৃদয়চ্যুত করে।

    অ্যাসটেরিক্সের বন্ধু বিশালকায় ওবেলিক্স এবং তার পোষা কুকুর অতি ক্ষুদ্র ডগম্যাটিক্স— অ্যাসটেরিক্সের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনেও বৈচিত্র নিয়ে আসে। ওবেলিক্স যেহেতু মন্ত্রপূত শরবতের হাঁড়িতে পড়ে যায় ছোটবেলায়, তাই ওর মধ্যে চিরতরে অদম্য শক্তি গচ্ছিত থাকে। তাই গেটাফিক্সের শরবত ওকে আর খেতে দেওয়া হয় না। ওবেলিক্সের জীবনের এই ঘটনার সঙ্গে আমার জীবনের মিল খুঁজে পাই। খুব ছোটবেলায়, যখন আমার কয়েক মাস মাত্র বয়স, আমার চিকেন পক্স হয়, কারণ আমার দিদি ও মায়েরও হয়েছিল। আমার চিকেন পক্স সেরে যাওয়ার পর, মা’কে কেউ বলেছিলেন, হালকা অ্যালকোহল দিয়ে গা মুছিয়ে দিলে আমার ত্বকের দাগগুলো চলে যাবে এবং সংক্রমণ কম হবে। সে যুগে স্যানিটাইজার বা অ্যালকোহল দেওয়া কোলন ছিল না। বাবার বন্ধুরা সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আড্ডা দিতেন। বিয়ার আসত। মা সেই বিয়ার থেকে দু’এক বোতল সরিয়ে রেখে তা দিয়ে আমার গা মুছিয়ে দিতেন। ফলে বড় হয়ে আমার আর কোনওদিনই মদ-পিপাসা জাগেনি। ওবেলিক্স যেমন মন্ত্রপূত শরবত ছাড়াই শক্তিশালী, আমিও মদ ছাড়াই যথেষ্ট উচ্ছ্বসিত।

    ফিরে আসি অ্যাসটেরিক্স ও গল-দের সাহসের গুণগানে। একদল গ্রামীণ মানুষ রোমানদের মতো সংগঠিত শক্তির বিরোধিতা করে চলেছে। নিজের অস্তিত্ব অহং বজায় রাখতে আমার লড়াই করার প্রেরণা অ্যাসটেরিক্স। ওর মতোই দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করার ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে আসতে চাই নিজের ভিটেয়, যেখানে আমার জন্য রয়েছে ঘি, আলুসেদ্ধ ভাত। যেমন সব অ্যাডভেঞ্চার থেকে ফিরে অ্যাসটেরিক্স তার সঙ্গীদের নিয়ে খায় মহাভোজ, যেখানে থাকবেই শূকর-রোস্ট। অ্যাসটেরিক্স হয়ে উঠল আমার আদর্শ। তাকে বা তার মতো পুরুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে যতটা না উদগ্রীব ছিলাম, তার থেকে বেশি নিজে অ্যাসটেরিক্স হওয়ার মন্ত্র খুঁজি। অ্যাসটেরিক্স-এর বুদ্ধি ও কৌতুকবোধ, আর স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা আমার মধ্যেও জেগে ওঠে। প্রথম জীবনে মা’কে মাঝেমধ্যে মনে হত স্বৈরাচারী শক্তি, কারণ তিনি প্রায়শই কমিক্স না পড়ে পড়ার বই পড়তে বলতেন। কিন্তু অ্যাসটেরিক্সই বুঝিয়ে দেয়, ওদের নেত্রী ইম্পেডিমেন্টা-র সহবৎ শিক্ষা মা’র শৃঙ্খলাবোধের শামিল। রাষ্ট্রের স্বৈরাচার বা সাম্রাজ্যবাদের চাপ আলাদা। এই হল অ্যাসটেরিক্স মারফত আমার রাজনৈতিক চেতনা।

    আমার খুব প্রিয় অ্যাডভেঞ্চার ‘অ্যাসটেরিক্স অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা’। ওই গল্প মারফত মিশরীয় সভ্যতার খুঁটিনাটি হয়ে ওঠে আমার কাছে জলবৎ তরলং। ক্লিওপেট্রার সৌন্দর্যের মধ্যমণি যে তাঁর নাক, সেটা অ্যাসটেরিক্সই শিখিয়েছে। মিশরীয় স্ফিংক্স-এর নাক ভাঙার নেপথ্য কাহিনিও যে ওবেলিক্স আর ডগম্যাট্রিক্সের কীর্তি, এটা আমি বহু বছর বিশ্বাস করতাম। অ্যাসটেরিক্স আমার কাছে শুধু প্রেরণা নয়, একই সঙ্গে আমার শিক্ষাগুরুও। আজও আমার মনে হৃদয়ে যে অ্যাসটেরিক্স বসে আছে, সে-ই আমাকে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে, সিনিয়র সিটিজেন হয়েও উদ্যোগী হতে সাহস যোগায়। আমার ম্যাজিক পোশন অ্যাসটেরিক্স।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook