সমালোচনা— সিনেমা: ‘স্যার’
মুখ্য চরিত্রে— তিলোত্তমা সোম, বিবেক গোম্বের
পরিচালক— রোহেনা গেরা
নায়িকা বড়লোকের বিটি আর নায়ক হদ্দ গরিব, অথবা উল্টোটা— বলিউডে এ তো হামেশাই হচ্ছে! এইসব অসম রোমান্সে অবশ্যই বাড়ির লোক, সমাজের লোক, দেশের লোকের ঘোরতর আপত্তি থাকে। প্রেমের রাস্তায় কাঁটা বিছোনোর জন্য তাঁরা কী-ই না করেন! আর গল্পের মোড যদি ট্র্যাজেডি হয় এবং মেয়ে বা ছেলের বাবা যদি অমরিশ পুরী বা ড্যানির মতো কোনও তাগড়া ভিলেন হন, তাহলে ক্লাইম্যাক্সে ‘অনার কিলিং’-ও ঘটে যেতে পারে। মোট কথা, ‘রিয়েল লাইফ’-এ যে-প্রেম প্রায় অদৃশ্য, পর্দার বাইরে যেখানে রিজওয়ানুর-কেসই বেশি, সেখানে রিল-জীবনে ঘুঁটে-কুড়ুনির মেয়েরা এখনও মাঝেমধ্যেই রাজপুত্তুর ছেলেদের প্রেমে পড়ে যায়। রাজার কুমারও পক্ষিরাজ ঘোড়া থেকে নেমে, পথের পাশের অনাথিনী মেয়েটির দুঃখিনী মুখখানা দুহাতে তুলে ধরে কপালে চকাস চুমু খায়।
বলিউডি রূপকথার এই চেনা ন্যারেটিভ-টাকেই নিজের মতো করে এই সময়ের ছকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছেন ‘ইজ লাভ ইনাফ স্যার’-এর লেখক-পরিচালক রোহেনা গেরা। দেশি ও ফরাসি যৌথ প্রযোজনার যে ছবিটি ২০১৮-র জার্মানিতে প্রথম মুক্তি পেয়েছিল, ২০২১-এর কোভিড ভ্যাকসিনে থইথই নিও-নর্মাল পরিস্থিতিতে সেটাই নেটফ্লিক্স-এ হপ্তা দু-তিন ধরে ভারতীয় দর্শকদের সবচেয়ে পছন্দের শোয়ের লিস্টির ওপরের দিকে আছে। কীভাবে? চারদিকে যখন নানা রকম ভাঙনের শব্দ— প্রায় বছরখানেক ধরে একফোঁটা জীবাণুর দৌরাত্ম্যে সবরকম ভালবাসা-বিশ্বাস-সম্পর্কগুলো যখন এক্কেবারে তলানিতে— তখন এই মেট্রো-নগরীর রূপ-গাথা, কোথাও কি আধুনিক-নাগরিক মানুষের আশা-ভরসা-ইচ্ছাপূরণের সাধ মেটায়? অতিমারীর দাপট যেভাবে পরিযায়ী শ্রমিক থেকে শুরু করে মোটা পে-প্যাকেজের কর্পোরেট-চাকুরে, সব্বার জীবিকা-যাপন, প্রেম-প্যাশন সব নেড়েঘেঁটে অস্থির অনিশ্চিত করে ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে অর্থনীতির তৈলাক্ত বাঁশের আগা আর গোড়াকার দুই পুরুষ-নারীর বেশ ধূপ-ধুনোওয়ালা ‘নিকষিত হেম’ গোছের অপূর্ব অলৌকিক স্বর্গীয় প্রেম কোথাও কি বিশ্বাসের কয়েক হাজার ওয়াট আলো দপ করে জ্বেলে দেয়?
ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। এই কাহিনি-চিত্রনাট্যের স্বপ্নের রাজপুত্তুরটি থাকে মুম্বইয়ের একটি বহুতলের অ্যাপার্টমেন্টে। আর গরিবের মেয়েটি আসছে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার কোল-ঘেঁষা একটি মহারাষ্ট্রীয় গ্রাম থেকে। সে-গ্রামে এখনও মেয়েরা বিধবা হলে, তাদের জীবনের সব রং সমাজের আচার-বিচার-রীতি-রেওয়াজের ব্লটিং পেপারে বেমালুম হাপিশ হয়ে যায়। একটা বিয়ে, একজন পুরুষের ছাতার ছায়ায় না থাকলে, সেখানে মেয়েদের বেঁচে থাকাটাই বাতিল! তাদের কাছে মুম্বই যেন এক মিথিক্যাল বা পুরাণকল্পের মায়ানগরী! সেখানে একবার পৌঁছতে পারলেই বাসনা-কামনা, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষার ঝুলি ভরে যাবে। ছবির প্রথম সিকোয়েন্সেই আমরা দেখি ওই গ্রামের মেয়ে রত্নার কাছে মুম্বই থেকে কাজের ডাক এসেছে। রত্নাকে প্রায় বাল-বিধবাই বলা যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বাবা-মা জোরজার করে কোনও খোঁজখবর না নিয়েই একজন অসুস্থ লোকের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। আর পাঁচ মাসের মধ্যেই সে বিধবা হয়। এবং গ্রাম-সমাজের নিয়মমাফিক, তার জীবনের মানেটাই ফুরিয়ে যায়।
সেখানে মুম্বইয়ের মহা-বড়লোক একটা অ্যাপার্টমেন্টে ‘কাজের লোক’-এর চাকরিটা তাকে নতুন করে বাঁচার মানে ফিরিয়ে দেয়। ‘স্যার’-এর শুরুতেই দেখি, রত্না ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে বাসে-ট্রেনে বহু পথ পার হয়ে, মুম্বই পৌঁছচ্ছে। এই পরিবহন ও পরিযান বা ‘মাইগ্রেশন’-এর ব্যাপারটা এখানে খুব জরুরি। রূপকথা-টথায় সাধারণত গরিবের মেয়েরা বিজন গাঁয়ে বা রাস্তায় বা জঙ্গল-টঙ্গলে তাদের দুঃখিনী কুঁড়েঘরে থাকে। রাজপুত্ররা শিকার, বেড়ানো বা এটা-ওটা কাজে রাজধানীর বাইরে গেলেই তাদের মোলাকাত, ‘চারিচক্ষুর মিলন’ ইত্যাদি ঘটে যায়। এই ছবিতে, মেয়েটিই তার কুটিরের বাইরে আসে। একটা মোটরবাইকের পিছনে সওয়ার হয়ে গ্রামের পথ পেরিয়ে বড়রাস্তায় ওঠে। সেখান থেকে ম্যাজিক ভ্যানের বাক্সে চাপাচাপি, ঠাসাঠাসি, অচেনা নারীপুরুষের সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করে বাসস্ট্যান্ডে আসে। দূরপাল্লার সরকারি বাস তাকে মেট্রো-নগরীর দোরগোড়ায় নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে লোকাল ট্রেনের ভিড় ঠেলে, প্ল্যাটফর্মের জনারণ্য পেরিয়ে, মুম্বইয়ের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে কাজের বাড়িতে পৌঁছে যায়।
এই পুরো সফরটায়, রত্নার চারপাশের ল্যান্ডস্কেপ ক্রমশ বদলাতে থাকে। সেই সঙ্গে, রত্না নিজেও। ঘাট-সেকশনের পাহাড়ি পথ বেয়ে তার পরিযান যত নগরের দিকে এগোয়, রত্না তার অভ্যাস থেকে গেঁয়ো বিধবার চিহ্নগুলো সরাতে সরাতে চলে। হাতের সস্তা ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে নীল প্লাস্টিকের চুড়িগুলো পরে নেয়। এই বিধবা মেয়ের সামান্য প্রসাধনটুকুও কোথাও তাদের গাঁয়ের মোড়লতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা খুচরো গেরিলা অন্তর্ঘাত হয়ে যায়। ওই মেয়ে বাসের মধ্যেই যখন একটু আয়েস করে, সিটে হেলান দিয়ে বসে, কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনে, সেখানেও কোথাও তার শরীরের ভাষায় ফেলে-আসা-গ্রামের সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক অভ্যাসের দূরত্ব তৈরি করে নেওয়ার চেষ্টা থাকে। এই যে একটার পর একটা যান বদলে রত্না ক্রমশ মহানগরীর কাছাকাছি আসছে, ততই তাকে মেট্রোপলিসের কসমোপলিটান যাপনের সঙ্গে মানানসই লাগছে। এই মেয়ের কাছে মুম্বই তাই কোনও ‘সব-পেয়েছি’র মহানগরী নয়, যেমনটা তার পলিটেকনিক-পড়ুয়া বোন ভাবে। এ শহর রত্নার কাম-ধান্দা, জীবিকা-রোজগারের জায়গা। সেই রোজগারের টাকাতেই তার বোনের লেখাপড়া চলে। রত্না চায়, বোন লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াক। সাততাড়াতাড়ি বিয়ে-থা’র চক্করে না পড়ুক, গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতো। আবার এই রোজগারের টাকা জমিয়েই, সেলাইয়ের কাজে নিপুণা রত্না তার ‘ফ্যাশন ডিজাইনার’ হওয়ার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখে।
সেলাই-দিদিমণি নয়, নিদেন পক্ষে টেলর-মাস্টারও নয়, একেবারে ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার এমন একুশ শতকীয় ‘অ্যাম্বিশন’, প্রায় উনিশ শতকে পড়ে থাকা গ্রামে বসে রত্নার মগজে কীভাবে এল, ছবিতে সেটা খুব পরিষ্কার নয়। তবে যাই হোক, রত্না যখন আত্মবিশ্বাসী পায়ে, দপদপিয়ে এই মেট্রো-রূপকথার বহুতলে আড়াই-তিন হাজারি স্কোয়ারফিটের ‘প্রাসাদ’-এ পৌঁছয়, তখন এইটুকু অন্তত পরিষ্কার, নিজে যেচে রাজপুত্তুরের করুণা-প্রসাদের তার দরকার নেই। তাছাড়া প্রেমে লেঙ্গি খেয়ে, পাকা বিয়ে প্রায় ছাঁদনাতলার চৌকাঠে কেঁচে গিয়ে, প্রোমোটার-বিল্ডার বাবার রাজা-বেটা নিজেই তখন ব্যাপক ঘেঁটে আছে। একটু বাড়তি যত্ন, নীরব সহানুভূতি, সান্ত্বনা, আশ্বাস, এসব তখন তারই অনেক বেশি দরকার। আর এখান থেকেই রেহানা একটা অদ্ভুত, পারস্পরিক নির্ভরতার রোমান্সগাথা বুনেছেন। বাড়ির মালিকের মাইনে করা ২৪ ঘণ্টার কাজের লোক হিসেবে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ-রান্নাবান্না-খেতে দেওয়া-বাসন মাজা— এসব তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। রত্না নিঃশব্দে, প্রায় নেই হয়ে থেকেও ওইসব ঘরকন্নার কাজেও কোথাও একটা বাড়তি মেয়েলি ছোঁয়া বুলিয়ে দেয়! এই রূপ-কাহিনির রাজকুমার অশ্বিন খাওয়ার টেবিলে চাদরের ভাঁজে সেই উষ্ণতাটুকু বুঝে নিতে পারে। উল্টোদিকে মার্কিন মুলুকে লেখাপড়া শেখা, নিউইয়র্কে লেখালিখি-সাংবাদিকতা করে আসা, অশ্বিনের ব্যবহারেও কোথাও কাজের লোকের প্রতি গড়পড়তা উচ্চবিত্ত ভারতীয়সুলভ তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা অপমান করার প্রবণতা ছিল না।
তবে সেই স্বাভাবিক ভদ্রতা, বাড়ির কাজের মেয়েকেও সম-মানুষ হিসেবে দেখা বা খানিকটা মনোযোগ দেখানোটাকে গোড়াতেই প্রেম বলে ধরে নেওয়ার মতো কাঁচা, টিন-এজ সুলভ খোয়াবের দুনিয়ায় রত্নার ঘোরাফেরা নয়। প্রথম দেখাতেই কোনও পুরুষের ফিদা হয়ে যাওয়ার মতো রূপ-লাবণ্যর চমক-চটক তার নেই। শ্রম আর সময়ের ছোপলাগা সেই শরীর তবু কি কোনও পুরুষের ছোঁয়া পাওয়ার অপেক্ষায় আকুল? অশ্বিনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা যখন ‘প্লিজ’-‘সরি’-‘থ্যাঙ্ক ইউ’-এর সৌজন্য পেরিয়ে, সহমর্মিতার পাড় ছুঁয়ে, উপহার দেওয়া-নেওয়ার পাট সেরে প্রথমবার শরীরে পৌঁছতে চায়— অশ্বিনের আদর যখন তার কপাল ছুঁয়ে আর একটু নিচে, তার দুই ঠোঁটের ভেতর এতদিনের সংযমের বাঁধ ভেঙে ফেলতে চায়— রত্নার শরীরও তাতে সাড়া দিয়ে জেগে উঠতে চায়! কিন্তু তার পরেও রত্না অশ্বিনের প্রসারিত বাসনার হাত ঠেলে সরে আসে। আর আদর ফুরোতে না ফুরোতেই অশ্বিনের মায়ের হুকুমের ফোন চলে আসে রত্নার কাছে। পরের দিন বাড়িতে যে পার্টি আছে, সেখানে স্পেশাল মরাঠি ‘মচ্ছিকারি’ রাঁধতে হবে রত্নাদের। অশ্বিনের চুমু-আদর শ্রেণি-স্টেটাসের যে-দূরত্বটা ঘোচাতে চাইছিল, একটা ফোন এক মুহূর্তে রত্নাকে আবার তার নিজের জায়গাটা দেখিয়ে-চিনিয়ে দেয়।
গোটা ছবিটায় রত্না কক্ষনও সেই লক্ষ্মণরেখাটা পেরোবার চেষ্টা করেনি। হয়তো পেরোতে চায়ওনি। তাও প্রেমিক-মালিক যখন ছেলেমানুষি বেপরোয়াপনায় বলে ওঠে, লোকের বাঁকা হাসি বা ফিসফাস কথার তার কিস্যু যায় আসে না; তখনও রত্না অভিজ্ঞতার জমিতে পা রেখে স্পষ্ট করে বলে দেয়— তার যায় আসে! কারণ সে জানে, গ্রামই হোক কিংবা শহর, প্রাইভেট স্পেস-এ সমাজের নাক গলানোর হিসেবটা নিজের নিজের ধরন মেনেও শেষ অবধি একই। সে এটাও জানে, লোকের কথা যখন পচা ডিম-টমেটোর মতো গায়ের ওপরে এসে পড়বে— পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষা করার চাপ সাঁড়াশির মতো এঁটে বসবে, তখন অশ্বিনও সেটা সামলাতে পারবে না। গ্রামের গরিব মেয়ের ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন সত্যি করার জন্য তাকে সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া, তার ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করে দেওয়া অথবা তার হাতে বানানো শার্ট পরে অফিস যাওয়া, আর কাজের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের কথাটা দুনিয়ার সামনে বুক বাজিয়ে বলে দেওয়াটা এক নয়। রত্না সেটা বোঝে।
তার প্রেম আর শ্রদ্ধার ‘স্যার’-কে সে তাই অমন বিড়ম্বনায় ফেলতে চায় না! রোহেনার রূপকথায় তাই ঘুঁটেকুড়ুনির মেয়ে নিজেই তাই রাজার ছেলের প্রাসাদ ছেড়ে আবার তার কুঁড়েঘরে ফেরত যায়। রাজপুত্তুরও বিবাগী হয়ে তার নিউইয়র্কের ডেরায় উড়ে যায়! মহিলা পরিচালক বলেই হয়তো রোহেনার এই মেট্রো-রূপকথার ন্যারেটিভটা রত্নার দিক থেকেই বোনা হয়েছে। রাজকুমারের সোনার হৃদয়— কিন্তু চিত্ত ততটা বীরপুরুষের নয়। এই একটু দুর্বল, একটু দ্বিধাগ্রস্ত, অনেকটা অনুভূতিপ্রবণ, রোমান্টিক যুবকটিকে একদম মাপে মাপে পর্দায় তৈরি করেছেন বিবেক গোম্বার। এমনকী নিউইয়র্ক-ফেরত অশ্বিনের হিন্দিতে আলতো মার্কিনি টান সুদ্ধ। কিন্তু এই রূপকথা তো রাজপুত্রের নয়। গেঁয়ো, গরিবের মেয়ের। আর সেই মেয়েটি হিসেবে তিলোত্তমা সোম অনন্যা, ছবিতে রত্নাকে তিলে তিলে তিলোত্তমা গড়েছেন তিনি। গ্রাম্যতার চিহ্নগুলো শরীরে নিয়েও তার মনের আধুনিকতা— নিজের ডিগনিটি, সম্মানবোধের গায়ে একটুও আঁচড় লাগতে না দিয়েও স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাগুলোকে গোপনে বাঁচিয়ে রাখা— এবং অশ্বিনের সঙ্গে তার আশ্চর্য প্রেম— চিত্রনাট্যের নানান ভাঁজ আর মোড়-ফেরাগুলোকে তার সমস্ত শরীর আর অভিব্যক্তি দিয়ে কী ভীষণ প্রাণময় আর অনুভবগ্রাহ্য করে তুলেছেন! অশ্বিনের সঙ্গে তার প্রেম কখনওই বিছানা অবধি পৌঁছয়নি। গোটা ছবিতে কখনওই তার শরীর এতটুকুও দেখা যায়নি। তবু অশ্বিনকে ঘিরে কোথাও তার মনের মধ্যেই রেখে দেওয়া লুকনো ইচ্ছে, খানিকটা হলেও একটা অধিকারবোধ— এগুলো কখনও কখনও এক ঝলক হাওয়া, এক ফালি রোদ, এক পশলা বৃষ্টির মতোই তিলোত্তমা তাঁর ঠোঁটের কোণে, চোখের তারায় খেলিয়ে দেন।
তিলোত্তমা ছাড়া রোহেনার ছবিটা হতই না। গোটা ছবিটা জুড়েই তিনি তাঁর আশ্চর্য স্বাভাবিকতা দিয়ে রূপকথার রোমান্স আর গ্ল্যামারের মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু ‘ইজ লাভ ইনাফ স্যার?’ তো শেষ অবধি রূপকথাই! তাই ক্লাইম্যাক্সে জ্যান্ত ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীরা না আসুক, ইচ্ছেপূরণটুকু তো ঘটতে হবে! অশ্বিন তাই নিউইয়র্কে বসেই রত্নার ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার পয়লা সিঁড়িটা বানিয়ে দেয়। রূপকথার রাজকুমাররা যেমন ভালবাসার সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে গরিবের মেয়ের জীবনটাই পালটে দেয়! ছবির একদম শেষে, ফ্ল্যাট-প্রাসাদের দেওয়াল-মেঝে-আসবাবের অন্তঃপুরে ঘুরে মরা ক্যামেরা আবার রত্নার সেই প্রিয় ছাদের কোণটায় আসে, প্রথমবার আদর-পর্বের পর অশ্বিনকে নিয়ে সে যেখানটায় এসেছিল! পায়ের নিচে আবারও আলোয় আলোয় মিথিক্যাল মায়াপুরী মুম্বই! রত্নার সেই পুরনো সস্তার ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর, আরও কমদামি পুরনো মডেলের মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে! ফোনের ওদিকে সাত সমুদ্দুর ওপার থেকে অশ্বিন! একবার সাড়া না পেয়ে অশ্বিনের গলায় সেই দ্বিধা। চোখের জল মুছে, একটু থেমে, ‘স্যার’-এর বদলে গরিবের মেয়ে এই প্রথমবার নাম ধরে ডাকল তার রাজপুত্তুর প্রেমিককে— তার সারা মুখে ছড়ানো এক মায়া আর বিশ্বাস! এই নিও-নর্মাল যেটা সব্বার দরকার! পর্দা জোড়া অন্ধকারে পিয়ের অ্যাভিয়েত-এর সঙ্গীতেও ঝমঝমিয়ে বেজে ওঠে সেই ভরসার সুর…।