যেন আর একটা বিশ্বযুদ্ধই! আতঙ্ক আর বছর-জোড়া কত লড়াইয়ের শেষে ‘করোনা’র ঢেউ এখন ঝিমিয়ে। একেবারে যে অস্তমিত, বলা যাচ্ছে না। তার শক্তি যেন ফুরিয়েও হয় না আর শেষ।
নিরন্তর গবেষণার ভিতর, এর মধ্যেই কিছু প্রতিষেধক এসেছে দেশে দেশে। প্রয়োগের পর তাদের উৎকর্ষ আর ফলাফলের অপেক্ষায় এখন সারা পৃথিবী। কাজেই সব মিলিয়ে এমন একটা দিন হয়তো সামনেই, যখন করোনায় মৃত বলে পাওয়া যাবে না নতুন আর কাউকেই।
কিন্তু করোনা চলে গেলে, এই দুঃসহ স্মৃতি কি ভোলার? উত্তর, ‘না’। তবে এই স্মৃতি কি সংরক্ষণযোগ্য? এক কথায় উত্তর, সম্ভবত ‘হ্যাঁ’। এই দুই সহজ প্রশ্নের ছোট্ট দুটো উত্তরের প্রেরণায় সৃষ্টিমূলক ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসছে বিশ্বের সংগ্রহশালাগুলো। সোজা কথায়, করোনার স্মৃতি এবার জাদুঘরে ধরে রাখতে আগ্রহী অনেকেই। তাই ইতিউতি চোখে পড়ছে ‘করোনা’র স্মৃতি আগলে রাখার ব্যতিক্রমী সব উদ্যোগ।
‘করোনা’কে নিয়ে কী ভাবছে পৃথিবীর মিউজিয়ামগুলো। ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কথাই ধরা যাক। প্রতি বছর এই সংগ্রহশালায় কয়েক সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে আসেন পৃথিবীর নানা প্রান্তের সংগ্রহশালার কিউরেটররা। প্রায় দশ-বারো বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রশিক্ষিত কিউরেটরদের সংখ্যাটা প্রায় কয়েকশো। এঁদের সকলের পরামর্শে ব্রিটিশ মিউজিয়াম গড়ে তুলছে তার ‘কোভিড সংগ্রহ’। সেই সংগ্রহে মুখোশ গুরুত্বপূর্ণ। যা অনেক ক্ষেত্রে কেনা হয়েছে ‘অনলাইন’ বিপণিগুলো থেকে। এই সংগ্রহ গড়ে তোলার সময় নিয়মিত আলোচনায় উঠে এসেছে কিছু প্রশ্ন। যেমন, এই সংগ্রহের লক্ষ্য কী, সকলের জন্য কীভাবে খুলে দেওয়া যাবে সংগৃহীত বস্তুর সম্ভার, শুধুই কি সংগৃহীত হবে এই অতিমারীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বস্তুসামগ্রী, না কি সংরক্ষিত হবে অতিমারীর কবলে পড়া মানুষের যন্ত্রণা আর দুর্দশার স্মৃতিও, যা শুধু আটকে নেই স্পর্শ করা যায় শুধুই এমন কিছু বস্তুতেই!
মিউজিয়ামের কাজ একরকম গল্প বলা। কাজেই শুধুই সংগ্রহযোগ্য বস্তুই নয়, ‘করোনা’-র স্মৃতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে নানা গল্পের খোঁজেও রয়েছে পৃথিবীর সংগ্রহশালাগুলো। স্কটল্যান্ডের প্রায় এক ডজন সংগ্রহশালা নিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান গ্লাসগো মিউজিয়ামস। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সংগ্রহ করা হয়েছে ‘কোভিড’ নিয়ে আঁকা ভারতীয় গ্রামীণ শিল্পীদের ছবি। এই সংগ্রহ গড়ে তোলার বিষয়ে নীতি নির্দিষ্ট করেছেন যারা, তাঁরা মনে করেছেন, কাগজ এবং কাপড়ের উপর এই ছবিগুলো ভারতে আঁকা হয়েছিল ‘করোনা’র সময় গ্রামে গণ-সচেতনতা গড়ে তুলতে। গ্লাসগো মিউজিয়ামস-এর সংগ্রহ করা পাঁচটি ভারতীয় ছবির একটির শিল্পী অপিন্দর সাঁই। পটচিত্রের আদলে তাঁর আঁকা বহুবর্ণ ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে মুখোশ পরিহিত করোনাকালীন সমাজের খণ্ডচিত্রাবলি, যার ভিতরে রয়েছেন ডাক্তার, পুলিশ, গৃহস্থ, মুখোশ-পরা মানুষজন। স্কটিশ কাউন্সিল অন আর্কাইভস জোর দিচ্ছে ‘কোভিড’-এর সময় লেখা ব্যক্তিগত দিনপঞ্জি, নানা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা সংস্থার নথিপত্র সংগ্রহের উপর। আর এই কাজটাই সুসপন্ন করতে গড়ে তোলা হয়েছে একটা নীতিনির্ধারক ‘কালেক্টিং পলিসি ওয়ার্ক গ্রুপ’।
‘করোনা’-র গভীর বিষাদের ছায়ায় তবু যেন হারিয়ে যায়নি হাসি। মিউজিয়াম অফ লন্ডন অন্যান্য নানা কিছুর সঙ্গেই সংগ্রহ করে চলেছেন এই অতিমারীর সময় ‘ভাইরাল’ হয়ে যাওয়া ‘টুইট’। অনিশ্চিত সময়ে, এই মিউজিয়ামের সংগ্রহভুক্ত নানাজনের বিচিত্র সব ‘টুইট’-এ যেমন রয়েছে একাকিত্ব, বিষণ্ণতা, আতঙ্ক, অসহায়তার ছবি, তেমনই রয়েছে কৌতুকের উপাদানও। যেমন, এক আপাত স্তব্ধ পৃথিবীতে ‘অ্যামাজন’ থেকে ‘ট্যাম্পন’ কিনে জনৈক মহিলা বাক্স খুলে পেয়েছিলেন বরফে জমানো এক ব্যাগ ‘সসেজ’, সম্ভবত বস্তু দুইয়ের ‘আকারগত সামঞ্জস্যের কারণেই’। ‘করোনা’কালীন লন্ডন-জীবনের ‘টুইট’ সংগ্রহের এই সহজ কিন্তু অভিনব প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘গোইং ভাইরাল’। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম আয়োজন করেছে এক ‘অনলাইন’ প্রদর্শনীর, যার নাম ‘প্যান্ডেমিক অবজেক্টস’। দস্তানা, ‘মাস্ক’, অতিমারীর জন্য নকশা করা বিভিন্ন ‘সাইনেজ’ জায়গা করে নিয়েছে এই প্রদর্শনীতে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি সংগ্রহ করেছে রোজকার জীবনের অতি সাধারণ সব সামগ্রী, যা দেখায় দারিদ্রের ছবি।
এই অতিমারী অতি সাধারণকেও যেন করে তুলেছে অসাধারণ। শুধু সংগ্রহশালার চার দেওয়ালের ভিতরেই নয়, অনেক সময় খোলা আকাশের নীচেও দেখা যাচ্ছে কোভিডের স্মৃতি বুকে দাঁড়িয়ে থাকা সব প্রদর্শনী। যেহেতু ‘করোনা’ আর তাকে নির্মূল করার লড়াইয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে চিকিৎসা-বিজ্ঞান; হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, ওষুধের দোকান, ল্যাবরেটরিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেও নানা সামগ্রী সংগ্রহ করবার প্রচেষ্টায় রয়েছে সংগ্রহশালাগুলো। আর এইসব উপাদান সংরক্ষণ করতে গিয়ে তারা প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হচ্ছে নতুন নতুন সব চ্যালেঞ্জের। যেমন ব্যবহৃত, ব্যতিক্রমী ‘মাস্ক’, ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’, ‘পিপিই কিট’, ‘ভেন্টিলেটর’, চিকিৎসার আরও নানা উপাদান কীভাবে জীবাণুমুক্ত করে সংগ্রহ করা যায় আর সর্বসাধারণের জন্য নিরাপদভাবে প্রদর্শিত করা যায় তা ভাবাচ্ছে সংগ্রহশালার সঙ্গে যুক্ত সকলকে।
‘করোনা’-যোদ্ধাদের সম্মানে চিনের প্রকাশ করা ডাকটিকিট, গার্ডিয়ান উইকেন্ড-এর প্রচ্ছদে ছাপা ‘করোনা’ পোস্টমার্ক, আফ্রিকার কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের বৃদ্ধার হাতে-তৈরি মাস্ক, একজোড়া দস্তানা, কাজ হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া কোনও যুবকের লেখা শেষ চিঠি, কবিতা, গান, শুনশান রাস্তা, থমকে থাকা শহর আর দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে ঘরে ফেরার মন-ভেঙে-দেওয়া ছবির মতো কত স্মৃতি যে নীরবে জমে উঠছে বিশ্বের সংগ্রহশালাগুলোর সম্ভারে— ভেবে কূল পাওয়া যায় না।
‘করোনা’ চলে গেলে তার কিছু স্মৃতি রয়ে যাবে, ইতিহাসে মানুষের দুঃখেরও ঠাঁই আছে বলে।