পরের দিন লোনাভালা থেকে ফিরে চলে এলাম। সেবার ফেরবার সময়ে আর গুরু দত্তের গাড়িতে নয়, শচীন দেববর্মণের গাড়িতে। সারা রাস্তা শচীনদা কমলালেবু আর ডাব খাওয়াতে-খাওয়াতে নিয়ে এসে তুলে দিলেন গুরুর পালি হিলের বাড়িতে। খানিক পরে গুরু-ও এসে পড়ল। গীতাও এসে পড়ল। এই প্রথম গুরুর বাড়িতে ঢুকলাম। ঘরের দেওয়ালে দেখলাম অনেকগুলো জানোয়ারের চামড়া টাঙানো। কোনোটা ভালুকের, কোনোটা বাঘের। ওগুলো শুনলাম নাকি গুরুর নিজের হাতে শিকার করা।
সে দিনটা ছিল রবিবার। অর্থাৎ ছুটির দিন। স্টুডিও বন্ধ। সুতরাং কোথাও যাওয়ার প্রশ্ন নেই আর। ভাবলাম, এইবার বোধহয় হিন্দি কনট্রাক্ট-এর কথা উঠবে। অনেকক্ষণ সবাই মিলে গল্প হতে লাগল। নানা গল্প। কিন্তু কনট্রাক্টের কথা আর ওঠে না। আর আমি নিজে থেকেও কথাটা তুলতে পারছি না।
গীতা বললে— রাত্তির বেলা আপনি কি খাবেন বিমলদা?
বললাম— আমার জন্য একটু সাদাসিধে কিছু করে দিন। আমি ঝাল বা মশলা বেশি খাই না—
— কাল খেয়ে আপনার শরীর খারাপ হয়নি তো?
বললাম— না—
গুরু বললে— আপনি এখানে কিছুদিন থেকে যান, শরীর ভালো হয়ে যাবে—
বললাম— আমার কিন্তু বেশি দিন থাকার উপায় নেই, আমাকে ‘দেশ’ পত্রিকায় কিস্তিতে লেখা দিতে হয়—
— কি লেখা?
— ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বলে একটা উপন্যাস লিখছি ওই কাগজে—
— আপনার পুরোটা লেখা হয়নি?
বললাম— না, লিখে-লিখে কিস্তি দিই প্রতি সপ্তাহে—
— যদি আপনার কিছু অসুখ-বিসুখ হয়, তাহলে কি হবে?
বললাম— বন্ধ হয়ে যাবে।
— তাহলে আগে থেকে লিখে রাখেন না কেন?
বললাম— আসলে যে আমি আল্সে লোক, কোনো কাজ সময়মতো করবার অভ্যেস নেই—
— ‘সাহেব বিবি গোলাম’ও কি ওইরকম করেই লিখেছিলেন?
বললাম— হ্যাঁ—
গুরু দত্ত হয়তো একটু অবাক-ই হয়ে গিয়েছিল। আমার কথা শুনে কিছু বললে না। তারপর কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলে— আচ্ছা, জবার রোলটা কাকে দিলে ভালো হয় বলুন তো?
আমি বললাম— আপনাদের এখানকার আর্টিস্টদের সবাইকে চিনি না—
গুরু বললে— আমি ভাবছি ওই পার্টটা দেব ওয়াহিদাকে—
— সে কে?
— আমার একজন আর্টিস্ট আছে, তার নাম ওয়াহিদা রেহমান,সে খুব ভালো অ্যাক্ট্রেস।
দেখলাম গীতা দত্তের মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম— কেমন চেহারা তার?
গুরু বললে— খুব হ্যান্ডসাম। আপনার জবার পার্টে খুব চমৎকার মানাবে। আসলে ওয়াহিদাকে আমি-ই খুঁজে বার করেছি। আগে বিশেষ নাম ছিল না। শুধু নাচতো। জানেন, আমি তাকে হায়দ্রাবাদ থেকে এনেছি—
এসব ব্যাপার আমার কাছে নতুন। গুরু বললে— আজকে ওয়াহিদাকে দেখলেই বুঝতে পারবেন— আজকে ওকে এখানে আসতে বলেছি—
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম— কোথায় আসতে বলেছেন?
গুরু বললে— স্টুডিওতে—
বললাম— আজকে স্টুডিওতে কেন? আজ তো স্টুডিও বন্ধ—
গুরু বলল— আজকে বাংলা ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিটা আনিয়েছি, আমাদের প্রোজেকশান রুমে আজ দেখাবার ব্যবস্থা করেছি— সেখানে সবাই আসবে। শচীনদা আসবে, বউদি আসবে, ওয়াহিদাকে আসতে বলেছি— নবেন্দু ঘোষ-কে চেনেন তো? সাহিত্যিক। তাঁকেও আসতে বলেছি—
গীতা বললে— আপনি একটু বিশ্রাম করুন ততক্ষণ, আমরা একসঙ্গেই যাব—
ভাবলাম ভালোই হল। এও একধরনের জগৎ। এ জগৎটার সঙ্গে পরিচয় ছিল না এতদিন, এবার পরিচয় হবে। দেখা যাক্ এরা কী ভাবে, কী ধরনের। ঘর থেকে উঠে নিজের ঘরে বিশ্রাম করতে গেলাম।
গুরু দত্ত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আমার সম্বন্ধে যদি কিছু বলি, তাহলে আশা করি তা মার্জনীয় হবে। গুরু দত্ত সিনেমার লোক, আর আমি সাহিত্যের। দুজনের জীবিকার ধারাই আলাদা। হয়তো দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা। তবু সিনেমার লোকই হই আর সাহিত্যিকই হই, আসলে তো আমরা মানুষ। আমরা যে মানুষ এবং মানুষ নিয়েই যে আমাদের কারবার, সেখানেই দুজনের একটা মূলগত মিল ছিল। এই মানুষের কারবারে সব চেয়ে যে জিনিসটার প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে মানুষ চেনার ক্ষমতা। আমার নিজের কথা আগে বলি, তারপর গুরু দত্তের কথা বলব।
আমার ছোটবেলা থেকে আমাকে নিরুৎসাহ করবার লোকের কখনও অভাব হয়নি। আশে-পাশে গুরুজন থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই একবাক্যে বলে এসেছে— এটার দ্বারা কিছু হল না। আমার লেখা পড়ে সবাই বলেছে— এটা কোনো গল্পই হয়নি।
সবাই আমার মঙ্গলের জন্যেই বলেছে— কোনও সরকারী অফিসে চাকরি নিয়ে নাও বাপু, তাতে অন্তত দুটো খেতে পাবে। সাহিত্য করলে সারা জীবনে উপোস করতে হবে তোমাকে। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সে উপদেশাবলী আমাকে এখনও শুনতে হয়। এই বুড়ো বয়েস পর্যন্ত তারা আমার ওপর শুভকামনা বর্ষণ করা থেকে বিরত হয়নি। এইটেই আমার সবচেয়ে বড়ো সৌভাগ্য! অবশ্য তাদের জয় হোক, কিন্তু এ যাবৎ আমিও আমার গোঁ ছাড়িনি। আমি লিখেই চলেছি, এবং যতদিন মস্তিষ্ক, চোখ এবং হাত সতেজ থাকবে, ততদিন লিখেই যাব। কিন্তু তবু বলব সেই সব শুভাকাঙ্ক্ষীরা যদি সেদিন নিরুৎসাহ না করতেন, তাহলে কোথায় পেতাম আজকের এই উৎসাহ! সুতরাং মনে-প্রাণে যদি কাউকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় আজ তো সে তাঁদেরই। তাঁদের উপকার যেন এ-জীবনে কখনও না ভুলি।
গুরু দত্ত আমার এই কথাগুলো শুনছিল। বললে— তাহলে আমার কথা শুনুন— কয়েক বছর আগেকার কথা। তখন সবে নতুন কোম্পানি করেছি। আমাকেও নিরুৎসাহ করবার লোকের অভাব নেই। লাখ-লাখ টাকার ব্যবসা। যদি ডোবে তো সমূলে ডুববে। একদিন একজন খবর দিলে যে, সেকেন্দ্রাবাদে একটা মাদ্রাজি মেয়ে আছে, তাকে নাকি শিখিয়ে-পড়িয়ে নিলে ভালো নায়িকা হতে পারে। কানে ঠেকেছিল।
হঠাৎ গুরু দত্তের ম্যানেজার গুরুস্বামীর বাড়িতে একদিন রাত সাড়ে এগারোটার সময় গুরু গিয়ে হাজির। কি ব্যাপার? না সেকেন্দ্রাবাদ চল। তার মানে বোম্বাই থেকে সেকেন্দ্রাবাদ প্রায় সাড়ে তিনশো মেইল রাস্তা। সেই রাত্রেই সেকেন্দ্রাবাদে গিয়ে নায়িকা পছন্দ করবে। খেয়াল যখন হবে গুরু দত্তর তখন সে খেয়াল যেমন করে হোক চরিতার্থ করতে হবেই। সুতরাং কারো আপত্তি করলে চলবে না। চল সেকেন্দ্রাবাদ। গাড়িতে রইল গুরু দত্ত, আব্রার আল্ভি আর গুরুস্বামী। গাড়ি উড়ে চলল ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি মেইল গতিতে। হল তাকে পছন্দ। ডেকে নিয়ে আসা হল বোম্বাইতে। গলার আওয়াজ পরীক্ষা করা হল। যেদিন স্টুডিওতে পৌঁছোল সে মেয়েটি, সবাই দেখে মুখ বেঁকাল।
একজন মুখের সামনেই বললে— আরে গুরু, এ কিসকো লায়া তুম!
আর একজন বললে— একে বাড়িতে আয়া করে রাখুন গুরুজী—
সবাই নিরুৎসাহ করতে লাগল। এর দ্বারা কখনও কাজ হয়! সবাই ঠাট্টা করতে আরম্ভ করলে। ছাগল দিয়ে ধান মাড়ানোও যা, একে দিয়ে নায়িকার অভিনয় করানোও তাই। একে টিকিট কেটে যেখান থেকে নিয়ে এসেছিলে সেখানে ফেরত পাঠিয়ে দাও।
— কিন্তু একে যে অনেক টাকা দিয়ে এর সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেছি—
— যত টাকাই দাও আর বেশি লোকসান দিও না এর পেছনে—
গুরু বললে— না, ঠিক করেছি একেই পরের ছবির হিরোইন করব—
— কিন্তু যখন আপনার ছবি ফ্লপ্ করবে, যেন আমাদের দোষ দিতে পারবেন না—
আমি গল্প শুনছিলাম। বললাম— তারপর?
গুরু এবার বলল— দেখুন ওই যে বসে আছে—
বলে ওয়াহিদা রেহমানের দিকে দেখিয়ে দিলে। ওয়াহিদা রেহমান তখন নিজের জীবনের গল্প শুনছে আর মিট্ মিট্ করে হাসছে—
গুরু বললে— জিজ্ঞেস করুন না প্রথম-প্রথম ওকে কত মেরেছি— কত বকেছি। কিন্তু আজ বিখ্যাত স্টার হয়ে গেছে—
যা হোক, ছবির শো হল। সবাই দেখলাম ‘সাহেব বিবি গোলাম’। আবার বহুদিন পরে দেখলাম। দেখি না পাশেই ছিলেন শচীন দেববর্মণের স্ত্রী মীরা দেবী। তাঁর চোখ ছল্-ছল্ করছে। আমার দিকে চেয়ে বলল— কী গল্পই না লিখেছেন!
আমি কিন্তু তখন নবেন্দু ঘোষকে খুঁজছি। নবেন্দু ঘোষকে দেখতে পেয়ে বললাম— কাল চলে যাব, আপনাকে এর চিত্রনাট্য করতে হবে কিন্তু—
নবেন্দু বললে— ঠিক কাল সন্ধেবেলা আমি গুরু দত্তের বাড়িতে আসছি, তখন কথা হবে।
এইতো গেল প্রথম দিককার কথা। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ঘটনা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটা মানুষকে যতটুকু চেনা যায়, তখন ততটুকু চিনেছি। তখন মাত্র দেখেছি একজন সুপুরুষ, সহৃদয়, সহানুভূতিশীল রসিক মানুষকে, তার বেশি কিছু নয়। গুরু দত্ত সন্ধেবেলা এসে আমার সামনে বসল।
বললে— একটা অনুরোধ করব আপনাকে বিমলবাবু?
বললাম— বলুন।
গুরু বললে— আমাকে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিটা করতে সবাই বারণ করেছে। এমনকী আমার স্ত্রী পর্যন্ত বারণ করেছে। কিন্তু আমি এ ছবি করবোই। আমি ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ। যে কাজ আমি করব বলি সেটা করবোই— আমি কারো কথা শুনবো না। আমার নিজের মতেই আমি চলি।
— কিন্তু এতে তো আপনার ক্ষতি-ই হয়?
গুরু বললে— হোক ক্ষতি—
— কিন্তু দশজনের মতামত নেওয়া ভালো। তাতে অনেক লাভ হয়।
— লাভ-লোকসানের কথা যদি ভাবতুম, তাহলে আজ আমি অন্যরকম হতাম বিমলবাবু। লাভ-লোকসানের চেয়ে আমার নিজের খেয়ালটাই বড় কথা। তাই আমার একটা অনুরোধ আছে—
— কি অনুরোধ?
গুরু বললে— অনুরোধ একটা নয়, দুটো। কিন্তু তার আগে প্রথম কাজ হল আপনার সঙ্গে কনট্রাক্ট করা। তারপর এক নম্বর অনুরোধ হল কাল খবরের কাগজের লোক আসবে আপনার ইন্টারভিউ নিতে—
— কেন?
— কারণ আপনিই যে ‘সাহেব বিবি গোলামে’র লেখক। তারা আপনার কাছে উপন্যাসটার সম্বন্ধে, আপনার সম্বন্ধে নানা প্রশ্নের উত্তর শুনতে চায়। আর ক্যামেরাম্যানও আসবে, আপনার ফটো নিয়ে কাগজে ছাপাবে—
— ফটো?
আমি বরাবরই ফটোর ব্যাপারে লাজুক। নিজেকে আড়ালে রেখেই আমি সাহিত্য-সাধনা করতে ভালোবাসি। কিন্তু গুরু বললে— প্লিজ বিমলবাবু, আপনি আপত্তি করবেন না। এটা আমারও ইচ্ছে—
অগত্যা রাজি হলাম। গুরু বললে— আমার আর একটা অনুরোধ ‘সাহেব বিবি গোলামে’র স্ক্রিপ্ট-টা আপনি নিজেই লিখে দিন—
আমি জানতাম গুরু এই অনুরোধ করবে, তাই আগেভাগেই আমি লেখক নবেন্দু ঘোষকে অনুরোধ করে রেখেছিলাম এই উপন্যাসের চিত্রনাট্য লেখার জন্য। তাকে আমি রাজি করাতামও। আমি আমার আপত্তি জানালাম। কিন্তু গুরু কিছুতেই শুনলে না। বললে— আপনার বই আপনি যেরকমভাবে করবেন, অন্য কেউ সেভাবে করবে না। আপনার লেখা উপন্যাস আপনি চিত্রনাট্য লিখে দিলে সেই চিত্রনাট্যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে। প্লিজ বিমলবাবু, আমি এই সিনেমাটা খুব যত্ন করে করতে চাই। এই বইটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। কোনো রকম কমপ্রোমাইজ করতে চাই না আমি এটার জন্য। অনুরোধটা আপনাকে রক্ষা করতেই হবে—
অতএব গুরুর অনুরোধ আমাকে রাখতেই হল। ও আমার কোনও আপত্তি শুনল না। ঠিক হল গুরু আমাকে একজন সহকারী দেবে আমাকে স্ক্রিপ্ট লেখাতে সাহায্য করার জন্য। লোনাভালার নির্জন বাড়িতে বসে স্ক্রিপ্ট লেখা হবে। কিন্তু হলে কি হবে, আমিই মুশকিলে পড়লাম। আমাকে সপ্তাহে-সপ্তাহে কলকাতার ‘দেশ’-এ ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর কিস্তি পাঠাতে হবে, আবার ‘সাহেব বিবি গোলামে’র চিত্রনাট্যও লিখতে হবে। শরীরটাও তেমন জুৎসই নয় আমার।