আমাদের দেশের রাজনৈতিক ভাষ্যে ‘এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা’ উক্তিটির দাপট যখন ক্রমেই বেড়ে চলেছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে একটি কথা না বললেই নয়— ‘ভারতীয়’ হওয়া মানেই (প্রকৃত এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থে) একসঙ্গে বহু সত্তা এবং একাধিক আত্মপরিচিতি ধারণ করতে পারা। এ ব্যপারটি বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ভাষার ক্ষেত্রে। ভারতবর্ষে কিছু মানুষ একভাষী, এ কথা হয়তো মিথ্যে নয়। তা সত্ত্বেও এই চমকপ্রদ রকমের পাঁচমিশেলি দেশটায় প্রত্যন্ততম গ্রামের বাসিন্দাও জন্মমুহূর্ত থেকেই একাধিক ভাষার সংস্পর্শে আসেন। আরও লক্ষাধিক মানুষের মতো আমারও বড় হয়ে ওঠা বহু ভাষার হাত ধরে। দৈনন্দিন জীবনে আমাদের (অর্থাৎ আমার পরিবার, প্রতিবেশী, বন্ধুবর্গের) পাল্লায় পড়ে নানা সদ্ব্যবহার, অসদ্ব্যবহার, অপব্যবহার, সংকরীকরণ ও বকচ্ছপীকরণের জটিল রসায়নে তাদের মধ্যে কোনও ভাষাই আর নিজের কৌলীন্য বজায় রাখতে পারেনি। আজও যে ‘ভাষায়’ আমি সবচেয়ে সাবলীল— তা আদতে বাংলা (আমার মাতৃভাষা), ইংরেজি (স্কুল-কলেজে আমার লেখাপড়ার মাধ্যম), এবং হিন্দি (হিন্দি সিনেমা, রেডিও, এবং দূরদর্শনের দৌলতে) ভাষার এক জটিল খিচুড়ি। এ হেন ‘অশুদ্ধতা’-র অসুখ সারানোর নানা চেষ্টা করা হয়েছে বটে (যেমন বাংলার ‘বিশুদ্ধ’ প্রয়োগে ব্যর্থ হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদাহরণ তুলে ধরা, বা ‘পিনড্রপ সাইলেন্স’ যে ঠিক ইংরেজি নয় স্কুলে সে শিক্ষা দেওয়া), তবে আমি, আমার অধিকাংশ বন্ধু বা পরিচিতদের মতোই, মূলত নিজের আয়ত্তের এই তিনটি ভাষার নানাবিধ রসদই আজও ব্যবহার করে থাকি, মাঝেমধ্যে অন্য কিছু ভাষার থেকেও অলঙ্কার ধার নিয়ে।
একই ব্যক্তিত্বে বিভিন্ন সত্তার এই সহাবস্থান আমাদের এমনই গা-সওয়া হয়ে গেছে, এই বিষয়টিকে আমরা অসাধারণ বলেও মনে করি না, বোধও করি না তাকে নিয়ে তলিয়ে গবেষণার কোনও প্রয়োজন আছে। কলকাতার মতো শহরে এ জিনিসটি যেভাবে টের পাওয়া যায়, বোধহয় আর কোথাও যায় না। যতদূর মনে পড়ে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ভাষার এই সহাবস্থানকে আমি সহজ, স্বাভাবিক বলেই ধরে নিয়েছি। যে বিরাট ভাড়া-বাড়িটির একতলায় আমার বড় হয়ে ওঠা, সেই বাড়ির দোতলাতেই থাকতেন এক পঞ্জাবি পরিবার, আবার বিহারের এক শ্রমজীবী পরিবার বাস করতেন আউটহাউসে। সেই রাস্তায় তিনটে বাড়ি পরেই যাঁরা থাকতেন তাঁরা কেরলের মানুষ, আবার আর একটু এগিয়ে গেলেই কিছু রাজস্থানিদের বসবাস— তাঁদের বাড়ির ছেলে আমার ভাই এবং আমার সঙ্গে একই স্কুলে পড়ত। এদের সবার থেকে শুনে শুনেই আমার নানা রকম কথা, নানা শব্দ শেখা (তার মধ্যে বেশ কিছু অশালীন শব্দও ছিল বটে), সেগুলো আজও আমার মনে আছে। আমাদের বাড়ি জুড়ে ছড়ানো বইগুলোও এই বহুভাষিকতার শরিক ছিল। জীবনে প্রথম যে অনুবাদ করা বইটির সংস্পর্শে আসি, সেটি ছিল রঙবেরঙের ছবিতে চিত্রিত একটি রূপকথার গল্পের সংকলন— রাশিয়ান বই হিসেবেই তাকে আজও আমি ভাবতে ভালোবাসি। তখন অবশ্য গল্পগুলো পড়ে বোঝার মতো বয়স হয়নি— কেবল স্মরণে আছে তার পাতাগুলো ছিল বাঁধানো, আখরোটের খোলায় চড়ে ভেসে যাওয়া একটি পিঁপড়ের ছবিও মনে পড়ে। তবে এটুকু সে-বয়সেই টের পেয়েছিলাম যে পাতার হরফগুলো বাংলা হলেও, বইয়ের মধ্যে কী যেন একটা অপরিচিত ভাব, কেমন যেন ‘ভিনদেশি’ একটা ব্যপার ছিল। তার পর গত অর্ধ-শতাব্দীতে অন্তত কয়েকশো অনূদিত বই পড়ার সুযোগ হয়েছে— কিছু নিছকই পড়ার আনন্দে, কিছু কর্মসূত্রে শিক্ষকতার তাগিদে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমি এই বইগুলোকে ‘অনুবাদ’ বলে ভাবি না, বা মূল রচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনুবাদের বিশ্বস্ততার বিচার করি না— কারণ মূল রচনার ভাষাটিই আমার জানা নেই যে! অতএব আমার মনের ভিতর ভাল, গুরুত্বপূর্ণ, বা প্রভাবশালী বইয়ের তালিকাটিতে এই বইগুলোকে আমি এক বিচিত্র স্থান দিয়েছি; আমি ধরে নিই যেন সে-সমস্ত বই বাংলা এবং ইংরেজি এই দু’টি ভাষাতেই লেখা। একটি বিশেষ ধারাকে উদাহরণ হিসেবে আজ রাখি। যে ঔপন্যাসিকদের লেখা আমি ভালবাসি, তাঁদের মধ্যে সের্ভান্তেস থেকে ডিফো, অস্টেন, দস্তয়েভস্কি, ডিকেনস, জর্জ এলিয়ট, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ক্যালভিনো, অমিতাভ ঘোষ, কে আর মীরা— আমার কল্পনায় এঁরা প্রত্যেকেই যেন উপন্যাস লিখেছেন বাংলা এবং ইংরেজির ওই বহুভাষিক মিশ্রণেই। নানা প্রসঙ্গে এঁদের লেখার কোনও অংশ যখন মনে করার চেষ্টা করি, অভ্রান্ত ভাবেই আমার সেসব লেখা মনে পড়ে যায় আমার একান্তই নিজস্ব ওই বিচিত্র মিশ্র ভাষায়।
বলছি বটে ‘একান্তই নিজস্ব’, তবে আদতে এ তো রাস্তাঘাটের ভাষা, স্কুল-কলেজের ভাষা, পথের ধারে আড্ডার ভাষা— যে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, আড্ডাদের আমি নিজের ঘরবাড়ি বলেই চিনি। অন্য কোনও ভাষার থেকে একটি শব্দ বা শব্দবন্ধও ধার নেয়নি, এমন ‘বিশুদ্ধ বাংলা’ শেষ কবে শুনেছেন মনে করুন তো? বিজ্ঞাপনের গানেই হোক (‘সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন’), বইতেই হোক (‘ফাইট! কোনি, ফাইট!’), বা ভিড়-জীবনের দৈনন্দিন আদান-প্রদানেই হোক (‘আস্তে লেডিজ’), বিশুদ্ধতা সব সময়েই হার মেনে যায় সংকরত্বের কাছে। এ কথা অবশ্য ঠিক, বাংলা ভাষ্যের বিশ্বচরাচরে কোনও কোনও ভাষাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হয়, আবার অন্য কিছু ভাষাকে দেখা হয় একটু হীনতার চোখে। তবে সে আলোচনা নাহয় অন্য একদিন করা যাবে। আপাতত এই জগাখিচুড়ি সত্তাকেই উদযাপন করা যাক, কারণ আমরা সবাই আদতে এমনই পাঁচমিশেলি।