ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • গায়কীতে মুন্সিয়ানা উজ্জ্বল


    অরুণাভ দেব (February 27, 2021)
     

    প্যান্ডেমিকের এক্কেবারে গোড়ার দিকে, যখন ওমলেট-খিচুড়ি-খেয়ে-বেঁচে-থাকা জাতীয় চিন্তাভাবনা বাঙালির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল, গানবাজনা আবার কবে কীভাবে শোনা  যাবে, তা নিয়ে কেউই বিশেষ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গেল যে গানবাজনা চাই-ই চাই। প্রচুর শখের শিল্পী দস্তুর মতো প্রযুক্তি বিশারদের পরিচয় দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তাঁদের গানবাজনায় ভরিয়ে দিলেন। একই সঙ্গে প্রচুর পেশাদার শিল্পী— আমি এখানে প্রধানত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কথা বলছি— এমন কিছু রেকর্ডিং প্রকাশ করলেন যেগুলো শুনে ও দেখে প্রথমে মনে হল যে ঠাট্টার ছলে করা, তবে একটু শুনেই বোঝা গেল যে ঠাট্টা-ঠাট্টা ভাবটা অনিচ্ছাকৃত। ক্রমশ আয়োজকরা যত্ন করে অনলাইন অনুষ্ঠান করা শুরু করলেন— তার বেশ কয়েকটিতে অবশেষে খুবই উচ্চমানের সঙ্গীত  ও উপস্থাপনা শ্রোতারা পেলেন। করোনা-ক্লান্তির মধ্যে এই অনলাইন অনুষ্ঠানগুলি শুনে প্রচুর সঙ্গীত প্রেমিক হাঁপ ছাড়লেন। কিন্তু আবার কয়েক মাস কাটতেই, যখন আর সব ক্ষেত্রেই মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন ফিরে এল, অনলাইন অনুষ্ঠানগুলির প্রতিও শ্রোতাদের একটা দুধের-স্বাদ-ঘোলে মেটানো মনোভাব তৈরি হল। সেই কারণেই বোধহয়, জানুয়ারি মাসে ব্লাইন্ড স্কুলের মাঠে বেহালা ক্লাসিকাল ফেস্টিভ্যালে, নিকুচি-করেছে-করোনা বলে শ্রোতাদের ঢল নামল। শিল্পীর সামনে রক্তমাংসের শ্রোতা আর শ্রোতাদের সামনে মঞ্চের ওপর রক্তমাংসের শিল্পী— দুটোই এই অদ্ভুত বছরটার  পরে একটা আশ্চর্য তাৎপর্য গ্রহণ করল। আমি বেহালায় যাইনি— করোনার ভয়েই— অনলাইন স্ট্রিমিং দেখেছি। তবে সেই স্ট্রিমিং-এ শ্রোতাদের দেখতে পেয়ে অস্থিরতা আর ঈর্ষার একটা মারাত্মক কম্বিনেশন  অনুভব করেছি। তাই কলকাতা লিটেরারি মিট-এর আয়োজনে যখন ২৯ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কৌশিকী চক্রবর্তীর গানের খবর এবং পরে আমন্ত্রণ পেলাম, না-যাওয়ার সম্ভাবনাটা আর মাথাতেই আসেনি। প্রায় এক বছর সামনাসামনি গান না শোনার পর, খোলা আকাশের নিচে, চাঁদের আলোয়, শীতের হাওয়ায়, পেছনে ভিক্টোরিয়া দেখতে দেখতে যখন কৌশিকীর গানের অপেক্ষা করছিলুম, তখন মনে হচ্ছিল যে একটা প্রবল সিটি মারা ছাড়া আর কোনও ভাবেই নিজের মনের অবস্থা ব্যক্ত করতে পারব না।  

    শুরুর রাগ মধুবন্তী। কিছু কিছু রাগ এমন, যেগুলোর চিন্তা বা মূল্যায়ন প্রায় সব সময়েই অন্য আর একটি রাগের পরিপ্রেক্ষিতে করার প্রবণতা থাকে। শ্রোতারা যেমন এটা লক্ষ করেন যে শিল্পী কতটা সন্তর্পণে অন্য রাগটি এড়িয়ে চলছেন, ঠিক তেমনি অন্য রাগটির ছায়া কীভাবে, রাগচ্যুতি না ঘটিয়ে, এই রাগে পড়ছে তার মজাটাও উপভোগ করেন। মধুবন্তীর ক্ষেত্রে এই জুটি রাগটি মুলতানি। খাতায়-কলমে, কোমল ধা আর কোমল রে, শুদ্ধ ধা আর শুদ্ধ রে দিয়ে বদলে দিলেই মুলতানি মধুবন্তী হয়ে যায়। কিন্তু রাগরূপ যে খাতা-কলমের ঊর্ধ্বে, তা সদ্য-প্রবর্তিত শ্রোতারাও জানেন। ধা আর রে-র বদলের পরেও, মধুবন্তীর নানা জায়গায় মুলতানি উঁকি মারে— কখনও তীব্র মা-পা-শুদ্ধ নি-র সংমিশ্রণে আবার কখনও-বা কোমল গা, তীব্র মা-র মাখামাখিতে। কতটা উঁকি মারতে দেওয়া আর ঠিক কখন শুদ্ধ রে বা শুদ্ধ ধা-র আবির্ভাব ঘটিয়ে লুকোচুরি বন্ধ করা— শ্রোতা আর শিল্পী দু’জনের কাছেই মধুবন্তী পরিবেশনার এটি একটা মজাদার বিষয়।  

    সেদিন কৌশিকী অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুলতানি-মধুবন্তীর এই লুকোচুরি খেললেন। একতালে নিবদ্ধ বিলম্বিত রচনার (‘শ্যাম ভায়ে ঘনশ্যাম’) বিস্তারের সময় এই প্রয়াস স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেল: বিশেষ করে কোমল গা আর তীব্র মা-র প্রয়োগে, আর, খুবই অভিনব ভাবে তীব্র মা আর শুদ্ধ নি-র একটা মেরুরেখা তৈরি হওয়ায়। মন্দ্র সপ্তকে শুদ্ধ নি থেকে তীব্র মা-তে সোজা এসে দাঁড়িয়ে আর তার একটু পরেই তীব্র মা থেকে মন্দ্র সপ্তকের শুদ্ধ নি-তে মীড় করে ফিরে এসে কৌশিকী এই দুটি স্বরের মধ্যে যে সংযোগ সৃষ্টি করলেন তাতে মুলতানির ছায়া বারবার গানে এসে পড়ল, কিন্তু উপযুক্ত সময়ে সা-এর কণ নিয়ে শুদ্ধ রে-র প্রয়োগে মুলতানির ভারিক্কি মেজাজে মধুবন্তীর তুলনামূলক ফুড়ফুড়ে ভাব ফিরে এল। মধুবন্তীর পুরো পরিবেশনাতেই কৌশিকী এই ভাবে রাগরূপ বজায় রাখায় মধুবন্তীর এক অপূর্ব ছবি শ্রোতারা পেলেন। আর তার সঙ্গে তাঁর শিল্পী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় তো ছিলই। নিখুঁত সুর লাগানো, কঠিন লয়কারি, ধারাল তান ছাড়া যে ভাবে তৈরি-অঙ্গ আর বিস্তার-অঙ্গের ভারসাম্য বজায় রাখলেন (তিনতালে দ্রুত বান্দিশ ‘কাহে মান কারো’ গাওয়ার সময়েও), তাতে যে সত্যটা এখন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত সব মানুষই জানেন, সেটাই আবার স্থাপিত হল: যে এই মুহূর্তে কৌশিকীর মতো পরিপূর্ণ কণ্ঠশিল্পী পাওয়া বিরল।      

    মধুবন্তীর পরে তিনটি  ঠুমরি পরিবেশন করলেন কৌশিকী: পাহাড়ি-তে ‘সাজানবা অব তো আও’ আর ‘রঙ্গি সারি গুলাবি চুনারিয়া’ এবং ভৈরবীতে ‘সাইয়াঁ নিকাস গ্যয়ে, ম্যায় না লাড়ি’। ঠুমরি সাধারণত দুটো ধারার গায়কীতে গাওয়া হয়: বেনারস-লখনউ-তে গড়ে ওঠা পুরব অঙ্গ আর পাতিয়ালা ঘরানার শিল্পীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত পঞ্জাব বা পাতিয়ালা অঙ্গ। পুরব অঙ্গ ঠুমরির শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আমরা পাই বেগম আখতার, সিদ্বেশ্বরী দেবী, শোভা গুরতুর গলায় আর পাতিয়ালা অঙ্গের পাই ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান এবং ওস্তাদ বরকত আলী খানের গায়কীতে। সাধারণত এই দুটি অঙ্গের গায়কী একই শিল্পীর একই পরিবেশনায় পাওয়া যায় না। পুরব অঙ্গের ঠুমরি অনেক বেশি ধীরস্থির, কিছুটা বিলম্বিত বিস্তারের মতো কথাগুলির বরহত হয়ে; পাতিয়ালা অঙ্গ ঠুমরিতে তৈরির জায়গাটা অনেকটাই— হরকত, মুড়কি, তান জাতীয় অলঙ্কারের প্রয়োগ পুরব অঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি।   

    কৌশিকীর খেয়াল গায়কীর তৈরি-বিস্তারের ভারসাম্য এক অন্য রূপে তার ঠুমরি গায়কীতে সেদিন প্রকাশ পেল। ‘সাজানবা আব তো আও’ আর ‘সাইয়াঁ নিকাস গ্যয়ে’, দুটো ঠুমরিই তিনি গাইলেন পুরোপুরি পুরব  অঙ্গ মেজাজে। সযত্নে পাহাড়ির আর ভৈরবীর বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলিতে ঠুমরির কথাগুলিকে প্রাসঙ্গিক করে তুললেন। আর তারই মাঝে পঞ্জাব/পাতিয়ালা অঙ্গের কিছু ধারাল হরকত আর তান ঠুমরিগুলিকে একটি অপূর্ব নান্দনিক মাত্রা দিল। পুরব আর পাতিয়ালার এই মিশ্রণ কৌশিকীর ঠুমরি-কাজরি-দাদরাতে শ্রোতারা  বেশ কিছু দিন ধরে উপভোগ করছেন— এই মিশ্রণ তার  ঠুমরি গায়কীকে একটা স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে, যেটা এখন প্রচুর খুদে খুদে ঠুমরি শিল্পী ‘কৌশিকী স্টাইল’ বলে অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। আর এই অবলম্বনের লিস্টে প্রথম ‘আইটেম’ হচ্ছে ‘রঙ্গি সারি গুলাবি’ রচনাটি, যেটা সেদিন ছোট করে কৌশিকী গাইলেন। একটু ইউটিউব ঘাঁটলেই বোঝা যায় যে কৌশিকীর গাওয়া এই ঠুমরি (আর ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’) বেগম পারভীন সুলতানার ‘ভবানি দয়ানি’ বা পণ্ডিত ভীমসেন জোশির ‘যো ভজে হরি’র পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যতক্ষণ না গাইবেন, শ্রোতারা ছাড়বেন না, আর যেই শুরু করবেন, সারা প্রেক্ষাগৃহে একটা বারোয়ারি স্তরে গদগদ ভাব ছড়িয়ে পড়বে। সেদিনও তাই হল— ‘রঙ্গি সারি’ ধরা মাত্রই শ্রোতাদের মুখে এক গাল হাসি ফুটল, শীত  অতিক্রম করে, মুড়িসুড়ি দিয়ে গান শোনা সার্থক হল।

    কৌশিকীর সঙ্গে সঙ্গতে ছিলেন সারেঙ্গিতে মুরাদ আলী, তবলায় শুভঙ্কর ব্যানার্জি আর হারমোনিয়াম-এ গৌরব চ্যাটার্জি। সারেঙ্গির সঙ্গত থাকলে কণ্ঠসঙ্গীত এমনিতেই আরও বেশি উপভোগ করা যায়, আর মুরাদ আলী থাকলে মাঝে মাঝে মনে হয় যে শুধু সারেঙ্গিটাই আর একটু শুনি। এক মুহূর্তের জন্যও শিল্পীর গানে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে, যে-মানের সঙ্গত তিনি দিলেন, বোধহয় ওস্তাদ সুলতান খানের পর এই রকম মানের সারেঙ্গি সঙ্গত আর কেউ দেননি। যতবার তার সঙ্গত শুনি, কলকাতায় যে তিনি কেন আরও ঘন ঘন আসেন না, সেইটাই শুধু মনে হয়। শুভঙ্কর ব্যানার্জির সঙ্গত নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তবলা বাদকদের মধ্যে তিনি এক জন; মিষ্টি ঠেকার যেমন রাখলেন, কৌশিকীর তান ও তেহাই-এর, বিশেষ করে মধ্য লয়ে, উপযুক্ত জবাব দিয়ে আসর একেবারে জমিয়ে দিলেন। গৌরব চ্যাটার্জির সঙ্গত সব সময়েই মার্জিত, সেদিনও তাই ছিল। উচ্চমানের সঙ্গত না হলে কখনওই জমজমাট অনুষ্ঠান হয় না, ভাল গান হয়েও কিছু যেন বাকি থেকে যায়। সেদিন ভিক্টোরিয়ায় কৌশিকী আর তার সঙ্গতশিল্পীরা একে অপরকে নিজের মতো জায়গা দিয়ে গানবাজনার একটা  দারুণ ‘মাহল’ তৈরি করলেন। সঙ্গীতের যতই বিশ্লেষণ হোক না কেন, শেষমেশ  মেজাজটা নিয়েই শ্রোতারা বাড়ি ফেরেন, সেটাই মনে রাখেন। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook