একদিন যখন সেই ছেলেটাই বড় হয়ে প্রথম ছবি করল— তখন মনে পড়ে গিয়েছিল ‘পূর্ণ’ থিয়েটারের কথাটা। সেই ছবির নাম ‘বাজী’। আর হুকুম দিয়েছিল সেই ‘বাজী’ কলকাতায় প্রথম দেখানো হবে ‘পূর্ণ’ থিয়েটারে। ‘পূর্ণ’ থিয়েটারে সেই বোধহয় প্রথম হিন্দি ছবি দেখানো হয়। আর ‘বাজী’ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরু দত্তের রাতারাতি নাম এল, টাকা এল।
গুরু বললে— একদিন কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম ‘পালি হিল’-এর এই বাড়িটা বিক্রি হবে— আমি সঙ্গে সঙ্গে এসে বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করলুম। বললাম— বাড়িটা আমি কিনব, কত দাম?
জিজ্ঞেস করলাম— এত জায়গা থাকতে ‘পালি হিল’ পছন্দ হল কেন?
গুরু বলেছিল— আমার এক বন্ধু এখানে ছিল, তার নাম আপনি শুনেছেন বোধহয়, তার নাম দেবানন্দ—
বললাম— খুব শুনেছি—
— তার কাছে আসতাম আর ভাবতাম, যদি কখনও বাড়ি কিনি তো এই পালি হিলেই কিনব—
তা শেষ পর্যন্ত এক লাখ টাকায় আটচল্লিশ নম্বর পালি হিলের বাড়িটা কিনে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল গুরু। অনেকদিন দুপুরবেলা সেই বড়-বড় গাছের তলায় চুপ করে থাকতে-থাকতে আমারই মনে হত আমি যেন এক অন্যলোকে চলে গিয়েছি। সে এমন এক লোক যেখানে অশান্তি বলে কিছু নেই, অভাব বলেও কিছু নেই। ওই বাড়িটাতে গেলেই আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যেত। অথচ ওই বাড়ির মধ্যেই যে গুরু অত অশান্তির মধ্যে ছটফট্ করত, তা তখনও জানতে পারিনি। আর সেই জন্যেই হয়তো অমন করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার হুকুম দিয়েছিল। সেই বাড়ি ভেঙে ফেলার ঘটনাটাও তো একটা আলাদা গল্প, সেটা পরে বলব।
গাড়িটা বাগানের ভেতরে ঢুকতেই দেখি সামনের পোর্টিকোর তলায় অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকেই চিনতে পারলাম না। শুধু নজরে পড়ল শচীনদাকে। শচীন দেববর্মণ।
শচীনদা এগিয়ে এলেন। বললেন— আরে বিমল, তুমি? তোমার খবর কি?
তারপর সকলের সঙ্গে পরিচয় হল। প্রথমেই গুরু দত্ত। পরস্পর নমস্কার করলাম। গায়ে একটা আদ্দির পাঞ্জাবি। পরনে সিল্কের রঙিন একটা লুঙ্গি। একমুখ পান। বললে— আমার স্ত্রী, গীতা দত্ত—
তাকেও নমস্কার করলাম। অত্যন্ত সাধারণ একটা আদ্দির পাঞ্জাবি, আর একটা লুঙ্গি। একমুখ পান। একমুখ পান পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কথা বলছে আপনার আমার মতো। এ যেন অভাবনীয়। সকালবেলা কলকাতা থেকে বেরিয়েছি আর বিকেল পাঁচটায় পালি হিলে পৌঁছেছি। গায়ে একফোঁটা ঘাম পর্যন্ত জমেনি। মনে হচ্ছে যেন নিজের বাড়ির একতলা থেকে দোতলায় উঠেছি। কিংবা হয়তো তাও নয়। এক হাজার মাইল দূরে এসেও কোনও ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই। সামান্য যেটুকু সংকোচ ছিল তাও দূর হয়ে গেল গুরু দত্তের হাসিমুখ দেখে। কোনও মানুষের হাসি যে এত সুন্দর হতে পারে, তা গুরুকে দেখার আগে কল্পনাও করতে পারিনি। গুরু দত্ত হয়তো সিনেমায় অভিনয় করবার সময় হেসেছে। যারা তাকে সিনেমায় দেখেছে তারা তার হাসি দেখেছে। আমি তার সিনেমার অভিনয় কখনও দেখিনি। তাই বোধহয় আমি সে হাসি দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
সুন্দর পুরুষ অনেক দেখা গেছে। কিন্তু সৌন্দর্যেরও রকমভেদ আছে। কারও সৌন্দর্য আকর্ষণ করে, কারও সৌন্দর্য ভয় পাওয়ায়। কারও সৌন্দর্য অন্যদের আগুনের মতো পুড়িয়ে ছারখার করে। কেউ আবার সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় নিজেই উল্লসিত হয়ে জীবন কাটায়, অন্যদের ভাগ দেয় না। ‘সৌন্দর্য’ সম্বন্ধে শাস্ত্রে অনেক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু গুরুর সৌন্দর্য অন্যরকম। গুরু দত্তের কাছে যারাই এসেছে তারাই তার সৌন্দর্যের আভায় উপকৃত হয়েছে। আমি একদিন বলেছিলাম— আপনার মতো সুন্দর চেহারা, মাদ্রাজে যখন গিয়েছিলাম তখন ‘বহুরাণী’ বলে একটা ছবি তোলা হচ্ছিল। একটা দৃশ্যে গুরু দত্তকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার মুখে সে দৃশ্যে দাড়ি-গোঁফ পরানো হয়েছিল।
গুরু দত্ত বললে— আপনি কে. আসিফের ছবিতে দেখবেন সেখানে আরও সুন্দর দেখিয়েছে আমায়—
সে ছবি শেষ হল না। শেষ হবেও না। সেই কে. আসিফের ‘লাভ অ্যান্ড গড্’। তাতে গুরু দত্তের যেটুকু অংশ তোলা হয়েছিল, সেটুকু সমস্ত নষ্ট করে ফেলতে হবে। অন্য অভিনেতা হয়তো তাতে অভিনয় করবে।
যা হোক, সেদিন সেই পালি হিল-এর গুরু দত্তের বাড়ির সামনে আমি হয়তো খুব অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম তার মুখখানাকে। নিজের অজ্ঞাতেই যে কতক্ষণ চেয়েছিলাম, তার খেয়াল ছিল না।
গুরু বললে— আপনি কি টায়ার্ড? যদি ক্লান্ত মনে করেন তো এখানে বিশ্রাম করুন। আমরা সবাই লোনাভালায় যাচ্ছি, কাল এই সময় ফিরব—
— কোথায় যাচ্ছেন?
গুরু দত্ত বললেন— লোনাভালায়। সে এখান থেকে নব্বই মাইল দূরে একটা জায়গা—
আমি কি উত্তর দেব ভাবছি। গুরু দত্ত বললেন— আপনার হয়তো সেখানে যেতে কষ্ট হবে, তার চেয়ে আপনি এখানে থাকুন। আপনার কোনও কষ্ট হবে না, আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য সূর্য ভাইয়া এখানে থাকবে—
সূর্য ভাইয়া মানে সূর্য লাডিয়া। গুরু দত্তের বাংলা সার্কিটের ডিস্ট্রিবিউটর। সূর্য লাডিয়াই বলতে গেলে গোড়া থেকে অর্থাৎ তিন বছর আগে থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। আমি ভেবে দেখলাম আমার জন্য আর একজন লোক কষ্ট পাবে। আমার জন্য, তার লোনাভালায় যাওয়া হবে না।
বললাম— ঠিক আছে, আমিও যাব আপনাদের সঙ্গে—
ভাবুন, সেই হাজার মাইল উড়ে যাওয়ার পর জামা-কাপড় বদলানো নেই, এমনকী গাড়ি থেকে স্যুটকেসটাও নামানো হল না। সেই অবস্থাতেই রাজি হয়ে গেলাম। সবাই আমার কথাতে খুশি। কিন্তু আমি মনে-মনে ভয় পাচ্ছি। শরীর খারাপ নিয়ে এত দূর এসেছি, এর পর যদি আরও শরীর খারাপ হয় তো ওরাই বা কী মনে করবে? শচীনদা বললে— ভেরি গুড্ বিম, ভেরি গুড্— চলো মারাঠি গান-বাজনা শুনতে পাবে সেখানে। তোমার কোনও কষ্ট হবে না। আর তা ছাড়া আমি তো সঙ্গে আছি, আমারও তো শরীর খারাপ। আমার সঙ্গে ডাব আছে, কমলালেবু আছে—
শেষ পর্যন্ত তাই-ই ঠিক হল। সে অবস্থাতেই আমি আবার গাড়িতে উঠে বসলুম। গুরু সেই লুঙ্গি পরেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরল। শচীনদার পরনেও লুঙ্গি। কবি শাহীর লুধিয়ান্ভি, তার পরনে কেবল শার্ট-ট্রাউজার। কে কোন গাড়িতে উঠল জানি না। গুরু আমাকে তার পাশে বসিয়ে নিলে। পেছনের সিটে সূর্য লাডিয়া। গুরু গাড়ি চালাচ্ছে।
সূর্য লাডিয়া জিজ্ঞেস করলে— কি রান্না হচ্ছে?
গুরু বললে— মাংসের বিরিয়ানি, চিকেন কারি আর…
আমি ভয়ে চমকে উঠেছি। বললাম— বিরিয়ানি? কিন্তু আমি তো ওসব খেতে পারব না, আমার ওসব সহ্য হবে না—
গুরু বললে— ঠিক আছে, আপনি যা খাবেন তাই-ই রান্না হবে—
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। গুরু গাড়ি চালাচ্ছে বটে, তবে সারাক্ষণ আমার সাথে কথা বলছে। সে যে কত কথা তা আজও আমার মনে আছে, সমস্তই ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সম্বন্ধে। জীবনে নিজের লেখা সম্বন্ধে এত নিন্দে শুনেছি যে তা একসঙ্গে করলে তাও আর একটা ‘সাহেব বিবি গোলাম’ হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন গুরু দত্ত যেসব কথা বলতে লাগল আর কারও কাছ থেকে তা শুনিনি। সমস্তই প্রশংসার কথা। সেসব এখানে লেখা যাবে না, লেখা উচিতও নয়। তবু আজ মনে পড়ছে সেদিনকার সে কথাগুলো তেমনি করে বলবে, এমন আর কেউ রইল না পৃথিবীতে। কখনও জলের ধার দিয়ে, কখনও সমুদ্রের ধার দিয়ে কখনও ক্ষেতের পাশ দিয়ে চলেছি। চলেছি তো চলেছি-ই। তারপর চলতে চলতে গাড়িটা চড়াই উঠতে লাগল একটা পাহাড়ের গা বেয়ে।
যা হোক, লোনাভালায় পৌঁছনো গেল। এটা একটা বাংলো বাড়ি গুরুর। বম্বে শহর থেকে দূরে একটু নির্জনে নিরিবিলিতে থাকার মতো জায়গা।
সকলে মিলে আড্ডা জমে উঠল। শচীনদা অনেক গান শোনালেন। শচীনদার সঙ্গে আমার বহুদিনের আলাপ। খুব ছোটবেলা থেকে আমি গান লিখতাম। সেই সূত্রে এইচ.এম.ভি.-র স্টুডিওতে রেকর্ডিং-এর জন্য আমার যাওয়া-আসা ছিল, সেখানেই শচীন দেববর্মণ, অনুপম ঘটক, অনিল বাগচী, অনিল বিশ্বাস সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অনেকদিন পরে গান শুনোট বেশ ভালো লাগল। গুরু দত্তের সঙ্গেও অনেক আলোচনা হল। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সিনেমাটা করার কথা কিভাবে তার মাথায় এল, কি-কি প্ল্যান করেছে যেটা করার জন্য… ইত্যাদি। আমি চুপ করে শুনতে লাগলাম।
গুরুর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত সিনেমা সম্বন্ধে আমার নিজের কোনও সাক্ষাৎ-অভিজ্ঞতা ছিল না। আমার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বাংলা ছবি হয়েছে আগে। কিন্তু আমি স্টুডিওতে যাইনি কখনও। কর্তৃপক্ষ অনেক অনুরোধ করেছেন, তবুও যাইনি। না-যাওয়ার কারণ ছিল একটা। কারণটা এই যে সাহিত্যিক যদি নিজেই সিনেমার মোহে পড়ে যান তাহলে তাঁর সাহিত্যের ক্ষতি হয়।
কথাটা কারও কারও কাছে অবিশ্বাস্য হতে পারে। কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে ভেবে দেখেছি যে সিনেমার একটা মোহ আছেই। বিশেষ করে সাহিত্যিকদের মধ্যে। অনেক সাহিত্যিক মনেপ্রাণে সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে যেতে চান। এবং এই জড়িয়ে যাওয়ার সূত্রে তাঁদের সাহিত্য-জীবনও শেষ পর্যন্ত বিড়ম্বিত হয়ে যায়। প্রথম প্রথম শুধু গল্পের চিত্রনাট্য নিয়ে নাড়া-চাড়া করতে হয়। তারপর সেই গল্প নিয়ে আলোচনা করতে-করতেই পরিচালনা করার ইচ্ছে হয়। তখন সাহিত্য-রচনা শিকেয় ওঠে। সিনেমা এইরকম করে বহু সাহিত্যিকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নষ্ট করেছে। এসব আমার জানা ছিল। তাই আমি হাজার প্রলোভন সত্ত্বেও সিনেমা স্টুডিওর ধারে-কাছে ঘেঁষিনি। কিন্তু এবার ঘটনাচক্রে আমাকে একেবারে সিনেমা-স্টুডিওর মধ্যে যেতে হল। এবং আমি আস্তে-আস্তে গীতা দত্ত, গুরু দত্ত, ওয়াহিদা রেহমান-এর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলাম। যাদের নিয়ে কলকাতার লোকের মুখে এত আলোচনা, তাদের কাছ থেকে দেখলাম। পরে ভেবেছিলাম— এদের এত কাছ থেকে দেখে আমি কি পেলাম? আমার কি লাভ হল?
সেই লাভ-লোকসানের কথাই আজ লিখতে বসেছি। সেই হিসেব নিকেশ করব বলেই আজ কলম ধরেছি। জানি না পারব কিনা।