স্বাদের রামধনু

দৃশ্য: এক/ সময়: দিন/ স্থান: টাইম মেশিন/ চরিত্র: ইয়ং বাঙালি ও মহারাজা বিদেহ নিমি।

আলোর গতিতে গার্গেঞ্চুয়া পার করে সাঁ সাঁ ছুটে চলেছে টাইম মেশিন। ইয়ং বাঙালির সহযাত্রী মিথিলার মহারাজা বিদেহ নিমি। দু’জনের বয়সের ফারাক কয়েক হাজার বছরের হলেও বাঙালির বাচালতাই শক্তি। সর্বজ্ঞ উবার কুল অ্যাপ্রোচে তাই প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

বাঙালি:  মহারাজ, আমি ইন্টারনেট ঘেঁটেঘুটে যা বুঝলাম তাতে এটা স্পষ্ট যে, আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কেবল ছ’টা স্বাদ, তাই তো?

নিমি:  না।

বাঙালি: তাহলে? ক’টা স্বাদ?

নিমি: কোনও স্বাদ নেই।

বাঙালি: মানে? ইন্টারনেটে কত লেখায় আত্রেয় মুনির চরক সংহিতার Citation পেলাম, পরিস্কার বলছে ছ’টা স্বাদ। অম্ল, মধুর, নোনতা, তেতো, কটু, কষায়…

(বাঙালির বকবক শেষ হল না। নিমি থামালেন।)

নিমি: আয়ুর্বেদে স্বাদ বলে কিছু হয় না খোকা। রস বলে একটা বস্তুর কথা বলা হয়েছে।

বাঙালি: রস তো বাঙালির বশে মশাই। সে গোল্লা হোক বা বড়া হোক!

নিমি: তাই তো হামবড়া বাঙালি গোল্লায় গেছে।

বাঙালি: Sorry?

নিমি: আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে মহাভূত বা পঞ্চভূত-এর সঙ্গে পিত্ত, বট আর কফের যে সম্পর্ক তা জিভ দিয়ে অনুধাবন করার জন্য রস-এর কথা বলা হয়েছে। পরে তা স্বাদ বলে সরলীকরণ করা হলেও তার ব্যপ্তি অধরাই থেকে যায়। চরক সংহিতাতে ওরকমই ছ’টা রস, যা তুমি গুগল করে পেয়েছ, তার কথা বলা হলেও ব্যাপারটা পুরোপুরি ঠিক না।

বাঙালি: ঠিক না? চরক সংহিতা ঠিক না?

নিমি: ওই ছ’টা রসের ব্যাপার ঠিক না?

বাঙালি: তাহলে স্বাদ… মানে রস ক’টা?

নিমি: সাতটা— অম্ল, মধুর, নোনতা, তেতো, কটু, কষায়, ক্ষার।

বাঙালি: খাড়? খাড় মানে তো রাগ! আমরা ঝাঁট জ্বলে গেলে বলি খাড় খেয়ে গেছে।

নিমি: এটা খয়ে মূর্ধণ্য সয়ে আকার বয়ে শূন্য র। ইংরেজীতে বলে অ্যালকালাইন।

বাঙালি: আচ্ছা? এটা তো জানতাম না!

নিমি: ইন্টারনেট থেকে আয়ুর্বেদ পড়লে জানার চান্স কম তো! সেই জন্যই রস বলতে তোমার বড়ার কথা মনে হল।

বাঙালি: আরে ওটা তো স্মার্ট কামব্যাকের জন্য। রস বলতে রসগোল্লা, রসবড়ার কথাই তো মনে আসবে বাঙালির। কী অদ্ভুত!

নিমি: কেন? ফোঁড়ার কথা এল না কেন?

বাঙালি: ফোঁড়া?

নিমি: হ্যাঁ ফোঁড়া! ফোঁড়া থেকেও তো রস গড়ায়!

বাঙালি: হ্যাঁ, তা গড়ায় কিন্তু…

নিমি: জিভে লাগিয়েছ কখনও?

বাঙালি: কী? ফোঁড়ার রস?

নিমি: হুঁ।

বাঙালি: একবার, ছোটবেলায়।

নিমি: ওটাই ক্ষার… সাত নম্বর রস, তোমাদের স্বাদ।

বাঙালি: ধুর! ফোঁড়া আবার কোনও খাবার হল নাকি?

নিমি: সে তো বিষও খাবার নয়! তাই বলে কি লোকে খায় না?

বাঙালি: কিন্তু আমি তো চরক সংহিতার নাম করে, ছ’টা স্বাদ নিয়ে একটা আর্টিকল লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে দিয়েছি। কত লোক বাহবা দিয়ে কমেন্ট করল, এত খেটেখুটে একটা লেখা লেখার জন্য!

নিমি: খেটেছ, সেটা লোকে জানল কী করে?

বাঙালি: মানে আমিই স্টেটাসে লিখেছি ওই ‘খেটেখুটে’ কথাটা।

নিমি: তুমি তো আচ্ছা অশিক্ষিত! ইন্টারনেট থেকে আয়ুর্বেদ পড়েছ। চরক সংহিতার নাম নিয়েছ, অথচ পাতা উল্টেও দেখোনি। তারপর নিজেই ফলাও করে বলছ, খেটেখুটে লিখেছ? আয়ুর্বেদে মাত্র ছ’খানা স্বাদ? ইডিয়ট! ইয়ার্কি হচ্ছে? 

বাঙালি: তাহলে এখন কী করব স্যর?

নিমি: কী আর করবে? ফেসবুকই করো!

আরও পড়ুন: ‘বেতার জগৎ’-এর শারদীয় সংখ্যার জন্য কর্তাদের আদেশও অমান্য করা হয়েছিল! লিখছেন ভবেশ দাস…

ওপরের লেখাটা কাল্পনিক। কিন্তু পুজোর স্বাদবাহার নিয়ে বাস্তবিক একটা লেখা লিখতে বসে খেয়াল হল, জাতীয় আয়ুর্বেদ দিবস সদ্য চলে গিয়েছে। আয়ুর্বেদের সাতটা স্বাদ থুরি রসের ব্যাপারে প্রথম জেনেছিলাম ‘রেনবো জেলি’ ছবিটার গল্প লেখার সময়। এমনিতে চারদিকে আত্রেয় মুনির ছয় রসের তত্ত্বই বেশি পপুলার, কিন্তু আমার মন ঠিক মানছিল না। আয়ুর্বেদ আমাদের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেখানে সাতটা স্তরের কথা স্পষ্ট, তাহলে স্বাদের বেলায় একটা কম পড়ছে কেন? আমার এক মাস্টারমশাইকে জিজ্ঞেস করলাম এবং উনি যা বললেন, তাতে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। ছয় রস ছাড়াও কিছু অনুরসের কথাও বলা হয়েছে আয়ুর্বেদে, কিন্তু ইতিহাস সেখানেই শেষ নয়। আত্রেয় মুনির বহুল-প্রচারিত ছয় রসের বিপরীতে মিথিলার সম্রাট, মা সীতার পূর্বপুরুষ মহারাজা বিদেহ নিমি তাঁর সাত রসের তত্ত্বকে তুলে ধরেন। যদিও নিমি অশ্বিনীকুমারদের ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত প্রথম মানব-সন্তান, যিনি দেবতার থেকে গ্রহণ করেছিলেন আয়ুর্বেদ শিক্ষা, কিন্তু জাতে ছিলেন ক্ষত্রিয়। তাই সপ্তর্ষির অন্যতম, ব্রহ্মজ্ঞানলব্ধ মুনি আত্রেয়র সঙ্গে গোহার হারেন ভোটাভুটিতে। আত্রেয় মুনির ছয় রস, অর্থাৎ অম্ল, মধুর, লবণাক্ত, তিক্ত, কটু, কষায় ছাড়াও নিমি গ্রহণ করেছিলেন ক্ষার রসকে। নিমির যুক্তি ছিল দুটো: প্রথম, জিভ ক্ষারীয় স্বাদকে আলাদাভাবে অনুভব করে, এবং দ্বিতীয়, এর অভিনবত্ব চিকিৎসাশাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক ল্যাব টেকনিকের অনেক আগে নিমি একটা দিগন্তকারী অনুমান করেছিলেন, যা এখন নিউরোসায়েন্সে স্বীকৃত। তা হল বিভিন্ন রাসায়নিক উদ্দীপক আচরণগতভাবে আলাদা আলাদা প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে।

‘রেনবো জেলি’ ছবির দৃশ্যে কৌশিক সেন ও মহাব্রত

চোখ আমার কপালে উঠে যায় বেশ কয়েক বছর পর, ২০২৩ সালে, যখন জানতে পারি আধুনিক রসায়ন-বিজ্ঞান ড্রোসোফিলা মেলানোগাস্টার নামের এক মাছির মধ্যে একটি বিশেষ রিসেপ্টর খুঁজে পেয়েছে, যার নাম অ্যালকালিফাইল। এটি ক্ষারীয় স্বাদ চেনে এবং ক্ষারীয় উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া শুরু করে। এটি বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ দেয় যে, ক্ষারীয় স্বাদের একটি স্বতন্ত্র পথ আছে। ‘নেচার’ পত্রিকাতেও এই অ্যালকালিফাইলের ভূমিকা তুলে ধরা হয়, যা নিমির বিস্তৃত ধারণার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। বিস্ময়কর কাণ্ড হল আত্রেয় মুনির কাছে যে হার স্বীকার করতে হয়েছিল নিমিকে, তা যে কত বড় অন্যায় সেটা কয়েক হাজার বছর পর প্রমাণ দিল বিজ্ঞান। আজ নিমি বা আত্রেয়র মধ্যে কেউ-ই বেঁচে নেই, কিন্তু সত্য প্রতিস্থাপন হল নতুন করে। জয়ী হল আয়ুর্বেদের সাত রস বা সাত স্বাদের তত্ত্ব। তাই ভবিষ্যতে কেউ যদি বলেন আয়ুর্বেদে ছ’খানা স্বাদ স্বীকৃত জানবেন হয় তিনি আয়ুর্বেদ পড়েননি, নয়তো ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটিকে গবেষণাধর্মী খাটাখাটনির প্রথম এবং শেষ পর্যায় বলে ধরে নিয়েছেন। ‘রেনবো জেলি’ ছবিতে যদিও ক্ষারের বদলে ঝালকে বেছে নিয়েছিলাম গল্পের হিউমার আর রান্নার পদের খাতিরে। বাঙালি পরীপিসি বাঙালী গন্ডারিয়াকে একটু ঝাল না খাওয়ালে চলে? তাই পুজোর স্বাদবাহারের পুরো মজা নিতে নিমির রসতত্ত্বর বদলে পরীপিসির সাত স্বাদের সাত পদই চেখে নেওয়া যাক। 

ভাল রান্না আমার বাল্যপ্রেম। পেটের ঠিক মধ্যিখানে মস্ত একটা তিল রয়েছে, তাই পেটুক বলে টিটকিরি দিত অনেকে। একদিন মনখারাপ হওয়ায় মা বলল, ‘ওকে পেটুক বলে না, বলে খাদ্যরসিক।’ আমি ভাবলাম, আরিব্বাস, কথাটা তো দারুণ! পরে জেনেছি, ওই যুক্তিটা আসলে আমার মাতামহর। আমি যেটুকু রাঁধতে পারি, তা মূলত শেখা আমার মায়ের থেকেই বাকিটা রণবীর ব্রার। তবে সত্যি বলতে কী, রান্নার পটুত্ব রক্ত হয়ে বয়ে চলেছে আমার মায়ের পরিবারের ধমনিতে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় ওপার বাংলায় সব ফেলে চলে আসতে বাধ্য হলেন যখন, আমার দাদু আর দিদিমা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁদের রন্ধনসৌকর্যটুকু। এবং তাঁদের প্রথম তিন কন্যাসন্তান, অর্থাৎ আমার বড়মাসি, মেজমাসি আর আমার মা ভারতীয় ক্রিকেট দলের গাভাসকর, তেন্ডুলকর আর কোহলির মতো সে লেগেসি নিয়ে গেছে যথাক্রমে এগিয়ে। এ-কথা সত্য যে, কোনও বিষয়ে পারদর্শী হতে হলে, ‘পার্টটাইম’ বলে কিছু হয় না। বছরের প্রত্যেকটা দিন নাগাড়ে চালিয়ে যেতে হয় অনুশীলন। ঈশ্বরের কৃপায় হোক বা জন্মগত সৌভাগ্যের বশে দিবস-রজনী চারবেলা মায়ের হাতের কোহলিসুলভ ব্যালেন্সড্ স্বাদ চেখে চেখে রসনা আমার পোক্ত হয়েছে খারাপ-ভাল যাচাই করার ক্ষেত্রে। গর্ডন র‍্যামসে একজায়গায় বলেছিলেন সঠিক স্বাদ আসলে নস্টালজিয়ার মতো। একবার চেখে নিলে রয়ে যায় স্মৃতিতে। ভাল শেফের কাজ হল, শুধু তাকে অনুসরণ করা। র‍্যামসে সাহেবের কথার সূত্র ধরে আমার এই স্মৃতিচারণ— সাত স্বাদের সাত প্রণালীর। কিছুটা এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে, কিছুটা আমার কল্পনায়।

১. চেরি পুডিং

পুডিং বানানোর প্রক্রিয়া আর আলাদা করে বলছি না, সেটা মোটামুটি সবারই জানা। যাঁরা জানেন না, তাঁরা ইউটিউব টিউটোরিয়াল বা ‘রেনবো জেলি’ ছবিটা দেখে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে যেটা বলার, তা হল পুডিংয়ের বাটি ক্যারামেলাইজ করার সময় এক চিমটে দালচিনির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে চিনির শিরা খুব বিশেষ কার্সেনোজেনিক হয়ে ওঠার আগেই রং ধরে নেবে, সেই সঙ্গে একটা মধুর ঘ্রাণও তৈরি হবে। পুডিংয়ের দুধ ঈষৎ হলদেটে ঘন হবে, তবে গাঢ় নয়। সেই দুধে মাখন আর ডিম দিয়ে ম্যাশ করা মিল্ক ব্রেডের সোনালি মিশ্রণ ভাল করে ফেটিয়ে নিতে হবে। ফেটিয়ে নেওয়ার সময় একচিমটে নুন দেওয়া সাদা উষ্ণ দুধ অল্প অল্প করে মেশাতে হবে যাতে বেশি ফ্রৎ না তৈরি হয়। ভ্যানিলা এসেন্স পড়বে তিন থেকে চার ফোঁটা মাত্র। ওটুকুই যথেষ্ট। এর পর ক্যারামেলাইজড বাটিতে পুডিং এর মিশ্রণ খানিকটা ঢেলে প্রথম একটা লেয়ার তৈরি করতে হবে। তারপর তার ওপর বিছিয়ে দিতে হবে আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা আমন্ডের ছাল ছাড়ানো ছোট ছোট টুকরোর গালিচা। এবার মিশ্রণের দ্বিতীয় লেয়ার ঢেলে দিলেই কৌটো বন্ধ। পুডিংয়ের বাটি মাঝামাঝি আঁচে গরম জলে যতক্ষণ সাঁতরাবে ততক্ষণে চেরি স্প্রেডটা তৈরি হয়ে যাওয়া দরকার। চেরি স্প্রেডের জন্য কিছু চেরি, দিনদশেক আগে থেকেই কামিকারা গোত্রিয় রামে ভিজিয়ে রাখা প্রয়োজন। রাম থেকে ছেঁকে তুলে বীজ বের করে কয়েক ফোঁটা ব্যালসেমিক ভিনিগার আর একচিমটে গোলমরিচ দিয়ে চেরির পেস্ট বানাতে হবে। তার সঙ্গে মেশাতে হবে শুকনো গরম প্যানে টস করা পৌনে একচামচ সাদা তিল। পুডিং হয়ে গেলে গ্যাস বন্ধ করে ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষা। প্লেটের ওপর ওল্টানো তুলতুলে ক্যারামেলাইজড পুডিংয়ের শরীরে সযত্নে রাঙিয়ে দিতে হবে চেরির পেস্ট। প্লেটের একদিকের খালি অংশে অল্প চেরির পেস্টে চামচের ঘা মেরে প্যাটার্ন তৈরি করে একটা গোটা চেরি দুভাগ করে চিরে সাজিয়ে দিলেই চেরি পুডিং রেডি।

২. কমলা গাজোয়ারি

কমলা গাজোয়ারির সঙ্গে গায়ের জোরের থেকে গাজরের সম্পর্ক বেশি নিবিড়। গাজরের হালুয়ার মত গ্রেট করা গাজর ভাল করে পাক দিতে হবে খোয়া ক্ষীরে। তারপর একটা অম্লমধুর কমলা লেবু খোসা সমেত ওপর থেকে কেটে নিতে হবে গোল করে। খুব সাবধানে কমলালেবুর পাল্প স্ক্রেপ করে বের করে নিলেই বাটির আকারের খোসাটা রেডি। এরপর গাজরের হালুয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হরে বীজ ছাড়া কমলালেবুর পাল্প। তারপর চামচ দিয়ে কমলা লেবুর খোসার ভেতর পুরে দিতে হবে মিশ্রণ। শেষমেশ ফ্রিজের চিল ট্রে-তে ঘণ্টাদুয়েক কাটালেই কমলা গাজোয়ারি খেতে চমৎকার হয়।

৩. হলদে মাখন মাখা

প্রথমেই ছেঁচে নেওয়া কাঁচা হলুদ চিলি অয়েলে হালকা টস করে ছেঁকে নেওয়া দরকার। যতক্ষণ ঠান্ডা হচ্ছে, ততক্ষণ একচামচ লাইট সয়া সস্ আর সাড়ে তিন চামচ মাখনের ব্যাটার তৈরি করতে হবে ফেটিয়ে ফেটিয়ে। এই কাজটা প্রথমে কঠিন মনে হবে, ছানা কাটার মতো ছেড়ে ছেড়ে যাবে মাখন, কিন্তু ব্যাটার কফির প্রায় দু-গুণ সময় নিয়ে ব্যাটার করলে স্মুদির মতো চেহারা নেবে জিনিসটা। আমার স্ত্রী ঠাট্টা করে বলে, এ স্বাদ চাখার জন্য কবজির জোরের দরকার। যা-হোক বেশ খানিকটা কসরতের পর ব্যাটারে ছেঁকে রাখা হলুদ মিশিয়ে দিলেই হলদে মাখন মাখা প্রস্তুত। ভাত কিংবা গার্লিক ব্রেড দিয়ে খেতে চমৎকার। কনস্টিপেশন আর সর্দি কাশির জন্য মিরাকিউরল। এতে আলাদা করে কোনও নুন লাগে না।

৪. চিজ চিলি

গরম প্যানে মাখন দিয়ে হালকা টস্ করে নিতে হবে সাত-আটটা মধ্যিখান থেকে চিরে নেওয়া কাঁচালঙ্কা, কয়েক কোয়া রসুন আর স্প্রিং অনিয়ন কুঁচো। তারপর ঢেলে দিতে হবে আধকাপ জল। জল ফুটতে শুরু করলেই শেডার চিজ আর চিজ স্লাইস দিয়ে ঢাকা দিতে হবে আঁচ কমিয়ে। পাঁচ-সাত মিনিট পরে ঢাকনা খুললেই যখন দেখা যাবে চিজ গলে গেছে, তখন অল্প চিলি ফ্লেক্স আর অরিগ্যানো ছড়িয়ে গ্যাস বন্ধ করে আবার মিনিটদুয়েক ঢেকে রাখলেই যথেষ্ট। লং গ্রেন বাসমতি চালের সাদা ভাতের সঙ্গে খেতে হয়। খুব ঝাল হয়, কিন্তু দারুণ হয়। ঝাল ব্যালেন্স করার জন্য এর সঙ্গে গোল্ডেন প্রন ফ্রাই বা ডিমের পোচ মন্দ লাগে না। 

৫. ওয়াসাবি অনিয়ন স্যালাড

অল্প বাদাম একরাত ভিজিয়ে খোলা ছাড়িয়ে নিতে হবে। ওর মধ্যে একটা বড় পেঁয়াজ গোল গোল করে কেটে রিং বানিয়ে ওয়াসাবি পেস্ট আর তিলের তেল দিয়ে মেখে রাখা প্রয়োজন। তারপর পার্পেল লেটুস কুচো করে কেটে ছড়িয়ে দেওয়ার পর অল্প কালোজিরে শুকনো প্যানে নেড়ে গার্নিশ করে দিলেই স্যালাড হাফ রেডি। এরপর এতে পড়বে নুন, অল্প মধু আর লম্বা লম্বা পর্ক সালামির ফালি। ওয়াসাবি, তিলের তেল আর সালামির উমামি মুখের ভেতরে অনুভূতির যে বিস্ফোরণ ঘটায় তার পরমানন্দ ব্যক্ত করা অসম্ভব। নাকের জলে চোখের জলে হলেও স্যালাড শেষ না করে উঠতে পারা কিন্তু মহ‍ৎ বৈরাগ্যের পরিচয়। ঝাঁঝ সামলাতে অল্প একটু অলিভ অয়েল চাইলে ছড়িয়ে দেওয়াই যায়।

৬. চা কষা 

আধ কাপ গ্রিন টি আর আধ কাপ ক্যামোমাইল টি মিশিয়ে ঠান্ডা করতে দিন। ঈষ‍ৎ উষ্ণ জলে ভিজতে থাকুক বাটারফ্লাই পি ফ্লাওয়ার টি। মিনিটচারেক ভিজে গেলে চিপে দিন একফালি কাগজি লেবুর রস আর নামমাত্র মধু। এরপর ফ্রিজ থেকে ক্যামোমাইল আর গ্রিন টির মিশ্রণ বের করে মিশিয়ে দিলেই চা কষা শুধু চুমুকের অপেক্ষা।

৭. উচ্ছে রসুন চিপস

উচ্ছে গোল গোল করে কেটে হলুদ দিয়ে মাখিয়ে রাখতে হবে। তারপর কড়াইয়ে অনেকটা সরষের তেল দিয়ে চাপাতে হবে গ্যাসে। তেল গরম হলে রসুন আর শুকনো লঙ্কা চিরে তাতে অর্পণ করার মিনিটখানেকের মধ্যেই দিয়ে দিতে হবে উচ্ছে। এই ভাজাটা হবে ডুবো তেলে। এর পরের ধাপটাই কঠিন। আমি আজও রপ্ত করতে পারিনি। উচ্ছে, রসুন লঙ্কা তিনটেই মুচমুচে চিপসের মতো হয়ে গেলেই ঝাঁঝরি দিয়ে তুলে নিতে হবে তেল ঝরার জন্য। রং হবে খয়েরি। খেতে হবে কুড়মুড়ে। আমি যতবার চেষ্টা করেছি, হয় পুড়ে যায় নচেৎ স্যাঁতসেঁতে সবুজ থাকে। তেল ঝরে যাওয়ার পর শুকনো খয়েরি চিপসে বিটনুন আর লঙ্কা গুঁড়ো ছড়ালে দারুণ লাগে। আমার মা এ-জিনিস বানিয়ে দেয় খেলাচ্ছলে, বাড়ির সবাই ভাত দিয়ে খেতে পছন্দ করে কিন্তু আমি চিনি ছাড়া লাল চা দিয়েও সাবাড় করার ক্ষমতা রাখি।

পুজোর হুল্লোড়ে সময় না পেলেও সময় করে কখনও সাতখানা স্বাদ চেখে দেখবেন। জীবন রঙিন মনে হতে বাধ্য। ভুলে গেলে চলবে কেন, পশ্চিমি দুনিয়ার অনেক আগেই ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ প্রথম বলেছিল— ডু নট মেক মেডিসিন ইওর ফুড, মেক ফুড ইওর মেডিসিন। সে মেডিসিন শুধু শরীরের নয়, মনেরও।