শতধারার বাদল

Badal Sircar

সাতের দশকের যে সময়ে থিয়েটারের তৃতীয় অধ্যায় শুরু করছেন বাদল সরকার, তখন বাংলার পরিস্থিতি ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ। তাঁর এতদিনের যে প্র্যাকটিস— মঞ্চ; সেখান থেকে মাটিতে নেমে এল তাঁর থিয়েটার। এই বদল একরাতে যে হয়নি, বলাই বাহুল্য; ১৯৬৭ সালে তৈরি হচ্ছে নিজের নাটকের দল— ‘শতাব্দী’।

ততদিনে লেখা হয়ে গেছে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ থেকে ‘সারারাত্তির’-এর মতো সব নাটক। ’৬৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত ‘শতাব্দী’ মঞ্চেই কাজ করে গেছে। ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১-এ ‘সাগিনা মাহাতো’ নাটক প্রথমবারের মতো ওপেন স্পেসে অভিনীত হচ্ছে। কলকাতার এবিটিএ-র হল ঘরে। তার কিছু পরে খোলা মাঠে কার্জন পার্কে একের পর এক নাটক অভিনীত হচ্ছে। থিয়েটারকে নতুনভাবে এক দার্শনিক ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড় করানোর সময় চারপাশে থিয়েটার মহলে আওয়াজ কম ওঠেনি। কাদা কম ছোড়া হয়নি।

বলে রাখা দরকার যে, স্বক্ষেত্রে খ্যাতির চূড়া থেকে নেমে এসেছিলেন বাদল সরকার। ততদিনে ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ থেকে ‘জওহরলাল নেহরু ফেলোশিপ’ পেয়ে বসে আছেন তিনি। রমরমিয়ে চলেছে ‘শতাব্দী’-র সব মঞ্চনাটক। হাউসফুল হয়েছে একের পর এক নাটক। একটা মানুষের কতটা সদিচ্ছা, উদ্যম, রাজনৈতিক বোধ এবং সাহসের উপস্থিতি— তা তখনকার সময়ের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। নাহলে কেন-ই বা নিজের প্রতিষ্ঠিত ভূমি থেকে বেরিয়ে আসবেন। প্রতিষ্ঠিত দল ভেঙে আবার সেই দলই নতুন করে তৈরি করবেন। ‘শতাব্দী’ নতুন করে যখন আবার শুরু হচ্ছে, তখন পুরনো দলের দু-জন বাদে কেউ-ই আর থাকলেন না।

আরও পড়ুন : সাদাত হাসান মান্টো ভারতের লেখক যত, ততটা পাকিস্তানেরও! লিখছেন রাজীব চৌধুরী…

বাদল সরকার খ্যাতির চূড়া থেকে নেমে এসেছিলেন

একজন থিয়েটার কর্মীর সঙ্গে দর্শক-মানুষের সংযোগ করার জন্য থিয়েটারকে যা যা হতে হয়, পোর্টেবেল, ফ্লেক্সিবেল, ইনএক্সপেন্সসিভ— সেই সবের খোঁজই বাদল সরকার করেছেন। ‘থিয়েটারের ভাষা’ বইতে তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন সেই কথা— ‘যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থায় করা যায়, অর্থাৎ ‘ফ্লেক্সিবল’ বা নমনীয়। যা সহজে স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, অর্থাৎ ‘পোর্টেবল’ বা বহনীয়। যা টাকার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল নয়, অর্থাৎ ‘ইনএক্সপেনসিভ’ বা সুলভ।’

একমাত্র দর্শকদের দানে চলবে এই থিয়েটার; যা দান নয়, দাম নয়, অংশগ্রহণ রূপে বিবেচিত হবে। তৃতীয় ধারার গঠনগত রূপ হবে— নমনীয়, বহনীয়, সুলভ, এবং মুক্ত।

কার্জন পার্কে নাটক ‘ভোমা’

বাদল সরকার চাকরির খোঁজে লন্ডনে যান ১৯৫৭ সালে; সেখানে ছিলেন ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত। পরে চাকরিসূত্রে ন’মাস থাকেন ফ্রান্সে, ১৯৬৩-’৬৪ সাল পর্যন্ত এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন নাইজেরিয়ায়। এরপর কলকাতায় ফিরে নিজের নাটকের দল তৈরি করেন— ‘শতাব্দী’। প্রায় দশ বছরের সময়সরণি ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, এই সময় নাটকের প্রসেস কিন্তু থেমে থাকেনি। ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৩) থেকে শুরু করে ‘সারারাত্তির’ (১৯৬৩), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৫), ‘বাঘ’ (১৯৬৫), ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ (১৯৬৬) ‘পাগলা ঘোড়া’-র (১৯৬৭) মতো সব নাটক লেখা হচ্ছে। হিসেব করলে দেখা যায়, মোট ১৬টি নাটক।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে দেখছেন জুলিয়ান বেক-জুডিথ মালিনাদের ‘লিভিং থিয়েটার’, রিচার্ড শেখনারের ‘এনভায়রনমেন্টাল থিয়েটার’ এবং ’৬৯ সালে পোল্যান্ডে বাদল সরকারের সঙ্গে গ্রোটস্কির সাক্ষাৎ হচ্ছে। ভাবনার আদানপ্রদান হচ্ছে; সময়ের সঙ্গে ভেতরে জারিত হচ্ছে ভাবনা। তার আগেই ঘটে গেছে চীন-ভারত যুদ্ধ। উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে নকশালবাড়ি সেই সময়ে উল্লেখযোগ্য। এই সময়েই বাদল সরকার মঞ্চের ঘেরাটোপ থেকে দর্শকদের মধ্যে নেমে আসছেন— ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১। থার্ড থিয়েটারের ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু ফর্মের পরিবর্তন নয়। রাজনৈতিক-দার্শনিক পরিবর্তন।

বাদল সরকার, কার্জন পার্কে, ‘স্পার্টাকাস’ নাটকে

‘শতাব্দী’-র প্রথমদিককার নাটকগুলো বিখ্যাত হলেও তার ধরনের সঙ্গে পরের দিকে তৃতীয় ধারার নাটকের মধ্যে ফর্মের যেমন ফারাক হল, তেমনই কন্টেন্টের ফারাকও ঘটল। শারীরিক দূরত্ব কমে দর্শকের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ল। যোগাযোগ আরও ঘনিষ্টতর হল। কনটেন্টের সংলাপের ওপর ভার কমে তাহলে কি শুধুই শরীরি ভাষার ওপর ভার বাড়ল?

কিন্তু আদতে যা ঘটল, তা উল্টো। বাচিক ভাষার সঙ্গে শারীরিক ভাষার মাত্রা যোগ করে বাচিক ভাষা আরও স্ট্রং হয়ে উঠল। বাদল সরকার এক আলোচনায় বলছেন— ‘আমার ভোমা নেন, গন্ডী যদিও অ্যাডপটেশন তাহলেও সেটা যদি নেন, বাসী খবর নেন, তো আপনি দেখবেন, যে বাংলা জানে না তার কাছে পৌঁছানো খুব মুশকিল। ভাষার উপর প্রচুর নির্ভরতা আছে। যেটা ঘটছে সেটা হচ্ছে শুধু ভাষার উপর নির্ভরতা নয়, যেটা আমাদের ন্যাচারিলিস্টিক থিয়েটারে হয়ে থাকে। শুধু ভাষা নয়, তার সঙ্গে শরীরের ভাষাটাও যোগ দিতে হবে। নাটককে প্রিসাইজ্‌ হতে হবে।’

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, তৃতীয় ধারার নাটকের সংলাপের মধ্যে সেই প্রিসাইজ্‌ড ফর্ম। স্পার্টাকাস থেকে মিছিল। ‘ভোমা’ থেকে ‘হট্টমেলার ওপারে’। কাট-কাট সংলাপ একটার পর একটা এসে যায়। ‘স্পার্টাকাস’-এর কয়েকটা লাইন একটু দেখে নেওয়া যাক।

কার্জন পার্কে নাটক ‘স্পার্টাকাস’

‘সূত্রধর।। কাজ। খেলা। শাস্তি। মানুষের নয় ক্রীতদাসের। রোম সাম্রাজ্য। দু’হাজার বছর আগে। খ্রীষ্টপূর্ব একাত্তর সাল। রোম সাম্রাজ্য। কিন্তু রোম সাম্রাজ্য নাকি ধ্বংস হয়ে গেছে, দাস প্রথা নাকি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন বিংশ শতাব্দী, উনিশশো সাতানব্বই সাল। সভ্য মানুষ সভ্য সমাজ। তাই কি?’

পথচলতি মানুষের হোক বা অফিসফেরত দর্শকের, নজর পড়ে নাটকের দৃশ্যে। সংলাপ কানে ঢোকে। মানুষ ব্যস্ততা ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ে। নাটক দেখে। একাত্তর সালে। আজকেও। ২০২৫ সালে।

আজ যে সময়ের মধ্য দিয়ে দেশ-কাল-রাজনীতি বয়ে চলেছে, তা ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বলাই চলে। বাদল সরকারের যে অ্যাপ্রোচ ছিল, তা দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের— কমিউনিকেশনের প্রশ্নে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, অর্ধশতবর্ষ পার করা ‘থার্ড থিয়েটার’ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা কমিউনিকেট করতে পারছে? সাতের দশকে তৈরি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের কথা ‘ভোমা’ নাটক এই সময়ে কাকে কমিউনিকেট করছে? করছে কি আদৌ?

থিওসফিক্যাল সোসাইটি হলে নাটক ‘ভোমা’

‘এক।। কী বললে?

দুই।। না প্রভু! কলকাতা শহরে উচ্চ সেতু বানাবো।

তিন-চার-পাঁচ-ছয়।। উচ্চ সেতু বানাবো।

দুই।। পাতাল রেল বানাবো।

তিন-চার-পাঁচ-ছয়।। পাতাল রেল বানাবো।

দুই।। গর্ত খুঁড়ব। গর্ত বোজাবো। 

তিন-চার-পাঁচ-ছয়।। গর্ত খুঁড়ব। গর্ত বোজাবো।

দুই।। কলকাতা শহর—

তিন-চার-পাঁচ-ছয়।। কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে!

এক।। আর আমার লোন শোধ দিবে কে?

দুই।। তুমি দেবে প্রভু। তুমি আরও ধার দেবে, আরও শোধ নেবে। যতো দেবে, ততো বেশি বেশি শোধ নেবে। শতকরা ষাট।

এক।। একশো ধার করিয়া একশোই শোধ?

দুই।। তাই তো দাঁড়াচ্ছে প্রভু।

এই।। তাহার মানে তুমি তখন দেউলিয়া?

দুই।। বলাই ষাট! দেউলিয়া হবে দেশ, আমি কেন হতে যাবো? আমার টাকা আছে সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কে।

এক।। তোমাকে যে দেশের লোক দেশদ্রোহী বলিবে?’

আজ যে সময়ের মধ্য দিয়ে দেশ-কাল-রাজনীতি বয়ে চলেছে, তা ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ বলাই চলে। বাদল সরকারের যে অ্যাপ্রোচ ছিল, তা দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগের— কমিউনিকেশনের প্রশ্নে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, অর্ধশতবর্ষ পার করা ‘থার্ড থিয়েটার’ এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা কমিউনিকেট করতে পারছে? সাতের দশকে তৈরি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের কথা ‘ভোমা’ নাটক এই সময়ে কাকে কমিউনিকেট করছে? করছে কি আদৌ?

বাদল সরকার তাঁর নাটকে যে-কথা আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে লিখেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ কি আজও প্রাসঙ্গিক? দেশের স্বাধীনতার আটাত্তর বছর পরেও আমাদের সেই সাতের দশকের ইস্যু নিয়ে দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে? দর্শকই সে-কথা বলুক। এমনিতে এআই আর সামাজিক দূরত্বের নিময়ের বেড়াজালে সবকিছু যখন ভার্চুয়াল হতে শুরু করেছে, তখন থিয়েটারকেও নাকি ভার্চুয়াল হতে হয়েছে। অথচ থিয়েটার জীবন্ত কলামাধ্যম, লাইভ শো। এই একটা ক্ষেত্রে সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন, ইউটিউব নকল করতে পারবে না। অর্থাৎ, দর্শক-অভিনেতা একই দিনে, একই সময়ে, একই স্থানে উপস্থিত হচ্ছেন এবং থিয়েটার ঘটছে। এই ২০২৫ সালেও। এটাই থিয়েটার।

বাদল সরকারের নিজের তৈরি বইয়ের প্রচ্ছদ

আটের দশকের মাঝামাঝি একবার বাদল সরকার পাকিস্তান গিয়েছিলেন। লাহোরে, উর্দু কবি ফৈয়জ়ের স্মরণে, ‘ফৈয়জ় মেলায়’। সঙ্গে ছিলেন পাঞ্জাবের গুরুশরণ সিং, দিল্লির তিনজন পথনাটকের সঙ্গে যুক্ত মহিলা, মহিলাদের ব্যাপার নিয়ে থিয়েটার কর্মী— শ্রীমতী রতি বার্তোলমিউ, মায়া রাও এবং অনুরাধা কাপুর; সফদর হাশমি, ত্রিপুরারি শর্মা। এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে এ যে কল্পনার বাইরে— তা বলাই বাহুল্য।

সে যাই হোক, অর্ধশতাব্দী পার করা থার্ড থিয়েটারের জোর এখানেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র। মানুষে-মানুষে বন্ধন। বর্মহীন এক সজীব মাধ্যম। একথা বাদল সরকার কবেই লিখে গিয়েছিলেন।

সূত্রঋণ:

‘থিয়েটারের ভাষা’— বাদল সরকার

‘পাকিস্তানে নাট্যচর্চা’— বাদল সরকার, ‘স্যাস’ নাট্যপত্র, ১৯৮৮

‘থিয়েটারি গল্প— আদিপর্ব’— বাদল সরকার, ‘নানামুখ’, ১৯৮৮

সুরজিৎ ঘোষের সঙ্গে কথোপকথন; ‘দেশ’, ৫ ডিসেম্বর ১৯৯২

নাটক সমগ্র (তৃতীয় খণ্ড)— বাদল সরকার; মিত্র ও ঘোষ, ১৪০৯