মানুষ অনেক আশ্চর্য জিনিস বানিয়েছে; রোবট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেঘ জমিয়ে বৃষ্টি, চিনের প্রাচীর (যা কিনা মহাকাশ থেকেও দেখা যায়), কিন্তু এবার ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অনায়াসে বানিয়ে ফেললেন একটা দুর্ভিক্ষ! গত বছর থেকে গাজা আক্রমণ করে, মারণাস্ত্র হেনে, লোকজনকে ঘরছাড়া করে, বহু মানুষকে হত্যা করে অতটা সাধ মেটেনি বোধহয়, তাই প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হওয়া গাজায় বেশ কিছুদিন ধরে ত্রাণ ঢুকতে দিচ্ছেন না, খাবার ঢুকতে দিচ্ছেন না, অনাহারে মরতে বাধ্য করছেন বহু মানুষকে।
শেষ চার মাস কোনও ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে পারছে না গাজায়। যেটুকু ঢুকছে, তাও কড়া-হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। খাবার নিতে লাইন দেওয়া, হুড়োহুড়ি-করা মানুষগুলোর উপর প্রায়ই গুলি চলছে। রোগে আর বোমায় তো মানুষ মরছেই, এবার আমাদের স্ক্রলে, প্ল্যাকার্ডে, ফাঁকা মনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে গাজার শিশুদের কঙ্কালসার মুখগুলো। তারা অনেকেই হাড়ের খাঁচা হয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। ওদের কান্নাও আর ভেসে আসে না, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ— তাও ধিকিধিকি চলে শ্বাস, জোরে চলার ক্ষমতা নেই।
হাসপাতালে রোগীরা অপুষ্ট তো বটেই, নার্সরাও ক্লান্ত, ডাক্তারদেরও মাথা ঘুরছে খালিপেটে। আল-আকসা মার্টার্স হাসপাতালের ডিরেক্টর ইয়াদ আমাওয়ি সাক্ষাৎকারের মাঝেই থেমে যান মাথাব্যথায়। বলছেন, ‘সব সময় একটা চিন্তা— খাবার কোথা থেকে আসবে?’ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৫ পাউন্ড ওজন কমেছে তাঁর। আরও অনেকে দাঁড়াতে পারছেন না, কাজ করতে পারছেন না। অনাহারে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা প্রচুর— ১১১, যার অনেকেই গত ক’সপ্তাহেই মারা গেছে।

যে-শহরে দুধ নেই, ময়দা নেই, ভাত নেই, সেখানে বাচ্চারা বাঁচবে কী করে? আয়াত আল-সোরাদির যমজ সন্তান আহমেদ আর মাজেন, গর্ভাবস্থায় অপুষ্ট— জন্মের সময়ে তাদের ওজন ছিল মাত্র ২ পাউন্ড। এক মাস তারা ইনকিউবেটরে ছিল, তারপর হোয়াটসঅ্যাপে দুধ চেয়ে চেয়ে আয়াত কোনওমতে কয়েকদিন জুটিয়েছেন বাচ্চার খাবার। আহমেদ বাঁচেনি— ১৩ দিনের মাথায় মারা গেছে। মাজেন এখনও লড়ছে, আয়াত চালের মাড়ে গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে খাওয়াচ্ছেন। তাও ওজন বাড়ছে না।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে যাঁরা রিপোর্ট করছেন, যাঁরা ক্যামেরা ধরছেন, তাঁরাও আর পারছেন না। এএফপি-র প্যালেস্টিনীয় সাংবাদিকরা বলছেন, শরীরে আর শক্তি নেই। অথচ ইজরায়েল বলছে, ‘ক্রসিং তো খোলা আছে, ট্রাক আনুন।’ কিংবা, ‘আমরা ছবিগুলো দেখেছি, ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’ জাতিসংঘ বলছে, কে ঢুকবে, কী ঢুকবে, কত ঢুকবে— তার সবটাই ঠিক করে ইজরায়েল। ত্রাণ নিয়ে ঢুকলেও যুদ্ধের কাটাকুটির মাঝখান দিয়ে যেতে হয়— কখনও সেনার সঙ্গে হাত মেলাতে হয়, কোথাও রাস্তাই আর নেই, আর কোথাও আছে গ্যাংস্টারদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এসব পেরিয়ে যখন একটা বা দুটো ট্রাক হাজার-হাজার, তীব্র-খিদেয়- ছটফট-করা মানুষদের

মাঝখানে পড়ছে, তখন ট্রাক ঘিরে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষেরা, খাবার নিয়ে খেয়োখেয়ি করা মানুষেরা, ময়দা কেড়ে নেওয়ার লড়াইয়ে মেতে ওঠা মানুষেরা সেনার গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে!
ইজরায়েলের দাবি, ত্রাণ যাতে চরমপন্থীদের হাতে না পড়ে, সেই ব্যবস্থার জন্যই এত কড়াকড়ি। তাই কী আর করা যাবে, শিশুরা মরবে অপুষ্টিতে, মা-বাবা নিজেরা খাবার না খেয়ে সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন। একজন মা বলছেন, তাঁর মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে। তবু তিনি এখনও চাকরি করেন, সামান্য টাকা মাস গেলে পান, সবটাই খরচ করেন সন্তানদের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার জন্য। অনেকেই পারেন না, একরাম এমকাতে-র ভাইঝি, মাত্র দু’মাস বয়স, মরে গেল চার পাউন্ড ওজন নিয়ে। অনেক মা-বাবা খিদেয় কাঁদতে থাকা বাচ্চাকে শুধু গল্প বলছেন— ‘আজ কেন খাওয়া হবে না।’
এই অবস্থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রস বলছেন মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষ, একটা পরিকল্পিত চূড়ান্ত খাদ্যাভাব। খাবার না ঢুকতে দিয়ে, অবরোধ করে, হিসেব কষে তৈরি করা পরিস্থিতি। এখন আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে ইজরায়েল বলছে, আচ্ছা দেখছি, গাজার কোনও কোনও জায়গায় ১০ ঘণ্টা বিরতি দেব সামরিক নজরদারিতে, কিন্তু সে কথা বাস্তবে কতদিন টিকবে কে জানে!

যুদ্ধবিরতির সময়ও যখন ইজরায়েল ত্রাণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তখন বুঝতে আর বাকি থাকে না— এখানে ক্ষুধাই শাসনের উপায়। খাবার বিতরণ করা হচ্ছে এমন জায়গায়, যাতে তা পেতে গেলে মানুষ বাধ্য হয় মিলিটারি জোন পেরোতে, আর সেখানেই গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছে লোকে। অতএব এই ট্র্যাজেডিটা ছক-মাপা। একদম আধুনিক ভিডিও গেমস-এর মতো। গুলিগোলা বাঁচিয়ে টার্গেট একটু খাবার!
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এলাকা থেকে যাঁরা রিপোর্ট করছেন, যাঁরা ক্যামেরা ধরছেন, তাঁরাও আর পারছেন না। এএফপি-র প্যালেস্টিনীয় সাংবাদিকরা বলছেন, শরীরে আর শক্তি নেই।
‘মাস স্টার্ভেশন’ বইয়ের লেখক অ্যালেক্স ডি ওয়াল বলেন, ‘অনাহার শুধু শারীরিক কষ্ট নয়—এটা একটা সামাজিক ট্র্যাজেডি।’ অনাহারের কবলে মানুষ নিজের সম্মান হারায়, আত্মীয়কে ফিরিয়ে দেয়, সন্তানকে বেছে নেয়। আর এই অপমান, এই মানসিক আতঙ্ক প্রজন্মের পর প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়। আইরিশরা ১৫০ বছরেও ভুলতে পারেনি ১৮৪০-এর দুর্ভিক্ষ। গাজা তাহলে কতদিন নেবে? একদিকে হামাস আর অন্যদিকে ইজরায়েলের হামাস দমন, মাঝে উলুখাগড়া গাজার নিরীহ মানুষরা!
যদি যুদ্ধবিরতির সময়েও ইজরায়েল ঠিক করে, কে খাবার পাবে আর কতটা— তাহলে খাবার আর সমস্যার সমাধান নয়, সমস্যা জিইয়ে রাখার একটা অস্ত্র, গাজার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার এক কৌশল। ‘ভুল করে কাউকে না খাইয়ে মারা যায় না,’ বলেন ডি ওয়াল। ‘তাতে সময় লাগে—সচেতন সিদ্ধান্ত লাগে।’ তাই যখন কেউ বলে, ‘অনাহার চলুক’, তখন বোঝা যায়, যুদ্ধটা আর শুধু বোমার নয়— ক্ষুধার, দারিদ্রের, অসম্মানের। আর তার শিকার আজকের গাজার প্রতিটা মানুষ।