নদীর ঠিকানা

path of a river

নদীকে নির্মাণ করেছে প্রকৃতি। অনেকদিন  ধরে,  আদর দিয়ে, যত্ন করে; নদী জন্মের পর থেকে যেন আমৃত্যু সজল ধারায় থাকতে পারে— তার জন্য প্রকৃতি নির্মাণ করল বৃষ্টিকে। বৃষ্টি কোথায় থাকবে? তার জন্য প্রকৃতি বানাল মেঘকে। কিন্তু বৃষ্টি যে আকাশ থেকে পড়ে না। তা ওঠে মাটি থেকেই। কালো মেঘের গুরুগুরু ডাকে শ্রাবণের ধারা ঝরে পড়ে। সেই বৃষ্টি পৌঁছে যায় মাটির বুকের উপর দিয়ে, নদীর কাছে। বৃষ্টির জলে শুখা নদী ভরে ওঠে। শ্রাবণের ধারা দু’কুল ছাপিয়ে বন্যা আনে।

দুঃখের নদী দামোদর। কারণ সে বন্যা আনে প্রতিবছর। তবে বাংলার মানুষ কোনওদিন দামোদরকে দুঃখের নদী বলেনি। কারণ দামোদরের বন্যা দুধের সরের মতো পলি বিছিয়ে দিত নদীর পাড়ে, প্লাবন ভূমিতে। উর্বর পলিতে বন্যার পরে চাষ হত। বন্যার পর নদী খাত গভীর হত। বন্যাকে উদযাপন করত বাংলার মানুষ। বন্যা নিয়ে আসা নদীকে দুঃখের কারণ হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছিল ইংরেজরা। নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় তৈরি হল, পাড়, বাঁধ বা এমব্যাঙ্কমেন্ট। আর তার ফলেই নদীখাত ক্রমশ অগভীর হতে শুরু করল। পলি বোঝাই হল নদীর বুকে। বদলে গেল নদীর চরিত্র।    

আরও পড়ুন: বৃক্ষজীবন কীভাবে বাঁধা পড়ল মানুষী যৌন কল্পনায়? লিখছেন বিজলীরাজ পাত্র

এবার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও এক ধাপ এগোনো হল। বানানো হল নদী শাসন করতে বড়, বিস্তৃত বাঁধ। আর সেই বাঁধই বন্যাকে প্রথমদিকে আংশিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারল। বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা যখনই পলি পড়ে কমে গেল, তখনই বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেল। বেশি দূরে নয়, দামোদর নদী পরিকল্পনাকে দেখলেই তা বোঝা যায়। দামোদরের উপর এতগুলো বাঁধ নির্মাণ করেও দামোদরের নিম্ন অববাহিকাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। উল্টে দেখা গেল, নিম্ন অববাহিকাতে বন্যার ফলে, দামোদর নিজের গতিপথ পাল্টেছে।

আবার ফারাক্কা ব্যারেজের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও প্রমিনেন্ট। ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরির পর গঙ্গার চরিত্র গেল পাল্টে। ফারাক্কা ব্যারেজকে গঙ্গা ভাঙতে পারল না। উত্তরের দিকে থাকা পাথুরে রাজমহল পাহাড়কেও সে ভাঙতে পারল না। তার বদলে গঙ্গা মালদহের মানিকচক, পঞ্চানন্দপুরের দিকে ভাঙতে আরম্ভ করল। দশ-বারোটা গ্রাম নয়, ৬৫-টি গ্রাম ভেঙে খেয়ে ফেলল গঙ্গা। গঙ্গার নিম্নগতির মুখে এক বাঁধের কারণেই নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করল আমূল ভাবে।

মানুষ নিজে থেকেও নদীর চলার পথ পাল্টেছে। তারও অনেক উদাহরণ রয়েছে বাংলাতে। উত্তরবঙ্গে, চিলাপাতার জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যায় একটি নদী। নাম, ভান্ডারী। শোনা যায়, একসময়ে, ভান্ডারী নামে এক প্রবীণ মানুষ থাকতেন এই এলাকাতে। যিনি জঙ্গলের সঙ্গে-সঙ্গে বানিয়া ও আরও একটি নদীকে দেখে রাখতেন। সেই নদীটার কোনও নাম ছিল না। ভান্ডারী ঐ নদীটাকে দেখাশুনা করতেন বলে আশেপাশে, গ্রামের মানুষেরা সেই নদীটাকে বলতেন ভান্ডারীর নদী। এমনভাবেই দিন যায়। ভান্ডারি যে-জায়গাতে থাকতেন, বৃষ্টির ধারা প্রবল বেগে সেই জায়গাকে ভাসিয়ে দিয়ে যেত। এই সমস্যা থেকে বাঁচার উপায় খুঁজছিলেন তিনি। উপায় পেলেন। একটু দূর দিয়ে জল যাবার জন্য তিনি একটি খাল কেটে দেন। তারপর, কোনও এক বর্ষা কালের বন্যাতে ঐ কাটা খালেই প্রবল বেগে জলের ধারা নেমে তৈরি হয়ে যায় একটা নদী। যা পরবর্তী সময়ে ঐ কাটা খাল ভান্ডারী ২ নদী নামে পরিচিতি পায়। আর ভান্ডারীর পূর্বের ধারাটি ভান্ডারী ১ নদী হিসেবে চিহ্নিত হল।

ফারাক্কা বাঁধ

এমনই এক ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে উত্তরবঙ্গের আরেক নদীর সঙ্গে। নদীটার নাম রায়ডাক। রায়ডাক নামে দুটো নদী আছে। প্রথমটি রায়ডাক ১ ও দ্বিতীয়টি রায়ডাক ২ নদী। রায়ডাক ২ নদীর জন্ম প্রাকৃতিক ভাবে হয়নি।

বহুদিন আগের কথা। উত্তরবঙ্গের মানুষ শুখা মরুশুমে সেচের জন্য বানিয়েছিল জামপৈ। কেমন দেখতে ছিল সেগুলো? অনেকটা উটের পিঠের কুঁজের মতো করে পাথর ও মাটি দিয়ে নদীর বুকে বাঁধ দেওয়া হয়। এই বাঁধগুলোর উচ্চতা খুব অল্প হত। নদীর বুকে জামপৈ তৈরি হয়ে গেলে নদীর জল সেখানে বাঁধা পেয়ে উঁচু হয়ে যেত। সেই জলকেই নদীর স্রোতের উজানে একটা খাল কেটে মাঠে নিয়ে যাওয়া হত। এই খালগুলোকে বলা হত জামপৈ খাল। পৃথিবীর অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগিয়ে গ্রামের মানুষ তাদের চিরায়ত সনাতনী জ্ঞানকে সেচের কাজে ব্যবহার করত এইভাবে।

কাজেই জামপৈ খালগুলো মাঠের বহুদূর পর্যন্ত জল পৌঁছে দিতে পারত; বন্যা আসলে, জামপৈ জলের তোড়ে ভেঙে যেত। পলি জমে বুজে যেত খালগুলো। একসময়ে, বর্ষা চলে গেলে, গ্রামের মানুষেরা একসঙ্গে দল বেঁধে ভেঙে যাওয়া জামপৈ-কে ঠিক করত। জামপৈ খালের পলি পরিষ্কার করে গভীর করত আরও। অনুমান করা হয়, সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে কোনও এক বন্যাতে জামপৈ খাল দিয়ে বন্যার জল প্রবাহিত হয়ে একটা নদী সৃষ্টি হয়েছিল। রায়ডাক নদীর জামপৈ থেকে সৃষ্টি হওয়া নদীটার নাম হয় রায়ডাক ২।

মধ্যবঙ্গেও রাজারা নদীপথ পাল্টে দিয়েছে; ঐতিহাসিক প্রমাণও রয়েছে সে-কাজের। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন নদিয়ার শাসক। কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারীও তখন কৃষ্ণনগরেই। কিন্তু সে-সময়ে শুরু হল, বর্গীদের আক্রমণ। কাজেই, জমিদারী বাঁচাতে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। খোঁজ শুরু হল বিকল্প জায়গার। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজধানীকে স্থানান্তর করার জন্য, মাঝদিয়ার কাছে জঙ্গল ও নদী পরিবেষ্টিত একটা জায়গা পছন্দ হয়। সেখানে থাকতেন নসরৎ খাঁ নামে এক বৃদ্ধ ডাকাত। জায়গাটি পরিচিত ছিল নসরৎ খাঁর ডেরা নামে। জায়গাটি বড্ড পছন্দ হয়ে যায় কৃষ্ণচন্দ্রের। কাজেই জমিদারী স্থানান্তরিত হয়। সেখানে গড়ে উঠল প্রাসাদ। সঙ্গে শিব মন্দির। কৃষ্ণচন্দ্র জায়গাটিকে শিবের নিবাস স্থল বানিয়ে নাম রাখলেন শিবনিবাস।

জমিদারী তো স্থানান্তর হল। কিন্তু জমিদারীর সুরক্ষা দেওয়া যায় কীভাবে? সে-চিন্তা থেকেই, কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জমিদারির ক্ষেত্রের চারিদিক ঘিরে তৈরি করলেন, একটি গোলাকার নদী। অনেকটা হাতের কঙ্কনের মতো। সেই পরিখার মতো খালটার নাম দিলেন, কঙ্কনা নদী। কঙ্কনা নদীতে জলের একটা ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সারা বছর জলের জোগান থাকে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাঙ্গাসি নদী থেকে একটি খাল কাটালেন। আর খালটি জুড়ে দিলেন কঙ্কনা নদীর সঙ্গে। আর যোগাযোগের সুবিধার জন্য আরও তিন মাইল একটি খাল কেটে জুড়ে দিলেন হাঁসখালির উত্তরে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে।  

সে-সময়ে অঞ্জনা নদীর গতিপথ আজকের গতিপথের মতো ছিল না। তখন অঞ্জনা নদী কৃষ্ণনগরের কাছে জলঙ্গি নদী থেকে বেরিয়ে যাত্রাপুর গ্রামের কাছে দুই ধারাতে ভাগ হত। তারপর একটি ধারা জয়পুর, জালালখালি, ধর্মদা, বাদকুল্লা হয়ে মামজোয়ান গ্রামের কাছে দক্ষিণ বাহিনী হয়। অন্য ধারাটি যাত্রাপুর, বেতনা প্রভৃতি গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মামজোয়ানের কাছে পূর্বের ধারার সঙ্গে মিলিত হয়। তারপর, ঐ দুই ধারাই একসঙ্গে হরধামের উত্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাকদহের কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। এই নদীটি অঞ্জনা নামে প্রবাহিত ছিল। পরবর্তী সময়ে পাঙ্গাসীর জল পেয়ে শিবনিবাস থেকে চাকদহের গঙ্গা পর্যন্ত জলের ধারাটি পুষ্ট হয়ে ওঠে। এই নতুন জলের ধারাটির নাম হয় চুর্ণী। আর পাঙ্গাসি নদীর মাথা ভেঙে যায় বলে নদীর ধারাটি পরিচিতি লাভ করে, মাথাভাঙ্গা নদী নামে। এ-ভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্বকালেই বানালেন, ‘চূর্ণী নদী’ ।

বাংলাদেশের ইছামতী নদীর ক্ষেত্রেও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের একটা উদাহরণ পাওয়া যায়। বলা হয় ইচ্ছে থেকে তৈরি করা হয়েছিল, ইছামতী নদী। এ-কথার ঐতিহাসিক কোনও ভিত্তি নেই। তবে প্রচলিত একটি আখ্যান রয়েছে। সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে বাংলার শাসক ছিলেন ইসলাম খান চিস্তি। প্রশাসনিক কাজের জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময় ঢাকা যেতে হত। রাজমহল থেকে সহজে ঢাকা যাতায়াতের তেমন কোন সুবিধাজনক পথ ছিল না। এই জন্য ইশা খান একটি কাজ করেন। পদ্মা থেকে খাল কেটে যমুনা নদীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটি প্রস্তাব আনেন। তারপর পদ্মা থেকে একটি খাল কেটে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে জুড়ে দেন। ইশা খানের ইচ্ছে মতো খাল কেটে যে জলের ধারা তৈরি করা হয়েছিল, তাই পরবর্তী কালে ইছামতী নদী নামে পরিচিত হয়।

জমিদারী বাঁচাতে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। খোঁজ শুরু হল বিকল্প জায়গার। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজধানীকে স্থানান্তর করার জন্য, মাঝদিয়ার কাছে জঙ্গল ও নদী পরিবেষ্টিত একটা জায়গা পছন্দ হয়। সেখানে থাকতেন নসরৎ খাঁ নামে এক বৃদ্ধ ডাকাত। জায়গাটি পরিচিত ছিল নসরৎ খাঁর ডেরা নামে। জায়গাটি বড্ড পছন্দ হয়ে যায় কৃষ্ণচন্দ্রের। কাজেই জমিদারী স্থানান্তরিত হয়।

মাছ চালানের সঙ্গেও জুড়ে আছে নদীর গতিপথ পরিবর্তিনের  ইতিহাস। ১৯০৭ সালে এমন এক নদী তৈরি করা হয়েছিল বাংলাদেশের খুলনাতে। ফরিদপুরে মাছ চালান করবার জন্য খুলনা থেকে গোপালগঞ্জের কুমার নদ পর্যন্ত একটি খাল কাটা হয়েছিল। খুলনার মাছ স্টীমারে করে এই বানানো জলপথ দিয়েই কলকাতায় আসত। চালানী মাছের মধ্যে থাকত কৈ, মাগুর, ইলিশ, পুঁটি, শোল প্রভৃতি। এই কাটা খালটিকে স্থানীয় মানুষেরা বলতেন ‘বিলরুট’। পরবর্তী সময়ে এই কাটা খালটি বিলকাটি নদী হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এ-পথে ১৯৪২ সাল নাগাদ চালান দেওয়া মাছের পরিবহনের পরিমাণ কমে আসে।  

নদীর পথ পাল্টানোর ইতিহাস আজকের নয়, বহু দিনের। কখনও নদী নিজের ইচ্ছাতে পাল্টায়, বন্যাকে সঙ্গী করে। যেমন তিস্তা একসময়ে গঙ্গাতে মিলিত হত। তারপর এক বন্যাতে সে তার পথ পাল্টে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। আবার কখনও মানুষ তার নিজের ইচ্ছাতে নদীর পথকে পাল্টে নিয়েছে। নদী ভাঙনও নদীর গতিপথকে পাল্টে দেয়।  উদাহরণ হিসেবে পদ্মার ভাঙনে পাল্টে গিয়েছিল একটা আস্ত নদীর গতিপথ। সেই নদীর নাম শিবনারায়ণ। নদীর চেহারার এই পরিবর্তন পরিবেশের ওপরে মানুষের হস্তক্ষেপের জন্যও হয়। নদী বিজ্ঞানের ভাষায় তা ‘অ্যান্থোপজেনিক ইন্টারভেনসন’। একটা পুরনো নদী, তার চেহারা হঠাৎ করে কিছুটা পাল্টে ফেলে। এককথায় বদলে যায় তার চেহারা। নদী বিজ্ঞানী শ্চুম এই পরিবর্তিনের নাম দিয়েছিলেন ‘রিভার মেটামরফোসিস’ বা ‘নদীর রূপান্তর’।

মানুষের মতোই নদীর জীবন। শোক, তাপ, রোগ-ভোগ, বিপর্যয় মানুষকে যেমন পাল্টে দেয়, ঠিক তেমনি বন্যা, ভাঙন, বড় বাঁধ, নদীর উপর মানুষের আক্রমণ নদীর গতিপথকেও পাল্টে দেয়। নদীর জীবনে এ-ভাবেই খেলা ঘরের খেলা চলে।