ক্যালেন্ডারে সদ্য পেরিয়েছে ৬ ও ৯ আগস্ট। ১৯৪৫ থেকে ২০২৫– মাঝে কেটে গিয়েছে ৮০টা বছর। তবু ক্ষতর দাগ সহজে মেলায় না। ৮০ বছর আগে ৬ আগস্ট ঠিক সকাল ৮.১৫-য় যে ইউএস বম্বার-১৯ উত্তর মেরিনা আইল্যান্ড থেকে উড়েছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটেছিল হিরোশিমা শহরের ঠিক ৬০০ মিটার ওপরে। মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল জাপানের এই বর্ধিষ্ণু শহর। বাড়ি-ঘর-দোর তো বটেই, নিমেষে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় প্রায় ৮০,০০০ মানুষ। তার ঠিক তিন দিনের মাথায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে নাগাসাকি শহরে। মৃত্যু হয় প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষের, যার মধ্যে ছিল অজস্র মহিলা ও শিশু।
ধ্বংসের শেষ এখানেই হয়নি। বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার আক্রমণের ফলে তেজস্ক্রিয় রশ্মির সঞ্চার হয়েছিল এই দুই শহরে, তাতে যারা এই আক্রমণের পরেও প্রাণে বেঁচেছিল— তারাও বেশিদিন এই ভয়াবহ রশ্মির প্রভাবের সঙ্গে লড়াই না করতে পেরে হার মেনেছিল। বিভিন্ন রকমের রোগে ভুগে তাদেরও মৃত্যু হয়েছিল কিছুদিন, বা কিছু বছরের মধ্যেই।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রের শত ফিকিরে আমাদের অন্তরের বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়! লিখছেন রোদ্দুর মিত্র…
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ আনতে আমেরিকা কেন এই ভয়াবহ পদক্ষেপ নিয়েছিল, তা নিয়ে আজও তর্ক-বিতর্ক চালানো যায়। আমেরিকার মতে জাপান কোনওমতেই আত্মসমর্পণ করতে রাজি না হওয়ায় এই আক্রমণ করতে তারা বাধ্য হয়। তবে এটা কোনওমতেই অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, ১৯৪৫ সালে দাঁড়িয়ে আমেরিকা তাদের সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শনে উদ্যত হয়েছিল, এই পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে।
আজ ৮০ বছর পেরিয়েও জাপানের ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শরীরে ও মনে নিয়ে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন সেতসুকো থুরলো। ওই অভিশপ্ত দিনে, তাঁর বয়স ছিল ১৩। নিমেষের মধ্যে নিজের সহপাঠীদের পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখেছিলেন। এই মানসিক আঘাত কোনওদিন ভোলার নয়। বাকি জীবনটা সেতসুকো সারা বিশ্বে কেবল একটা কথাই প্রচার করে গিয়েছেন, পারমাণবিক বোমা কতটা ভয়ংকর, এবং ভবিষ্যতে আর কেন তা ব্যবহার করা উচিত নয়। ২০১৭-তে নোবেল শান্তি পুরস্কার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক বোমা ও মানবিকতার কখনো সহাবস্থান হতে পারে না।’
এত বছরে পরমাণু বোমার ব্যবহার হয়নি ঠিকই, তবে বেশিরভাগ দেশের যুদ্ধের ভাণ্ডারে তা মজুত করে রাখা আছে। ‘জোর যার মুলুক তার’ মতাদর্শ খাটাতে, অপর দেশকে ভয় দেখাতে পারমাণবিক বোমার জুড়ি মেলা ভার। একথা কেন বলছি, তার উত্তর পাওয়া যাবে ‘কোল্ড ওয়ার’-এর দিকে তাকালেই। ১৯৪০-১৯৯০, এই পঞ্চাশ বছর ধরে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময়টুকু খুঁটিয়ে নজর করলেই বোঝা যাবে এই আদর্শগত দ্বন্দ্বের কতটা জুড়ে ছিল পারমাণবিক শক্তির গুরুত্ব। সম্মুখ সমরে না গিয়েও এই দুই দেশ সমানে একে-অপরকে হুমকি দিয়ে গিয়েছে পারমাণবিক হামলার। আর যতদিন এই চাপান-উতোর চলেছে, ততদিন এর সঙ্গে জুড়ে থাকা বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটিয়েছে, কোনওদিন তাদের নিয়তিও হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো হবে, এই কথা ভেবে। তবে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে থাকলে কী হবে– দেশের সামরিক শক্তি বাড়াতে ভাণ্ডারে পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা যত বাড়ে, তত ভাল। না হলে অন্য দুর্বল দেশকে ভয় দেখনো যাবে কী উপায়ে? আবার যুদ্ধের ভাণ্ডারে এই অস্ত্র না থাকলেও বিপত্তি। তাতে অন্য দেশ দুর্বল ভেবে বসতে পারে।
‘কোল্ড ওয়ার’ মিটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর হল। হিরোশিমা-নাগাসাকির ওপর বিধ্বংসী আক্রমণের পরে যতই মানুষ এই ভয়াবহ অস্ত্র বা বোমা-র ব্যবহার থেকে দেশের ওপরমহলকে দূরে থাকার আর্জি জানিয়েছে, তার লাভ হয়নি বিশেষ। উল্টে, যত দিন গিয়েছে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ যেন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, চায়না, ইউকে, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং ইজরায়েলের কাছে শুধু পারমাণবিক অস্ত্র আছে তাই নয়– নিত্যনতুন প্রযুক্তির সাহায্যে তা ক্রমাগত উন্নত (পড়ুন, আরও ভয়াবহ) হয়ে উঠছে।
বিশ্ব জুড়ে পারমাণবিক সংঘর্ষের ভয় উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যদিও এর সরকারি বিবৃতি কোনও দেশ থেকে সরাসরি আসেনি। ‘কোল্ড ওয়ার’-এর সময় থেকেই বিভিন্ন দেশ পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছে। ফলে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বাড়লেই এক দেশের অন্য দেশের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয় সহজেই। মুখে না বললেও, আন্তর্জাতিক সংঘাতে কোনও সময়েই আর এই বিধ্বংসী হামলা যে হবে না, এই কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। এছাড়া ক্ষমতার অমানবিক প্রদর্শনের সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
নয়ের দশকের পর পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বিশেষ হাঙ্গামা না হওয়ার ফলে, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক খানিক হলেও হালকা হয়েছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বদল ঘটেছে অনেক। গত পাঁচ-ছ’বছরের বিশ্বের রাজনীতির দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাব, ক্ষমতার আসন যারা দখল করেছে, তারা মূলত অতি দক্ষিণপন্থী। ফ্যাসিজমের উত্থান ঘটেছে, আর বেড়েছে মানুষের প্রতি মানুষের এবং দেশের প্রতি দেশের অসহিষ্ণুতা।
ফলে, বিশ্ব জুড়ে পারমাণবিক সংঘর্ষের ভয় উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না, যদিও এর সরকারি বিবৃতি কোনও দেশ থেকে সরাসরি আসেনি। ‘কোল্ড ওয়ার’-এর সময় থেকেই বিভিন্ন দেশ পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছে। ফলে দ্বন্দ্বের তীব্রতা বাড়লেই এক দেশের অন্য দেশের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয় সহজেই। মুখে না বললেও, আন্তর্জাতিক সংঘাতে কোনও সময়েই আর এই বিধ্বংসী হামলা যে হবে না, এই কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। এছাড়া ক্ষমতার অমানবিক প্রদর্শনের সম্ভাবনা তো রয়েছেই।
২০২৫-এ বিশ্বের পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যাবে– ২০১৪-র শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ আজও চলছে। ইউক্রেনের মর্যাদার বিপ্লবের পর, রাশিয়া ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া দখল করে এবং তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এরপর রাশিয়ান আধা-সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করে, যারা পূর্ব ডনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের বৈধতাকে অস্বীকার করার ফলেই এই অশান্তির শুরু। ইউক্রেনকে নিরস্ত্র করার অভিপ্রায়ে এই যুদ্ধ শুরু হয় এবং গত বছর পুতিন ইউক্রেনের প্রতি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠায় পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছে। যদিও আমেরিকা পুতিনের এই দাবিকে কেবল ‘ভয় দেখানো’ বলেই মনে করছে।
সেই সঙ্গে এটাও ভুললে চলবে না যে গত দু’বছর ধরে গোটা বিশ্ব গণহত্যার একরকম সরাসরি সম্প্রচারের সাক্ষী হয়ে চলেছে। ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের একটা অংশে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি জানিয়েছিল ফিলিস্তিনিরা। সেই থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘাতের শুরু। ৭ অক্টোবর, ২০২৩ থেকে যে সমস্যার শুরু হয়েছিল, তা এই দু-বছরের মাথায় এসে একেবারেই একপাক্ষিক ক্ষমতা প্রদর্শনে পরিণত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক গণহত্যার নজির গড়ে তুলেছে ইজরায়েল। আর এর পিছনে রয়েছে তাদের সামরিক শক্তির নির্লজ্জ প্রদর্শন এবং বেশ কিছু শক্তিশালী দেশের তাদের প্রতি নীরব ও সরব সমর্থন। এই গত দু-বছরে যে-পরিমাণ বোমাবর্ষণ প্যালেস্টাইনের ওপর হয়েছে, তার প্রভাব দুই-এরও বেশি পারমাণবিক বোমার চেয়ে অনেক গুরুতর। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বোমাবর্ষণে, অনাহারে– যার মধ্যে নবজাতক ও শিশুদের সংখ্যা হাজারেরও বেশি। যুদ্ধ ও ‘ন্যায়বিচার’-এর নামে এই অমানবিক অত্যাচার ঘটছে সারা বিশ্ববাসীর সামনে। এই বা কোনও পারমাণবিক যুদ্ধের চেয়ে কম কী?
‘বোমা’ এই শব্দটা শুনলে ভয় তো করবেই– তবে কিছু কিছু সময়ে এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও বেশ কিছু শব্দ– যেমন প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। কখনও রাজনৈতিক আন্দোলন, কখনও ক্ষমতার আস্ফালনের বিরুদ্ধে লড়াই, আবার কখনও অন্যায়ের প্রতিবাদ– সেসবের সঙ্গেও এককালে এর সম্পর্ক ছিল বইকি! তবে সেসব আপাতত ব্যাকফুটে।
সম্প্রতি বিশ্বের অসহিষ্ণু মনোভাব আপাতত আরও অন্ধকার দিকে মোড় নিচ্ছে। সেখানে শক্তিশালীর রোয়াব দুর্বলের ওপর কঠিন আঘাত হানতে দু’বার ভাবছে না। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ যেন অতিকথনের পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বশান্তি চুক্তিতে বেশিরভাগ দেশ পারমাণবিক বোমা বা অস্ত্রের প্রয়োগের বিরুদ্ধে নাম লেখালেও– সামান্য অশান্তিতেই হুমকি দিতে ছাড়ছে না। ফলে, ক্ষমতার আসনে যারা বসে আছে, তাদের বিশ্বাস করাও ক্রমাগত দুস্কর হয়ে উঠছে।
তোমার যুদ্ধের ভাণ্ডার যত কালান্তক অস্ত্রে পরিপূর্ণ– তোমার ক্ষমতা বাকি দেশের চেয়ে তত বেশি। এ যেন ‘সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর এক অন্য রূপ। বিন্দুমাত্র বিপদের আশঙ্কা দেখলে আগেই আঘাত হানো। এই মানসিকতার জয়জয়কার যখন চারিদিকে– তখন যে কোনও সময় পারমাণবিক আক্রমণ যে অমূলক ভয়মাত্র– সে-কথাই বা বলি কী করে?