বাঘের বাড়ি

Reference image of Tiger

দৌড়-দৌড়-দৌড়! আর্চির সন্ধান করতে-করতে, বেশ একটু এগিয়েই গিয়েছিল ইরফান। চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বড় পুকুরটার সামনে। ওর হিসেবমতো, জল খেতে এখানেই আসবে আর্চি। হঠাৎ খবর এল, তাকে রাস্তায় দেখা গেছে; কিন্তু ততক্ষণে প্রায় ছয় কিলোমিটার এগিয়ে গেছে ইরফান। ঝড়ের গতিতে ধুলো উড়িয়ে, আধ ঘন্টার রাস্তা দশ মিনিটে নামিয়ে এনে যখন সে পৌঁছল, তখন সেখানে অন্তত পনেরো-কুড়িটা জিপসির ভিড়। রাস্তার ওপর পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ‘টিপেশ্বর ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি’-র হার্টথ্রব আর্চি!

মন ভরে, পেট ভরে বাঘ দেখে খুশিমনে টুরিস্টরা যখন রিসর্টে পৌঁছল তখন সন্ধ্যের আলো মরে এসেছে। একসঙ্গে পাঁচ-পাঁচটা টাইগার সাইটিং— খুশি মনে কেজি দু’য়েক পাঁঠা কিনে বাড়ির পথ ধরে ইরফান, প্রচুর বকশিশ পাওয়া গেছে আজ।

আরও পড়ুন: শান্তিপূর্ণ জঙ্গলে হঠাৎ কেন বাঘের আনাগোনা? লিখছেন তিষ্য দাশগুপ্ত

এ-গল্প শুধু ইরফানের একার নয়, সুন্দরবন থেকে করবেট, বন্দীপুর থেকে বান্ধবগড়; উপচে পড়া বাঘের দেশ— ভারতবর্ষের আনাচে-কানাচে প্রতিনিয়ত পাড়ি জমান পর্যটকেরা, তাকে এক ঝলক দেখার আশায়। অথচ আজ থেকে বছর কুড়ি আগেও ব্যাপারটা এরকম ছিল না। ২০০৬ সালে, সারা ভারতে বাঘ সুমারির পরে জানা যায়, দেশের সর্বমোট বাঘের সংখ্যা— ১৪১১, সেখান থেকে ২০২২ সালের সর্বশেষ সুমারির রিপোর্ট অনুযায়ী এই মুহুর্তে দেশে বাঘের সংখ্যা ৩৬৮২।

সারা পৃথিবীর প্রায় সত্তর শতাংশের বেশি বাঘ ধারণ করে আমার-আপনার এই দেশ ভারতবর্ষ। ২০২৫ সালে এই মুহূর্তে দেশে মোট টাইগার রিজার্ভের সংখ্যা ৫৮। ‘ন্যাশনাল টাইগার কনজার্ভেশন’ অথরিটি এবং ‘মিনিস্ট্রি অফ এনভায়রনমেন্ট ফরেস্ট এন্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর কর্তাদের চওড়া হাসি সংক্রামিত হয় ছাপ্পান্ন ইঞ্চির মুখে— ভেসে আসে সেই বজ্রনির্ঘোষ; ‘মিত্র, বাঘো মে বাহার হ্যায়!’

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রাক্কালে এই সাফল্য উদযাপনের হিড়িকে গা ভাসিয়ে দিতে-দিতে মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন কাঁটা হয়ে বিঁধতে থাকে; বাঘ তো নাহয় বাড়ল, অতঃকিম?

কাজিরাঙা থেকে তাডোবা, কানহা থেকে করবেট, সর্বত্র ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী। টাইগার রিজার্ভগুলো বেশিরভাগই সম্পৃক্তপ্রায়, অতএব ভাল বাসার খোঁজে বুদ্ধিমান মার্জারপ্রবরের দল বেড়িয়ে আসছে বাফার জোনে, টেরিটোরিয়াল এরিয়ায়— যেখানে নিত্যদিন বাঘে মানুষে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। এহেন অবস্থায় আমরা কি আদৌ প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাঘকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য প্রস্তুত? এই প্রশ্নের উত্তরটাই খোঁজার চেষ্টা করব এবার।

২০২৫-এর মাঝামাঝি এসে দেখতে পাচ্ছি, রনথম্বরে কানকাটি নামক বাঘিনীর হাতে একজন ফরেস্ট রেঞ্জার সহ একটি বাচ্চার মৃত্যু। কাজিরাঙার বাইরে গোলাঘাট জেলায় গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে, পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ বাঘকে। ২০২১-এ তাডোবায় বাঘিনীর হাতে ফরেস্ট গার্ডের মৃত্যু। তেলেঙ্গানা সহ মধ্যভারতের বিভিন্ন জায়গায় পোচিংয়ের সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক। এই তালিকার শেষ দেখতে পাওয়া বেশ দুস্কর। তাহলে সমস্যাটা কোথায় আর সমাধানই বা কি?

প্রবাদপ্রতিম বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ডক্টর যাদবেন্দ্রদেব বিক্রমসিং ঝালা হামেশাই বলে থাকেন, জঙ্গল যদি ধাত্রী হন, এবং বাঘ যদি হয়ে থাকে সন্তান— তাহলে এই সম্পর্কে টাইগার করিডোরের ভূমিকা অনেকটা ‘আম্বিলিকাল কর্ড’-এর মতো, যে নাড়ির টানে বারবার সন্তান ফিরে আসে তার মায়ের কোলে। ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ বাঘের আস্তানার দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখব এই ‘নাড়ি’ জুড়ে দু’পেয়েদের দাপাদাপি। কোথাও রাতাপানি টাইগার রিজার্ভের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, কোথাও বা আবার কাওয়াল টাইগার রিজার্ভের ঠিক মধ্যিখানে অবস্থান করছে বিরাট শহর নির্মল। অতএব, যেইটুকু ‘নাড়ির টান’ অবশিষ্ট আছে তাকে জান প্রাণ দিয়ে বুকে আগলে রাখা এখন সময়ের দাবি।

ম্যানেজমেন্টের কথায় যদি আসি তাহলে দেখা যায় বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস অফিসাররা যখন ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁদের স্বপ্ন ছিল কালেক্টর হওয়ার। ফলে ইউপিএসসি পাশ তাঁরা করেছেন বটে, কিন্তু জল-জঙ্গল ও নামানুষদের বিষয়ে অভিজ্ঞতা, ব্যবহারিক জ্ঞান ও সর্বোপরি তাদের প্রতি ভালবাসা অত্যন্ত সীমিত। ফলে ‘কর্তব্যের’ বাইরে গিয়ে জঙ্গলের মঙ্গল করার ইচ্ছে কতজনের থাকে তা বলা বেশ মুশকিল। রনথম্বরে একজন

রেঞ্জারের অকাল মৃত্যু, কাজিরাঙায় সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও গা না ঘামানো— এই ঘটনাগুলি প্রকৃতপক্ষে ‘ইল ম্যানেজমেন্ট’-এরই ফলাফল।

প্রকৃতি ও মানুষ, এবং প্রকৃতির দুই সন্তান মানুষ ও বাঘ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জীবনযুদ্ধে তাদের মুখোমুখি দেখা হওয়া ও সংঘাত ও অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু সংঘাত সত্ত্বেও তাকে বিপদসীমার নীচে আটকে রাখাটাই কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। দীর্ঘকাল মহারাষ্ট্রে বাঘ নিয়ে কাজ করা বাংলার গবেষক সুমন কোলের মতে, মহারাষ্ট্রের বেশিরভাগ অংশে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি, শিক্ষার হার কম। কিন্তু চন্দ্রপুর, ব্রহ্মপুরী প্রভৃতি বাঘা-বাঘা জায়গায় বাঘে মানুষে সংঘাত হলেও মানুষ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার পথে হাঁটে না, কারণ মহারাষ্ট্রে বাঘের কবলে পড়লে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পদ্ধতি খুব সরল, মাত্র সাত থেকে দশ দিন সময় লাগে। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের আর্থ সামাজিক কাঠামোগুলি আলাদা-আলাদা, তাঁদের সমস্যা এবং চিন্তাভাবনায় রয়েছে বিস্তর ফারাক। একটু সংবেদনশীল হয়ে রাজ্যগুলো যদি ম্যান এনিম্যাল কনফ্লিক্ট কমাতে কম্পেনসেশনের পদ্ধতি সরল এবং তরান্বিত করে তবে বাঘে মানুষে সম্পর্ক উন্নত না হবার কোনও কারণ নেই।

বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিস অফিসাররা যখন ইউপিএসসি-র প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তাঁদের স্বপ্ন ছিল কালেক্টর হওয়ার। ফলে ইউপিএসসি পাশ তারা করেছেন বটে, কিন্তু জল-জঙ্গল ও না-মানুষদের বিষয়ে অভিজ্ঞতা, ব্যবহারিক জ্ঞান ও সর্বোপরি তাদের প্রতি ভালবাসা অত্যন্ত সীমিত।

অভিজ্ঞ গবেষক ও অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী প্রফেসর কামার কুরেশি মনে করেন দেশে বহু টাইগার রিজার্ভে এখনও বাঘের সংখ্যা যথেষ্ট কম, উপযুক্ত পরিকাঠামো যদি এখন থেকেই গড়ে তোলা যায় সেইসব জায়গায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে নতুন, ভাল বাসার সন্ধান খুঁজতে মানুষের ঘরে হয়তো হানা দিতে হবে না দক্ষিণরায়দের। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলোর সদিচ্ছা, আমলাদের উদ্যোগ এবং অর্থের বিনিয়োগ— তিনটিই আশু প্রয়োজন; কিন্তু সব ক্ষেত্রে এখনও যথেষ্ট ঔদাসীন্য বিদ্যমান।

এনটিসিএ ইতমধ্যেই মানুষ ও বাঘের সহাবস্থান সুগম করতে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এছাড়া উত্তর পূর্ব ভারত হয়তো তার ভৌগোলিক দুর্গমতার কারণেই বাঘের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল, এখনও বহু সংখ্যক বাঘের স্থান সংকুলানে সক্ষম সেভেন সিস্টার্স। শুধুমাত্র বেঙ্গল টাইগার-ই নয়, উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড় ও প্রকৃতি ইন্দো চাইনিজ টাইগার (প্যানথেরা টাইগ্রিস করবেটি)-এর জন্যও আদর্শ আবাসস্থল হতে পারে। আশা জাগে ডাম্পা টাইগার রিজার্ভের ক্ষেত্র অধিকর্তা আইএফএস অগ্নি মিত্রর কথায়। 

অতএব, ‘বাঘো মে বাহার সে বাঘো কি বরসাত’— একেবারেই কোনও অলীক কল্পনা নয়। কারণ ইরফানরাও জানে, আর্চি ভাল থাকলে ভাল থাকবে ওরাও— শুধু প্রয়োজন একটু সরকারি উদ্যোগ এবং সদিচ্ছার।