আজিজুল হক আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত তিনি, আমার থেকে বয়সে একটু ছোট, দু’তিন বছরের; আমাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতান্তর হলেও কখনও বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়নি। রাজনীতির জন্য, বামপন্থার জন্য— ওঁর যে আত্মত্যাগ, তা অবিস্মরণীয়! আজ আমি আমার এক বন্ধুকে হারালাম। বাংলার রাজনীতি একজন স্পষ্টবক্তা, সাহসী, লড়াকু মানুষকে হারাল; যাঁর জ্ঞান যতদিন ছিল, বলেছেন রাষ্ট্র বিপ্লবের কথা, বলেছেন রাষ্ট্র অবলুপ্তির কথা। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের লড়াকু ইতিহাস তো সেভাবে লেখা হল না, জানি না ভবিষ্যতে কেউ লিখবেন কি না, লেখা হলে, আজিজুল হক সেখানে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন: মানবসভ্যতার ইতিহাসে শ্রম আদি-অকৃত্রিম— অথচ শ্রমজীবীরা অবহেলিত! লিখছেন প্রবুদ্ধ ঘোষ…
আজিজুল বারবার বলেছেন রাষ্ট্র মানেই পীড়নের যন্ত্র, রাষ্ট্রযন্ত্র থাকলে কোনওদিনই শোষণের অবলুপ্তি হবে না। শেষ পর্যন্ত নিজের এই রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রের পতন সম্ভব কি না, তা ঠিক না বেঠিক, এই বিতর্কে না গিয়েও বলতে পারি, সম-সময়ে দাঁড়িয়ে এ-ধরনের কথা বলতে বুকের পাটা লাগে। মেরুদণ্ড লাগে, যা আজিজুল হকের ছিল। কোনওদিনই আজিজুল নিজের অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি। আমার বয়স এখন আশি, আমাদের সম-সময়ে রাজনীতি করা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকলেন, একমাত্র অসীম, অসীম চট্টোপাধ্যায়। আর কেউ থাকলেন না, আমারও শরীর ভাল নেই, আজিজুলের সঙ্গে শেষ দেখা করতে যাব, তাও সম্ভব হল না।
বহু রাজনৈতিক প্রতিবাদ সভা, মিছিলে আমি আর আজিজুল একসঙ্গে পথ হেঁটেছি। আমাকে আজিজুল বলেছিলেন, তুমি চেষ্টা করো, পারবে। আমাকে বামপন্থী দলগুলো অতটা ভরসা করে না, যতটা তোমাকে করে। আজিজুল আমাকে একবার বলেছিলেন, সমস্ত রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্ত্বেও, বামপন্থী দলগুলি, যারা লাল ঝাণ্ডা ধরে আছে, তারা একটা কোনও ইস্যুতে একসঙ্গে যদি কলকাতার বুকে নামে, তাহলে কিন্তু রাষ্ট্রের বুক কেঁপে যাবে!
এটা আজিজুলের স্বপ্ন, যা আমরা পূরণ করতে পারিনি। আজীবন এই আক্ষেপ ওঁর ছিল, আমারও আছে। জানি না, আমার জীবিতাস্থায় কোনওদিন তা দেখে যেতে পারব কি না। ভারতের বুকে শ্রমিকশ্রেণি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে, শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র, সেটা হলে তো শুধু ভারতের বুকে হবে না, হলে সারা পৃথিবীর বুকে হতে হবে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে, আর শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা কখনও হয় না। মানচিত্র থাকবে, রাষ্ট্রও উঠে যাবে, এটা সম্ভব নয়। ভারতে থেকে এই স্বপ্ন বুকে নিয়েই আমরা একদিন বামপন্থী দলে যোগ দিয়েছিয়াম এবং সাধ্যমতো সৎ, স্বচ্ছভাবে এই পথে থাকার চেষ্টা করেছি। জানি না আমাদের সেই স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে কি না, আমিও মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এই স্বপ্নটাই দেখব! আজও এটাই বলি, পরিবর্তন দেখে যেতে পারব না, তার প্রথম পদক্ষেপটা যদি দেখে যেতে পারি! আজিজুল হকের মৃত্যুর পর এটুকই আমার আকাঙ্ক্ষা, আমার স্বপ্ন!