রানির চাল, রানির চলন

সব লাল হো যায়েগা’: ভারতের মানচিত্রের ঠিক এ রকম হালই হবে ব্রিটিশরা যদি ভারতবর্ষের দখল নিয়ে নেয়— মহারাজা রঞ্জিত সিং এমনটাই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

‘মাই লিটল ব্ল্যাক প্রিন্স’— রানি ভিক্টোরিয়া পঞ্জাবের শেষ মহারাজা দলীপ সিং-কে আদর করে এই নামেই ডেকেছিলেন।

পঞ্জাবের ইতিহাসের এই দু’টি মাইলফলকের মাঝের ইতিহাসটায় রানি জিন্দাঁ নেহাত একটা রঙিন চকমকি পাথরে পর্যবসিত হয়েছেন— আকর্ষণীয়, সুন্দর, কিন্তু গোটা যাত্রাপথে কখনওই তাৎপর্যপূর্ণ নন। চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনি মাঝের এই ফারাকটাই ভরাট করতে চেয়েছেন তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট কুইন’-এর মধ্যে দিয়ে। বইটায় আমরা শুনি রানি জিন্দাঁ-র স্বর, আর তথ্য এবং কল্পনার মিশ্রণে দেখতে পাই এক সম্রাজ্ঞীর অভিযান: অনাম্নী সরল-গ্রাম্য মেয়ে থেকে জেনানার কৌতূহলোদ্দীপক জীবন পেরিয়ে, তাঁর দরবারি কূট-রাজনীতির গল্প। 

চিত্রা সব সময়ই তাঁর মুখ্য নারী-চরিত্রগুলির মনে আর মস্তিষ্কে কেবল প্রবেশ করেই ক্ষান্ত থাকেন না, বরং সেই চরিত্রগুলিকে আত্মস্থ করার চ্যালেঞ্জকে বেশ উপভোগ করেন। তা দ্রৌপদীর দ্বন্দ্বই হোক বা সীতার মনোবেদনা, লেখক সব সময়ই তাঁর চরিত্রদের আবেগ জীবন্ত করে তোলেন। চরিত্রদের প্রকাশভঙ্গি, তাঁদের ভাষা সমকালীন পাঠকদের মধ্যে অনুরণিত হয়। রানি জিন্দাঁ-কে নিয়ে এই উপন্যাসটিও বেশির ভাগ অধ্যায়েই সেই ধারা বহন করেছে। 

রানি জিন্দাঁ পরতে পরতে তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেন জীবনের ধাপে ধাপে, আর ধাপগুলো যত পার হন, উপন্যাসটা তত জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রথমে সাধারণ মেয়ে, তার পর স্ত্রী, তার পর রানি এবং শেষে বিদ্রোহিনী। বইয়ের এই চারটি অধ্যায় কিন্তু স্বমহিমায় জ্বলজ্বল করে ওঠে দ্বিতীয় ভাগের শেষ দিকটা থেকে। 

চিত্রা তাঁর বইয়ের গবেষণার ব্যাপারে বলছিলেন, ‘বইয়ের প্রথম ভাগের গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কারণ তেমন কোনও তথ্য ছিল না।’ যতটা জানা গিয়েছে, জিন্দাঁ ছিলেন একজন পশুরক্ষকের মেয়ে, আর তাঁর ভাই জওহরের সঙ্গে ছিল খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (ভাই-বোনের এই সম্পর্কের দরুন তিনি কয়েকটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন) এবং তিনি এমন রূপবতী ছিলেন যে রাজা-মহারাজাদের মাথা ঘুরে যেত। 

চিত্রা অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় মহারাজা রঞ্জিত সিং আর তরুণী রানি জিন্দাঁর প্রেম-কাহিনি লিখেছেন। কিন্তু মহারাজের অন্যান্য রানিদের সঙ্গে দাবার চালের মতো জিন্দাঁর মোকাবিলার বর্ণনা লেখাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। রানিদের মধ্যে ক্ষমতার শ্রেণিবিভাগ, সব চেয়ে বড় রানি মাঈ নক্কেইন-এর চক্রান্ত আর অভিসন্ধি, রানি জিন্দাঁর সঙ্গে রানি গুড্ডন-এর বন্ধুত্ব, এই সব ঘটনা খুব পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে দেয়, জিন্দাঁ শুধুমাত্র মহারাজার সঙ্গিনী নন, তিনি একজন ব্যক্তিত্বময়ী স্বতন্ত্র নারী।

লেখকের কৃতিত্ব, তিনি কখনওই রানি জিন্দাঁকে ভালত্বের মোড়কে বন্দি রাখেননি। জিন্দাঁ এমন একজন নারী, যাঁর মধ্যে ছিল নিষিদ্ধ ক্ষুধা এবং তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার মিশেল। এমনকী যখন মহারাজা রঞ্জিত সিং-এর মৃত্যু হয়েছে, সেই তীব্র মনোবেদনার সময়ও লেখক জিন্দাঁকে কেবল মহারাজার প্রতি নিবেদিত এক বিধবা নারী ও অসহায় মা হিসেবে তুলে ধরেননি, নারী হিসেবে জিন্দাঁর জীবনের প্রতি তৃষ্ণাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন: ‘আমি বাঁচতে চাই আমার জন্যও। আমি পৃথিবীর কতটুকুই বা স্পর্শ করেছি। আরও কত কিছু দেখার আছে, আরও কত কিছু আস্বাদ করা বাকি রয়েছে। আমি তো এ সবের প্রতি লোভী। আমি জীবনের তিক্ততাকে গ্রহণ করব, আবার মিষ্টতাকেও। আমি যন্ত্রণা সহ্য করব।’  

লেখকের কৃতিত্ব, তিনি কখনওই রানি জিন্দাঁকে ভালত্বের মোড়কে বন্দি রাখেননি। জিন্দাঁ এমন একজন নারী, যাঁর মধ্যে ছিল নিষিদ্ধ ক্ষুধা এবং তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার মিশেল।

জিন্দাঁ নিজের ছেলের জন্য এতটুকু সুযোগ দেখতে পেলেই, ঝাঁপিয়ে পড়ে তা নিয়েছেন। তিনি জীবনে পুরুষসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছেন এবং পুরুষ-সঙ্গ করেছেন। তিনি ক্ষমতার ঝাঁঝালো আরকের স্বাদ গ্রহণ করেছেন যখন তিনি রাজদরবারে কূটনীতির চাল চালছেন, আর তার কিছু দিনের মধ্যেই খালসা সেনার মতো একটা শক্তিশালী বাহিনীকে পরিচালনা করছেন। পঞ্জাবের ইতিহাস তাঁকে মনে রেখেছে মাঈ জিন্দাঁ হিসেবে, খালসার মাতৃ-স্বরূপা। রানি হিসেবে ততটা মনে রাখেনি, কারণ খুব কম সময়ের জন্য যুবরাজ দলীপ সিং-এর রাজপ্রতিভূ হিসেবে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন।     

উপন্যাসের আরও একটি জায়গায় লেখক তাঁর মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, যেখানে আমরা দেখি, দরবার দখল করার জন্য রানি জিন্দাঁ পিতৃতন্ত্রের হাতিয়ারগুলিকে খুব চতুর ভাবে নিজের সুবিধে মতো বেঁকিয়ে-চুরিয়ে নিচ্ছেন। তিনি খালসা সেনার সামনে, নাটকীয় ভাবে, নেহাতই তাদের একজন, প্রায় তাদের পরিবারের একজন হয়ে ধরা দিচ্ছেন। তিনি সৈন্যদের উদ্বুদ্ধ করতে অবলীলায় ব্যবহার করছেন তাঁর স্বর্গীয় স্বামীর নাম, আবার রাজদরবারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে, নিজেকে তুলে ধরছেন নেহাতই শিশু যুবরাজের অসহায় বিধবা মা হিসেবে। প্রতি বারই যে-মুহূর্তে তিনি কোথাও সুযোগের সন্ধান পাচ্ছেন, তাঁর সৌন্দর্যকে, তাঁর বিপন্ন অবস্থাকে, জনসমক্ষে তাঁর মতো একজন রানির উপস্থিত হওয়ার বাধ্যতাকে ব্যবহার করে, বিপক্ষকে পরাস্ত করছেন পদে পদে।

উপন্যাসের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি ‘বিদ্রোহিনী’, যে-পর্যায়টি ঔপনিবেশিক ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়। দশ বছরের দলীপ সিং-কে সরিয়ে নেওয়া হয় তার মায়ের কাছ থেকে এবং দীক্ষিত করে তোলা হয় এই মন্ত্রে— যা কিছু ভারতীয়, সবই খারাপ। তার চেয়েও মর্মান্তিক, দলীপ সিংকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করে, রানি ভিক্টোরিয়ার দাক্ষিণ্যে জীবনধারণ করতে বাধ্য করা হয়। উপন্যাসের এই পর্যায়ে এসে চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনি-র কাছে বেশ অনেকটা তথ্য মজুত হয়েছে, যাতে রচনার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি আরও মজবুত হয়ে ওঠে। এই সময় আমরা দেখি, রানি জিন্দাঁ প্রায় অন্ধ, চল্লিশের কোঠায় তাঁর বয়স কিন্তু শরীর সে তুলনায় অনেক বেশি ভঙ্গুর, চলেছেন ইংল্যান্ডে, তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। রানি জিন্দাঁ তখন তাঁর সংগ্রামী সত্তাকে দমিয়ে রেখে দেন (এবং নিজের মা-সত্তাকে প্রাধান্য দেন), কিন্তু তাঁর চেয়েও জরুরি— তিনি তাঁর ছেলেকে ব্রিটিশ রাজত্বের, দরবারের, বিশেষত অন্য আর এক রানি, রানি ভিক্টোরিয়ার কবল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। যদি সে জন্য তাঁকে হিন্দুস্তান থেকে, বিশেষত প্রাণের লাহৌর শহর থেকে বহু দূরে বিদেশ-বিভুঁইয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন।

রানি জিন্দাঁ এবং দলীপ সিং, তৈলচিত্র

উপন্যাস যখন শেষ হয়, মনে একটা উপসংহারের চাহিদা থেকে যায়। যে-উপসংহার হয়তো রানি জিন্দাঁর ‘শেষ লাহৌর-যাত্রা’র সময়টাকে বর্ণনা করতে পারত। কিন্তু চিত্রা ঠিক সেটাই করেছেন, একটা ঐতিহাসিক উপন্যাসের যা করা উচিত। পাঠকের মধ্যে রানি জিন্দাঁ ও তাঁর সময় ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কের জানার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। 

উপন্যাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কলকাতা একটা জরুরি ভূমিকা পালন করে। যেখানে কলকাতার স্পেন্সে’স হোটেলে (এখনকার গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট-এ তখন এই হোটেল থাকলেও, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই) যুবক দলীপ সিং-এর সঙ্গে রানি দেখা করেন। আর রানি জিন্দাঁ যখন তাঁর প্রিয়তম হিন্দুস্তানকে দেখেন, কলকাতার গঙ্গার ধারটিই তাঁর চোখে ধরা দেয়।

চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনি সাধারণত যে-দক্ষতায় তাঁর উপন্যাস সাজান ও ধাপে ধাপে বুনে তোলেন, তাতে অনেকগুলো ছবি ফুটে ওঠে এবং উপন্যাস খুবই সিনেমাযোগ্য হয়ে ওঠে। খবর বলছে, খুব তাড়াতাড়ি এই উপন্যাসটি সিনেমা হতে চলেছে। ডাচ মিডিয়া সংস্থা এন্ডেমল শাইন (ইন্ডিয়া) এরই মধ্যে উপন্যাসটি তাদের বাছাইয়ের তালিকায় রেখেছে। হয়তো আমরা খুব শিগগির শুনতে পাব কঙ্গনা রানাওয়াত লুব্ধ দৃষ্টি রেখেছেন এই চরিত্রের দিকে। এবং এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী নিশ্চয়ই এমন প্যাশনেট, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, সুন্দরী রানির ভূমিকায় অভিনয় খুব উপভোগ করবেন। আমরা আশা করতেই পারি, এই চরিত্রে তিনি যদি অভিনয়ে ব্যস্ত থাকেন, অন্তত কিছু দিনের জন্য তাঁর টুইটার-হ্যান্ডল থেকে দূরে থাকবেন!  

দ্য লাস্ট কুইন
চিত্রা ব্যানার্জি দিবাকারুনি
হার্পার কলিন্স, ৫৯৯/-

Read in English