মশক-মঙ্গল

মানুষখেকো বাঘ না দেখলেও সে-বই আমাকে বাঘখেকো মশার কথা মনে পড়িয়ে দিল। ত্রৈলোক্যনাথ (সে-বইয়ে অবিশ্যি নাখ, প্রুফ-রিডারকে মশা কামড়াচ্ছিল নাকি!) মুখোপাধ্যায় ‘ডমরু-চরিত’-এ যে মশার কথা বলেছিলেন। সেই যে, ‘কালো চড়াই পাখীর ন্যায় শত শত কি-সব দেওয়ালের গায়ে বসিয়া আছে। তাহাদের সর্বশরীর কালো, কিন্তু পেটগুলি রক্তবর্ণের। তাহাদের দুইটি করিয়া ডানা আছে, উড়িবার নিমিত্ত ডানাগুলি নড়িতেছে।… রক্তবর্ণের কোনো দ্রব্য খাইয়া পেট পূর্ণ করিয়াছে, সেজন্য উড়িতে পারিতেছে না।… এই জীবই রক্তপান করিয়া ব্যাঘ্রটিকে বধ করিয়া থাকিবে।’ (তৃতীয় পরিচ্ছেদ, ‘সুন্দরবনের অদ্ভুত জীব’)

সে অন্য কোনও জীব নয়, ‘বৃহৎ মশা। মশা! চড়াই পাখীর ন্যায় বৃহৎ মশা। মশা যে এত বড় হয়, তাহা কখন শুনি নাই। শরীরটি চড়াই পাখীর ন্যায় বড়, শুঁড়টি বৃহৎ জোঁকের ন্যায়। ডাক্তাররা যেরূপ ছুরি দিয়া ফোঁড়া কাটে, শুঁড়ের আগায় সেইরূপ ধারালো পদার্থ আছে।…’

বৃহৎ মজারু মশার কাট-আউট প্রচ্ছদের এ-বইয়ে মশার শুঁড়ের আগাটিও যথেষ্ট ছুঁচলো, চোখ বন্ধ করে চামড়ায় ঠেকালে মশার কামড় খাচ্ছি বলেই মনে হবে। ‘উফ্‌ মশা’ নামে উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের মশাক্রান্ত বইটি প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স। বইয়ের চেহারাটিও অভিনব। মশার আদলের কাট-আউট দিয়ে তৈরি সম্মুখ ও পশ্চাৎ-প্রচ্ছদ। সাধারণত এমন ধরনের প্রচ্ছদ ছোটদের বইতেই করা হয়। তা-ও বেশির ভাগ জানা-অজানা সিরিজ টাইপের বইয়ে। বাংলা সাহিত্যে নানা রূপে হরেক মশাচর্চার কথা নিয়ে পরিণত পাঠকের জন্য বইয়ে এমন প্রচ্ছদ অভিনব বই কী!

আরও পড়ুন: শুক্রগ্রহে অভিযান করেছিল বাঙালি? বাংলার প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে যে-বিস্ময় জমা হয়ে রয়েছে! লিখছেন দীপ ঘোষ…

উষারঞ্জনের গদ্যটিও বেশ। এমনিতে তিনি রবীন্দ্র-গবেষক হিসেবেই সুপরিচিত। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সংযোগ তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথও তো মশার গুরুত্ব খাটো করে দেখেননি।  মশাকেই তো তিনি এক সময়ে বাংলাদেশের ‘প্রবলতম শত্রু’ বলেছিলেন। কে জানে, সেই দুঃখে তাদের বেশ কিছু বাহিনী হিমালয়গামী হতে চেয়েছিল কি না। চাইতেই পারে। তবে ওই ঠান্ডায় ‘কে যায় অত দূর’ ভেবে তারা হয়তো উত্তর-পূর্ব ভারতে একটু জিরোচ্ছিল। নইলে গুয়াহাটিতে গৃহপ্রবেশের দিনই উষারঞ্জনকে অমন মিলিটারি কায়দায় ছেঁকে ধরবে কেন তারা!

সে যাই হোক, উষারঞ্জনও তাদের ছাড়েননি। বাংলা সাহিত্যে তাদের প্রায় সকল ভোঁ-ভোঁকেই ধরতে চেয়েছেন কলমে। সেই যে মধুসূদন ফরাসি কবির অনুসরণে লিখেছিলেন ‘সিংহ ও মশক’, তা-ও চোখ এড়ায়নি লেখকের। ‘ক্ষুদ্র শত্রু ভাবি লোক অবহেলে যারে, বহুবিধ সঙ্কটে সে ফেলাইতে পারে’— সতর্ক করেছিলেন মধুসূদন। সেই সতর্কতা মেনেই হয়তো মশাকে অবহেলা না-করে পুরো একটা মশক-মঙ্গলই লিখে ফেলতে চেয়েছেন লেখক।

সে-মঙ্গলে নানা মজা, নানা রেফারেন্স। মশা নিয়ে মশকরাও। প্রস্তাবনায় এ-মঙ্গল, উষারঞ্জন জানিয়েছেন, অসহিষ্ণু-সহিষ্ণু দু’পক্ষের জন্যেই। আর, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর অজন্তা-যাত্রায় ট্রেনে পাওয়া গব্বর সিংয়ের মতো দেখতে গান্ধী-পদবিধারী এক আশ্চর্য সহিষ্ণুপক্ষের কথা বলেছেন, যাঁর যুক্তি ছিল—

‘মচ্ছর নে কাটা ইয়ে উসকা জুনুন থা
মৈনে খুজলায়া ও মেরা সুকুন থা
চাহ কর ভি উসকো মার না সকা
কিউ কি আখির মে উসপে
মেরা হি খুন থা।’

বৃহৎ মজারু মশার কাট-আউট প্রচ্ছদের এ-বইয়ে মশার শুঁড়ের আগাটিও যথেষ্ট ছুঁচলো, চোখ বন্ধ করে চামড়ায় ঠেকালে মশার কামড় খাচ্ছি বলেই মনে হবে। ‘উফ্‌ মশা’ নামে উষারঞ্জন ভট্টাচার্যের মশাক্রান্ত বইটি প্রকাশ করেছে আনন্দ পাবলিশার্স। বইয়ের চেহারাটিও অভিনব। মশার আদলের কাট-আউট দিয়ে তৈরি সম্মুখ ও পশ্চাৎ-প্রচ্ছদ।

অসহিষ্ণুপক্ষও অবিশ্যি মশাকে নিয়ে কম কাব্য করেননি। যেমন ধরুন অন্নদাশঙ্কর রায়—

‘মশায়!
দেশান্তরী করলে আমায়
কেশনগরের মশায়।
বাঘ নয়, ভালুক নয়
নয়কো জাপানী
বোমা নয় কামান নয়
পিলে কাঁপানী।’

তবে অন্নদাশঙ্করকে যাঁরা দেশান্তরী করেছিল তারা নিছক ছাপোষা মশা বলে বিশ্বাস করি না আমি। নিশ্চয় তারা ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’-র সেই দীর্ঘশুণ্ড, গজগণ্ড, বৃহন্মুণ্ড ও বিকৃততুণ্ডদের বংশধর। এমন সব প্রাণী যে-প্রজাতিতে আছে, তারা তো মানবজাতির শত্রু হবেই। এদের মধ্যে ম্যালেরিয়াবাহী প্রজাতিটির তো প্রজাতীয় সংগীতই লিখে ফেলেছিলেন সতীশচন্দ্র ঘটক, রজনীকান্তের বিখ্যাত গানের প্যারডি করে, ‘তুমি নির্মূল কর বেঙ্গল-নরে শরীর-চর্ম শুকায়ে…’!

ডেঙ্গির ভয়ে পেনেটির বাগানবাড়িতে ছোটবেলাতেই পালাতে হয়েছিল যে-রবীন্দ্রনাথকে, শেষ বয়সেও মশা তাঁকে ছাড়েনি। ১৯৪০-এর ডিসেম্বর বা কাছাকাছি সময়। মুখে-মুখে ছড়া কাটছেন ‘অসুস্থ’ কবি। শুশ্রূষাকারীদের জন্য কবির বেজায় ভাবনা। রোগ-যন্ত্রণা ভুলে সুযোগ পেলেই ছড়া কাটতেন, শুরু করে দিতেন হাসি-তামাশা। ছড়াগুলি জনকয়েক মিলেই উপভোগ করা যেত। লিখেও রাখা হত, জানাচ্ছেন সুধীরচন্দ্র কর। একটা ছড়া ছিল,

‘মশা রক্ত খেতে চায় খাক্ ভুয়ো ভুয়ো
কিন্তু খেয়েদেয়ে কানে দিয়ে যায় দুয়ো।’

বাংলা সাহিত্যকে কেন্দ্রে রেখে ব্যক্তিজীবন আর বিশ্বসাহিত্যপাঠকে সম্বল করে তন্ন তন্ন করে মশা খুঁজেছেন উষারঞ্জন। কিন্তু নিছক মশামারা কেরানির মতো গবেষণা করেননি। তাঁর তরতরিয়ে বয়ে চলা গদ্যে মশার পিছনে চলেছে তাঁর ভ্রমণকারী মনও। আর সেই যাত্রাটিকে চমক-লাগানো অবয়ব দিয়েছেন এ-বইয়ের অপ্রকাশ-নাম নির্মাতা আর প্রচ্ছদশিল্পী শান্তনু দে। তবে এ-বইয়ের প্রুফ-রিডার বোধহয় মাছিমারা কেরানি হতেই চেয়েছিলেন। নইলে বেশ কিছু শব্দশেষ ঊর্ধকমা তার সহচর প্রথমটিকে পশ্চাদ্দেশ দেখায় কেন? তারা কি জানে না, যে-কোনও মুহূর্তে সেখানে মশার কামড় পড়তে পারে!

উফ্ মশা
উষারঞ্জন ভট্টাচার্য
আনন্দ
৪০০.০০