চাষি পরিবার আবার দরিদ্রতায় ফিরে গেল; এবার আরও একটি পেট ভরানোর দায়, তাই সবার ভাগে সেই অল্প খাবারও কম পড়ল। ডালিম গাছটি নষ্ট হওয়ায় এবং দ্রারিদ্রের এই অবস্থায় ফিরে আসার জন্যে সবাই রুম্মনকে দোষী করল। সবাই মিলে ঠিক করল যে ও অপয়া, আর যে-দিন থেকে বাচ্চা রুম্মন হাঁটতে শিখল, সে-দিনই তারা বাড়ির বাইরে খেদিয়ে দিয়ে তাকে নিজের খাবারের জন্যে ভিক্ষা করতে পাঠিয়ে দিল। সারাদিন রুম্মন রাস্তায়-রাস্তায় তার খাবার ভিক্ষা করে রাতে এসে তার বাড়ির দোরগোড়ায় ঘুমিয়ে পড়ত— বাড়ির চৌকাঠ পার করা তার বারণ।
কিছু বছর এই রূপে কেটে গেল, আর দারাজগোশ, যে সব ঘটনার সাক্ষী রইল, অপেক্ষা করল সেই দিনের জন্যে যে-দিন ভগবানের নির্দেশ পালন হবে।
জেলে ও জেলেনির মৃত্যুর পর লামাদ ও তার মা ওদের ছোট কুঁড়েঘরেই থাকতে লাগল। রোজ ভোরে লামাদ মাছ ধরতে বেরিয়ে যেত, আর সেই সন্ধ্যাতেই তার ধরা মাছ শহরে বিক্রি করত। এক দিন সে রুম্মনকে ভিক্ষা করতে দেখে, তার মা’র দুর্দশার কথা ভেবে রুম্মনকে একটা মাছ দিল। তার পরের দিনও তাই করল, আর তার পরের দিনও। ধীরে-ধীরে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল আর তার পর ভালোবাসা। যখন দারাজগোশ ওদের দেখল, তখন তার মনে হল এরাই সেই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা নয় তো, যাদের মৃত্যুতে ভগবানের নির্দেশ পূর্ণ হবে?
আরও কিছু বছর পার হল, লামাদের মা মারা গেলেন। সে বছর এমন খরা হল যে নদীটিও শুকিয়ে গেল। তার পর এল দুর্ভিক্ষ, লোকে তাদের ছেলেমেয়েদের খাবারের জন্য বিক্রি করতে বাধ্য হল। এক দিন লামাদ শুনতে পেল যে রুম্মনের বাড়ির লোকেরা তাকে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রি করতে দিয়েছে। লামাদ রুম্মনকে এক পলকের জন্যেও চোখের আড়াল করতে চাইত না বলে তার কাছে একটাই রাস্তা বাকি রইল। তাই সে নিজেকে বিনামূল্যে রুম্মনের সাথে ক্রীতদাস হিসেবে দিয়ে দিল।
রুম্মনের বিক্রেতা দুটি জোয়ান দাস-দাসী পেয়ে, এই সুযোগে রুম্মনের দাম বাড়িয়ে দিল। এক রাজদূত এই অদ্ভুত জুটির কথা শুনে, রাজার জন্য উপহার হিসেবে তাদের কিনে নিল। রুম্মনকে নির্বাসিত করা হল রাজার হারেমে, আর লামাদকে রাজার আস্তাবলে কাজ দেওয়া হল। নতুন বছরের শুরুতে তাদের দুজনের দাসত্ব শুরু। তারা যে আর কোনোদিন পরস্পরের দেখা পাবে না, এই চিন্তাটি কখনও তাদের মনে আসেনি। নিয়তির এই নিদারুণ পরিহাসে তারা অনেক চোখের জল ফেলে ঠিক করল যে যেই দিন তাদের আলাদা করে দেওয়া হবে, সেদিনই তারা আত্মহত্যা করবে। রুম্মন একটি ভয়ঙ্কর বিষ জোগাড় করল, আর লামাদ একটি ছোরা। দারাজগোশ, যে সবের সাক্ষী, এবার বুঝতে পারল কী করে ভগবানের নির্দেশ পূর্ণ হবে।
প্রতি বছরের শেষ রাত্রিতে বিলমানের রাজা সারবকে ডেকে বিলমানের আগামী বছরের ভবিষ্যৎবাণী জানতে চাইতেন। প্রত্যেক বারের মতো, এইবারও গণনা করতে বলায় সারব দারাজগোশকে ডেকে বলল— ‘খোঁজ নাও স্বর্গে কী বলাবলি হচ্ছে আর আমাকে সেই খবরটা দাও!’ দারাজগোশ তার বিশাল ডানা মেলে উড়ে গেল। খানিকক্ষণ পর সে ফিরে এসে বলল— ‘স্বর্গের দেবদূতেরা বলছেন যে আজ বিলমানের ভাগ্য পাল্টাবে।’
সারব তার গণনা করল, কিন্তু তার সংখ্যা এবং চিহ্নগুলি মিলল না, দারাজগোশ যা বলল তার কোনও প্রমাণও পাওয়া গেল না। এ-রকম তো আগে কখনও হয়নি! চিন্তিত হয়ে সে দারাজগোশকে আবার ডেকে বলল— ‘আরেকবার যাও স্বর্গে, খোঁজ নাও কী বলা হচ্ছে, শুনে আমাকে জানাও!’ দারাজগোশ আবার উড়ে গেল, ফিরে এসে বলল—‘স্বর্গের দেবদূতেরা বলছেন যে এই রাজ্যের ভাগ্য ওই রাজদূতের উপহার দেওয়া দুই ক্রীতদাস-ক্রীতদাসীর সাথে বাঁধা।’
সারব ফের গণনা করে এর প্রমাণ বার করার চেষ্টা করল, সংখ্যা এবং চিহ্নগুলি এবারও নীরব রইল। কিন্তু সে তার জিন্কে বিশ্বাস করত, তাই রাজার সম্মুখে সে দারাজগোশের কথাটিই ভবিষ্যৎবাণী করল। রাজা তার কথা শুনে রুম্মন ও লামাদকে ডেকে পাঠালেন।
লামাদ প্রথম মুখ খুলল। সে বলল, ‘হে রাজা, আমার কথা শুনে যদি আপনার মনে হয় যে তা মানুষের আদর্শ হওয়া উচিত, তবে আমি মিনতি করছি যে আপনার সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, আপনি তাকে ছেড়ে দেবেন!’
রাজা বললেন, ‘তাই হবে!’
তখন লামাদ গোড়া থেকে রাজাকে তার গল্প বলতে লাগল: কেমন করে বন্যার জল সেই গরীব চাষির নিষ্ফলা জমিকে উর্বর করে তাকে বড়লোক করে তুলল, সে কী ভাবে লামাদের মা’কে বিয়ে করল, আর একদিন তার অন্তঃসত্বা মা’কে কী ভাবে তাড়িয়ে দিল, কেমন করে শহরবাসীরা তার মাকে পরিত্যাগ করে তাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিল। লামাদ বলল কেমন করে এক জেলে দম্পতি তার মাকে আশ্রয় দিল, তাদেরই কুঁড়েঘরে কেমন করে তার জন্ম হল, কেমন করে সে তার মা’র কালিমা দূর করতে প্রতিজ্ঞা করেছিল; রুম্মনের সাথে তার কেমন করে ভালোবাসা হল, কেন সে নিজেকে দাসত্বে বিলিয়ে দিল, কেনই বা নিজেকে মেরে ফেলবে ঠিক করল আর কেনই বা তার মনে শান্তি নেই, কারণ তার মা’র মান সে ফেরাতে পারল না।
সবাই দেখল যে গল্পটি শুনে রাজা অভিভূত। লামাদ তার গল্প শেষ করতে না করতেই রাজা বললেন, ‘এ-গল্প সত্যিই সবার আদর্শ!’
যেই মুহুর্তে রুম্মনকে ছেড়ে দেওয়া হল সে এগিয়ে এসে রাজাকে বলল, ‘হে রাজা, আপনার যদি মনে হয় আমার গল্পটি থেকে সব মানুষের কিছু শেখার আছে, তাহলে আপনাকে মিনতি করি, যে আমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে ছেলেটি নিজের স্বাধীনতা বিলিয়ে দিয়েছে, আপনি তাকে মুক্তি দেবেন!’
তাতে রাজা বললেন, ‘তাই হবে!’
তখন রুম্মন তার আত্মকথা শুরু করল, আর রাজাকে বলল কী করে একদিন দুই কৃষকের জমির ঠিক মাঝখানে একটা ডালিম গাছ গজিয়েছিল; কী করে তার বাবা-মা’র বিয়ে হল এবং ওই ডালিম গাছের জন্য তাদের ভাগ্য ফিরে গেল, কী করে তার জন্মের সাথে-সাথে ডালিম গাছটি শুকোতে শুরু করল। কীভাবে গাছটির মৃত্যু ও তার পরের দুঃখকষ্টর জন্য রুম্মনকে অপয়া ভেবে তাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেওয়া হল। রুম্মন রাজাকে বলল, কী করে সে লামাদকে ভালবেসে ফেলল, কীভাবে তার পরিবার তাকে ক্রীতদাসী করে বিক্রি করে দিল আর কীভাবে লামাদ নিজের স্বাধীনতা খুইয়ে স্বেচ্ছায় তার ভালবাসার ক্রীতদাস হল, আর কেন সে ঠিক করেছিল যে জগৎ তাদের আলাদা করার আগেই সে আত্মহত্যা করবে।
রুম্মনের গল্প শেষ হওয়ার আগেই রাজার চোখে জল এল। উনি বলে উঠলেন, ‘সত্যিই তোমার এই গল্পটি সকল মানুষের একটি শিক্ষা!’
লামাদ ও রুম্মন এখন দুজনেই স্বাধীন। তারা কৃতজ্ঞতায় রাজার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ল, কিন্তু উনি ওদের নিজের হাতে তুলে বললেন, ‘এবার আমি তোমাদের একটি গল্প শোনাব, যেটি প্রত্যেক শ্রোতারই শিক্ষা-নিদর্শন!’ বলে তিনি শুরু করলেন, ‘বহু বছর আগে, একটি চোর এক চাষির বিপুল ঐশ্বর্যের কথা শুনে একদিন তার বাড়িতে ঢুকল। সেখানে সে ওই চাষিকে তার অপরূপা স্ত্রী-র পাশে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে। তার রূপ দেখে আর থাকতে না পেরে, চোরটি সেই ঘুমন্ত মেয়েটির সাথে সম্ভোগ করে কিছু না নিয়েই পালিয়ে যায়, কারণ মেয়েটির ঘুম ভাঙতে আরম্ভ করেছিল। বেশি দূর যাওয়ার আগেই লোকে তাকে ধাওয়া করে। তার কাছে সিঁদকাঠি ছিল বলে সে জানত যে ধরা পড়লে ফাঁসি অনিবার্য। ছুটতে-ছুটতে সে এক খোলা জমিতে একটি ডালিম গাছ দেখে তার গোড়ায় নিজের সরঞ্জাম পুঁতে ফেলে। তারপর তার শত্রুদের পিছনে ফেলে সে গা ঢাকা দেয়। কয়েক মাস পরে যখন সে বেরোয়, তখন আবার সেই স্থানে তার সরঞ্জামের জন্য ফিরে যায়। গিয়ে সে দেখে যে গাছটি আর নেই। তখন তার মনে পড়ে যে, গাছটির গোড়াকে সে আঘাত করেছিল তাই গাছটি নিশ্চয় মরে গেছে এবং জ্বালানির জন্য সেটিকে কেটে ফেলা হয়েছে। সেই রাতের অন্ধকারে খোলা মাঠে সে বুঝতে পারল না যে ডালিম গাছটি কোথায় ছিল। দুর্ভিক্ষে তখন বাকি দেশ ছারখার।
সে তাই দেশের রাজধানীর দিকে চলল, যেখানে তার রোজগারের সম্ভাবনা বেশি। পরদিন ভোরে সে শহরের সিংহদরজা দিয়ে সর্বপ্রথম প্রবেশ করে। এসে দেখে, সিংহদরজার কাছে ভিড় জমে আছে। আগের রাত্রে বিল্মানের রাজা মারা গেছেন। প্রথা অনুযায়ী, বিল্মানের নাগরিকরা সিংহদরজার পাশে দাঁড়িয়ে পরদিন প্রথম যে প্রবেশ করে, তাকেই রাজা ঘোষণা করে। এইভাবে সেই চোর বিল্মানের রাজা হয়। তার এই ভাগ্যের ফের সে ভগবানের আশীর্বাদ মেনে নিয়ে, নিজের আগের জীবনের অনুশোচনা করে। তার কুকীর্তির জন্য ভগবান তাকে ক্ষমা করেছেন এই ভেবে সে সুবিচারে এতদিন তার রাজকার্য পালন করেছে, কিন্তু তার সবথেকে বড় অন্যায় তার কাছে লুকানো ছিল এতদিন, যতদিন না এই দুটি প্রেমিক-প্রেমিকা, যারা তার কুকীর্তির জন্য সবার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছে, তাদের গল্প শোনায়।’
সবাই চুপ করে আশ্চর্য হয়ে এই গল্পটি শুনল। রাজা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমি যা আগে করে ফেলেছি তা পাল্টাতে পারব না, কিন্তু শেষবারের মতো রাজা হয়ে আমি এই অন্যায়ের বিচার করব।’ এই বলে তিনি তাঁর মাথার মুকুট লামাদের ওপর রাখলেন এবং লামাদ ও রুম্মনকে বিল্মানের রাজা ও রানি ঘোষণা করলেন।
সারব তার গুহায় ফিরে আবার গণনা করল। এবার সংখ্যা এবং চিহ্নগুলির কুয়াশা ভেদ করে সে বুঝতে পারল যে, দারাজগোশের মিথ্যার জন্য লামাদ ও রুম্মন তাদের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে পেরেছে। সারব তাকে বলল, ‘তুমি আমাকে ওই দুই ক্রীতদাস সম্বন্ধে মিথ্যা বলেছিলে! কিন্তু আগে বলো, তুমি যা জানতে তা জানলে কী করে!’
দারাজগোশ উত্তর দিল, ‘আমি চোরটিকে চাষির ঘরে ঢুকতে দেখেছিলাম। তার ডালিম গাছের গোড়ায় সরঞ্জামগুলিও পুঁতে রাখতে দেখেছিলাম।’ সারব তখন বলল, ‘যে জিন তার মনিবকে মিথ্যা কথা বলে, তাকে পুড়িয়ে ফেলাই নিয়ম, কিন্তু আমি তোমার এতগুলো বছরের একনিষ্ঠতার জন্য ক্ষমা করলাম। তবে তোমাকে আমার কাজে আর রাখতে পারব না, কারণ তুমি একবার আমার কাছে সত্য লুকিয়েছ, আবারও লুকাতে পারো! অতএব, তোমায় আমি মুক্তি দিলাম। উড়ে যাও এখান থেকে আর কোনওদিন ফিরে এসো না। তবে মনে রেখো, তুমি ভগবানের নির্দেশে বাধা দিয়েছ, এ জল অনেক দূর গড়াবে!’
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। দারাজগোশ সারবের গুহা থেকে উড়ে গেল আর অনেকদিন পৃথিবীতে ঘুরল। তারপর একদিন সে আবার প্রথম স্বর্গে উড়ে গেল দেবদূতদের কথা শুনতে। কিন্তু গোমুখী দেবদূতেরা তার পথ চেয়ে বসে ছিল; সে ঢোকামাত্রই তারা আগুন-চাবুক হাতে নিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে আক্রমণ করল। দারাজগোশ সেদিন তার ডানার জোরে পালিয়ে বাঁচল, পিঠে শুধু একটি পোড়া দাগ নিয়ে। তার পরে যতবারই চেষ্টা করেছিল, স্বর্গের দরজায় পাহারা পেয়েছিল। তাই সে ঠিক করল, সে আর কোনওদিন স্বর্গে যাবে না।
আজ আর সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করার গণক নেই। যেদিন থেকে দারাজগোশ ভগবানের নির্দেশে বাধা দিয়েছে, সেদিন থেকে জিনেদের স্বর্গে প্রবেশ নিষেধ; আর যদি কোনও জিন এই নিষেধ অমান্য করে, তাহলে গোমুখী দেবদূতেরা তাদের আগুন-চাবুক মেরে তাড়িয়ে দেয়। রাতের আঁধারে এক নিমেষে আকাশের কোনায় যে-আলো ঝিলিক মেরে চলে যায়, সে এই আলো।
অনুবাদ: যশোধরা চক্রবর্তী
ছবি এঁকেছেন: শুভময় মিত্র