আমার ফোটোগ্রাফার বন্ধু একবার বলেছিল, ‘এ-লাইনে আর কিছু না হোক, এটা বলতে পারব যে হাওড়া থেকে সোনারপুর, প্রায় সব পাড়াতেই আমরা কচুরি খেয়ে-খেয়ে বেড়িয়েছি!’
কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। প্রায় দু-দশক আগে, যখন খবরের কাগজের অফিসে প্রথম চাকরির সুবাদে সকাল দশটা থেকে রাত দুটো অবধি উদয়াস্ত খাটুনির বছর চারেক গিয়েছিল, সেখানে বাকি দিনের আর সব ‘জাঙ্ক ফুড’-এর মধ্যে বোধহয় মুড়ি-বাদাম আর হাতে-গরম কচুরিকেই তুলনামূলকভাবে ‘হেলদি’ আখ্যা দেওয়া যেত।
এ-ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, নামজাদা মিষ্টির দোকানের টেবিল-পেড়ে হিং-এর কচুরি বা কড়াইশুঁটির ভার্সানটা নয়, স্রেফ একটু হিং-গন্ধী, ফুটপাথ-চলতি, স্বচক্ষে ভেজে-উঠতে দেখা যে কচুরি, আমি তার কথা বলছি। দু-একটা খাস নাম-করা দোকানও এর মধ্যে পড়ে যায় অবশ্য, যেমন দেশপ্রিয় পার্কের কাছে মহারাণী আর মহারাজা, লেক রোডের শর্মা’জ, বা ভবানীপুর থেকে থিয়েটার রোড এলাকার মধ্যে একাধিক অন্নরস। কিন্তু এই দু-একটা ‘দোকান’ বাদে আমার কচুরি খাওয়ার কার্বন ফুটপ্রিন্ট যত্রতত্র, উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার সব পাড়ার বুক জুড়ে, এবং আমার বন্ধুর কথায়, শুধু নদীর এ-পারে আবদ্ধ নয়।
এ-সব কচুরির মধ্যে দুটো বড় মিল— এক, এ-চিজ অবাঙালি, এবং দুই, এটা শুধুমাত্র দাঁড়িয়েই খাওয়া হয়। এসি গাড়িতে বসে যারা কচুরি কেন, কোনো কিছুই খায়, তাদের আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। কেন, সে-কথায় একটু পরে আসছি।
খাবারের কথা তো প্রতি কলামেই বলে থাকি। আজকে একটু মানুষের কথা বলি। কলকাতার শহরে পরিযায়ী মানুষের জীবন নিয়ে কেউ যদি কখনও সিনেমা বানাতে চান, যে-কোনো একটা কচুরির দোকানে মাস খানেক সময় দিলে কাহিনী-চিত্রনাট্য-সংলাপ মায় আবহসঙ্গীত-শুদ্ধু একটা গোটা ছবি আরামসে উঠে আসতে পারে। ঠিক রিসার্চ না করলেও, ‘মহারাজা’-র কর্মীবৃন্দের দৈনন্দিন জীবন আমি একবার স্টাডি করেছিলাম, যেহেতু সেটা বাড়ির কাছেই, এবং যেহেতু আমার এক বন্ধু একদম ‘দোকান’-এর উপরেই ভাড়া থাকতেন।
‘দোকান’টা এককালে বাড়িটার একতলার একটা রাস্তার দিকে মুখ করা ঘর ছিল। আমরা যবে থেকে ‘মহারাজা’-তে কচুরি বিক্রি হতে দেখেছি, এই একটা জায়গাতেই দেখেছি; উল্টো ফুটে সুজয়-‘কাহানী’-খ্যাত ‘মোনালিসা গেস্ট হাউস’-এর পাশে বহু দশক আগে যে-দোকানটা চলত, তার নাম ছিল ‘মহারাণী’, যা এখন ফুট বদলেছে, তবে ‘মহারাজা’র তুলনায় ব্যবসা ফিকে। যাই হোক, এই দোকান-ঘর আয়তনে খুব বেশি হলে দশ বাই পনেরো হবে, মেরেকেটে। তারই মধ্যে দানবাকৃতি কড়া, যাতে দোকান খোলা থেকে বন্ধ— মানে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে দুপুর দুটো, আবার বিকেল চারটে থেকে রাত ন’টা—অনবরত তেল ফুটতে থাকে; ভেজে উঠতে থাকে কচুরি, শিঙ্গাড়া, জিলিপি। এখানে কর্মী ছ-জন; একজন ময়দা ঠাসছে, একজন তাল থেকে ময়দা নিয়ে লেচি বানাচ্ছে, একজন কচুরি বেলছে, একজন ভাজছে, একজন ভাজা কচুরি তুলে ঝুড়ি ভরে কাস্টোমার-টু-কাস্টোমার পরিবেশন করছে আর খদ্দেরের থেকে পয়সা বুঝে নিচ্ছে শেষ জন। এটা ‘ফ্রন্ট এন্ড’। ‘ব্যাক এন্ড’-এ কর্মরত আরো জনা-চারেক— একজন (প্রায় টন-খানেক) আলু থেকে আলু বেছে ছাড়াচ্ছে, একজন ঘুটঘুটানন্দের মানুষখেকো ডেকচির মতো একটা ডেকচিতে সেই আলু সেদ্ধ করছে, একজন সিঙ্গাড়ার পুর রান্না করছে আরো একটা কড়ায়, আর শেষের জন সেই রান্না করা পুর সযত্নে ঠেসছে, ঠেসেই চলেছে ত্রিকোণ শিঙ্গাড়ার খোলে। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, এই যন্ত্রবৎ অথচ অসামান্য এফিশিয়েন্সির ক্রমাগত আবর্তটা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখলে নেশা হয়ে যাবে। ‘ব্যাক-এন্ড’-এর ঘরটা আয়তনে আরো একটু ছোট; ১০’x১০’ হবে, দেখে বোঝা যায়, ভাঁড়ার, রান্নাঘর, বা হয়তো বাথরুম ছিল।
যে-অগ্রজসম বন্ধু এই ‘দোকানের’ উপরে ভাড়া থাকতেন, ২০০০ দশকের মাঝের দিকে একসময়ে তাঁর বাড়িতে আমরা বহু রাত অবধি, প্রায়শই পার্টি করতাম। প্রথম দিকে খুব একটা খেয়াল করিনি, তারপর একদিন প্রায় ভোর-রাতে বেরোনোর সময়ে, সেই নো-ননসেন্স, শ্রম-বিশ্বাসী, অসম্ভব পরিশ্রমী রূপকদা’কে একবার ভুল করে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিলাম, ‘এদের (অর্থাৎ মহরাজা-কর্মীদের) শোবার ব্যবস্থা কোথায়?’ এক সেকেন্ডও না ভেবে রূপকদা উত্তর দিয়েছিল, ‘এখানে’, কেননা উত্তরের সঙ্গে-সঙ্গে ওই একফালি প্যাসেজে মাদুর-পাতা ঘুমিয়ে-থাকা এক মহারাজা-কর্মীকে আমাদের ডিসটার্ব না করে ডিঙিয়ে পেরোতে হয়েছিল।
রূপকদা হাই প্রেশারের রুগী, তাই গ্রীষ্মকালে বাড়িতে সবসময়ে ষোলোতে এসি চলত, দিন-রাত নির্বিশেষে। আমার মনে আছে, সময়টা গরমেরই ছিল, আর রাতের কলকাতার গরম আর আর্দ্রতাকে যা-খুশি গালাগাল দিতে-দিতে নিচে নামতে-নামতে এই ঘটনাটা ঘটে।
দশ বাই পনেরোর দোকান-ঘর, যা সারাদিন ওই দানবীয় কড়ার তাপে উত্তপ্ত থাকে, সেখানে পাঁচ জন। কাউন্টারের ম্যানেজার বাঙালি, সে বাড়ি চলে যায়। দশ বাই দশের ঘরে আরো তিন জন। বাকি এক বাইরে। দুটো ঘরেই দুটো হাঁপ-ধরে যাওয়া ছোট টেবিল ফ্যান, যে-দুটোও সারাদিন ধরে উনুনে আঁচ জাগিয়ে রাখতে চলে। কিসের গ্রীষ্ম, কিসের বর্ষা। এসি, না এলিয়েন। ঘুম রাত এগারোটায়, দিন শুরু ভোর চারটে। দিনের পর দিন।
কচুরি বাঁচিয়ে দিয়েছে। কাজের দিনে, বার বার। প্রাতঃরাশের সময় পাইনি, দুপুরের খাওয়া পিছিয়ে হয়েছে বিকেল পাঁচটা, দুপুরের আর রাতের খাওয়ার সময়ের ব্যবধানটা এতটাই বেশি হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে অসুস্থ বোধ হব-হব অবস্থা— দামাল সাংবাদিকতা-জীবনে, যেখানে রুটিন বলে কিছু থাকতে পারেনা, কাজের রুটিন ছাড়া, সেখানে কচুরি বাঁচিয়ে দিয়েছে, দিনের পর দিন। এক মিনিটে হাতে-গরম, পাঁচ মিনিটে খাওয়া, হাত ধোয়া, দাম মেটানো, অন ইয়োর ওয়ে।
খুচরো হলেও, রাস্তার কচুরি কিন্তু মুড়ির মতো সমাজের সর্বস্তরভেদী খাবার নয়— এক পিস হরে দরে পাঁচ থেকে দশ টাকা দাম হতে পারে, দাম নির্ভর করছে শহরের কোন প্রান্তে, কোন পাড়ায় খাচ্ছেন তার উপর। তা-সত্ত্বেও, অফিস-ব্যস্ত স্বল্পপুঁজী কর্মীর পক্ষে আজকের যুগে দাঁড়িয়েও যে ৩০-৪০ টাকায় খাওয়াটা সারা যায়, এটা ভাবা যায় না, এবং এটা সত্যিই কলকাতা ছাড়া ভারতবর্ষের আর কোনো শহরে ভাবা যায় না।
কলকাতা লিট্ মিট। ব্যস্ত সপ্তাহ। সকাল থেকে রাত এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। একটা গোটা বছর পর, অতিমারী পেরিয়ে, টানা পাঁচ দিনের এত বড় একটা অন-গ্রাউন্ড সাহিত্য উৎসব খুবই আনন্দের কারণ। সে যজ্ঞে আমরা তুচ্ছ কিছু এলিমেন্ট। কি খাবো-কি খাবো প্রাণ, কেননা ভেন্যু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, যার চৌহদ্দীর বাইরে ভেলপুরি-ঝালমুড়ি-পাপড়ি চাট ছাড়া আর কেউ কোনোদিন কিছু খেতে যায় না, তাই অন্য কিছু পাওয়াও যায় না। চারদিকে একঝাঁক শিক্ষানবীশ ইন্টার্নদের দৌড়ে-ঝাঁপিয়ে কাজ করতে দেখে ভালো লাগছে, কিন্তু এটাও মনে হচ্ছে, সকাল দশটা থেকে রাত ন’টা অবধি এরা খাচ্ছেটা কি, ভিক্টোরিয়ায়?
আমি জানি না লিট্ মিটের এই ইন্টার্নরা আর কচুরি খায় কি না (আমরা অবশ্য আজকেই একটা খাস্তা কচুরি খেলাম, তাজ বেঙ্গলের কেটারিং-এর, যার নাম ‘টিপনি কচুরি’, নামের মানেটা জানতে হবে), তবে আমার ওদের দেখে মনে হয়েছিল, আমি যদি ওদের দলে পড়তাম, সলিউশন খুব সহজ। রাস্তার ও-ফুটে, পেল্লায় চৌরঙ্গী বিয়াল্লিশের প্রায় গায়ে-গায়েই একটা দানবাকৃতি কড়া। যাতে ফুটছে গোটা তিরিশেক কচুরি।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র