আপনি যদি গাঙ্গেয় উপত্যকা অথবা অসম, বাংলা বা ওড়িশা থেকে আগত কর্মকার শ্রেণির মানুষ হন, তবে খুব সম্ভবত পিতৃপক্ষের শেষের দিকে, নবরাত্রির প্রথম দিন মহালয়ার ঠিক আগে আগে বিশ্বকর্মা পুজো পালন করার অভিজ্ঞতা আপনার নিশ্চয়ই হয়েছে। পিতৃপক্ষে পিতৃগণ অর্থাৎ পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানো হয়, মৃত্যু নিয়েই তার কারবার। আবার নবরাত্রি কিন্তু পুনর্জন্মের কথা বলে। অতএব মৃত্যু এবং পুনর্জন্মের ঠিক মাঝখানে রয়েছে বিশ্বকর্মা পুজো। এর মর্ম বোঝা কঠিন নয়, কারণ বিশ্বকর্মা হচ্ছেন কর্মকারদের আরাধ্য দেবতা, স্বর্গের কর্মকার।
এ পুজোর জন্য নির্দিষ্ট দিনটি হল কন্যা সংক্রান্তি, সূর্য সেদিন কন্যারাশিতে প্রবেশ করেন। বলা হয়, এ দিনেই বিশ্বকর্মা লাঙল আবিষ্কার করেন এবং তা তুলে দেন মানবজাতির হাতে।
বিশ্বকর্মার অন্যন্য নামগুলি হচ্ছে প্রজাপতি (মানুষজনের নেতা), মহারাণা (মহান, কর্মসিদ্ধ কর্মকার), ব্রহ্মণস্পতি (সমগ্র মহাকাশ অথবা সকল স্থানের প্রভু), এবং দক্ষ (যিনি কাজে নিপুণ)। স্থাপত্যশাস্ত্র, বাস্তুশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র, এবং জনবসতি ও ঘরবাড়ি সংক্রান্ত বিভিন্ন শাস্ত্রাদির সাথে তাঁর যোগসূত্র রয়েছে। বিশ্বকর্মাই সম্ভবত প্রথম কর্মকার, এবং বিশ্বকর্মা জাতি বা কর্মকার সম্প্রদায়ের (ছুতোর, এবং কামার শ্রেণীর মানুষ) প্রতিষ্ঠাতা। গ্রিক পুরাণে তাঁর সমগোত্রীয় দেবতা ছিলেন হেফায়েস্টস। রোম-এ ছিলেন দেবতা ভালকান। নানারকম সব যন্ত্রের ব্যবহারের ক্ষমতা রয়েছে বলেই মানুষ পশুর থেকে পৃথক।
বেদে তাঁর নাম ত্বষ্ট্রা। একজন পুরুষ যখন একজন নারীর প্রতি অগ্রসর হন, তাঁকে তখনই স্মরণ করা হয়, কারণ মাতৃগর্ভে শিশুর রূপ তিনিই নির্মাণ করেন, ভ্রূণকে তার সঠিক গঠন দেওয়ার দায়িত্ব তাঁরই উপর। কেউ কেউ এই দেবতার সাথে যোগসূত্র খুঁজে পান ব্রহ্মার সাথে, যিনি সকল প্রাণের স্রষ্টা। প্রথমদিকের বৈদিক শাস্ত্রে তাঁকে বীজরূপে কল্পনা করা হয়; এই বীজের থেকেই পঞ্চ মুনির উৎপত্তি। সপ্তঋষি যেমন নানা ভাবনা বা চেতনার নির্মাণ করেন, এই পঞ্চ মুনি করেন নানা বস্তুর নির্মাণ। এখানেই তাঁদের পার্থক্য।
কেউ আবার বিশ্বকর্মার সাথে যোগসূত্র খুঁজে পান ইন্দ্রের, ঋগ্বেদ অনুসারে ইন্দ্রই প্রথম দেবতা যিনি আকাশ এবং পৃথিবীর আলাদা অস্তিত্ব নিমার্ণ করেন। অতএব চিত্রকল্পে ইন্দ্রর মতোই তাঁকে কল্পনা করা হয় হাতির পিঠে বসা অবস্থায়, হাতে নানারকম যন্ত্রপাতি— যেমন হাতুড়ি, টাকু, ছেনি-বাটালি এবং মাপকাঠি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রহ্মা এবং ইন্দ্রকে একই ঈশ্বর-রূপে কল্পনা করা হয়, স্বর্গের স্রষ্টা এবং আকাশের প্রভু। অতএব সেখানে ব্রহ্মার মূর্তি হাতির পিঠে বসেন। এ ব্যপারে দেড় হাজার বছর আগে ভারতের পূর্ব উপকূলের সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক লেনদেনের ইতিহাসের প্রভাব থাকা সম্ভব।
যেহেতু বাংলায় এই পুজো বেশ জনপ্রিয়, এবং যে কর্মকারেরা এই দেবতার প্রতিমা গড়েন তাঁরাও বাংলারই লোক, বিশ্বকর্মার মূর্তি গড়তে যে কাঠামো ব্যবহার করা হয়, সেই একই কাঠামো ব্যবহার করা হয় কার্তিকের মূর্তি গড়তে। এ কারণেই অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বকর্মার মূর্তিকে কার্তিকের মূর্তি বলে ভুল করা হয়। কিন্তু কার্তিকের বাহন যেমন ময়ূর, বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। আর বিশ্বকর্মার হাতে ধরা থাকে যুদ্ধের অস্ত্র নয়, কর্মকারের যন্ত্রপাতি। আধুনিক পোস্টার শিল্পে অবশ্য বিশ্বকর্মাকে দেখতে কার্তিকের মত কম, ব্রহ্মার মতই দেখায় বেশি; তাঁর বৃদ্ধ মূর্তি, মুখে পাকা দাড়ি, তাঁর বাহন রাজহাঁস, বা হাঁস বলাই ভাল। হাঁস ভারতীয় পাখি, আবার রাজহাঁস ইয়োরোপীয় পাখি, ভারতীয় শিল্পীদের উপর ইয়োরোপীয় শিল্পের বিপুল প্রভাবের হাত ধরেই শিল্পে তার প্রবেশ।
বিশ্বকর্মা নানা নগর নির্মাণ করেছেন; দেবতাদের জন্য অমরাবতী, অসুরদের জন্য হিরণ্যপুর, যক্ষদের জন্য অলকাপুরী, পাণ্ডবদের জন্য মায়াপুর, কৃষ্ণের জন্য দ্বারবতী। সূর্যের তেজের খানিকটা অংশ নিয়ে তা ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেছিলেন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, আবার দধীচির হাড় দিয়ে তিনি গড়েছিলেন ইন্দ্রের বজ্র। তিনি নির্মাণশিল্পের দেবতা, অর্থনীতির সাফল্যের জন্য তাঁরই আশীর্বাদের প্রয়োজন।