সাতাশ বছর হল এই বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছে, ১১ বছর হল রনি মারা গেছে, শেষ সাত বছর ধউলি এই বাড়িতে থাকে না, আর নয় নয় করে বছর তিনেক প্রগতি আর তার চাকর ছাড়া কোনও তৃতীয় ব্যক্তির পা পড়েনি এই বাড়িতে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন— কেউ না।
আর শেষ দেড় বছর তো করোনার ভয়ে নিজের বাড়িরই সিকিউরিটি গার্ড হয়ে কেটে গেল। রাতে বাথরুম করতে ওঠার সময়টা ছাড়া সারা দিনের রুটিনে আর কোনও হেলদোল হয়নি এই দেড় বছরে।
মাঝে শুধু একবার তিন ইঞ্চি সাদা ফাতনাটা ঝুপ করে জলের নীচে ডুবে গেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সব্য এসেছিল জীবনে। কিন্তু খুব চটজলদি, তালেগোলে-অম্বলে, ব্যাপারটার ইতি হয়ে গেছিল। ভাগ্যিস! জানাজানি হলে কী বলত লোকে? ‘বুড়ি বয়সে ভীমরতি’। এ জীবনে মন্দ মেয়ে আর হওয়া হল না।
জীবনে ভাল বউ বা ভাল মা হওয়া হল না। বিয়ের পর থেকে, জীবনের ভালবাসার রস তাকে তার পাঠকদের সঙ্গেই লেপটে রাখল। সেই ভালবাসা কাটিয়ে সংসারকে প্রাধান্য দেওয়াটা তার মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে পারল না। বেশ কয়েকবার ক্ষণিকের আবেগে মনে হয়েছে, একবার মা হওয়ার স্বাদ পেলে হত। কিন্তু সেই চিন্তা স্থায়ী হয়নি।
জীবনে মাস্টারপিসটা আর লেখা হয়ে উঠল না। সব মিলিয়ে-জুলিয়ে ২২টা বই আর অগুন্তি আর্টিকল প্রকাশিত হয়েছে তার, এই ৩০ বছরে। মনে আছে, বিয়ের পর প্রথম লেখাটা শেষ করে প্রগতির মনে হয়েছিল, আজ থেকে এটাই তার পেশা। বাকি জীবনটা লেখালিখি করেই কাটাবে সে।
তাই লেখাটা একটা নামি ম্যাগাজিনে মনোনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের রিপোর্টারের চাকরির রেজিগনেশন লেটারটা লিখে ফেলতে একটুও দেরি হয়নি তার। আজ আর একটা লেটার লেখার পালা, জীবনের শেষ লেটার।
ভাবতে শুরু করলে আরও কত কিছুই তো বেরোবে, যা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করা হয়ে ওঠেনি। অফকোর্স, আজকের পরে আর হবেও না।
২.
লেখার টেবিলের সামনের জানলা দিয়ে আকাশে একটা লালচে আভা জানান দিচ্ছে, তারিখটা বদলে যাচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত হৃদ্স্পন্দন প্রগতির কানে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে, সে এখনও বেঁচে আছে।
কিন্তু এমনটা তো একেবারেই হওয়ার কথা ছিল না। এতদিন পৃথিবীর বুকে তার বর রনি বা তার সৎ মেয়ে ধউলির মতো বহু প্রাণ, প্রগতির কথা রাখেনি। কী অদ্ভুত, আজ মৃত্যু অবধি তার কথা রাখল না!
১৮ এপ্রিল প্রগতির জন্মদিন। মনে মনে ২০২১-এর দিনটাকেই সে পৃথিবীতে নিজের শেষ দিন হিসাবে রেখে যেতে চেয়েছিল।
মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে মানুষের মনটা অনেকটা ব্ল্যাক হোল-এর মতো হয়ে যায়। সারা জীবনের সমস্ত অপাংক্তেয় বিশ্লেষণ ছোট্ট মস্তিষ্কের ওপর নিজেদের সশব্দ বর্ষণ করতে শুরু করে। বিবিধ ভাবনার পাহাড় কেটে প্রগতি যখন নিজের সামনে রাখা সাদা খাতাটার দিকে তাকাল, তার চোখে পড়ল শুধু তিনটি লাইন, যা সারা রাত জুড়ে লিখতে চেষ্টা করা বাকি দশটা ছিঁড়ে দেওয়া লেখার মতোই এতটাই সাধারণ এবং মেলোড্রামাটিক যে, সেটা প্রগতি দত্তর মতো খ্যাতনামা লেখিকার সুইসাইড নোট হতেই পারে না। অগত্যা আবার একটা পাতা ফড়ফড় করে প্যাড থেকে ছিঁড়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিল সে।
কিন্তু এটাই বা কী করে মেনে নেওয়া যায় যে, প্রগতি দত্তর মতো সাহিত্যিকের শেষ সৃষ্টি সাধারণ হবে? এই তো হবে তার অধরা মাস্টারপিস। হতেই হবে।
পরক্ষণে আবার মনে হয়, একটা সুইসাইড নোট, সমাজ যাকে সাহিত্যের উঠোন থেকে সটান বহিষ্কার করেছে ‘নোট’ বলে তকমা দিয়ে, যার ভাগ্যে ‘লেটার’ পদবিটাও জোটেনি, তাকে তার সারা জীবনের শৈল্পিক অন্বেষণের মধ্যে মাস্টারপিস বলে বসিয়ে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
কিন্তু জীবনটা তো একটুও বাড়াবাড়ি না করে একদম ছাপোষা ভাবেই কেটে গেল, এখন নাহয় হলই একটু বাড়াবাড়ি। মৃত্যুকে যদি খ্যাতির ময়দানে জীবনের অবদানগুলোর সঙ্গে লড়িয়ে দেওয়া যায়, সেখানে জীবন বা মৃত্যু যেই জিতুক, জিতবে তো আসলে প্রগতিই।
৩.
প্রগতির এই সুদীর্ঘ শিল্পী-জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, দু’রকম সময়ে শিল্পীর সাহিত্য রচনা বাধা পায়। এক, যখন মাথায় কোনও ভাবনাই সুস্থির ভাবে গঠনমূলক রূপ নেয় না। দুই, যখন বিবিধ ভাবনার ফোয়ারা মাথার ভেতর একসঙ্গে উথলে ওঠে। যখন এমত পরিস্থিতি আসে, বেশি কিছু না করে, মাথা ঝুঁকিয়ে খানিক সময়ের জন্য পেন-খাতা থেকে দূরে সরে যাওয়াই বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে প্রগতির সমস্যাটা হল, তার নিজেকে দেওয়া নিজের গ্রেস পিরিয়ড।
ঠিক কতক্ষণের বিরতি এক অমলিন ইতিহাস সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত? আদৌ কি সে পারবে এমন একটা কিছু লিখে যেতে, যা তার আত্মহত্যাকে গ্লানির কবর থেকে তুলে এতটাই মহিমান্বিত করবে যে, পরবর্তী প্রজন্ম তাকে সব কিছুর ওপরে, তার মৃত্যুর চিন্তনবোধ দিয়ে মনে রাখবে?
হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে আসা ভোরের হাওয়ায় প্রগতির মুখে সটান এসে ধাক্কা মারল কয়েকটা কবিতার লাইন—
‘মৃত্যু টুকরো-ফুকরো হয়ে বসে আছে পাশে
কলকাতার রাস্তা ভেজে গঙ্গার বাতাসে
এভাবে কি যাবে দিন? এভাবেই যাবে?’
সারা রাতের সমস্ত জাবর কাটা, ঘিনঘিনে, হড়হড়ে, জোলো ভাবনার দলা-পাকানো পিণ্ডটা এই কবিতার লাইনগুলোতে আহত হয়ে শরীরে হারিয়ে গেল। চোখে ঘুম নেমে এল।
৪.
শেষ এক সপ্তাহ প্রগতি মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছে। মনে আছে, উনপঞ্চাশে মেনোপজ-এর পরে পরে, অদ্ভুত ভাবে, ব্রা পরে যৌনাঙ্গকে সুঠাম ভাবে আগলে রাখার তাগিদটা কমে গিয়েছিল একদম। খুব ভেবেচিন্তে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা নয়, এমনিই হয়ে গেছিল। ঠিক একই ভাবে আজ সর্বাঙ্গের মুক্তির যুদ্ধে নেমেছে সে। যে মানুষটা স্বেচ্ছায় নিজেকে মৃত্যুর কোলে উজাড় করে দিচ্ছে, তার কি আর নীল রং-এ ভয় থাকে?
তাহলে বাপু মাস্কটা নাহয় এবার তোলাই থাক। বাড়ি ছেড়ে একটু-আধটু বেরোতে তো হয়ই। করোনার দ্বিতীয় ভাগের ঢেউ এতটাই মারাত্মক যে, বাইরে বেরোলে ভয়ার্ত মুখগুলো বহুবার প্রগতির দিকে কটূক্তি ছুড়ে দিয়েছে, মাস্ক না-পরার জন্য। মজাটা হল, খারাপ লাগার থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতার স্বাদ বয়ে এনেছে এই সমস্ত ভেসে-আসা চিৎকার। দেহকে নিজের ভালবাসার গণ্ডির বাইরে রাখার স্বাধীনতা— এ এক অনবদ্য স্বাদ। হঠাৎ তার ইচ্ছে হয় ফেসবুকে একটা স্টেটাস দিতে— ‘মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় নিজের জন্য সাজিয়ে নিন, ঠিক যেমন প্রথম প্রণয়ের রাতে নিজের সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে খানিকটা নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন। দেখবেন ঘড়ির টিকটিক-এ বাঁধা হাতে-গোনা সময়টা সঙ্গমের চেয়েও বেশি আনন্দ দেবে।’ এই সময়টাতে জীবনের প্রতি তৈরি হওয়া বিতৃষ্ণাগুলো মৃত্যুর আবেগের নীচে শহিদ হয়ে যায়, আর মনের ভেতর সেই ফাঁকে জায়গা করে নেয় কলকাতার রাস্তা-ভেজা গঙ্গার বাতাস অথবা নজরুল মঞ্চের দর্শকাসন থেকে ভেসে আসা অসংখ্য গুণগ্রাহী পাঠকের হাততালির অনুরণন। একটা পজিটিভিটির ঢেউ আছড়ে পড়ে ধমনীগুলোতে। আহা, এমন ভাবেই যদি বাঁচা যেত! ফোনটা বের করে নীল রঙের ‘এফ’ লেখা আইকনটাতে আঙুল ছোঁয়াতে গিয়ে প্রগতি বাস্তাবের সাথে ধাক্কা খেল।
এটা একটু ইমোশনাল বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? ঠিকই, সে একজন সাহিত্যিক এবং স্বভাবতই তার মনের অনেকখানি জুড়ে কল্পনার পাখা মেলা থাকবে সে ব্যাপারে তার ফেসবুক ফলোয়াররা অবগত। ফলত এই রকম একটা স্টেটাসকে সিরিয়াসলি নিয়ে লোকজন তার বাড়ি ধাওয়া করবে, এমনটা সত্যি নয়। কিন্তু তাই বলে এই ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।
৫.
প্লাস্টিকের চেয়ারটাকে পায়ের চেটোর আঘাতে উল্টে ফেলে দিতেই গলার কাছে একটা দলা-পাকানো নিঃশ্বাসের ড্যালা আটকে গেল। প্রচণ্ড একটা কষ্ট মাথাটাকে একবারে অবশ করে দিচ্ছে। চিৎকার করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও কোনও লাভ হল না। একটা গোঙানি ছাড়া আর কিছু বেরোল না। চোখ দুটো এমনভাবে বাইরে বেরিয়ে আসছে যেন দেহের নিঃশ্বাস নাক-মুখের পথ বন্ধ পেয়ে এবার চোখ ঠেলে বেরোতে চাইছে। দুটো হাতের দশটা আঙুল প্রাণপণে গলার ফাঁস আলগা করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় একটা ঝনঝন শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল প্রগতির। আর নিঃশ্বাসের ড্যালাটা মুখ দিয়ে উগরে এল।
দু’ঢোক জল গলায় পড়তে শরীরটা একটু ভাল লাগার কথা। কিন্তু অস্বাস্তিটা যেন যেতেই চাইছে না। এখনও সে তার গলায় দড়ির ফাঁসটা অনুভব করছে। সারা গা থেকে যেন আগুন ঝরছে, যেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পরেও যখন প্রগতির শরীর তার দুঃস্বপ্নের আগ্রাসন থেকে বেরোতে পারল না, তখন ধীর পায়ে সে তার একফালি ছোট্ট বাগানটার দিকে উঠে গেল। বাইরের হাওয়ায় গেলে যদি এই মারাত্মক সাফোকেশনটা থেকে একটু রিলিফ হয়। যেতে যেতে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। সকাল ১১টা ৪০।
৬.
আরও ২৪টা ঘণ্টা কেটে গেছে তার জন্মদিন পার হবার পর। কালকের সারা দিনটা চরম দুর্বলতা আর স্বপ্নের সেই দমবন্ধ অনুভবটা নিয়েই কেটেছে। খাতা-কলম হাতে নিয়ে আরও কয়েকবার প্রগতি চেষ্টা করেছে তার ঐতিহাসিক মৃত্যুর চিঠি লিপিবদ্ধ করার, কিন্তু প্রতিবারই তার শরীর এবং মনের বয়ে নিয়ে চলা দুঃস্বপ্নের স্বাক্ষর তাকে বিপথগামী করতে চেয়েছে। বরং শেষ কয়েকদিনের মৃত্যুভাবনার বৈচিত্রময়তা একটা উপন্যাসের কয়েকটা চরিত্রের আবছা অবয়ব তৈরি করেছে তার মনে, আর এইগুলোই প্রগতির কাগজ-কলমকে টানছে।
আসলে, এই যে অদ্ভুত মানসিক অবস্থান, এই যে মৃত্যুকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ছুঁয়ে আসার অভিজ্ঞতা, এই সবই ভয়ঙ্কর রকম নতুন।
মৃত্যুর হাতছানির সঙ্গে প্রগতির এই শৈল্পিক আকাঙ্ক্ষা এক দ্বন্দ্বে মেতে উঠেছে। কে জিতবে আর কে হারবে? হয়তো এটাই হবে প্রগতির সেই মাস্টারপিস!
দ্য অ্যানসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড!
৭.
— স্যার, সব মিলিয়ে ২২টা অসমাপ্ত সুইসাইড নোট আর একটা নতুন উপন্যাসের প্রথম দু’পাতার পাণ্ডুলিপি।
হাত বাড়িয়ে লোকাল অফিসারের হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে তার জিপের পিছনের সিটে রাখা ল্যাপটপ-ব্যাগটার ভেতর সযত্নে চালান করে দিল সাত্যকি। খুব সংবেদনশীল কেস। বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রগতি দত্তর অকস্মাৎ মৃত্যু বলে কথা।
তাঁর দেহ আবিষ্কার হয় আজ সকালে, যখন তাঁর চাকর দ্বিতীয় দিন বেল বাজিয়ে উত্তর না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় একটা পচা গন্ধ পায়। সে প্রতিবেশীদের খবর দেয় এবং তারা সকলে এসে সদর দরজা ভেঙে সাহিত্যিকের মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং পুলিশে খবর দেয়।
সাত্যকির লম্বা পুলিশি অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই মিলছে না। এ কী ধরনের আত্মহত্যা? এতগুলো অসমাপ্ত সুইসাইড নোট! দেহে ঘুমের ওষুধ বা বিষের কোনও লক্ষণ নেই।
ঘণ্টা ছয়েক লাগল। সাত্যকির মেল-বক্স-এ একটা মেল ঢুকল। ‘ফরেন্সিক রিপোর্ট— প্রগতি দত্ত।’
সঙ্গে সঙ্গে পিডিএফ-টা ওপেন করেই সাত্যকি তৃতীয় পাতায় নেমে এল, সটান চোখ স্থির করল সেখানে, যেখানে লেখা আছে— সাসপেক্টেড রিজন অফ ডেথ— ‘কোভিড ১৯’।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র