ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ২৭


    বিমল মিত্র (August 27, 2021)
     

    পর্ব ২৬

    কে. আসিফ সাহেব বিখ্যাত ডাইরেক্টর। কদিন আগেই তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘মুঘলে আজম’ ছবিতে কোটি-কোটি টাকা মুনাফা উঠেছে। তার আসর তখন সরগরম। দোতলার একটা বিরাট ঘরে তখন আসর জাঁকিয়ে সবাই বসেছে সবে। দু-একজন মহিলা আছে। গুরু দত্তের স্টুডিওর ম্যানেজার গুরুস্বামীও সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছে। গুরুর গুজরাটি বন্ধু কাঞ্জিও আছে। আর আছে কিছু গল্পলেখক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা। এক-কথায় আসর সরগরম। পরে জেনেছিলাম এরকম আসর প্রতিদিন রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত বসে। তিনটের আগে কোনোদিনই আসিফ সাহেবের আসর ভাঙে না—

    একটা অদ্ভুত কারণে এই দিনকার আসর আমার কাছে স্মরণীয়। অনিল বিশ্বাস; আমার বহুদিনের পরিচিত বন্ধু। এককালে কলকাতায় যখন হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানির অক্রুর দত্ত লেনের অফিসে আমার আড্ডা ছিল, সেখানেই অনিলের সঙ্গে আলাপ। তখন সে নগণ্য ছিল, পরে বোম্বাইতে এসে সুবিখ্যাত হয়েছে। শুনেছি সেখানে সে বিয়ে করেছে। সন্তান হয়েছে তার। কিন্তু আমার সঙ্গে তার বহুদিন কোনও যোগাযোগ নেই।
    এতদিন পরে সেই তার স্ত্রীকে দেখলাম। তার মেয়েকে দেখলাম। অবাক হয়ে গেলাম তাদের এই আসরে দেখে। আমি আমার পুরনো পরিচয় দিয়ে তাদের আর বিব্রত করলাম না, কিন্তু এই রাত পর্যন্ত তাদের উপস্থিতি দেখে বিস্মিত হলাম শুধু।

    গুরু আসিফ সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলে।
    আসিফ সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন— জানো গুরু, এই ‘সাহেব বিবি গোলাম’ গল্প ঘটনাচক্রে তোমার কাছে গেছে, নইলে এ ছবি আমিই করতুম।
    জিনিসটা ঠিক। চিঠিপত্র যখন আসিফ সাহেবের সঙ্গে চলছিল, তখনই হঠাৎ গুরুর লোক এসে রফা করে নেয়। এখন আসিফ সাহেবের চেহারাটা দেখলাম। বেশ বলিষ্ঠ পাঞ্জাবি মুসলমান, ভারি অমায়িক আর রসিক মানুষ। গুরুর মতোই গল্প-রসিক লোক। দিলদরিয়া মেজাজ। রোজ আসরে বসে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে রাত্রের খাওয়াটা সারেন।

    প্রচুর খাবা এল। মাংসের নানা রকম পদ। অত্যন্ত সুস্বাদু। খেতে-খেতে গল্প চলতে লাগল। সবাই দল বেঁধে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি দেখে এসেছে। সুতরাং টাটকা-টাটকা আলোচনা চলতে লাগল। ছবি ভালো হয়েছে কি খারাপ হয়েছে সেই আলোচনা।
    আসিফ বললে— গুরু, তোমার ছবির শেষটা ভালো হয়নি—
    গুরু জিজ্ঞাসা করলে— কেন?
    আসিফ বললে— শেষকালে ছবিটা ট্র্যাজেডি না করে কমেডি করলেই ভালো হত, তোমার ছবি পয়সা দিত—
    জিনিসটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলল। কথাটা আসিফ সাহেবের মুখ থেকে বেরিয়েছে। একেবারে ফেলে দেবার মতো কথা নয়।

    কথাটা নিয়ে তর্ক চলল। একবার যখন তর্ক চলে তখন তো তার আর শেষ থাকে না। কথাটার পক্ষে-বিপক্ষে নানারকম যুক্তি দেখাতে লাগল গুরু। আমাকে সাক্ষী মানা হল, কারণ আমি গল্পটার লেখক। কিন্তু আমি কোনও পক্ষেই রায় দিতে পারি না। আমি এখানে নিরপেক্ষ।

    কথাটা শুনে মনে হল গুরু যেন কেমন দমে গেছে। আরো রাত বাড়তে লাগল। আসিফেরও সংসার আছে, স্ত্রী পুত্র আছে। তারাও সমানে জেগে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ এক সময় গুরুর পান ফুরিয়ে গেল। তখন হয়তো খেয়াল হল যে ঘুমোবার জন্যই কিছুটা সময় দিতে হয়।
    আসলে ঘড়িতে তখন রাত চারটে। বলতে গেলে সকালই হয়ে গেছে। কিন্তু গুরুর মনটা তখন ভার-ভার। এত দিনের এত অর্থের আয়োজন, এত পরিশ্রম যে-ছবির পেছনে সে ছবি তাহলে কি সমস্ত পন্ডশ্রম?

    যথারীতি রাত পোহাল। রাত্রি তা যত উদ্বেগের রাতই হোক, তা তো পোহাবেই। মানুষের আশা-উদ্যম-দুঃখ-বেদনা-আনন্দ সব কিছুই অস্বীকার করেই দিন-রাতের পরিক্রমা চলে।
    সকালবেলা আবার দেখা হল ড্রয়িংরুমে। গুরু ঘুম থেকে উঠেছে। সকাল থেকেই একটার পর একটা টেলিফোন আসছে। বন্ধু-বান্ধবরা টেলিফোনে জানাচ্ছে কার কেমন লেগেছে ছবিটা। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে কেউই গৃহস্বামীর আতিথেয়তা কিংবা আয়োজনের নিন্দে করে না। সেইটেই হল রীতি।

    রাত্রি তা যত উদ্বেগের রাতই হোক, তা তো পোহাবেই। মানুষের আশা-উদ্যম-দুঃখ-বেদনা-আনন্দ সব কিছুই অস্বীকার করেই দিন-রাতের পরিক্রমা চলে। সকালবেলা আবার দেখা হল ড্রয়িংরুমে। গুরু ঘুম থেকে উঠেছে। সকাল থেকেই একটার পর একটা টেলিফোন আসছে। বন্ধু-বান্ধবরা টেলিফোনে জানাচ্ছে কার কেমন লেগেছে ছবিটা। সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে কেউই গৃহস্বামীর আতিথেয়তা কিংবা আয়োজনের নিন্দে করে না। সেইটেই হল রীতি



    গুরুও সেটা জানত। তাই তাতে বিচলিত হল না। দুদিন কেটে গেল। টেলিফোনে চারদিক থেকে বুকিং-এর রিপোর্ট আসছে। শেষের দিকে নাকি দর্শকরা উসখুস করছে। যেন ভালো লাগছে না তাদের। শেষটা যেন তাদের মনঃপুত হয়নি। তবে কি ছবি চলবে না? টিকিট বিক্রি কেমন এগোচ্ছে? হাউস ফুল চলছে। কিন্তু টান নেই তেমন।

    সত্যিই যদি তাই হয়তো ভয়ের কথা। সেদিন রাত্রে গুরু আমাকে নিয়ে গেল আবার কে. আসিফের বাড়িতে। সেদিনও ঠিক তেমন আড্ডা বসেছে। রিপোর্ট কেমন? না, মন্দ নয়, তবে খুব ভালো নয়।
    আসিফ সাহেব বললে— শেষটা কমেডি করো, ভালো লাগবে—
    গুরু জিজ্ঞেস করল— কি করে করব?
    আসিফ সাহেব বললে— শেষকালে ছোট বউ মদ খাওয়া ছেড়ে দিলে। সুস্থ হয়ে উঠল। স্বামী-স্ত্রীতে মিল হয়ে আবার সংসার জ্বলজ্বল করে উঠল—
    কথাটা আবার ভাবতে লাগল গুরু।

    আমি কলম নিয়ে আমার ‘সাহেব বিবি গোলামে’র গল্প বদলাতে চেষ্টা করতে লাগলুম। যে গল্প লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি পাঠকের বুকে গাঁথা হয়ে গেছে, তাকে বদলানো সোজা কথা নয়। নিজের বুকের পাঁজর নিজের হাতে ভাঙার মতো! কিন্তু তা হোক, যত কষ্টই হোক তাই-ই আমাকে করতে হবে। তাতে যদি গুরুর ব্যবসায় লাভ হয় তো হোক। তার এতদিনের পরিশ্রম, এতদিনের রাতজাগা, এত বড় স্টুডিও, এত স্টাফ ভরণপোষণের দিকটা বড় না আমার বানিয়ে-বানিয়ে লেখা গল্পটাই বড়ো। আবার নতুন করে শুটিং করতে হবে।



    অনেক রাত্রে বাড়িতে ফিরে যে-যার ঘুমোতে গেলাম। রাত্রে গুরু ঘুমোতে পারলে না। মুহুর্মুহু টেলিফোন। দিল্লি-পাঞ্জাব-বোম্বাই-এর সবগুলো সিনেমা-হাউসে মিনিটে-মিনিটে টেলিফোন করতে লাগল। ম্যানেজার গুরুস্বামী, আত্মা থেকে আরম্ভ করে সবাই ঘন-ঘন আসতে লাগল। বড় খারাপ রিপোর্ট। টিকিটের টান নেই।
    শনিবার সকালবেলা আবরার আল্ভিকে ডেকে আনা হল বাড়ি থেকে। সে এল। গুরু বললে— ছবির শেষটা বদলাতে হবে, উসকো কমেডি করো—
    আবরারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তর্ক করতে লাগল, যুক্তি খুঁজে বার করতে লাগল— সে-গল্প তো এ গল্প নয়! এ তো ফরমূলার গল্প নয়। এ তো জীবন আর জীবন সংগ্রামের হিউম্যান ডকুমেন্ট!
    তবু গুরু নাছোড়বান্দা। সে-ই ছবির মালিক। তার কথাই গ্রহণযোগ্য। অন্যদের তার হুকুম মানা কাজ! আর আমি? আমার গল্প আপনার সুবিধের জন্য। যেমন খুশি বদলান, তাতে আমার কোনও ক্ষতি নেই। আমার ছাপানো বই আছে। হিন্দি-বাংলা, সমস্ত ভাষায়। পাঠক-পাঠিকাদের অন্দরমহলে, এমন কি রান্নাঘরে পর্যন্ত ঢুকে গেছে। হাজার বিকৃত করুন তাকে, সেখান থেকে হঠাতে পারবেন না।

    আলোচনা করতে-করতে গুরু হঠাৎ উঠে চলে গেল। বোধহয় তখন তার পাগল হতে শুধু বাকি। আমি আর আবরার ঘরের ভেতর বসে রইলাম হতবুদ্ধি হয়ে।
    আবরার ভাবতে লাগল মুখ গম্ভীর করে। আর আমি কলম নিয়ে আমার ‘সাহেব বিবি গোলামে’র গল্প বদলাতে চেষ্টা করতে লাগলুম। যে গল্প লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি পাঠকের বুকে গাঁথা হয়ে গেছে, তাকে বদলানো সোজা কথা নয়। নিজের বুকের পাঁজর নিজের হাতে ভাঙার মতো!
    কিন্তু তা হোক, যত কষ্টই হোক তাই-ই আমাকে করতে হবে। তাতে যদি গুরুর ব্যবসায় লাভ হয় তো হোক। তার এতদিনের পরিশ্রম, এতদিনের রাতজাগা, এত বড় স্টুডিও, এত স্টাফ ভরণপোষণের দিকটা বড় না আমার বানিয়ে-বানিয়ে লেখা গল্পটাই বড়ো।
    আবার নতুন করে শুটিং করতে হবে। আবার নায়িকা মীনাকুমারীকে খবর দেওয়া হল সব কথা বুঝিয়ে। স্টুডিওর সেটটা ভাঙা হয়ে গিয়েছিল, আবার তাড়াতাড়ি করতে বলা হল। তারা আবার কাজ আরম্ভ করে দিল।

    সব তৈরি হয়েই ছিল। আমার লিখতে একটু বাকি ছিল, তাও শেষ করে ফেললাম। তখন বিকেল চারটে। শুধু আবরার সেটার হিন্দি অনুবাদ করে দিলেই স্ক্রিপ্ট সম্পূর্ণ হবে। হঠাৎ গুরু এসে হাজির।চেয়ে দেখি খুব চিন্তিত। বললে— না বিমলবাবু, আমি ভেবে দেখলুম, ও যেমন আছে, তেমনিই থাকবে। আমি ছবির শেষটা বদলাবো না—
    আমি তো অবাক গুরুর কথা শুনে। গুরু আবার বলতে লাগল— কেউ ছবি না দেখুক, আমার লাখ-লাখ টাকা লোকসান যাক, তাতে আমার কিছু ক্ষতি নেই, কিন্তু ছবি আমি বদলাব না, বদলাবার ছবি এ নয়। এর জাত আলাদা। লোকে বোঝে তো ভালো, যদি না বুঝতে পারে তো তাদেরই ক্ষতি, আমার লোকসান নেই—

    আমি গুরুর কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। গুরু তখনও বলছে— কে. আসিফ যাই বলুক, আমিও একজন ডিরেক্টর, আমারও বুদ্ধি বিবেচনা আছে। সমস্ত দুপুরটা আমি ভেবেছি। ও আমি কিছুতেই বদলাব না—
    আমি তখনও তার মুখের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে দেখছি।

    সেইদিনই প্রথম বুঝতে পারলাম যে গুরু কত বড় আর্টিস্ট! তাকে শুধু অভিনেতা বললে ভুল বলা হবে, শুধু রসিক বললেও ঠিক বলা হবে না। গল্প-লেখক বা ঔপন্যাসিক হলে সে মস্তো বড় লেখক হত, এ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook