অরণ্যের সঙ্গে গ্রামের ক্রমাগত তুলনামূলক বিচার ব্যতীত হিন্দু দর্শনের অর্থ করা যায় না। সামবেদে এই বিভাজনের সূত্রপাত। রামায়ণ এবং মহাভারত, এই দুটি মহাকাব্যের উদ্দেশ্য যেহেতু বৈদিক মূল্যবোধের প্রচার, আর তাই এই দুই মহাকাব্যে অরণ্যের বিপুল ভূমিকা আশ্চর্যের নয়। রাজপুত্রেরা নির্বাসিত হয়ে অরণ্যেই আসেন, সেখানেই মুনিঋষি, রাক্ষস, জন্তু-জানোয়ার এবং বিচিত্র সব জীবদের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। মহাভারত খুঁটিয়ে পড়লে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়।
সে অনেকদিন আগে এক অরণ্যে বাস করত পাঁচজন অনাথ, পাণ্ডুর পুত্র বা পাণ্ডবরা। মায়ের কাছেই তাঁরা মানুষ, তাঁদের বাবা মারা গেছেন। তারপরে একদিন মায়ের কাছেই তাঁরা জানতে পারেন, আসলে তাঁরা রাজপুত্র, রাজপরিবারের মানুষ। মা সেই জঙ্গল থেকে এর পরে তাঁদের নিয়ে যান পিতৃগৃহ হস্তিনাপুরে, যেখানে তাঁরা রাজার ছেলের মতো মানুষ হবেন।
তাঁদের ছিল কৌরব নামে একশোজন জ্যাঠতুতো ভাই, যাঁরা তাঁদের, অর্থাৎ পাণ্ডবদের মোটেও পছন্দ করতেন না। তার প্রধান কারণ, পাণ্ডবেরা ছিলেন বড় বুদ্ধিমান, বড় মেধাবী। কৌরবেরা যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন, যাতে পাঁচ ভাইকে যথাসম্ভব অনাহূত অনুভব করানো যায়। তাঁদের খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতেন কৌরবরা, এমনকী শেষে পাণ্ডবদের প্রাসাদে আগুন লাগিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে পাঁচ ভাই ফিরে গেলেন অরণ্যে, এবারে উদ্বাস্তু রূপে।
অরণ্যেই তাঁরা বসবাস করতে শুরু করলেন। বক, হিড়িম্ব, বা জটাসুরের মতো রাক্ষস বা বর্বর দানবদের সঙ্গে তাঁদের লড়াই করতে হল। তাঁদের এক ভাই রাক্ষসদের রাজকন্যা হিড়িম্বাকে বিবাহও করলেন। অবশেষে, তাঁরা এক তিরন্দাজির প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে, পুরস্কার হিসেবে পাঁচ ভাই মিলে এক রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারলেন। এই রাজকন্যাকে পাশে পেয়ে পাঁচ ভাইয়ের মনে হল, এবার তাঁদের পিতৃগৃহে ফিরে গিয়ে নিজেদের অংশের উত্তরাধিকার দাবি করার যোগ্যতা হয়েছে। একশো ভাই বাধ্য হয়ে পাণ্ডবদের হাতে খাণ্ডবপ্রস্থের অরণ্যটি সমর্পণ করলেন। অতএব পাণ্ডুর পুত্রেরা আবার অরণ্যে ফিরে গেলেন, এবারে ভূস্বামী হিসেবে।
পাণ্ডবেরা এই অরণ্যটি পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে ইন্দ্রপ্রস্থ নগর প্রতিষ্ঠিত করলেন। কিন্তু যেহেতু এই নগর একটি অরণ্যকে পুড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা, ওই অরণ্যের সমস্ত দগ্ধ প্রাণীদের অভিশাপ পড়ল তাঁদের উপর। সাফল্যের মুখ দেখে তাঁরা অহঙ্কারী এবং অধিক আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। নির্বোধের মতো একটি জুয়া খেলার আমন্ত্রণ তাঁরা স্বীকার করলেন, এবং জুয়ায় গোটা রাজত্ব হেরে সর্বস্বান্ত হলেন। তেরো বছরের জন্য নিজেদের রাজত্বের উপর অধিকার ত্যাগ করে তাঁরা আবার অরণ্যে ফিরে গেলেন নির্বাসনে।
এই নির্বাসনের সময়েই পাণ্ডবরা তাঁদের রাজকীয় অহঙ্কার ত্যাগ করে বিনীত হতে শিখলেন। তাঁরা শিখলেন যে, প্রকৃতির বুকে তাঁদের কেউ রাজা হিসেবে দেখে না। অরণ্যে রয়েছে কেবল শিকার এবং শিকারী। তেরো বছরের শেষে তাঁরা নিজেদের রাজত্ব পুনরাধিকার করতে ফিরে গেলেন, কিন্তু তাঁদের ভাইয়েরা সে অধিকার ফিরিয়ে দিতে নারাজ হলেন। এর ফলে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হল, তাতে কৌরবরা সবাই প্রাণ দিলেন। পাণ্ডবেরা শুধু নিজেদের রাজত্ব নয়, তার সঙ্গে তাঁদের পিতার রাজত্বও দখল করলেন। ত্রিশ বছর তাঁরা বুদ্ধিমানের মতো সুশাসন করলেন, তারপরে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে রাজ্যের ভার তুলে দিয়ে সন্ন্যাসীর বেশে অরণ্যে ফিরে গেলেন।
কিন্তু মৃত্যুর পরে যখন তাঁরা স্বর্গে গেলেন, তাঁরা দেখলেন স্বর্গে তাঁদের শত্রুপক্ষের জ্যাঠতুতো ভাইয়েরাও ঠাঁই পেয়েছেন। এতে তাঁদের রাগ হল। দেবতারা তখন তাঁদের মনে করিয়ে দিলেন, মর্ত্যে কৌরবেরা রাজ্যের ভাগ তাঁদের দিতে রাজি হননি। এখন মৃত্যুর পরে পাণ্ডবেরা নিশ্চয়ই তাঁদের স্বর্গরাজ্যের ভাগ দিতে অস্বীকার করবেন না? না হলে দুই পক্ষের মধ্যে আর তফাত কোথায় রইল? স্বর্গ অরণ্যের মতো নয়, সেখানে সবাই বেঁচে থাকে। আবার স্বর্গ অরণ্যেরই মতো, সেখানে পক্ষপাতিত্ব নেই।
অতএব পাণ্ডবদের জীবনের শুরুতে আমরা দেখতে পাই অনাথরূপে, অরণ্যে। এর পরে তাঁরা উদ্বাস্তুর বেশে অরণ্যে ফিরে আসেন, তারপরে ভূস্বামীর রূপে, তারপরে নির্বাসনে এসে অরণ্যে তাঁদের বিনয়ের শিক্ষা হয়, এবং শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসীর বেশে ফিরে এসে অনুধাবন করেন যে, অরণ্য সবার সঙ্গেই সমান ব্যবহার করে। এইভাবে দেখলে, মহাভারত এক বৈদিক সত্যের সন্ধান দেয়। অরণ্যে জোর যার, মুলুক তার। কেউ কাউকে সাহায্য করে না। জনবসতিতে তাই আমরা অন্য মানুষকে কতটা সাহায্য করি, সেটাই হল মানবসভ্যতার মাপকাঠি।