সত্যজিৎ সম্পর্কে আপনার প্রথম স্মৃতি কী? তখনই কি কিছু দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন?
যতদূর মনে পড়ে, আমাদের বাড়িতে সবকিছু ছাপিয়ে সত্যজিৎ রায়ের এক অতিমানবীয় উপস্থিতি ছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই জানতাম, তিনি এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমাদের বাড়িতে তাঁকেই ধ্রুবতারার মতো দেখা হত। আমি যখন ছোট ছিলাম, বা তারপর যখন আর একটু বড় হয়ে উঠছিলাম, আমার বাপি নিজেকে নাস্তিক বলতেন। বাড়িতে কোনও পুজো হত না বা ব্রত-টত পালন হত না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎকে পুজো করা হত। তাই আমার ঠিকঠাক মনে নেই, কবে ওঁকে প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম, কারণ তিনি আগাগোড়াই আমাদের জীবনের অংশ ছিলেন। প্রায় প্রতি রবিবার বাপির সঙ্গে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িটায় যেতাম। ওঁকে ডাকতাম মানিকজেঠু। ওঁর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল, বাচ্চাদের খুব সহজে কাছে টানতে পারতেন। উনি তাদের খুব উঁচু থেকে দেখতেন না, আবার বোকা-বোকা ভাবে তাদের সঙ্গে আধো-আধো কথাও বলতেন না। কোনও বানানো আগ্রহ দেখাতেন না। যেমন বড়দের সঙ্গে কথা বলেন, ছোটদের সঙ্গেও সেভাবেই বলতেন। উনি আমায় আমার ভরতনাট্যম চর্চা নিয়ে বেশ উৎসাহ দিতেন, পরে আমার ১২ বছর বয়সে আমার আরেংগেত্রম-এ প্রধান অতিথি হয়ে এসেওছিলেন। আমার ওঁকে মনে হত খুব নরম মনের একজন মানুষ, আমি তাঁকে নিষ্পাপ কৌতূহলে যতই প্রশ্ন করি না কেন, উনি কক্ষনও বিরক্ত হতেন না। উনি বাচ্চাদের যে কত ভাল বুঝতে পারতেন, কত অকৃত্রিম ভাবে তাদের সঙ্গে মিশতে পারতেন, সে প্রমাণ রয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে শিশুশিল্পীদের অসামান্য অভিনয়ে।
আপনার দেখা সত্যজিতের প্রথম ছবি কী? সেই ছবির স্মৃতি কী?
প্রথম দেখেছি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। বাপি-মা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে গেছিলেন, তবে কোন সিনেমা-হল সেটা মনে নেই। নিয়ে যাওয়ার আগে মা উপেন্দ্রকিশোরের গল্পটা পড়ে শুনিয়েছিলেন। আমি খুব ছোট ছিলাম, সিনেমাটা দেখে আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল। বিশেষ করে ভূতের রাজাকে দেখে আর রবিজেঠুকে দেখে (যিনি পারিবারিক বন্ধু) খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। বোধহয় ছবিটা দেখার পর দিন-সপ্তাহ-মাস কেটে গেলেও আমরা ছবিটা নিয়ে কথা বলতাম, বাপি-মা ছবিটার সূক্ষ্ম ও গভীর দিকগুলো নিয়ে কথা বলতেন, আর আমি জাদু আর গানগুলো আর গুপী-বাঘার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে বকবক করতাম। এখনও পারলেই গুগাবাবা দেখি, বাস্তবে যে হট্টগোল চলছে তা থেকে পালাবার একটা প্রিয় উপায় হল ওই ছবিটা দেখা। আমরা বাড়ির সবাই মিলে গানগুলো এখনও গাই। ওই ম্যাজিক আর গান আমার সঙ্গে চিরদিন আছে, অনেক অন্ধকারে আলোও দেখিয়েছে।
সৌমিত্র-সত্যজিৎ জুটি নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে, আপনার মতে তাঁদের যুগ্ম কাজের সাফল্যের কারণ কী?
বাপি সত্যজিতের ১৪টা ছবিতে অভিনয় করেছেন, পরিচালক ও অভিনেতার যুগ্ম কাজের বিরাট উদাহরণ এটা, প্রায় কুরোসাওয়া ও তোশিরো মিফুনে-র জুটির মতো। আমার মনে হয়, সত্যজিৎ যে-চরিত্রটা তৈরি করতেন, বাপি অভিনেতা হিসেবে অনায়াসে সেই চরিত্রটার মধ্যে ঢুকে যেতে পারতেন। বাপির একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল, চরিত্রটা ‘হয়ে ওঠা’র, তাঁর প্রতিভা ছিল অভিনেতা হিসেবে চরিত্রটার রক্তমাংসের মধ্যে ঢুকে পড়ার, আর খুব খিদেও ছিল অনেক রকমের চরিত্রে অভিনয় করার। সত্যজিৎ বোধহয় বাপিকে যে কোনও চরিত্রের আদলেই ঢেলে নিতে পারতেন, আর বাপিও ওঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্পনার কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করতেন, তারপর দুজনে মিলে সৃষ্টিশীল অভিযানটায় রওনা হতেন। আর একটা ব্যাপার ছিল, দুজনেই সাহিত্য অসম্ভব ভালবাসতেন। এই জন্যেও বোঝাপড়াটা এত ভাল হত, সেটা কাজে প্রতিফলিত হত।
একজন অভিনেতা হিসেবে, সত্যজিতের ছবিতে আপনার বাবার অভিনয়ের কী মূল্যায়ন করবেন? এর মধ্যে কি এমন ছবি আছে, যেটায় (বা যেগুলোয়) আপনার বাবার অভিনয় নিয়ে এমনিতে অতটা আলোচনা হয় না, কিন্তু আপনার খুব প্রিয়?
আমি সত্যজিতের ছবিতে বাপির অভিনয়ের মূল্যায়ন করব, এতটা স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু আমার খুব ভাল লাগে বাপিকে সত্যজিতের ছবিতে, কয়েকটায় বেশি ভাল লাগে। আগেও যেমন বললাম, বাপি খুব ক্ষুধার্ত অভিনেতা ছিলেন, শেষদিন অবধি আরও নতুন নতুন চরিত্রে অভিনয় করতে চাইতেন, উনি চরিত্রকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, তাকে নিজের অংশ করে নিতেন। উনি খুব পরিশ্রমী অভিনেতা ছিলেন, যে কোনও ফিল্ম শুরুর আগে নিষ্ঠাভরে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতেন। সত্যজিতের ছবিতে উনি যত রকমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তা থেকে অভিনয়ের ছাত্রেরা শিখতে পারেন। চরিত্রায়নের যে সূক্ষ্ম দিকগুলো, ছবিটা এগোবার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের যে একাধিক স্তর উন্মোচিত হয়, দর্শককে চরিত্রটার সঙ্গে যেভাবে একাত্ম বোধ করানো হয়— এইগুলোই বাপির অভিনয় থেকে শেখার মতো। অপু, অমল, ফেলু, উদয়ন পণ্ডিতের ভূমিকার সঙ্গে বাপি ‘অশনি সংকেত’-এর গঙ্গাচরণ বা ‘শাখাপ্রশাখা’র প্রশান্তর ভূমিকায় যে অভিনয় করেছেন, তা অসামান্য। ‘অভিযান’-এর নরসিং আর ‘কাপুরুষ’-এর অমিতাভর চরিত্রে বাপির অভিনয়ও আমার খুব প্রিয়।
সৌমিত্রবাবু সারাক্ষণ বই পড়তেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই ভালবাসা কি সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছিল?
বাবা চিরকালই প্রচুর বই পড়তেন, ছোট থেকে তিনি বইয়ের পোকা, সাহিত্যকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। আমার দাদু ও ঠাকুমা বই খুব ভালবাসতেন, তাঁরা সন্তানকে সেই ভালবাসাটা উত্তরাধিকারসূত্রে দিয়েছেন। আমার মনে হয় সত্যজিৎ আমার বাপির মধ্যে আত্মার আত্মীয় খুঁজে পেয়েছিলেন, দুজনেরই ছিল বিশ্বসাহিত্যের প্রতি, এবং অবশ্যই বাংলা সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ আর বই পড়ার অনিঃশেষ খিদে। আমার বাবা সত্যজিতের সাহিত্য-ক্ষমতাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, আর তাঁর পরিবারের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে তো সমীহ করতেনই। আমাদের পরিবারের সকলেই রায়-পরিবারের সব লেখাই গোগ্রাসে গিলতাম, এখনও সেসব বই পড়ি। আমার বাবা নিজের লেখা সত্যজিৎকে পড়ে শোনাতেন, মানিকজেঠু তাঁর মতামত খোলাখুলি জানাতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাপির লেখা নিয়ে দুজন আলোচনা করতেন। বাপি যখন ‘এক্ষণ’ লিটল ম্যাগাজিন শুরু করলেন, মানিকজেঠুই তার নামাঙ্কন করতেন আর প্রচ্ছদও এঁকে দিতেন। উনি বাপির চারটে বইয়ের প্রচ্ছদও করেছিলেন: ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াব বলে’, ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’, ‘শব্দরা আমার বাগানে’ এবং ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’। বিনোদিনী দাসীর লেখা ‘আমাদের কথা’রও প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ, যে বইটা বাপি সম্পাদনা করেছিলেন। বাপির সাহিত্য-দক্ষতার প্রতি সত্যজিতের এতটাই বিশ্বাস ছিল, ‘এক্ষণ’-এ ‘আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস’-এর ভূমিকার বাংলা অনুবাদ বাপিকে করার অনুমতি দিয়েছিলেন।
সত্যজিৎ বই থেকে অনেক ছবি করেছেন, আর সেগুলোর বেশ কয়েকটায় সৌমিত্র অভিনয় করেছেন। সাহিত্য অবলম্বনে তৈরি করা এই ছবিগুলোর কোনগুলোকে আপনার সবচেয়ে ভাল লাগে?
সত্যজিতের সাহিত্যপ্রীতিই তাঁকে বাধ্য করে, সাহিত্যের এতগুলো মণিমাণিক্যকে অসাধারণ ছবিতে রূপান্তরিত করতে। এই ছবিগুলোর অনেকগুলোতেই বাপি অভিনয় করেছেন, বাপির অভিনীত প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’ তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই অবলম্বনেই তৈরি। ‘চারুলতা’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি সংকেত’ আমার খুব প্রিয়, কিন্তু অসম্ভব ভাল লাগে ‘অপুর সংসার’। বিভূতিভূষণের বইয়ের পাতাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই ছবিটায়। এটা একটা ভীষণ কষ্টের ছবি, যা পৃথিবীকে বিহ্বল করেছে। আমি এখনও দেখলেই আকুল হয়ে পড়ি, আর আমার মনে হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো অপু আর হবে না। সেই সময় এবং সেই সমাজের যে দোলাচল, সেই সময়ের যুবসমাজের যে উদ্বেগ ও আবেগ, বাপি তা একেবারে মূর্ত করে তুলেছিলেন, আর অপু ও অপর্ণার মতো অমন রোম্যান্টিক আর করুণ একটা প্রেমের উপাখ্যান তো অদ্বিতীয়। সাহিত্য অবলম্বনে করা সত্যজিতের ছবিগুলোর মধ্যে এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়, কারণ এটা উপন্যাসের প্রতি অনুগত থেকে, তাতে আরও কিছু যোগ করেছিল।
শর্মিলা ঠাকুর সাম্প্রতিক একটা নিবন্ধে লিখেছেন যে সত্যজিৎ এমন বাজেটে কাজ করতেন, যা বার্গম্যান বা অন্যান্য বড় পরিচালকের বাজেটের ভগ্নাংশ মাত্র। বড় বাজেট পেলে তিনি কীভাবে কাজ করতেন বলে মনে হয়?
ঠিকই, সত্যজিৎ যখন ছবি করতেন তখন বাজেটের অনেক টানাটানি ছিল, কিন্তু ছবির উৎকর্ষ তো ছিল তুলনাহীন! তাঁর ছবি যে বিশ্বের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এখনও জ্বলজ্বল করছে, এতেই তো তাঁর অবিশ্বাস্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বাজেটটা দ্বিগুণ হয়ে গেলেই ছবিগুলো আরও অনেক ভাল হত কি না, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমার তো মনে হয়, এতগুলো সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, সেগুলো অতিক্রম করে যে সত্যজিৎ এই স্তরের ছবি বানাতেন— এটাই তাঁর অবিশ্বাস্য প্রতিভার প্রমাণ। এই সব মিলিয়েই তিনি ‘সত্যজিৎ’ হয়ে উঠেছেন।
সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে সত্যজিৎ কী নিয়ে গল্প করতেন? সিনেমা নিয়ে? আপনার বাবার অভিনীত অন্য ছবি নিয়েও কথা হত?
বাপির সঙ্গে মানিকজেঠুর প্রায়ই আড্ডা হত। এমনকী যখন বাপি মানিকজেঠুর ছবিতে কাজ করছেন না, তখনও প্রায় রবিবারেই বাপি বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে ঢুঁ মারতেন। ছোটবেলায় আমরাও বাপির সঙ্গে চলে যেতাম, কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর তো দাদার বেহালা ক্লাস থাকত ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিক-এ, আর আমার ভরতনাট্যমের ক্লাস থাকত কলামণ্ডলম-এ। আমরা বাড়ি ফেরার পর বাপি বলতেন, আজ মানিকজেঠুর সঙ্গে কী কী কথা হল, আর আমরা সম্মোহিত হয়ে শুনতাম। মানিকজেঠুর সঙ্গে কথোপকথন বাপির ওপর খুব প্রভাব ফেলত, আর পরোক্ষ ভাবে আমাদের গোটা পরিবারের ওপরেও। ওঁরা সবকিছু নিয়েই আড্ডা মারতেন, বিশেষত সিনেমা, সাহিত্য ও সঙ্গীত। বাপি অন্য পরিচালকদের সঙ্গে যে ছবি করছেন তা নিয়েও মানিকজেঠুর খুব উৎসাহ ছিল। তিনি বাপিকে পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন, যেভাবে একজন মেন্টর দেন, একজন গুরু দেন। একটা গল্প বলি। একদিন মানিকজেঠুর কাছে গিয়ে বাপি শুনলেন, মানিকজেঠু বাপির একটা সিনেমা দেখেছেন, যেটা বাপির মতে খুব একটা ভাল ছবি নয়। সেটা ছিল একটা এমনি বিনোদনমুখী ছবি, যা নিয়ে খুব একটা চিন্তা বা আলোচনার কিছু আছে বলে বাপি মনে করেননি। মানিকজেঠু বললেন, সৌমিত্র, তুমি ওই ছবিটায় মন দাওনি, কাজে পরিশ্রম করোনি, কেন? বাপি বললেন, ছবিটাকে বাপি এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি। মানিকজেঠু বললেন, তুমি একজন পেশাদার অভিনেতা, তোমার কর্তব্য হল যে ছবিটাই করবে সেটায় তোমার সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া। তুমি বিচার করতে যেও না ছবিটা কীরকম। তোমার যতখানি ক্ষমতা তার পুরোটা দিয়েই ছবিটা করবে। এই বকুনিটা, এই শিক্ষাটা বাবা সারাজীবন মনে রেখেছিলেন। লোকে যখন পরে জিজ্ঞেস করত, আপনি বাণিজ্যিক মশলা-ছবিতে এত সিরিয়াসলি অভিনয় করেন কী করে, উনি উত্তর দিতেন, আমি একজন পেশাদার অভিনেতা। মানিকজেঠুর সেদিনকার শিক্ষা বাপির সারাজীবন কাজে লেগেছে।
সত্যজিৎ থিয়েটারে কতটা উৎসাহী ছিলেন? তাঁর বহু অভিনেতাই কি মঞ্চে খুব সফল ছিলেন? সত্যজিৎ নাটক নিয়ে আলোচনা করতেন?
আমি যতদূর জানি, মানিকজেঠু থিয়েটারে খুব আগ্রহী ছিলেন। বাপির সঙ্গে মানিকজেঠু দেখতে গিয়েছিলেন কিংবদন্তিপ্রতিম শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় এবং একেবারে অভিভূত হয়ে গেছিলেন। আমার বাবার অভিনীত অনেক নাটকও মানিকজেঠু দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু আমি জানি না তাঁরা নাটক নিয়ে আলোচনা করতেন কি না। তবে বাপি যেহেতু নিয়মিত নাটক করতেন, নিশ্চয়ই মানিকজেঠুর সঙ্গে তা নিয়ে কথাও বলতেন। মানিকজেঠুর অনেক ছোটগল্পে নাটকের ভূমিকা আছ, অনেক চরিত্র নাট্যাভিনেতা, কোনও চরিত্র নাটকে মেক-আপ শিল্পী, তাই মনে হয় এই শিল্পমাধ্যমটার প্রতিও মানিকজেঠুর আকর্ষণ ছিল।
এই শতবর্ষে কি সত্যজিতের লেখা থেকে অনেক ছবি হওয়া উচিত? নেটফ্লিক্স চারটে ছবি করছে, আরও অনেকে উৎসাহী।
শতবর্ষ সত্যজিৎকে নতুন করে আবিষ্কারের পক্ষে সেরা সময়। তাঁকে আরও ভাল করে পড়তে ও জানতে হবে। আমি ওঁর লেখার প্রবল অনুরাগী, ওঁর ছোটগল্পগুলো শিশু ও কিশোরদের জন্য লেখা হলে কী হবে, সব বয়সের মানুষকে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুগ্ধ রেখেছে। তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে চিরকালীন বাঙালিয়ানার যে অসামান্য ছবিটা পাই, তাকে আলিঙ্গনের সময় এসেছে। আমরা বোধহয় ভুলতে বসেছি, জীবনে কী সবচেয়ে জরুরি, আমরা বড্ড অধৈর্য, আগ্রাসী হয়ে পড়েছি, সব ব্যাপারে রুক্ষ মতামত দিচ্ছি। সত্যজিতের গল্প আমাদের অন্য এক জগতের গল্প বলে, এক ভদ্র, সহনশীল, নরম জগত। তাঁর গল্প থেকে এখনকার তরুণ পরিচালকেরা ছবি করছেন, এটা দারুণ খবর। আরও পরিচালক, লেখক, শিল্পীরা এগিয়ে এসে সত্যজিৎকে অনেক দিক থেকে দেখুন ভাবুন।
শতবর্যে সত্যজিৎ রায় মিউজিয়াম তৈরি নিয়ে আলোচনা চলছে। আপনাকে যদি সঙ্কলনের দায়িত্ব দেওয়া হত তা হলে আপনি কী রাখতেন সেখানে? নিজের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষকে উৎসাহিত করা কি জরুরি?
সত্যজিৎ রায় মিউজিয়াম তৈরি করার ভাবনাটা সত্যিই দারুণ। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রপরিচালক ছাড়াও তিনি ছিলেন অসামান্য লেখক, অলঙ্করণ শিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, ক্যালিগ্রাফার, সেট ডিজাইনার, সঙ্গীত পরিচালক এবং চিত্রসমালোচক। ফলে, তাঁকে বিশদে জানা খুব জরুরি। তাঁর কাজের প্রকৃত সমাদর করার জন্য তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা, তাঁর উপর কীসের প্রভাব আছে সে-কথা জানা প্রয়োজন। একটা সমাজ যদি তার ইতিহাস সম্বন্ধে ভাল করে না জানে, তাহলে এগোবে কী করে? ইতিহাসই আমাদের তৈরি করে, ইতিহাসই ঠিক করে দেয় আমরা কী ভাবব, কী করব। ফলে ভবিষ্যতের সংস্কৃতি নির্মাণের জন্য, আর ভুল ধারণার মোকাবিলা করার জন্য ইতিহাসকে তো মনে রাখতেই হবে। আর সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন বহুমুখী প্রতিভার কাজের সংরক্ষণ, ইতিহাস ধরে রাখার এক চমৎকার উপায়।
আমি যদি মিউজিয়াম কিউরেট করার ভার পেতাম? অনেক অনেক জিনিস রাখতাম। কোথা থেকে তার তালিকা যে শুরু করি! আমি ঠিক জানি না। সত্যজিৎ নামক জিনিয়াসের সব রকমের কাজকে ঠিকঠাক তুলে ধরাটা আসলে হিমালয়-সমান একটা প্রজেক্ট। যিনি এই সংকলনের দায়িত্বে আছেন, তাঁকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। আমি অধীর আগ্রহে এই মিউজিয়াম গড়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকলাম।
সৌমিত্রবাবু অনেক সময় বলেছেন যে সত্যজিৎ রায় চলে যাওয়ার পর তিনি অনাথ বোধ করতেন। কিন্তু সৌমিত্রবাবু চলে যাওয়ার পর এ কথা কি বলা যায় যে, তাঁর সঙ্গে বাংলা সিনেমা, সংস্কৃতি এবং থিয়েটার জগত— যে প্রতিটি ক্ষেত্রে এই দুজনে অগ্রগণ্য ছিলেন— তার স্বর্ণযুগটি শেষ হয়ে গেল?
বাবা চলে যাওয়ার পর একটা বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুতে আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতে একটা বিরাট ক্ষতি তো হয়েই গিয়েছিল, এখন আর আইডল বলে শ্রদ্ধা করার মতো কেউ থাকল না। মানিকজেঠু আর বাবা, দুজনেই সিনেমা, থিয়েটার এবং সাহিত্যের মানচিত্রে একটা গভীর ছাপ রেখে গেছেন। এমন কীর্তির ছাপ খুবই বিরল। সাধারণত একজন মানুষ কোনও একটি বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন, কিন্তু এই দুই বিশুদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোক বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক জগতে এবং বাঙালি মননে নিজেদের বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে গভীর প্রভাব রেখে গেছেন। আগামীর বহু প্রজন্মের কাছে এই শূন্যতাবোধটা থাকবে। তাঁদের জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সহজে দেখা যায় না। এই দুই রেনেসাঁস-মানব আর নেই। অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের মতো কেউ আসবেন বলে তো মনে হয় না।