কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটি আমরা প্রায় সকলেই পড়েছি। অন্তত এটুকু জানি, যে সেই গল্পে গ্রেগর সামসা বলে জনৈক ব্যক্তি রাতারাতি একটা কিম্ভূত পোকায় রূপান্তরিত হয়েছিল। কালজয়ী এই গল্পটি নিয়ে নানান আলোচনা হয়েছে—গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাওয়ার তাৎপর্য ঠিক কী, বা তা আসলে কীসের রূপক, তার ব্যাখ্যায় সমালোচকরা পাতার পর পাতা ভরিয়ে তুলেছেন। কিন্তু, জ্বলজ্যান্ত একজন মানুষ যখন সত্যিই একটা অকিঞ্চিৎকর, নগণ্য পোকায় রূপান্তরিত হয়, তখন তার অসহায়তা আর নিরাপত্তাহীনতার বোধ যে কতখানি দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে, সমালোচকের টীকাভাষ্য থেকে তার আন্দাজ পাওয়া বোধহয় সম্ভব ছিল না।
আমরা যারা মধ্যবিত্ত, বা উচ্চমধ্যবিত্ত, অফিসে না-গিয়েও মাসান্তে যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোটামুটি ভদ্রস্থ মাইনে জমা পড়ে যায়, মেডিক্লেমের নিরাপত্তা যাদের স্বাভাবিক রক্ষাকবচ, মনে-মনে তারা এতদিন বিশ্বাস করে এসেছি যে, জায়গা ও সময়মতো টাকাকড়ি ফেলতে পারলে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা থেকে আমাদের কখনই বঞ্চিত হতে হবে না। চিকিৎসার অব্যবস্থা, ওষুধ ও সরঞ্জামের অপ্রতুলতা বরাদ্দ রয়েছে কেবল গরিব-গুর্বোদের জন্যই, সরকারি হাসপাতাল-নামক ‘বিভীষিকা’টি ছাড়া যাদের আর কোনও গত্যন্তর নেই। তাদের কথা ভেবে, আমরা কখনও হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, আবার কখনও বা সরকারের সমালোচনায় সরবও হয়েছি, কিন্তু তাদের ভাগ্যের সঙ্গে নিজেদের ভাগ্যকে জড়াতে হবে, এমন চিন্তা আমাদের দুঃস্বপ্নেও স্থান পায়নি। যদিও এবার, ঘটনা কিছু অন্যরকম ঘটল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ এসে যখন আছড়ে পড়ল দেশে, তখন আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, টাকাপয়সা দিয়েও হাসপাতালে বা বেসরকারি নার্সিংহোমে বেড মিলছে না, অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না হাজার চেষ্টাতেও। চিকিৎসার অভাবে, চোখের সামনে মারা যাচ্ছে আমাদের আত্মীয়পরিজন, বন্ধুবান্ধব। এইভাবে, একসময়ে বুঝতে পারলাম, গ্রেগর সামসার মতো, আমরাও রাতারাতি মানুষ থেকে পোকায় রূপান্তরিত হয়েছি, ইচ্ছে করলেই যাকে অনায়াসে পিষে ফেলতে পারে রাষ্ট্রযন্ত্রের উদাসীনতা, অবহেলা।
দিল্লি ও সন্নিহিত অঞ্চলে, আমরা যেখানে থাকি, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগমনটা ছিল ‘দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে’-গোছের। মহারাষ্ট্রের তুলনায় দেরিতে এসেছিল, এবং শুরুতে বৃদ্ধির হারটাও তেমন বেশি ছিল না। এপ্রিলের গোড়ায়, দিল্লি ও সন্নিহিত এলাকায় দৈনিক নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের কম। সংখ্যাটা হঠাৎ বাড়তে শুরু করে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে। ১০ই এপ্রিল তা পৌঁছয় ১০,০০০-এ, আর ২০শে এপ্রিল তা তিনগুণ বেড়ে হয় ৩০,০০০। প্রতিতুলনার খাতিরে জানিয়ে রাখি, গতবারের দৈনিক নতুন সংক্রমণের সংখ্যা কখনই ১০,০০০-এর গণ্ডী পেরোয়নি। অর্থাৎ, কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউটি ছিল প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় তিনগুণ তীব্র। এই বিপুল প্লাবনের ঠেলায়, আমাদের দেশের স্বভাবত অপ্রতুল স্বাস্থ্যব্যবস্থার যে অচিরেই নাভিশ্বাস উঠবে, তাতে বিস্মিত হবার কোনও কারণ নেই। শুধু অক্সিজেন বা হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতাই নয়, RT PCR পরীক্ষার সরঞ্জাম বাড়ন্ত হল, দোকান থেকে উধাও হয়ে গেল ডক্সিসাইক্লিনের মতো অতিসাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক, আইভারমেক্টিন-জাতীয় যেকোন ওষুধ, কিংবা মিথাইল প্রেডনিসোলোন বা ডেক্সোমিথাসোনের মতো বাজারচলতি স্টেরয়েড।
এপ্রিলের তেইশ তারিখ অবধি বাজারের এতশত হালহকিকত আমরা কিছুই জানতাম না। ওইদিন সন্ধেবেলা আমার স্ত্রীর জ্বর আসে। আগাম সতর্কতা হিসেবে সে নিজেকে একটি ঘরে সেলফ-আইসোলেট করে, কেননা বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা, এবং আট ও আড়াইবছরের দুটি বাচ্চা রয়েছে। তবুও, শেষরক্ষা হল না। পরদিন থেকে একে-একে আমরা সবাই জ্বরে পড়ি। স্ত্রী-র পরীক্ষা হয়েছিল শনিবার, কিন্তু তার রিপোর্ট এল মঙ্গলবার। যথারীতি, পজিটিভ। দু-একদিনের মধ্যে, একে-একে আমাদের সকলেরই পজিটিভ রিপোর্ট এল। সৌভাগ্যবশত, বাকি সকলের ক্ষেত্রেই রোগের প্রকোপ ছিল মৃদু। দু’দিন জ্বর আর হালকা পেটখারাপ ছাড়া বাচ্চাদের তেমন কিছুই হয়নি। বয়স্কদের ক্ষেত্রেও চার-পাঁচদিনের জ্বর, সর্দিকাশি আর দুর্বলতা ছাড়া অন্য কোনও সমস্যা ছিল না, সেটা একডোজ ভ্যাক্সিন নেওয়ার কারণেই হোক, বা শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধক্ষমতার জন্যেই হোক। কিন্তু জটিলতা দেখা দিল আমার স্ত্রী-র ক্ষেত্রে, সাতদিনের মাথায়। আচমকা রাত্রিবেলা, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ওঠানামা করতে লাগল। ডাক্তার বললেন, উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে, অর্থাৎ যাকে প্রোনিং বলে। তাতে অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে ৯৬-৯৭ হল। কিন্তু, পরদিন থেকে, ওইটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়াল—কিছুক্ষণ অন্তর অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যায়, উপুড় হয়ে শুলে আবার কষ্টেসৃষ্টে ৯৬-তে ওঠে। সঙ্গে অসম্ভব ক্লান্তি, দুর্বলতা। অন্য এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে নেবুলাইজিং আর ইনহেলার নেওয়া শুরু হল। অবস্থার বাড়াবাড়ি হল ২রা মে, যখন রাজ্যে নির্বাচনী ফলঘোষণার উত্তেজনা একেবারে তুঙ্গে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে হল ৮২, কখনও ৮৫। ডাক্তার প্রোনিং চালিয়ে যেতে বললেন। সত্যি বলতে তাতে উপকারও হচ্ছিল, কিন্তু তা খুব দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। তার সঙ্গে শুরু হল কাশি, যার ফলে শ্বাস নেওয়া অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়াল। নিজেকে এত অসহায় কখনও মনে হয়নি, কেননা এ-কথা জানাই ছিল যে, যদি অবস্থার চূড়ান্ত অবনতিও হয়, তাহলেও কোনও হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে জায়গা পাব না, অক্সিজেন দেওয়া তো দূরের কথা। সৌভাগ্যবশত, ঠিক এইসময়ে, অফিসের এক সহকর্মী আমাকে ফোনে জানালেন যে, একই ঘটনা তাঁর মায়ের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল, এবং আমি যেন কালবিলম্ব না করে ততক্ষণাৎ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্টেরয়েড চালু করি। না হলে, ফুসফুসের ক্ষতির আশঙ্কা। তাঁর কথামতো আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি, এবং তিনিও সম্মতি জানান। কিন্তু আগেই যেমন বলেছি, দিল্লি-নয়ডায় সে-সময়ে ওষুধের তীব্র আকাল। অন্তত চার-পাঁচটি ওষুধের দোকানে ফোন করেও নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধ পাওয়া গেল না। শেষে, সেই সহকর্মীই, দিল্লির একটি দোকান থেকে ওষুধ জোগাড় করে, অফিসের বিশেষ গাড়ি করে সেটি বাড়িতে পৌঁছে দিলেন, কেননা লকডাউনের কারণে, দিল্লি ও সংলগ্ন এলাকায় লোকজনের যাতায়াতের ওপর কড়া বিধিনিষেধ ছিল।
স্টেরয়েড দেওয়ার পর, এবং ইনহেলার ও নেবুলাইজারের ডোজ বাড়ানোর পর, অনেকটা উপকার হয়। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫/৯৬-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। ডাক্তার বুকের সিটি স্ক্যান করাতে বলেছিলেন। তাতে দেখা গেল, পৃথা-র মানে আমার স্ত্রীর ফুসফুস বেশ ভালোমতোই জখম হয়েছে। পালমোনোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে স্টেরয়েডের মাত্রা বাড়ানো হল, সঙ্গে ব্লাড থিনার। কেননা, কোভিডের ফলে, ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে হ্যামারেজের বা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে। তবে, তিনি আশ্বাস দিলেন, যেহেতু তিনদিন হল আর জ্বর আসেনি, এবং অক্সিজেন স্যাচুরেশনও মোটামুটি সন্তোষজনক, সেইহেতু নতুন করে অবস্থার অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা কম, এবং হাসপাতালে ভর্তির কোনও প্রয়োজন নেই। বরং, হাসপাতালগুলির এই মুহূর্তে যা-অবস্থা, তাতে সেখান থেকে অন্য ইনফেকশনের সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি এ-ও বলেন যে, কোভিডের ফলে হওয়া ফুসফুসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে, দুটি মাত্র চিকিৎসাই সন্দেহাতীতভাবে ফলদায়ী—স্টেরয়েড আর অক্সিজেন। রেমডেসিভির-জাতীয় ওষুধের কার্যকারিতা এক্ষেত্রে আদৌ কতখানি, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বস্তুত, শুধু ওই পালমোনোলজিস্টই নন, দিল্লি ও কলকাতার আরো দুই চিকিৎসকও রেমডেসিভিরের ব্যাপারে ঠিক একই কথা আমাকে বলেছিলেন।
যা হোক, ব্যক্তিগত বিবরণের ভার আর বাড়াব না। এটুকুই বলার, যে এখন আমার স্ত্রী ভালোই আছেন এবং সেরে উঠছেন দ্রুত। স্টেরয়েডের ক্রিয়ায় শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধক্ষমতা কমে যায় (বস্তুত, কোভিডের সময়ে আমাদের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধব্যবস্থা এতটাই সক্রিয় হয়ে ওঠে, যে ভাইরাস বিদায় নেওয়ার পর তা নিজের শরীরকেই পর্যুদস্ত করতে শুরু করে; তাকে ঠেকানোর জন্যেই স্টেরয়েডের ব্যবহার) এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে। ফলে, অন্য নানান রোগসংক্রমণের আশঙ্কা থাকে (যেমন এখন, ব্ল্যাক ফাংগাস সংক্রমণের হার হঠাৎ বেড়ে গেছে, যার একটা কারণ স্টেরয়েডের ব্যবহার বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা)। অতএব, এখনও কিছুদিন সাবধানে থাকতে হবে, এই আর কী।
শেষ করার আগে, আরেকটা কথা না বললেই নয়। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যেমন একদিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে সরকারের অকর্মণ্যতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বহর, তেমনি অন্যদিকে, মানুষের মনুষ্যত্ব ও সহমর্মিতা যে এখনও সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়নি, সে-কথাও প্রমাণ করে ছেড়েছে। সহকর্মীদের সাহায্যের কথা তো আগেই বলেছি। তাছাড়া, অসুস্থতার দিনগুলিতে, আমার বন্ধুবান্ধব, যাদের কেউ ডাক্তার, কেউ বা লাখনৌয়ের ড্রাগ-রিসার্চ সেন্টারের বিশিষ্ট গবেষক, কেউ বা শুধুই শুভানুধ্যায়ী—সবার সঙ্গে হয়তো প্রত্যক্ষ পরিচয়ও নেই—যেভাবে ক্রমাগত পরামর্শ দিয়ে গেছেন, খোঁজ নিয়েছেন বারবার, তাতে নিজেকে কখনও একা মনে হয়নি। তার ওপর, ফেসবুকে দেখেছি, কীভাবে আমার চেনা-পরিচিত মানুষজন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করতে, কীভাবে রেড ভলান্টিয়ার্সরা পশ্চিমবঙ্গের কোণায়-কোণায় ছুটে গেছেন ওষুধবিষুধ, অক্সিজেন নিয়ে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, বহুজাতিক কোম্পানিও কর্মীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন—কেউ অফিসের ক্যাফেটেরিয়াকে ছোটখাটো হাসপাতালে পরিণত করেছেন, কেউ অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর কিনে অসুস্থ কর্মীদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। এইসব ঘটনা অবশ্যই আশা জাগায়, অনেক বিপদের মধ্যেও আশ্বাস ও সান্ত্বনা জোগায়। কিন্তু, একই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, সমস্ত নাগরিকের জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপরিকাঠামো নিশ্চিত করার কাজটি সরকার কেন করবে না? কেন নাগরিকদের নিজের হাতেই তুলে নিতে হবে নিজের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব? এই প্রশ্নগুলো জোরগলায় জিজ্ঞেস করার প্রকৃষ্ট মুহূর্ত বোধহয় এটাই।