ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এক জাদুঘরের টানা-পড়েন


    সুকন্যা দাশ (Sukanya Das) (May 21, 2021)
     

    ক্যালিকো পঁহুচ গ্যয়ে ম্যাডাম’, জানাল ট্যাক্সিচালক। নেমে আশপাশে বয়নশিল্পের বিখ্যাত জাদুঘর খুঁজি। চোখে পড়ে আট ফুট উঁচু দেওয়ালে ঘেরা প্রাচুর্যের দ্বীপ ক’টি। উন্নয়নের মোড়কে ঢাকা শহরটার নাম আহমেদাবাদ। চোখ-ধাঁধানো সাদা দেওয়াল পাশে রেখে হাঁটতে থাকি। কিছু গাছপালা উঁকি দেওয়ায় মনে হল ভেতরে বড়সড় বাগানও আছে। একটা ব্যুগেনভেলিয়া তো একেবারে বাইরে এসে জুড়ে বসেছে। ঘোর কাটল একটা কাঠের দরজায় এসে। গুজরাতি হাভেলি ধাঁচের, বয়স অন্তত দুশো বছর তো হবেই। সেখানেই পেতলের ফলক লাগানো। আশ্বস্ত হলাম। যাক এটাই তাহলে ক্যালিকো মিউজিয়াম। 

    কিন্তু ঢোকাটা তো সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কলিংবেলটা কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো! সপ্তাহের গোড়ার দিকে অনেকেই বলেছিল, ‘ওখানে ঢোকা সহজ নয় রে! নানা হ্যাপা আছে।’ ভারী দরজাটায় ধাক্কা দিতে থাকি। শেষে বলেই ফেললাম, ‘ভাইয়া কোই হ্যায়?’

    দরজার ছোট্ট ফাঁক থেকে বেরিয়ে এল এক শীর্ণ মুখ। বয়স ওই দরজার কাছাকাছিই হবে। এবার প্রশ্ন, ‘কী দরকার?’ জানালাম। অপেক্ষা করতে করতে স্থানীয় মানুষদের প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবছিলাম। কেউ কৃত্রিম হেসে বলেছিল, ‘ক্যালিকো নিয়ে লিখবে? সাহস আছে তোমার!’ যে পরিবার এই মিউজিয়াম চালান, তাঁদেরই একজন আবার শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন। তবে আমার উদ্দেশ্য যাতে সফল হয় তার জন্য আমার এই শেষ মুহূর্তের অ্যাপয়েন্টমেন্টের ফলে তাঁদের সময়ের কিছুটা রদবদলও করে নিয়েছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম, ক্যালিকো মিউজিয়ামকে যতই খামখেয়ালি এক ঝগড়ুটে বুড়ি মনে হোক, তাকে সম্মান ও গুরুত্ব, দুই-ই দিতে হবে।

    ক্যালিকো মিউজিয়াম বন্ধ থাকার বিজ্ঞপ্তি

    ছোট দরজাটা খুলতেই, চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। মনে হল সিদ্ধিলাভ করেই ফেলেছি। বুঝলাম কেন অন্য গ্যালারি বা মিউজিয়ামের তুলনায় ক্যালিকো স্বতন্ত্র। সেটি একটি বিখ্যাত পরিবারের খাসতালুক। গত কয়েক দিনে, সংস্কৃতি নিয়ে স্থানীয় আড্ডায় বার বার একটা প্রশ্নই উঠে আসছিল। হাল ফ্যাশনের আর্ট গ্যালারির মালিক থেকে চওলে থাকা চিত্রশিল্পী, সবারই আবেগতাড়িত জিজ্ঞাসা, ‘আজকের দিনে ক্যালিকোর মতো প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব কতটুকু?’ শহরের অন্য কিছু জায়গায় সংস্কৃতি জগতের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেও মনে হয়েছিল, ক্যালিকো যেন একচেটিয়া সুবিধাভোগীদের পীঠস্থান।  

    হ্যাঁ। ভেবেছিলাম এইসব প্রশ্নই তুলে ধরব মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে। তাঁদের সন্দেহাতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে নয়, বরং তাঁদের এই উন্নাসিক সংস্কৃতি নিয়ে। অনলাইনে ক্যালিকো নিয়ে সমালোচনাগুলো মাথায় একে একে ভিড় করছিল। গাইড শিক্ষিত হলেও বড় তাড়াহুড়ো করেন, বয়নশিল্পের বিশেষজ্ঞরা এখানে এলেও তাঁদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ মেলে না, প্রদর্শনকক্ষগুলি দেখার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া হয় না, স্কেচিংয়ের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ, এমন নানা বিষয় নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার ইচ্ছে ছিল।   

    দরজার ওপারে মধুমালতীর গন্ধমাখা সবুজ গালিচায় মোড়া বাগান। গাছের পাতায়-ডালে শুধু রঙিন প্রজাপতি আর উজ্জ্বল টিয়াপাখিদের ওড়াউড়ি। চলছিল পাখিদের নেপথ্যসঙ্গীতও। সর্পিল পথের শেষে দেখি দাঁড়িয়ে আছে হাভেলি মিউজিয়ামের গৌরবময় পুরনো বাড়িটি। এটি ‘দ্য ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলস’-এরই অংশ।  

    এখানেই দেখা ক্যালিকো মিউজিয়ামের ডিরেক্টর অশোক মেহতা এবং ম্যানেজার দিলীপ শেঠের সঙ্গে। দুজনেই সজ্জন ব্যক্তি, অতিথিবৎসলও— কিন্তু আমার নিবন্ধ লেখার আগ্রহ দেখে কিছুটা অবাকই হলেন। তবে আপাদমস্তক পেশাদার বলে, সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য সব প্রস্তুতিই তাঁদের ছিল। মিউজিয়াম নিয়ে তিনটি ক্যাটালগ, আনুষঙ্গিক বইপত্র সব একসঙ্গে হাজির।  

    মেহতা বললেন, ‘এতেই সব পেয়ে যাবেন।’ ছবি দরকার হলে কীভাবে পাওয়া যাবে, জানিয়ে দিলেন শেঠ। চা-পর্ব মিটলে, দুজনে আয়েশ করে বসলেন। ‘বলুন, আর কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’   

    দরজার ওপারে মধুমালতীর গন্ধমাখা সবুজ গালিচায় মোড়া বাগান। গাছের পাতায়-ডালে শুধু রঙিন প্রজাপতি আর উজ্জ্বল টিয়াপাখিদের ওড়াউড়ি। চলছিল পাখিদের নেপথ্যসঙ্গীতও। সর্পিল পথের শেষে দেখি দাঁড়িয়ে আছে হাভেলি মিউজিয়ামের গৌরবময় পুরনো বাড়িটি। এটি ‘দ্য ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলস’-এরই অংশ। 

    প্রশ্ন? হ্যাঁ, আছে তো। বহির্বিশ্বের নিরিখে, দেওয়াল-ঘেরা ‘সিক্রেট গার্ডেন’-এ বসে কীভাবে দেখেন এই মিউজিয়ামকে? সাধারণ মানুষের সঙ্গে আপনাদের যোগ কতটুকু? বাইরের জগতের সঙ্গে জনসংযোগের কি এতটুকু প্রয়োজন নেই? বিশ্বের সর্বত্র আজ মিউজিয়ামগুলিকে কড়া চ্যালেঞ্জের, নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আধুনিক চিন্তা ও প্রযুক্তির ফলে মিউজিয়াম আর এখন নিছক দেখাশোনার জিনিস নয়। এখানে কর্তৃপক্ষ ও দর্শকের মধ্যে ভাবনার নিত্য আদান-প্রদান চলে। বহু ক্ষেত্রে দর্শকদের সক্রিয় যোগদানের ফলে মিউজিয়াম দর্শন অন্য মাত্রা পায়। ক্যালিকো কর্তৃপক্ষ এই বিষয়গুলি সম্পর্কে কতটা সজাগ? নিজেদের অস্তিত্বরক্ষায়, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রাখায় তাঁদের কোনও তাগিদ বা পরিকল্পনা আছে কি? এ ছাড়া, ব্যক্তিগত সংগ্রহ ও পারিবারিক ট্রাস্টি নিয়েও প্রশ্ন ছিল।  

    দুজনের সোজাসাপ্টা কথাবার্তা আমাকেও সহজ করে দিল। মেহতা বললেন, ‘সংরক্ষণ, সংরক্ষণ ও সংরক্ষণ। এই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।’ 

    তিনি আরও বললেন, ‘আমরা কাউকে বাদ দিতে চাই না। কিন্তু আমাদের মূল কাজই হল এই সব দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্মের সংরক্ষণ। জানি, এই মিউজিয়াম  নিয়ে বহুজনের আগ্রহ রয়েছে। তা ছাড়া, পাঁচ দশক ধরে দর্শকদের এই মিউজিয়াম ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু প্রবেশের ক্ষেত্রে বুকিং নিয়ন্ত্রণ আমাদের করতেই হয়। তখন আমরা আগ্রহীদের অন্য কোনও দিন আসতে বলি। এই নিয়ম বয়ন বিশেষজ্ঞ, সংস্কৃতি-সংক্রান্ত ইতিহাসবিদ, মন্ত্রী, কূটনীতিক, জনসাধারণ, সবার ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য।’ 

    মিউজিয়ামের মূল প্রবেশপথ, যা সারা বছর বন্ধই থাকে

    বেশ, বোঝা গেল ক্যালিকো মিউজিয়ামে ঢোকা কেন সহজ নয়। কিন্তু মিউজিয়াম যদি লোকশিক্ষা না দেয়, তাহলে তার থেকেই বা কী লাভ? দর্শক নিয়ন্ত্রণ করাই বা এতটা গুরুত্বপূর্ণ কেন? 

    উত্তর তৈরিই ছিল। দুটো জোরদার কারণ। প্রথমটি হল, দর্শকসংখ্যা বেড়ে গেলে শিল্পকর্মেরই ক্ষতি। বিশেষ করে গুজরাতের গরম আবহাওয়ায় প্রশিক্ষণ না পাওয়া দর্শকদের ভিড় হলে সংরক্ষণের দফারফা। সেই কারণেই প্রদর্শন কক্ষের তাপমাত্রা সংরক্ষণের রীতিনীতি মেনেই বজায় রাখতে হয়। মনে রাখবেন ক্যামেরার একটি ফ্ল্যাশের ঝলকানি বহু বছরের চেষ্টাকে নষ্ট করে দিতে পারে। কিছু কিছু শিল্পকর্ম এতটাই ভঙ্গুর যে, সেগুলি সামলাতে আমাদের বিদেশি বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে হয়। অনেক সময় সব চেষ্টা সত্ত্বেও সংগ্রহের ক্ষতি হয়। তাই দর্শকসংখ্যা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, নিশ্চয়ই করব। তাঁদের প্রবেশাধিকার অবশ্যই আছে। শুধু সেটি নিয়ন্ত্রিত, এই যা। 

    দ্বিতীয় কারণ শিক্ষা ও সচেতনতা। প্রত্যেক দর্শক চান সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে এবং গাইডের সুবিধা নিতে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, দর্শকসংখ্যা যত কম হবে, প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও তত সহজ হবে। আমাদের দর্শকদের প্রায় সবাই, হয় তাঁরা বিশেষজ্ঞ নয়তো বিষয়টি নিয়ে সত্যিই আগ্রহী। তাই প্রতিটি প্রশ্নই যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ দাবি করে। মুশকিল হয় তাঁদের, যাঁদের কোনও রকমে কিছু দেখলেই হল। কিন্তু যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা ঠিকই আসেন। যেমন আপনি আজ এসেছেন। এতটা বলে মেহতা একটু হাসলেন।  

    ক্যালিকো মিউজিয়াম সম্পূর্ণ ভাবে চলে সারাভাই ফাউন্ডেশনের অর্থে ও তত্ত্বাবধানে। তাঁরা সরকারি অর্থ পেতে উৎসাহীও নন। মিউজিয়ামে ঢোকার কোনও প্রবেশমূল্যও নেই। 

    মেহতা বললেন, ‘অর্থসাহায্য এলে স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে নানা  দাবিদাওয়াও। লগ্নিকারীরা কিছু চাইলে, সেটা ন্যায্য  হলেও, দেখতে হবে সেটা মিউজিয়ামের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না? তাই এই দাবিদাওয়ার পরিবেশ আমরা এড়িয়ে চলারই পক্ষপাতী।’ 

    একাধিক সরকার, পর পর কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতায় এসে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা মিউজিয়ামের লাভের কড়ির ভাগ চায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁদের সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়েননি। এর ফলে কোনও সরকারই আর মিউজিয়ামের কর্মকাণ্ডে মাথা গলায় না। মেহতা বললেন, ‘তারা জানে বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে, নিজেদের খরচে শিল্পকর্মের এই জাতীয় সম্পদ আমরা সংরক্ষণ করছি। এটাই যথেষ্ট।’

    খরচের বহর, বিশেষ করে পরিচর্যা খাতে, বড় কম নয়। শেঠ বললেন, ‘মূল বাড়িটি একটি হেরিটেজ বিল্ডিং। এখানে আরও পুরনো শিল্পকীর্তি সংরক্ষিত আছে। এর ফলে পরিচর্যা ও মেরামতির কাজ চলতেই থাকে। আমরা চাই দর্শকরা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরুন। কিন্তু তার জন্য ঘরগুলির তাপমাত্রা রক্ষা করা খরচসাপেক্ষ হওয়া ছাড়াও চ্যালেঞ্জিংও বটে। এই কারণে আমরা জাপানের বিখ্যাত সংরক্ষণ উপদেষ্টা নোবুকো গাজহিতানির সাহায্য নিয়েছি। গরম আবহাওয়ায় প্রাচীন শিল্পকর্ম রক্ষার ব্যাপারে তিনি আমাদের জরুরি পরামর্শ দিয়েছেন। এর পিছনেও একটা নির্দিষ্ট বাজেট ধরা আছে।’ 

    স্বাভাবিক ভাবেই, মিউজিয়ামের ব্যালান্স শিটে, পরিচর্যা খাতে ব্যয়, বেতনের থেকে বেশি। তেইশ একরের সাম্রাজ্য সামলাতে ট্রাস্টের প্রয়োজন হয় ১২৫ জন পুরো সময়ের কর্মীর। তাই মোট খরচের পরিমাণ এখান থেকেই আন্দাজ করা যায়। 

    মিউজিয়ামের আর একটি দিক নিয়েও শেঠ আমাদের সচেতন করলেন। ‘ক্যালিকো মিউজিয়ামের এই রিট্রিট কমপ্লেক্সটি হল উদ্ভিদের স্বর্গরাজ্য। বোটানিকাল গার্ডেন হিসাবেও এটি মান্যতা পেয়েছে। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষার জন্য এখানে প্রায়ই আসেন আহমেদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির ছাত্রছাত্রীরা। এত গাছগাছালি স্বাভাবিক ভাবেই আকৃষ্ট করে প্রজাপতি, পাখি ও ছোট জীবজন্তুকেও। এদের রক্ষা করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’  

    এখানে ঢোকার সময় বিশাল সংখ্যায় পাখি ও প্রজাপতির ওড়াউড়ির কারণটা এতক্ষণে স্পষ্ট হল।

    সবাইকে উৎসাহ ও কর্মনিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সারাভাই পরিবারকে ধন্যবাদ জানালেন মেহতা। এর ফলেই তিনি ও তাঁর টিম এই কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পেরেছেন। মেহতা বললেন, ‘সারাভাই পরিবার যৌথ দায়িত্ব দেওয়ায় বিশ্বাসী। তাঁরা জানেন, অন্যায় অনুরোধ, সে যারই হোক, রেখে আমরা কখনওই বদনামের ভাগী হব না।’

    মেহতা এবার আমায় ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র অনলাইন পেজে ‘মিউজিয়াম’ পরিচ্ছেদে নিয়ে গেলেন। দেখলাম সেখানে লেখা, ‘একাধিক প্রয়োজন মেটাতে মিউজিয়ামগুলি নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে অবসর বিনোদন, পাণ্ডিত্যের আদান-প্রদান, শিক্ষামূলক কেন্দ্র হিসাবে তুলে ধরা, জীবনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি, আঞ্চলিক পর্যটনে উৎসাহ দান, পৌর সচেতনতা গড়ে তোলা, জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডে, এমনকী বিশেষ কোনও ভাবধারা গঠনে সক্রিয় ভাবে প্রচার অভিযান চালানো।’ 

    মেহতার মতে, এর ফলেই আজকের মিউজিয়ামগুলি হয়ে উঠেছে বিষয়-বৈচিত্র্য, নানা আঙ্গিক এবং বিশাল কর্মকাণ্ডের জলজ্যান্ত নিদর্শন। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য একই। সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাজের সাংস্কৃতিক চেতনাকে তুলে ধরা।  

    তিনি বললেন, ‘আমরা যারা সংরক্ষণের কাজে যুক্ত, সেখানে যোগদানমূলক কাজকর্ম একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য পর্যন্তই যেতে পারে। এর পর এগোতে পারেন শুধু বিশেষজ্ঞরাই। তাই ক্যালিকোকে তার নিজের ভূমিকা পুনরাবিষ্কার করার দরকার নেই। তাকে শুধু সত্যনিষ্ঠ থাকতে হয় সংগ্রহশালার মূল সংজ্ঞার প্রতি। এটি এমন একটি স্থান, যেখানে কালজয়ী শিল্পকর্ম সংরক্ষিত হয় এবং সেগুলি দেখে আগ্রহী মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারেন।’

    এখানকার কর্মীরা মনে করেন শিল্পকর্ম ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে তাঁরা দেশের কাজই করছেন। এই সংগ্রহশালা নিয়ে এতটাই তাঁদের আবেগ, এতটাই স্থির তাঁদের লক্ষ্য। মিউজিয়াম অধিকর্তা অশোক মেহতা স্পষ্ট বলেই দিলেন, ‘আমার উদ্দেশ্য ছিল একটাই। কোনও চাপের কাছে মাথা নোয়াব না। আর সংরক্ষণ, সংরক্ষণ, সংরক্ষণ। এই হবে আমাদের মূলমন্ত্র। আমরা সেটা পেরেছি।’  

    কিছুটা হতাশার হাসি হেসে মেহতা বললেন, ‘আগেকার সংরক্ষণের প্রয়োজনের সঙ্গে এখনকার আচার-অভ্যাস মেলানো বড় কঠিন ব্যাপার। তাই সে চেষ্টাই করি না। ভাগ্যিস আমরা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কোনও প্রতিযোগিতায় নেই! নাহলে নির্ঘাত হেরে যেতাম।’

    এ-বিষয়ে একমত হতেই হল। সত্যিই তো, আজ যদি কেউ মিউজিয়ামে গিয়ে যোগদানমূলক কর্মকাণ্ডে শরিক হয়ে, সেখানকার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট না করে, তা হলে তো তার মিউজিয়াম দর্শন ষোলো আনাই মাটি! 

    আলাপচারিতার শেষ দিকে এসে কেবলই মনে হচ্ছিল, ক্যালিকো মিউজিয়ামের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি এক গোলকধাঁধার সম্মুখীন। অন্য এক যুগের দুষ্প্রাপ্য শিল্পকর্মের তাঁরা অভিভাবক, অথচ তাঁদের রোজ লড়ে যেতে হচ্ছে আজকের সময়ের সঙ্গে। তাঁদের বিরুদ্ধে উঠছে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন থাকার অভিযোগ। 

    হয়তো তাঁরা নিজেদের বদলাবেন না। কিন্তু আমাদেরও বুঝতে হবে, আধুনিক মিউজিয়ামগুলি দর্শকদের সক্রিয় যোগদানের ফলে যতই মানবিক হয়ে উঠুক আর সমাজে পরিবর্তন আনুক, শুধুই সংরক্ষণে নিমজ্জিত, পুরনো ধারার মিউজিয়ামগুলি কখনওই গুরুত্ব হারাবে না। 

    আবার একই সঙ্গে, এইসব মিউজিয়ামকে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। প্রশ্ন ধেয়ে এলে, তার উত্তর দেওয়ার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। এমন যেন না হয় যে, পুরাকীর্তি সংরক্ষণ করতে গিয়ে তাঁদের চিন্তাধারাও মান্ধাতার আমলে আটকে গেল। আমাদের ইতিহাসকে জীবন্ত রাখতে এদের ভূমিকাও ফেলনা নয়। বর্তমান ক্রিয়াকলাপ আর ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা, দু’ক্ষেত্রেই তাঁদের সক্রিয় থাকতে হবে। ক্যালিকো মিউজিয়ামের সংগ্রহ সম্পর্কে অধিকর্তা জানালেন, এ বিষয়ে অনলাইনে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া আছে। 

    শেষে একটা কথাই বলি। আহমেদাবাদ গেলে আগে থেকে এই মিউজিয়ামে যাওয়ার স্লট বুক করে রাখুন। এটা ঠিকই যে এই বিপুল ধনসম্পদ তাঁদেরই, কিন্তু সেখান থেকে ঘুরে এসে আপনিও কম সমৃদ্ধ হবেন না। 

    ক্যালিকো-পরিচিতি : ১৯৮২ থেকে সারাভাই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে থাকা দ্য ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলস এবং সারাভাই ফাউন্ডেশনের গ্যালারিগুলি আহমেদাবাদের শাহিবাদ এলাকার দ্য রিট্রিট’-এ অবস্থিত। এখানে এলে বহু শতাব্দী ধরে চলে আসা ভারতীয় বয়নশিল্পের বিভিন্ন ধারার পরিচয় পাওয়া যায়। রোজকার পোশাক ছাড়াও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত তাঁবু ও শামিয়ানাও। উল্লেখযোগ্য সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর পালাম্পোর বা বিছানার ঢাকা, মুঘল দরবার, গুজরাত ও রাজস্থানের রাজপুরুষদের ব্যবহার করা মধ্যযুগীয় জমকালো পাটকা। রয়েছে সূক্ষ্ম সোজনি বা ফুলকারি হস্তশিল্পের শাড়ি। ক্যালিকোকে এক কথায় বলা যায় রকমারি ভারতীয় পোশাকের এক বিশাল ভাণ্ডার। গ্যালারিগুলিতে স্থান পেয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীতে নির্মিত ব্রোঞ্জের শিল্পকর্ম, রাজস্থানের বিখ্যাত বৈষ্ণব পিছভাই শিল্পকলা, জৈন চিত্রকলা ও মিনিয়েচার পেন্টিং।

    www.calicomuseum.org

    অনামিকা দেবনাথ, 
    অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, কলকাতা
    (ভারত সরকারের বস্ত্র মন্ত্রকের অধীন)


    ‘ক্যালিকো মিউজিয়াম দেশের এক অমূল্য সম্পদ। ওখানকার সংগ্রহ দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে তিনবার গিয়েও আশ মেটেনি। সব থেকে ভাল ব্যাপার হল, যাঁরা এই বিষয়ে সত্যিই আগ্রহী, শুধু তাঁরাই এই সংগ্রহশালা দর্শনে যান।’

    ‘সংরক্ষণে তাঁরা তুলনাহীন। জানি ওখানে প্রবেশ নিয়ে কড়াকড়ি আছে, কিন্তু জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণের স্বার্থে এটুকু মেনে নেওয়াই যায়। বিপজ্জনক ও ভঙ্গুর হেরিটেজ সাইট সংরক্ষণের জন্য দেশের সরকার তো একই রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে। সংরক্ষণই যেখানে মূল লক্ষ্য, সেখানে জনতার জন্য সব কিছু উন্মুক্ত করার দরকার নেই।’

    ‘ব্যক্তিগত ভাবে, আমি মনে করি না দেশের সব সম্পদের স্বত্বাধিকারী সরকারকেই হতে হবে। অনেক সময় সংরক্ষণের জন্য সরকারের হাতে যথেষ্ট অর্থবল, লোকবল এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞ থাকে না। তা ছাড়া একই বিষয়ে বিভিন্ন সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতিও হয়েছে। ক্যালিকোর মতো বেসরকারি অথচ অসাধারণ মিউজিয়ামের প্রতি আমার সবসময় সমর্থন থাকবে।’
     
    ‘এখনকার বহু মিউজিয়ামে যোগদানমূলক কাজকর্ম এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, সব সংগ্রহ ছোঁওয়া উচিত নয়। জনসাধারণের কাছে জাদুঘরকে প্রাসঙ্গিক করার অন্য উপায়ও আছে। কিন্তু সব জাদুঘরকে একই উদ্দেশ্য নিয়ে চলতে হবে, এমন কোনও কথা নেই।’ 

    ছবি তুলেছেন : কুশল বাটুঙ্গে

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook