ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সিনেমার মোৎজার্ট


    অ্যান্ড্রু রবিনসন (Andrew Robinson) (May 15, 2021)
     

    ১৯৫৫ সালে ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’ সিনেমার শুটিং-এর জন্য লোকেশন খুঁজতে ভারতে আসেন জন হুস্টন। কলকাতায় যখন আসেন, তখন বিজ্ঞাপনের জগতের একজন একেবারেই অচেনা, অখ্যাত, বিজ্ঞাপন জগতের শিল্পীর বানানো প্রথম সিনেমার খানিকটা নির্বাক রাফ কাট দেখেন তিনি। সিনেমার নাম ‘পথের পাঁচালী।’ হুস্টনের খুব পছন্দ হয়েছিল, তবে সত্যজিৎকে সাবধানও করেছিলেন, সিনেমার চরিত্রদের যেন বেশি ঘোরাফেরা করতে না দেখানো হয়; ‘দর্শক অধৈর্য হয়ে পড়ে। কিছু একটা কখন ঘটবে, তা দেখার জন্যে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে তারা ভালবাসে না’— বহু বছর পরে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকায় সত্যজিতের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে হুস্টনের এই কথাগুলো। নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টসের প্রদর্শনীর পরিচালকের কাছে হুস্টন সিনেমাটির সুখ্যাতি করেছিলেন, তার ফলেই ১৯৫৫ সালে মোমা-তে সিনেমাটির বিশ্ব প্রিমিয়ার হয়। সত্যজিতের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের সূত্রপাতও এখানেই। ‘ইনার আই’ নামে সত্যজিতের জীবনীটি লেখার কাজ যখন করছি, সে সময়ে ১৯৮৭ সালের একটি চিঠিতে, মৃত্যুর কিছুদিন আগেই, হুস্টন আমাকে বলেন, ‘ওই ফুটেজে একজন মহান চিত্রনির্মাতার সন্ধান পেয়েছিলাম। প্রথম আলাপেই আমার সত্যজিৎকে ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। ছবিটা দেখে আমার সবকিছুই খুব ভাল লেগেছিল।’ 

    ‘জলসাঘর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র মতো সত্যজিতের আরও কিছু সিনেমার সঙ্গে অপু ট্রিলজির প্রথম ভাগ ‘পথের পাঁচালী’ও অবশ্য বহুদিনই বাংলায় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে ক্লাসিক হিসেবে সম্মানিত। এসব সিনেমার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো, আকিরা কুরোসাওয়া, জঁ রেনোয়া এবং মার্টিন স্করসেসির মতো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চিত্র-পরিচালকেরা। ১৯৯১ সালে সত্যজিতের সত্তর বছরের জন্মদিন উপলক্ষে অ্যাটেনবরো (‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিনেমায় যিনি জেনেরাল আউটরামের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন) লিখছেন, ‘সত্যজিৎ একজন ‘বিরল প্রতিভার জিনিয়াস।’ কুরোসাওয়ার মতে, ‘সত্যজিতের সিনেমা না দেখা মানে কোনদিন চন্দ্র-সূর্য না দেখে এ দুনিয়ায় বাস করা।’ ‘বয়স এখনও বেশ কম হলেও সত্যজিৎ ভারতীয় সিনেমার জনক’, এ কথা বলেছিলেন রেনোয়া, বাংলায় আগমনের সময়ে সেই ১৯৪৯ সালেই যিনি সত্যজিৎকে পথের পাঁচালী গল্পটি নিয়ে কাজ করার উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। স্করসেসি বলেছিলেন, ‘সত্যজিতের জাদু, তাঁর চিত্রকল্পের সহজ কাব্য সবসময়ই আমার মনে থাকে।’ এ কথাটি তাঁর ১৯৯১ সালে বলা, যার অল্প কিছুদিন পরেই সত্যজিতের সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে একটি অস্কার পুরস্কার (সত্যজিতের প্রথম অ্যাকাডেমি পুরস্কার) দেবার ব্যবস্থা করেন স্করসেসি। এ পুরস্কার পাওয়ার ঠিক পরে পরেই, ১৯৯২ সালে, সত্যজিৎ মারা যান। 

    ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবির শুটিংয়ে অভিনেতা সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়

    এঁদের ছাড়াও সত্যজিতের সিনেমার অনুরাগীদের দলে রয়েছে অঁরি কার্তিয়ের-ব্রেসোঁর মতো চিত্রশিল্পীরা, মস্তিস্লাভ রস্তোপোভিচের মতো সঙ্গীতশিল্পীরা, ভি এস নাইপল বা সলমন রুশদির মতো লেখকেরা, এবং পলিন কেল বা ডেভিড রবিনসনের (যিনি চার্লস চ্যাপলিনের জীবনী লিখেছিলেন) মতো প্রথম সারির সিনেমা সমালোচকেরা। আশির দশকে নাইপল আমাকে বলেছিলেন, ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ হচ্ছে ‘শেক্সপিয়রের কোনও দৃশ্যের মতো— সংলাপে কেবল শ’তিনেক মতো শব্দ আছে, তবে আশ্চর্য, কত দুর্দান্ত কাণ্ডই না ঘটে!’

    মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি এবং আকিরা কুরোসাওয়া, আগ্রা, ১৯৭৭। ছবি: সত্যজিৎ রায়

    তবে সত্যজিৎকে তাঁর সিনেমার গতি নিয়ে হুস্টন একান্তে যে সাবধানবাণী দিয়েছিলেন, তা অমূলক ছিল না। বহু অ-বাঙালি দর্শক সত্যজিতের সিনেমাকে তাচ্ছিল্য করেন, কারণ তাঁদের মতে সিনেমাগুলোর গতি বড্ড শ্লথ। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে তাবড় তাবড় আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যত পুরস্কারই পেয়ে থাকুন না কেন, পাশ্চাত্যের দর্শকের কাছে অ্যাটেনবরো, কুরোসাওয়া, রেনোয়া বা স্করসেসির মতো পরিচিতি সত্যজিৎ পাননি। ভারতেও যে তাঁর সিনেমার খ্যাতি মূলত বাংলায়, গোটা উপমহাদেশে নয়, সে কথা সত্যজিৎ নিজে ভাল করেই জানতেন। এ কারণেই ভারত সরকার একটি বিরাট ‘সত্যজিৎ রায় মিউজিয়াম’ বানাতে চাইছেন কলকাতাতেই। দিল্লি বা মুম্বইয়ে নয়। এ স্বপ্ন যদি পূর্ণ হয়, তবে কোনও চিত্র-পরিচালককে উৎসর্গ করে একটি গোটা মিউজিয়াম বানানোর এই নিদর্শন হবে পৃথিবীতে দ্বিতীয়। এর আগে মাত্র একটি এমন নিদর্শন হল, সত্যজিতের প্রথম জীবনের অনুপ্রেরণা চ্যাপলিনের প্রাক্তন বাড়িতে ‘চ্যাপলিনজ ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সুইস প্রদর্শনী।

    সত্যজিতের সিনেমার আকর্ষণ ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে এতটা আলাদা কেন, তাঁর জন্মশতবর্ষে এ প্রশ্ন তোলা প্রয়োজনীয়। কেন কারও কারও কাছে তিনি জিনিয়াস, আবার অন্যদের কাছে ব্রাত্য ও অপরিচিত? ব্যক্তিগতভাবে আমি গোটা পৃথিবীতে যতজনকে চিনি, সত্যজিতের সিনেমা নিয়ে তাঁদের বেশির ভাগেরই ধারণা খুব অল্প। সত্যি কথা বলতে, এঁদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয়। 

    মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি এবং আকিরা কুরোসাওয়া, আগ্রা, ১৯৭৭। ছবি: সত্যজিৎ রায়

    আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা এবং মর্ম বোঝার পথে অনেকগুলো বাধা রয়েছে। প্রথমত, এসব সিনেমায় প্রতিফলিত হয়েছে সত্যজিতের বড় হয়ে ওঠার সাথে ওতপ্রোত প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের পরিশীলিত ও সূক্ষ্ম সংমিশ্রণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতোই, সত্যজিৎও যে পরিবারের ছেলে, সে পরিবারে পাশ্চাত্যের সাহিত্য ও দর্শন, এমনকী বিজ্ঞান (সত্যজিতের ঠাকুরদা, লেখক ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতমানের মুদ্রক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এর প্রমাণ) নিয়ে একটা প্রবল আগ্রহের চল ছিল। সত্যজিতের বাবা সুকুমার রায়, লেখা ও ছবি আঁকায় যাঁর নাম বাঙালির ঘরে ঘরে ফেরে, অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন লুইস ক্যারলের থেকে (অক্সফোর্ডের গণিতজ্ঞ চার্লস ডজসন)। কৈশোরে সত্যজিৎ নিজেও মেতে উঠেছিলেন পশ্চিমের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে, যে অভ্যাস সেই সময়ের বাঙালি পরিবারে বিরল ছিল। বিশেষ করে বেঠোফেন এবং মোৎজার্ট ছিলেন তাঁর পরম প্রিয়। ১৯৮২ সালে আমাদের প্রথমবারের আলাপে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘যখন ইউরোপীয় সাহিত্য পড়ছি, বা ইউরোপীয় ছবি দেখছি, অথবা পাশ্চাত্যের সঙ্গীত শুনছি, সে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই হোক বা লঘুসঙ্গীত, আমার কখনওই মনে হয়নি যেন কোনও অনাত্মীয়, বহিরাগত সংস্কৃতির সাথে যুঝতে হচ্ছে।’ বলা বাহুল্য, বাংলা এবং ইংরাজি দুই ভাষাতেই সত্যজিতের দখল ছিল বিখ্যাত। এই প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণের কারণে অনিবার্যভাবেই সত্যজিতের সিনেমার বহু দিকই ভারতের বাইরের দর্শকের কাছে অচেনা বা দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে, বারবার হোঁচট খান তাঁরা। সত্যজিতের দর্শনমনস্ক অন্তিম সিনেমা ‘আগন্তুক’-এ ‘নাসা’র সঙ্গে ‘নেশা’-র যে ‘পান’ বা শব্দের খেলা গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, তার মর্ম কতজন আন্তর্জাতিক দর্শক বুঝবেন?  

    অ্যান্ড্রু রবিনসন প্রণীত ‘সত্যজিৎ রায়: দি ইনার আই’ বইয়ের প্রচ্ছদ

    দ্বিতীয়ত, সিনেমাগুলোয় মূলত প্রকাশিত হয়েছে বাংলার সংস্কৃতি। সত্যজিতের মহান অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়, ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের বাইরেও বাংলার যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল, তুলনামূলকভাবে এ-যুগে তার স্বল্পই ছিল অবশিষ্ট। পাশ্চাত্যের বহু দর্শকই সম্ভবত ভেবেছেন, বাংলার বিষয়ে সিনেমা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী দরকার? যে ভাবনা হয়তো তাঁদের মাথায় আসেনি কুরোসাওয়ার বর্ণিত জাপান নিয়ে।

    তৃতীয়ত, সিনেমাগুলোর সংলাপ প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বাংলা ভাষায়— যা বেশির ভাগ দর্শকের কাছে, এমনকী ভারতেও, দুর্বোধ্য। সত্যজিতের অ-বাংলা কাহিনিচিত্র ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ যে অ্যাটেনবরো, নাইপল এবং স্করসেসির উপর বিশেষভাবে প্রভাব ফেলেছিল, তা আকস্মিক নয়। স্করসেসি বলেছিলেন, ‘ইতিহাস রচিত হচ্ছে— তা দেখানোর সাহস খুব কম পরিচালকেরই হয়েছে। ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সময়ে বেঁচে থাকতে বোধহয় এমনই লাগে। একইসঙ্গে তা দূরবর্তী এবং ট্র্যাজিক।’ ১৯৭৭ সালে লন্ডন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটির বিশ্ব প্রিমিয়ারে, স্বয়ং সত্যজিতের উপস্থিতিতে দেখা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ অবশ্যই আমাকেও আচ্ছন্ন করেছিল। সত্যজিতের জীবনী লেখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি বড় কারণ ছিল সেদিনের অভিজ্ঞতা। সত্যজিতের অন্য ফিচার ফিল্মের থেকে এ সিনেমাটি আলাদা, কারণ এখানে আংশিকভাবে হলেও (সুদক্ষ) ইংরেজি ভাষায় বাংলার বাইরের ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন বর্ণিত হয়েছে। 

    উপরে উল্লিখিত বাধাগুলোর একটা উদাহরণ হিসেবে ‘অপুর সংসার’ সিনেমার একটি উজ্জ্বল, অপূর্ব দৃশ্যের কথা ধরা যাক। অপু অন্যমনস্ক হয়ে মুখে একটা সিগারেট দেওয়ায় (শুধু খাওয়ার পরে একটা করে খাবে, স্ত্রীকে দেওয়া সে-প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে), তার স্ত্রী অপর্ণা দেশলাই ধরিয়েছে। অপুর চোখে পড়ে, আগুনের আলোয় অপর্ণার চোখেমুখে এক আশ্চর্য উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে। অপু কোমল স্বরে প্রশ্ন করে, ‘তোমার চোখে কী আছে বলো তো?’ অপর্ণা দুষ্টুমি করে উত্তর দেয়, ‘কাজল’, যার অর্থ চোখে দেবার ‘কোহল’, ইংরেজি সাবটাইটলে তাই বলা হচ্ছে। তবে বাঙালি দর্শকের কাছে অপর্ণার এই ‘কাজল’ তার শিশুসন্তানেরও নাম, অপু ও অপর্ণার যে-শিশু সিনেমায় আর কিছুক্ষণ পরেই জন্মাবে, এবং যাকে জন্ম দিতে গিয়ে অপর্ণার মৃত্যু হবে। অ-বাঙালি দর্শকের কাছে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবেগ এবং শৈল্পিক যোগসূত্রটি অধরা রয়ে যায়, কারণ এই কথার খেলার কোনও অনুবাদ অনিবার্যভাবেই অসম্ভব। এই দ্বৈত-অর্থের মধ্যে দিয়ে হয়তো সত্যজিৎ অতি সূক্ষ্মভাবে জানাতে চেয়েছেন, বহুদিন কাজলকে প্রত্যাখ্যান করেও, অবশেষে তার স্ত্রীর প্রয়াণের বহু বছর বাদে সিনেমার শেষ দৃশ্যে অপু ছেলেকে কোলে তুলে নেবে।

    চতুর্থ এবং শেষ কথা, শিল্পী হিসেবে সত্যজিতের ছিল বহুমুখী প্রতিভা। আশ্চর্য ভাবে, চিত্রনাট্য তিনিই লিখতেন, সেট এবং সাজপোশাকের ডিজাইনও করতেন, ক্যামেরা তিনিই চালাতেন, সম্পাদনা নিজেই করতেন, আবহসঙ্গীত তৈরি করতেন, আর এই সব কিছুর সঙ্গে করতেন পরিচালনা। এছাড়াও শিশুদের এবং বড়দের বই তিনি লিখেছেন এবং তার জন্য ছবি এঁকেছেন। লেখক ও প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবেও তাঁর ছিল অপার জনপ্রিয়তা, প্রচ্ছদের জন্য তাঁর নাম তো সিনেমা করারও আগে থেকে। সমস্ত বাঙালির কাছে অতিপরিচিত তাঁর বহু রসিক ও মজাদার গান, যা নিজের সিনেমার জন্যেই তিনি বেঁধেছিলেন। তাঁর শেষযাত্রায় শ্মশানের পথে যে বিরাট জনতা কলকাতার রাস্তায় তাঁর দেহের সাথে মিছিলে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই মুখে মুখে সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল এইসব গান, বিশেষত ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ সিনেমার ‘মহারাজা তোমারে সেলাম’। এই ‘বহুমুখী প্রতিভা’— যা পৃথিবীর মহান চিত্র-পরিচালকদের মধ্যে অনন্য, এমনকী চ্যাপলিনের ক্ষেত্রেও— সারা পৃথিবীতেই পেশাদার সিনেমাওয়ালাদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহের বীজ বপন করেছে, বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, যখন সব ক্ষেত্রেই স্পেশালাইজেশনের ঢেউ উঠছে, সব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞের খোঁজ পড়ছে। 

    সত্যজিৎ কি জিনিয়াস ছিলেন (অ্যাটেনবরো এবং অন্য অনেকেই কিন্তু এ কথা বলেছেন)? নিজের ‘আওয়ার ফিল্মস দেয়ার ফিল্মস’ বইতে চিত্র-পরিচালকদের ক্ষেত্রে সত্যজিৎ জিনিয়াস কথাটি সীমাবদ্ধ রেখেছেন শুধু চ্যাপলিন এবং জন ফোর্ডের জন্য। সত্যজিতের প্রকৃত বিচার করার জন্য সময়ের যে দূরত্বটুকু আমাদের দরকার, আমরা হয়তো পাইনি— এখনও তাঁর সময়ের বড় কাছাকাছি আমাদের বসত। অনেক সময়ে জিনিয়াসদের মৃত্যুর পরে বিশ্ব-জনতার বহু দশক লেগে যায় তাঁদের প্রকৃত মর্ম বুঝতে— জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ, রবীন্দ্রনাথ, এমনকী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের ক্ষেত্রেও এ ঘটনা ঘটেছিল। সত্যজিতের আর এক অনুরাগী, জেরার্দ দেপারদিউ— ১৯৯০ সালে সত্যজিতের শেষের আগের সিনেমার ‘শাখা-প্রশাখা’র প্রযোজনা করতে ইনিই সাহায্য করেন— তাঁর সিনেমার তুলনা করেছিলেন মোৎজার্টের সঙ্গীতের সঙ্গে। ১৯৩০-এর দশকের পর থেকে সত্যজিতের যে গভীর সঙ্গীতমনস্কতা, তাতে মোৎজার্টের অবদান অনস্বীকার্য। নিজের মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৯৯১ সালে মোৎজার্টের দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষ্যে সত্যজিৎ ‘হোয়াট মোৎজার্ট মিনস টু মি’ নামে একটি রেডিও সম্প্রচার করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘চারুলতা’ সিনেমায় প্রধান তিন চরিত্রের (চারু, ভূপতি, ও অমল) যে সম্মিলিত ‘অনসম্বল’ পারফর্ম্যান্স, তার অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন মোৎজার্টের অপেরায় সম্মিলিত কন্ঠসঙ্গীতের ব্যবহার থেকে। ১৯৬৪ সালে  ‘চারুলতা’ বানাবার সময়ে সত্যজিৎ চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’ সিনেমার তুলনা করেন মোৎজার্টের ‘দ্য ম্যাজিক ফ্লুট’ অপেরার সরলতার নির্যাস, স্টাইলের শুদ্ধতা এবং নিখুঁত কারিগরির সঙ্গে। সত্যজিতের মতে  ‘দ্য ম্যাজিক ফ্লুট’ মোৎজার্টের অপেরাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মোহনীয়, সবচেয়ে বেপরোয়া এবং সবচেয়ে সাবলাইম সৃষ্টি! আমার মতে সত্যজিতের শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলোয় এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে। সত্যজিতের নিজের জীবনের এবং নিজের বেশির ভাগ সিনেমার খাঁটি বাঙালিত্ব সত্ত্বেও, তাঁর জন্মের একশো বছর পরে মোৎজার্টের অনস্বীকার্য জিনিয়াসই বোধহয় তাঁর সবচেয়ে জুতসই তুলনা— তিনি সিনেমার জগতের মোৎজার্ট!

    অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘সত্যজিৎ রায়: দি ইনার আই’ বইয়ের লেখক, যে বইয়ের তৃতীয় সংস্করণ ২০২১ সালে ব্লুমবসবারি পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হবে।


    জুন ২১, ২০২১ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অ্যান্ড্রু রবিনসন-এর লেকচার ‘আ সেঞ্চুরি অফ সত্যজিৎ রায়’।
    লিঙ্ক:
    https://www.britishmuseum.org/events/members-exclusive/century-satyajit-ray-1921-2021

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook