রীতিমতো রোগা, দেখতে অত্যন্ত নিরীহ, হাইট তোপসের চেয়ে অন্তত দুই ইঞ্চি কম। মানে পাঁচ ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চির মতো। তোপসের বয়স তখন পনেরো। মাথা-ভর্তি কোঁকড়া চুল। যে লোকটির কথা বলা হচ্ছে, তাঁর বয়স তখন পঁয়ত্রিশ। ফেলুদা ও তোপসের সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা হয়, সেদিন তাঁর পরনে ছিল বুশশার্ট আর প্যান্ট, পায়ে পাঁচ নম্বর জুতো। রেলগাড়ির কামরায় প্রথম দেখা গিয়েছিল এই চরিত্রটিকে। আগ্রা ফোর্ট স্টেশন থেকে বান্দিকুই যাওয়ার ট্রেনটা যখন উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে রাজস্থানে ঢুকছে, ঠিক তখনই ওই ভদ্রলোক প্রথম কথা বলেন, ‘এখানে রোদের তেজই আলাদা। সাধে কি আর লোকগুলো এত পাওয়ারফুল!’
আলাপের পর জানা গেল, তিনি একজন রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লেখক। নাম লালমোহন গাঙ্গুলী, লেখেন জটায়ু ছদ্মনামে, বাড়ি ভদ্রেশ্বরে। ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর, এই থ্রি মাস্কেটিয়ার্স বাংলা সাহিত্যের একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পেরেছিল। যত দিন গেছে, ততই আমাদের প্রিয় থেকে প্রিয়তর হয়ে উঠেছেন লালমোহনবাবু।
লেখার কারণে, যত দিন গেছে, জটায়ুকে আমরা নানাভাবে চিনতে পেরেছি। তাঁর মতো বিষয়ী, জীবনশক্তিতে ভরপুর, ভদ্র ও উদার, সজাগ, কর্মক্ষম, আদ্যোপান্ত বাঙালি ব্যক্তিত্ব খুবই বিরল। এমনই এক চরিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায় অভিনেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সন্তোষ দত্তকে। ছবির নাম ‘সোনার কেল্লা’। সন্তোষ দত্ত এই জটায়ু চরিত্রটিকে ছবিতে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন, ছবি মুক্তির পরের বছরেই প্রকাশিত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ উপন্যাসে সত্যজিতের তুলিতে জটায়ুর চেহারা আমূল বদলে সন্তোষ দত্তের মতো হয়ে যায়। একজন অভিনেতার কারণে সাহিত্যের চরিত্র এমনভাবে বদলে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেছে বলে মনে হয় না।
আরও পড়ুন: কমেডি অভিনয়েও অন্য মাত্রা এনেছিলেন রবি ঘোষ!
লিখছেন সৌগত বসু…

সন্তোষ দত্ত প্রথম জীবনে ছিলেন ব্যাঙ্কের কেরানি। ইম্পেরিয়াল ব্যাংক। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আইন পরীক্ষা দিয়ে বদল করে নেন পেশা। ১৯৫৭ সাল থেকে তিনি ‘অ্যাডভোকেট’। ক্রিমিনাল ল-ইয়ার হিসেবেই ছিলেন সুপরিচিত। এর পাশাপাশি চলত অভিনয় করা। অভিনয়ের প্রতি টানটা ছিল ছেলেবেলা থেকেই। বাবা পূর্ণচন্দ্র দত্ত ছিলেন যথার্থ অভিনয়-রসিক। নিজে তো অভিনয় করতেনই, ছেলেকেও অভিনয়ে উৎসাহ দিতেন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল বর্ধমান জেলার পলাশি গ্রামে। সেই গ্রামের বাড়িতে পুজোর সময় হত নাটক। অংশগ্রহণ করত ছোট-বড় সবাই। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই সন্তোষ দত্ত সেই দলের অভিনেতা। শুধু তাই নয়, সাত বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবার ক্লাবে ‘শাজাহান’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। কলকাতায় এসে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে চলত নাটকের রেওয়াজ। সবিতাব্রত দত্ত, নির্মলকুমার প্রমুখ নাট্যরসিকদের সঙ্গে গড়ে তোলেন নাট্যসংস্থা ‘আনন্দম’। পরে যার নাম হয় ‘রূপকার’। এই ‘রূপকার’ নাট্যসংস্থার সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরি’ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখেই সত্যজিৎ রায় তাঁকে ছবির জগতে নিয়ে আসেন। প্রথম ছবি ‘পরশপাথর’। ১৯৫৭ সাল। প্রথম ছবিতে খুবই ছোট চরিত্রে রূপদান করেছিলেন। কিন্তু তাতেই তিনি দেখাতে পেরেছিলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা। ছবিতে প্রধান চরিত্র পরেশচন্দ্র দত্তের ভূমিকায় ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। পরেশবাবুর সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা দেবেন জনৈক ব্যক্তি। এই চরিত্রটি করেছিলেন সন্তোষ দত্ত। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘চরিত্রটি ছোট হলেও সেটা করতে খুব ভাল লেগেছিল। ছয়-সাত লাইন লম্বা সংলাপ ছিল। তখন আমি নতুন লোক। সে-কারণে আমার জন্য আর আটশো-নশো ফিট ফিল্ম অ্যালট করা হয়েছিল। আমি সেটা করে দিই আড়াইশো ফিটের মধ্যে।’
প্রথম অভিনয় থেকেই নজরে ছিলেন সত্যজিতের। পরের তিনটি ছবিও সত্যজিতের। তিন কন্যার ‘সমাপ্তি’, এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিতে ‘মহাপুরুষ’-এর পর চতুর্থ ছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’। দ্বৈত চরিত্র শুণ্ডির রাজা আর হাল্লার রাজা। এই ছবিতে অভিনয় করেই তিনি দর্শক এবং অন্যান্য পরিচালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘গণদেবতা’, তপন সিংহ-র ‘হারমোনিয়াম’, ‘এক যে ছিল দেশ’, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’, দীনেন গুপ্তর ‘মর্জিনা আবদাল্লা’, শংকর ভট্টাচার্যর ‘শেষরক্ষা’, পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘মালঞ্চ’ ‘স্ত্রীর পত্র’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন।

৩১ বছরের অভিনয়-জীবনে সন্তোষ দত্ত সত্যজিতের আটটি ছবি ও একটি তথ্যচিত্রে অভিনয় করেন। যার মধ্যে দু’টিতে ছিলেন দ্বৈত চরিত্রে। এবং বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিটি ছবিতেই তিনি অনন্য। ‘পরশপাথর’-এর সংবর্ধনা সভায় বক্তা, ‘সমাপ্তি’-তে কিশোরী, ‘মহাপুরুষ’-এ প্রফেসর ননী, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে শুণ্ডির রাজা ও হাল্লার রাজা, ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু, ‘জনঅরণ্য’-তে পুরনো বাড়ি ভাঙার দালাল হীরালাল, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতেও দ্বৈত ভূমিকায় শুণ্ডির রাজা ও গবেষক এবং ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে ‘হযবরল’ অংশে অভিনয় করেছিলেন উদো-র ভূমিকায়।
কৌতুকাভিনেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করলেও তিনি চেয়েছিলেন নিজেকে চরিত্রাভিনেতা রূপেই প্রতিষ্ঠিত করতে। অভিনয়-জীবনে তিনি তাঁর বাবার একটি উপদেশ সবসময় মেনে চলেছেন। তাঁর বাবা বলতেন সার্থক অভিনেতা হতে গেলে তিনটি গুণের অধিকারী হতে হবে; দর্শন, অনুধাবন ও অনুশীলন। এই তিনের অধ্যাবসায়ে তিনি অভিনয়ে, বিশেষ করে সিরিও কমিক অভিনয়ে নিয়ে এসেছিলেন নতুন মাত্রা।
চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি প্রথম জীবনে গ্রুপ থিয়েটারে এবং পরে বাণিজ্যিক থিয়েটারেও সমানে অভিনয় করে গেছেন। নিজের গ্রুপ, রূপকার ছাড়াও শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’-তে তিনি অভিনয় করেছিলেন। রঙ্গনা, বিশ্বরূপা, সারকারিনা প্রভৃতি থিয়েটারে তাঁকে দেখা গিয়েছে ‘নটনটী’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘বিষ’ প্রভৃতি নাটকে। জীবনের শেষ অভিনয় ছিল রঙ্গনায় ‘কনে বিভ্রাট’ নাটকে। শেষ ছবি পিসি সরকারের ‘গিলি গিলি গে’।
৩১ বছরের অভিনয়-জীবনে সন্তোষ দত্ত সত্যজিতের আটটি ছবি ও একটি তথ্যচিত্রে অভিনয় করেন। যার মধ্যে দু’টিতে ছিলেন দ্বৈত চরিত্রে। এবং বলতে দ্বিধা নেই, প্রতিটি ছবিতেই তিনি অনন্য। ‘পরশপাথর’-এর সংবর্ধনা সভায় বক্তা, ‘সমাপ্তি’-তে কিশোরী, ‘মহাপুরুষ’-এ প্রফেসর ননী, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে শুণ্ডির রাজা ও হাল্লার রাজা, ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবিতে রহস্য-রোমাঞ্চ লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু, ‘জনঅরণ্য’-তে পুরনো বাড়ি ভাঙার দালাল হীরালাল, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতেও দ্বৈত ভূমিকায় শুণ্ডির রাজা ও গবেষক এবং ‘সুকুমার রায়’ তথ্যচিত্রে ‘হযবরল’ অংশে অভিনয় করেছিলেন উদো-র ভূমিকায়।
টেলিভিশনে তিনি কয়েকটি সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘অভিনন্দন ভগীরথ’, ‘গোয়েন্দা ভগবান দাস’, ‘বীক্ষণ’। যে মাধ্যমেই অভিনয় করুন না কেন, সন্তোষ দত্তের অভিনয়ের সাবলীলতা ও স্বাভাবিকতা চরিত্রটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারত।
সন্তোষ দত্ত যে শুধু বিশিষ্ট চরিত্র-অভিনেতা বা কর্মসূত্রে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ছিলেন,0 তা নয়। অবসরে কাজের ফাঁকে লিখে গেছেন বেশ কিছু কবিতা, প্যারোডি গানের চরণ, গল্পের ছক, এবং দু’টি গদ্য রচনা। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ছবির ভবিষ্যৎ শুটিংয়ের দৃশ্যাবলি নিয়ে তাঁর লেখা ‘জটায়ুর মৃত্যু প্রতীক্ষা’ যেন দুর্দান্ত ফিল্মিক মন্তাজ। দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করে তা হয়ে ওঠে দুরন্ত গল্প। ইচ্ছে করলেই তিনি হয়ে উঠতে পারতেন আর-এক ‘জটায়ু’। এর প্রমাণ রয়েছে ওইসব লেখায়।


