ব্রিলিয়ান্তে মেন্দোজার সিনেমা ফিলিপিন্সের বাস্তব জীবনকে শুধু কষ্ট, দারিদ্র, যন্ত্রণার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে না— বরং সে-দেশের মানুষের মর্যাদা, অনুভূতি ও নৈতিক জটিলতা তুলে ধরে। তাঁর সিনেমা সাধারণত ‘observational realism’ বা নীরব পর্যবেক্ষণের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি ক্যামেরাকে চরিত্রের জীবনের খুব কাছাকাছি নিয়ে যান, যেন দর্শক কোনও নাটক নয়, বাস্তব জীবন দেখছে। সংলাপ কম, দৃশ্য ও পরিবেশ বেশি কথা বলে। তাঁর সিনেমায় ছড়িয়ে রয়েছে— মৎস্যজীবী, ধাত্রী, শ্রমজীবী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু বা দারিদ্রপীড়িত মানুষ। তিনি শহরের চাকচিক্য নয়, সমাজের প্রান্তিক দিকটিকে কেন্দ্র করে গল্প বলেন। ২০২৫ সালের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে দেখা তাঁর চারটি সিনেমা নিয়ে কয়েকটি কথা।

কিনাতে (Kinatay, 2009)
২০০৯-এর ছবি ‘কিনাতে’ ফিলিপিনো জীবনের মানবিক চিত্রায়ণ। এটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালনার পুরস্কার পায়। ছবিটি ছিল এক ধরনের সিনেম্যাটিক শক— যেখানে কোনও কৃত্রিমতা নেই, বরং ছিল বাস্তবের শৈল্পিক ডকুমেন্টেশন। মেন্দোজা ক্যামেরাকে ব্যবহার করেছেন এমনভাবেই, যেন দর্শক ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে ওঠে। কান উৎসবের জুরি এটিকে বলেছিলেন ‘A masterful control of cinematic time and atmosphere’— ইউরোপীয় আধিপত্য, নামজাদা চলচ্চিত্রকারদের বাইরে থেকে এই প্রথম ফিলিপিন্সের কোনও ছবি কানে সেরা পরিচালকের সম্মান পেল। মেনস্ট্রিম সিনেমার দাপটে ভারতীয় নান্দনিক ছবি যখন কোণঠাসা, কালেভদ্রে ২/৪টি সমান্তরাল সিনেমা মানবিক মুখ হয়ে ওঠে, তখন ফিলিপিন্স কী দুঃসাহসিক ছবি করছে তা না দেখলে বোঝা যেত না। একই কথা ইরানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
ছবিটির মূল জায়গা হল বিষয় নির্বাচন। সাম্প্রতিক হিন্দি ছবি ‘হোমবাউন্ড’ ঠিক একই কাজ করেছে— দেশে জাতপাত ও সংখ্যালঘুদের সমস্যা চিহ্নিত করেছে ২০২৫-এ; স্বভাবত অস্কারে নমিনেশন পেয়েছে ভারতীয় ছবি হিসেবে। মেন্দোজা-র ছবি ১৭ বছর আগে সেই ব্যাপারে পথ দেখিয়েছিল— যেখানে রক্ষক পুলিশ প্রশাসনই ভক্ষক। একেবারে নিচের মহলের লোক দিয়ে ড্রাগের ব্যবসা করায় পুলিশের সিন্ডিকেট, তাদের দাপট, হিংস্রতা, প্রতিশোধস্পৃহা, লোভ-লালসার সামনে দর্শক অসহায়ভাবে বসে থাকে।

চলচ্চিত্রের মূল শক্তি হল মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা— শ্রেণি, পেশা বা অপরাধবোধের বাইরে। তাঁর ক্যামেরা ফিলিপিন্সের রাস্তাঘাট, ঘিঞ্জি বাড়ি, বাজার, পুলিশের দপ্তর ঘুরে বেড়ায়— যারা নৈতিকতার অনুগামী, তাদেরও অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে ফেলে। এরপরও মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকে, এক যৌনকর্মীকে ড্রাগ ব্যবসায় জড়িয়ে কীভাবে ভয়ংকর পরিণতি দেওয়া হল, সেটাই এ-ছবির সারতত্ত্ব। এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে ফিলিপিনো সমাজে নানা স্তরের মানুষের চেহারা। ছবিটিতে পরিচালক দুরন্ত গতিময়তা এবং চারপাশের আনুষঙ্গিক শব্দ ও চরিত্রের কণ্ঠস্বরকে আবহসংগীত হিসেবে ব্যবহার করেছেন— আলাদা কোনও মিউজিক নেই। এই ছবির বাস্তবতা দর্শককে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করে দেয়। এই বিতর্কিত চলচ্চিত্রটি শুধু অন্তর্গত হিংস্রতা, হত্যাকাণ্ড, মর্মান্তিক পরিণতির ওপর নির্ভরশীল নয়, অস্বস্তিকর শট ও লাউড ভয়েসের ব্যবহার দর্শককে হতবাক করে দেয়।
মা’ রোজা (Ma’ Rosa, 2016)
বহু নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে অপরাধ ও আইন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, অনেকটা অর্থনৈতিক কারণেই, মা’ রোজার মতো মানুষজনকে অপরাধী বানানো যায়, কারণ তাদের জীবনের সুযোগই সীমিত। ছবির একদম শুরুতে মা রোজাকে (Jaclyn Jose) পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, ছোট ড্রাগ ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে।
ছবির নানা পর্বে এটা স্পষ্ট হতে থাকে যে, সাধারণ ব্যবসার আড়ালে অবৈধ ড্রাগ বিক্রিজনিত দুর্নীতি একটি পরিবারের সমস্যা নয়— বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির অংশ। ছবিতে রোজা-পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যা যেভাবে পুলিশের দুর্নীতির চক্রে গিয়ে আটকে যায়, সেটা দেখায় যে দুর্নীতি কেবল একজন লোকের গায়ে লাগেনি, এটা পুরো সিস্টেমে মিশে আছে।

পুলিশ ঘুষের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার চুক্তি করে; পরিবার টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খায়। এইভাবে চুরমার আর্থিক অবস্থা ও ভঙ্গুর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মা’ রোজা-র পরিবার হয়তো অবৈধ ব্যবসায় আবার নেমে পড়বে। তার চেয়ে বড় কথা, তা করতে গিয়ে নানা স্তরে নৈতিকতার চূড়ান্ত অধঃপতন দেখা যায়।
চারপাশে হাসি, খাবার, অঢেল মদ ও সিগারেটের গন্ধ— সবকিছুই আদতে দেখায়, প্রশাসনিক স্তরে কতটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে দুর্নীতি। থানার ভেতরে এই দৃশ্যের নির্মাণ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু— যা দেখায়, দুর্নীতি-দমন শাখা প্রতিদিনের অন্যায়কে ঘুষের বিনিময়ে রফা করছে। এক তীব্র অন্তর্নিহিত শ্লেষ ছবিটিকে বহুমাত্রিক দ্যোতনা দিয়েছে। এই ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগে ছিল। অভিনেত্রী জেসলিন হোসে মা রোজার চরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর নীরব অভিব্যক্তি, উত্তেজনা ভেতরে রেখে শরীরী ভাষা ও ঠোঁটের কম্পনে ফুটে ওঠা হতাশা এককথায় অসাধারণ। অপরাধে বাধ্য ও নৈতিকতার মাঝখানে টিকে থাকার লড়াই কত কঠিন, সেটা তাঁর অভিনয়ে ধরা পড়ে। ফিলিপিন্স থেকে ২০১৭ সালের অস্কারের (সেরা ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম বিভাগ) জন্য পাঠানো হয় এই ছবি।
সার্বিস (Serbis, 2008)
‘সার্বিস’ (২০০৮) ফিলিপিন্সের একটি নিও-রিয়ালিস্টিক ড্রামা— এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নৈতিকতা ও অপরাধের সহাবস্থানে টিকে থাকার কাহিনি। এই পরিবার ম্যানিলার এক পুরনো, প্রায় ধ্বংসপ্রায় ‘ফ্যামিলি’ নামের সিনেমা হল চালায়, যেখানে পুরনো প্রাপ্তবয়স্ক ছবি চলে। এর আড়ালে গড়ে উঠেছে একটি ‘সার্ভিস’ সিন্ডিকেট— যেখানে যৌনতা একদিকে জীবিকার মাধ্যম, অন্যদিকে অস্তিত্বের প্রতীক।

রিয়েল-টাইম ন্যারেশনে গল্পটি প্রায় একটি দিনেই ঘটে; সকাল থেকে রাত পর্যন্ত থিয়েটারের প্রতিটি কোণে চলা ঘটনাকে পরিচালক মেন্দোজা ধীরে, অস্থির ক্যামেরা প্রক্ষেপণে ধরেছেন।
মেন্দোজা প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য সিঁড়িতে বা সিঁড়ির মোড়ে রাখেন— বস্তুত এটাই শুটিং জোন। এই সিঁড়িগুলোই চরিত্রদের ওঠানামা, লুকনো চুক্তি, কিংবা মানসিক পতনের পথ দেখায়। ক্যামেরা প্রায়ই চরিত্রের সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে বা নামে— ফলে দর্শক চলাচলের অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে। সিঁড়ি এখানে স্থাপত্য নয়, তা মানুষের ভেতরের নৈতিক ওঠানামার প্রতীক। কখনও ওপরে উঠছে— মর্যাদা বা মুক্তির দিকে (সবচেয়ে ওপরতলায় পরিবারটি থাকে), আবার নিচে নামছে— পাপ, লজ্জা বা বাস্তবতার দিকে। ক্যামেরা প্রায়ই লম্বালম্বি গতিতে চলে— নিচ থেকে ওপরে, ওপরে থেকে নিচে।
এই টেকনিক দর্শককে ঘোর লাগানো এক বাস্তবতায় রেখে দেয়। মেন্দোজা এখানে থিয়েটারকে ‘জীবন্ত চরিত্র’ করে তুলেছেন— তার সিঁড়ি, করিডর, ফাটল, হেঁটে যাওয়া লোকজন, সবার এক-একটা গল্প আছে। এমনকী, নোংরা ভাষায় ভর্তি দেওয়াল, যা মাঝে মাঝে সাদা করা হয়। সমাজের অসীম ঘূর্ণিতে আটকে পড়া, পিছলে পড়া মানুষ। অথচ কোনও সেন্টিমেন্টাল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নেই। বিদ্যুৎ চলে গেলে ঘর অন্ধকার, গলির আওয়াজ ঢোকে— মনে হয় আমরা সত্যিই সেই থিয়েটারের ভেতরে আছি।

দাই উম্ব, (Thy Womb,2012)
দাই উম্ব ছবির ভেতরে আছে ফিলিপিন্সের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিম উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাপন প্রণালী। তাউই-তাউই-এর এক ধাত্রী, শালেহা, এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ছবির শুরুতেই দেখি গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসছে নবজাতক। শালেহা নাড়ি কাটে, কিন্তু নিজে মা হতে পারে না। কাটা নাড়ি সে ঘরে নিয়ে যায় ও সংরক্ষণ করে। স্বামী-সন্তান চায়, এর জন্য আরেকটি বিয়েতে রাজি হয়।
এই ছবিতে দেখা যায় অফুরান প্রকৃতি, মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, সমুদ্রের স্বর। নৌকোয় মাছ ধরা, দস্যুদলের লুঠ, বিবাহের আড়ম্বর— সব ধরা যায় নৌকোনির্ভর জীবনে।
নিজের ভালবাসা ও কর্তব্যবোধের মধ্যে টানাপোড়েনে পড়ে শালেহা নিজেই স্বামীর জন্য একটি ‘দ্বিতীয় স্ত্রী’ খুঁজতে বের হয়— একজন তরুণী, যিনি সন্তান জন্ম দিতে পারেন। এই যাত্রায় তার অন্তর্দ্বন্দ্ব, নীরব বেদনা, ত্যাগ, এবং জীবনের প্রতি মেনে নেওয়ার এক গভীর প্রক্রিয়া ফুটে ওঠে।
ব্যক্তিগত এই কাহিনির পটভূমিতে রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা— মুসলিম অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি, দারিদ্র, ও দ্বীপজীবনের রূঢ় অথচ মরমি সৌন্দর্য। প্রকৃতি এখানে শুধু দৃশ্যপট নয়, এক জীবন্ত চরিত্র।
শেষ কথা
মেন্দোজার সিনেমায় ধর্ম ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব বারবার ফিরে আসে— বিশ্বাস, কর্তব্য, পাপ, ক্ষমা, এবং আত্মসমর্পণের বিষয়গুলোকে তিনি অতি মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন। মেন্দোজা প্রায়ই নন-অ্যাক্টরদের ব্যবহার করেন এবং আলো, শব্দ, ও হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার মাধ্যমে ডকুমেন্টারি ধাঁচের বাস্তবতা তৈরি করেছেন— যাতে সিনেমা ও বাস্তবতার সীমারেখা মুছে যায়।




