মণিপুরের পরিচালক অশোক ভ্যেলু-র দ্বিতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘লুক অ্যাট দ্য স্কাই’ পেয়েছে ২০১৮-র কলকাতা ফিল্মোৎসবে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির পুরস্কার (গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার), ২০১৯-এ কেরলের দ্বাদশ আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির উৎসবে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির পুরস্কার, ওই বছরেই সপ্তদশ কল্পনির্ঝর আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ছবির প্যাটন পুরস্কার। এর আগেও ‘তৌ-তাই ’ (বীজ) ছবিটির জন্য ভ্যেলু ২০১৬-র কলকাতা ফিল্মোৎসবে সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবির পুরস্কার (গোল্ডেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার) জিতেছিলেন। ‘লুক অ্যাট দ্য স্কাই’ ছবিটি নিয়ে, ভ্যেলু ও তাঁর দাদা আলেকজান্ডার পৌমাই কথা বললেন অর্ক দাশ-এর সঙ্গে। ছবিটি মণিপুরের সেনাপতি জেলায় একটি নিরিবিলি নাগা-গ্রামে এক প্রতিবাদের গল্প বলে।
‘তুমি জন্মেছ এই গ্রামে, তোমার নাড়ি এখানে পোঁতা, এই গ্রামই হবে তোমার অন্তিম বিশ্রামের জায়গা। তাই, তুমি গ্রামের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেতে পারো না।’
— গ্রামের এক মোড়ল, ছবির নায়ককে।
মণিপুরের সেনাপতি জেলায় পৌমাই নাগা জনজাতি তাদের ঐতিহ্য অনেকটা বজায় রেখেছে, নিজস্ব ‘পৌলা’ ভাষা সহ, আর ছবিটি অনুযায়ী, তারা বজায় রেখেছে তীব্র রাজনৈতিক ধ্যানধারণাও, যার সামাজিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউট নিবেদিত ৩০ মিনিটের ছোট ছবিটি ‘হাই’ নামক এক বছর চল্লিশের পুরুষের গল্প বলে, যে দুই সন্তানের বাবা, পুরুল আটোংবা গ্রামে থাকে, আর যার গোটা পরিবারটাকে একঘরে করে দিয়েছে গ্রামের লোক, কারণ সে নির্বাচনে, জনপ্রিয় প্রার্থীকে সমর্থন করতে রাজি নয়।
সব কিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে, হাই লড়াই করে তার ভোট দেওয়ার অধিকারের জন্য, নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার অধিকারের জন্য। এই লড়াই— বা প্রতিবাদ— করতে গিয়ে, তার গোটা পরিবার অত্যাচারের সম্মুখীন হয়। শারীরিক, মানসিক অত্যাচার। শেষ অবধি একটা সামাজিক অভিশাপ দেওয়া হয় তাদের, মানে, একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান মতো করে, তাদের গ্রামজীবন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। ছবির শেষে দেখা যায়, হাই এতে এতটুকু লজ্জিত নয়, হতোদ্যম নয়। সে নিজের মর্যাদার জন্য লড়াই করে চলে, এবং তার গোটা পরিবার তার পাশে দাঁড়ায়।
‘লুক অ্যাট দ্য স্কাই’ শুধু একটা প্রতিবাদের ছবি নয়। জিথু জর্জ-এর অসামান্য চিত্রগ্রহণের সাহায্যে, আর পুরুলের অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্যানভাসে, এটি ভারতের এক প্রান্তে পড়ে থাকা এক দেশীয় জনজাতির কথা বলে, যাদের সম্পর্কে নাগরিক দর্শকের প্রায় কোনও ধারণাই নেই। সেদিক থেকে এর একরকম নৃতাত্ত্বিক উপযোগিতাও আছে, কারণ ছবিটি একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি ও দর্শনের উন্মোচন করে।
ভ্যেলু নিজে পুরুল-এরই লোক, তাঁরই গ্রামে ছবিটির শুটিং করা হয়েছে। ভ্যেলুর বাবা তাঁর যৌবনে গ্রামে এভাবেই একঘরে হয়েছিলেন। সেই ঘটনাটিই ছবিটির অনুপ্রেরণা। ভ্যেলু বলেন, ‘এ তো এখনও ঘটছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলেই হোক আর অন্যত্রই হোক, প্রতিবাদী স্বরকে এখনও পিষে দেওয়া হয়, বহিষ্কার করা হয়।’ দশ দিনের শুটিং-এ, জেনারেটর খারাপ হয়ে যাওয়ার সমস্যাও সামলাতে হয়েছে, এতজন অপেশাদার অভিনেতাকে দিয়ে কাজ করিয়েও নিতে হয়েছে, এবং অবশ্যই গ্রামবাসীকে বোঝাতে হয়েছে, ছবিতে দেখানো পরিস্থিতিটা কতটা সত্যি।
ছবিটার প্রতিটি মুহূর্তেই এর স্বাতন্ত্র্যটা বোঝা যায়। গ্রামের মানুষ ছবিটাকে যত পেরেছেন সাহায্য করেছেন। ভ্যেলু বললেন, ‘কয়েকজন অভিনেতা তো ভাবছিলেন এই ছবিটা তাঁদের অমরত্ব দেবে। একজন কাপড়ের দোকানদার এই ছবিতে ব্যবহৃত সব জামাকাপড় আমার ক্যামেরাম্যানকে এমনিই দিয়ে দিলেন।’
ভ্যেলু আরও জানালেন, ‘ছবির প্রতিটি অভিনেতা অপেশাদার। আমার পরিবারের অনেকেও অভিনয় করেছেন— আমার বাবা, বোন, কয়েকজন তুতো-ভাই।’ ভ্যেলুর দাদা আলেকজান্ডার, যিনি নিজেও একজন চলচ্চিত্র-নির্মাতা, অভিনয় করেছেন নায়কের পছন্দসই প্রার্থী হিসেবে। তিনি বললেন, ‘এটা একটা বিরাট দলগত প্রচেষ্টা। কারণ আমাদের তো ক্যামেরা, লেন্স, শব্দের যন্ত্র— সব, সমস্ত কিছু বিভিন্ন শহর থেকে পুরুলে নিয়ে আসতে হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম, কোনও টেকনিকাল সমস্যায় যেন আমাদের গল্প বলার ছন্দটা আটকে না যায়। এরকম একটা অজ গাঁয়ে এমন একটা ছবি বানানো যে সম্ভব হল, তা থেকেই বোঝা যায়, আমাদের ইউনিট-টা কত ঐক্যবদ্ধ ছিল।’