তারপর? পড়ে রইল একটুকরো সবুজ গালিচা। পড়ে রইল লাল টুকটুকে বলটা। যে বলটা সদ্য হারুজেঠুদের বাড়ির পাশে হাইড্রেনের পাঁকে পড়ে চকচকে হয়ে উঠেছে। কখনও বারবার মাটিতে ঠুকে, কিংবা সজোরে কোনও হেলে যাওয়া পাঁচিলের বুকে এঁকে দিচ্ছে একটা ঝাপসা মানচিত্র। যে-মানচিত্রকে জাপটে যাপন করছে একটা উপমহাদেশ, আমাদের না-পারা অক্ষমতাগুলো আর তার অব্যর্থ মলম। বিরাট কোহলি।
তখনও স্কুলে পড়ছি, টিফিনের পরে সূর্যের রাঙা হয়ে আসা আলোর মতোই ক্লান্তিকর শারণ্যবাবুর ইতিহাস ক্লাস। লাস্ট বেঞ্চে আবেশ-জড়ানো চোখে অক্লান্ত প্রমাদ গোনা শেষ ঘণ্টার। প্ৰিয় বন্ধুর বকবক খানিক একঘেয়ে। মোঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সুরেই তাল মেলাচ্ছে নিমগাছের ঘুঘুটা। আমার ব্রাউন পেপার জুড়ে ‘ডব্লুউডব্লুউই’-র স্টিকার। সামনের বেঞ্চে বসা রাজুর ছেঁড়া ব্যাগ থেকে এক টুকরো কাগজের মলাট উঁকি মারছে। আর তাতে বিরাট কোহলি-গৌতম গম্ভীরের ছবি। প্রথম সেঞ্চুরি। কলকাতায়, ক্রিকেটের নন্দন-কাননে। দৈনিকের পিছনের পৃষ্ঠা থেকে কাটা। পুরনো হয়ে যাওয়া। স্কুলছুট হয়ে সাইকেল নিয়ে টো-টো করার সময়ে পিছনের জং ধরা ক্যারিয়ারে বসে ও বলেছিল, সব বইতেই ও মলাট দেওয়ার সময়ে কোহলির ছবি রাখার চেষ্টা করে। দোকানে বাবার ঠোঙা বানানোর সময়ে পাশে বসে খবরের কাগজগুলোও বাছাই করে ও; কিন্তু অত ছবি সব সময়ে তো মজুত থাকে না। তারপর গরমের ছুটিতে আমি, ঋজু আর প্রীতম যখন ওর বাড়িতে গেলাম, সানন্দে পরিচয় করিয়েছিল দাসগুপ্ত ব্রাদার্স থেকে আনা মা-তারার ছবি সাঁটা ক্যালেন্ডারের পাশের দেওয়ালটার সঙ্গে। সযত্নে টাঙানো রয়েছে কিছু কাট-আউট, যেগুলো একান্ত ওর নিজের। একদিকে মেসি, অন্যদিকে কোহলি। আমাদের বাংলা মিডিয়াম মন অগ্রাহ্য করেছে রাজুর বাড়ির নোনাধরা ফাটা দেওয়াল, অক্লেশে ভুলে গিয়েছি টিফিন পিরিয়ড হলে ওর হারিয়ে যাওয়া। শুধু অভিভূত হয়ে সাক্ষী থেকেছি স্কুলের জার্সিতে ওর কোহলিচিত সেলিব্রেশনের আর থেকে গেছে সেন্ট-মেরিজকে দুরমুশ করে দেওয়া এক ইনিংস। আমরা মিশে গেছি পুকুরে উপুড়ঝুপুরি চানে আর বিশ্ব শাসন করা এমআরএফ ব্যাটে। বন্ধুত্বে ভরসা ছিল আমাদের। মুড়ি-মুড়কি, নকুলদানা আর বাতাসা ছাড়াও ভরসা ছিল কখনও ১৮ কিংবা ১০ নম্বর জার্সিতে। ভরসা ছিল লাল-হলুদে, ভরসা ছিল পাল তোলা নৌকায়। আর ভরসা ছিল বন্ধের দিন রাস্তাজোড়া ক্রিকেট ম্যাচে। ভরসা অটুট থেকেছে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে।
মাধ্যমিকের আগে টেস্ট পরীক্ষা। টিভি-তে বিজিটি। আমরা সকালে স্কুল যাওয়ার আগে নীল প্যান্টে জামা গুঁজতে-গুঁজতে ভরসা রেখেছিলাম, অ্যাডিলেডে বিরাট কোহলিকে পরেরদিনও ব্যাট হাতে নামতে দেখব। তারপর সাদা জার্সি গায়ে কিছু রূপকথা। কখনও ১৬৯, কখনও ১৪৭, কখনও বা দুই ইনিংসে ১১৫ ও ১৪১।
আরও পড়ুন : ব্র্যাডম্যান থেকে সচিন, রেকর্ড ভাঙার এক আশ্চর্য ইতিহাস! লিখছেন অনুজয় চট্টোপাধ্যায়…
তারপর বিশ্বায়নের বাজারে আমরা বড় হচ্ছি। একুশ শতক সেই কবেই শুরু হলেও আমাদের চৌকাঠে ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না। আমরা ২০১৪-র পরবর্তী সময়ে বদলে যাওয়া ভারত দেখেছি। অদ্ভুত সেই বদল। বোকাবাক্সকে এক লহমায় বোকা বানিয়ে দিল স্মার্টফোন। বুঝলাম, ফোনে খেলা দেখা ও চাকরি খোঁজা, দুটোই সম্ভব। তারপর কত জায়গায় জমা পড়ল সিভি; নিরুত্তর মেলবক্স। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, শুধুমাত্র বাড়ির সামনে পার্ক করা বাইকটুকু সরাতে বলায় শাসিয়ে গেল গুন্ডাবাহিনী। জবাব দিতে পারিনি। দিয়েছিল কোহলি। কখনও হাতে আটটা সেলাই নিয়ে টি-টোয়েন্টি লিগ কাঁপানো। কখনও-বা ম্যাক্সওয়েলের ভাঙা হাতের বিদ্রূপকে ফুৎকারে উড়িয়ে মাঠ জোড়া দৌড়। কখনও-বা ব্রিটিশদের মাঠে দাঁতে-দাঁত চেপে বজ্রনির্ঘোষ, ‘ফর সিক্সটি ওভারস্ দে শুড ফিল হেইল আউট দেয়ার।’
আহা! লর্ডসের মাটিতে ওই ঐতিহাসিক বিবৃতি যেন এক আশ্চর্য স্বর্গসুখ। আমার সমস্ত না পারার যন্ত্রণা বয়ে এসেছে তপ্ত শহরের কালবৈশাখী হয়ে। সেই অপূর্ব সোঁদা গন্ধ আর উদাসী হাওয়ার দাপট পেরিয়ে গেছে ওভাল থেকে মেলবোর্ন ছুঁয়ে সেঞ্চুরিয়ান কিংবা জোহসেনবার্গে। এমনকী, যে-আসন্ন ইংল্যান্ড টেস্ট না খেলে তিনি অবসর নিলেন, তার বিগত সংস্করণেও কোহলির নামের পাশে গোটা সিরিজ জুড়ে আড়াইশোর বেশি রান ছিল। তবু রানে কী আসে যায়! কোনও এক ব্রিটিশ সাহেব বলেছিলেন, ‘আদতে স্কোরবোর্ড একটি গাধা।’ আমরা বিশ্বাস করেছি। যে-বিশ্বাসে অগ্রাহ্য করেছি টেস্টে বাকি থাকা ৭৭০ রান। না-ই বা হল সব পাওয়া। তবু সংগ্রহ করেছি কিছু খড়কুটো।
ওই যে কিছু বছর আগে, বদলে যাওয়া ভারতে মহম্মদ শামির দিকে ধেয়ে আসা নো-বলগুলো। সুদূর দুবাইয়ের বুকে টি-টোয়েন্টির আসরে মুখোমুখি ভারত-পাক। বদলে যাওয়া ভারত, বিশ্বাস করতে শেখায় প্রতিবেশীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিতে হবে। না হলে প্রশ্ন উঠবে, দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে। সে তুমি বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী আর্মড-ফোর্সের বিশ্বস্ত সৈনিকই হও কি নীল জার্সির একনিষ্ঠ যোদ্ধা। তোমার ধর্ম দেখা হবে। বদলে যাওয়া রাষ্ট্রে ‘সেকু-মাকু-পনা’ চলবে না। তুমি সোফিয়া হও কি শামি, ‘ওই ধর্মের সবাই বিশ্বাসঘাতক।’
কখনও-বা ম্যাক্সওয়েলের ভাঙা হাতের বিদ্রূপকে ফুৎকারে উড়িয়ে মাঠজোড়া দৌড়। কখনও-বা ব্রিটিশদের মাঠে দাঁতে-দাঁত চেপে বজ্রনির্ঘোষ, ‘ফর সিক্সটি ওভারস্ দে শুড ফিল হেইল আউট দেয়ার।’
তবু কেউ-কেউ আজও রুখে দাঁড়ায়। সর্ববৃহৎ ক্রিকেট বোর্ড চুপ থাকলেও মুখ খোলেন ১৩৫ কোটির ক্যাপ্টেন। স্পষ্ট বয়ান, ‘ধর্ম নিয়ে কাউকে আক্রমণ করার চেয়ে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না। মেরুদণ্ডহীন এই লোকগুলোকে নিয়ে আমরা ভাবতে চাই না।’
বয়ে চলেছে সময়। বেড়েছে প্রজন্মের তুলাদণ্ডে প্রত্যাশার বাটখারা। কিচ্ছু ভাল লাগে না একদম। তাই চেষ্টা চলে জান কবুল। জানি এ অসম লড়াই। তবু ক্রিজে কোহলি আছে। যে পূর্বসূরির সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে না গিয়েও প্রমাণ দেয় অনেক কিছুর। শচীনের ২৪ বছরের টেস্ট কেরিয়ারে ১৫৯২১ রান, কোহলি সেখানে ১৪ বছরে ৯২৩০। তাছাড়া শচীনের কেরিয়ারের বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল না টি-টোয়েন্টির মায়াজাল। তবু গ্রেটেস্টরা শ্রেষ্ঠ হন; পরিশ্রম করে বড়জোর তার কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। ঈশ্বর হওয়া যায় না। ঈশ্বরদের ফেয়ারওয়েলের সাক্ষী থাকে ভক্তকুল। রোহিত, অশ্বিন, কোহলি ৩৩ কোটি দেবতার স্বর্গের কোনও দূত নন। এসবে তাই, বৃথা জড়াই। আমরা পেরিয়ে গেছি সেইসব দিন। ছায়া-সরণি বেয়ে চলে এসেছি অনেকটা দূর। সেই কবেই তিনি কেপটাউনে ৭৯ রানের লিগ্যাসি রেখে নেতৃত্বের দাঁড়ি টেনেছেন। সেলস টার্গেট ছুঁতে চাওয়ার প্রপঞ্চময় বাসনা গ্রাস করেছে আমাদের। ফিরে দেখা হয়নি আর শীত-শেষে রোদে শুকোতে দেওয়া রোয়া ওঠা উলের সোয়েটারটার দিকে, যা একদিন বহু শখ করে বিধান মার্কেট থেকে কেনা হয়েছিল। তবু জানতাম, কোহলি খেলছে। টার্মিনেশন লেটার পেয়ে একা জ্বরে কাঁপতে থাকা শরীরে মিস করেছি ইএমআই-এর ডেট। কিন্তু আমার লড়াই লড়ে গেছে কোহলি। আহমেদাবাদে জ্বর নিয়েও অজিদের বিরুদ্ধে ১৮৬ এসেছে। ড্রেসিংরুমের নির্দেশ না আসলে ২০০-ও হয়তো সম্ভব ছিল।
কত কিছুই তো আমরা সম্ভব ভাবতাম। বেঞ্চ হওয়ার পর আমাদের মতো মিডিওকাররা ভাবত, আরেকটা সুযোগ পেলে ঠিক পারব। বারবার অফ স্টাম্পের বাইরের বল হতাশ করলেও পরদিন আবার চূড়ান্ত সংযম দেখাতে পারব। আদর্শ আঁকড়ে থেকে বদলে দিতে পারব সমাজ। মন-মাথা-চোখ প্রতারণা করেছে। তবু অফিস টাইমের বাইরে ছুটে গেছি বসের কাছে। স্যর, একটা শেষ সুযোগ। পারব স্যর! আমার দিক থেকে কোনও কমতি থাকবে না। আমরা মিডিওকার কিন্তু পরিশ্রমী। নিন্দুকরা বলে, টেস্টের গ্রাফে ৪৬-র অ্যাভারেজ আদতেই ‘এলিট ক্লাস’।
কিন্তু আমি বিশ্বাস রাখি আয়নার প্রতিবিম্বে। এই এলিট ক্লাবেও রয়েছেন কোহলির থেকে কম অ্যাভারেজের কিছু নাম। অ্যালিস্টার কুক, যাঁর অ্যাভারেজ ছিল ৪৫.৩৫। ভিভিএস লক্ষণ, যাঁর অ্যাভারেজ ছিল ৪৫. ৯৭। তাই আমি চেষ্টা জারি রেখে যাই। তারপর আসে রঞ্জি মরশুম। ইংল্যান্ড সিরিজের আগে অন্তত এ-দলের হয়ে দুটো ম্যাচ খেলে সেট হওয়া। বাঁচার চেষ্টা। পরাজিত হয়েছি, কিন্তু হার মানিনি। তারপর বুঝেছি জীবনের নিষ্ঠুরতম সত্য। বৃদ্ধ ঠাকুমা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকত সিলিংয়ের দিকে চেয়ে। কত গল্প, ছাদের আচার, লুকিয়ে রাখা লজেন্স, ফিরতে দেরি হলে বারবার ‘বিরক্তিকর’ ফোন সব বন্ধ হয়েছে কালের নিয়মে। ওই নম্বরটা থেকে আর কোনও ফোন আসে না এখন।
অবশেষে বুঝেছি, একদিন অনেক না-পাওয়া নিয়ে সবাই অচল দশ পয়সা হয়ে যাব। কিন্তু কিছু না-পাওয়া থাক আক্রমণের সম্মুখে বেয়নেট হয়ে। পাশে থাক ভালবাসা, অর্ধাঙ্গিনী। তীব্র রোদে একটু ছায়া হয়ে। খারাপ ফর্মের সফ্ট টার্গেট হয়ে। হাসির আড়ালে কান্নাগুলোর আশ্রয় হয়ে। বোর্ড উত্থাপন করুক ‘গুরুগম্ভীর’ সব প্রশ্ন। তুলনা চলুক শচীন, গাভাসকর কিংবা বিগ ফোরের সঙ্গে। কিন্তু সে ছায়াযুদ্ধে আমি নেই। ইনশিওরেন্স আর মেডিক্লেমের ভারে ন্যুব্জ ঘাড় নিয়ে বাড়ি ফিরে পরিবারটুকুই আমার সব যুদ্ধের কমরেড। সবচেয়ে নিরাপদতম সঞ্চয়। তাই তিনি চলে গেলেন।
তিনি বহুবার বুঝিয়েছেন, ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল। ওই যে পার্থের মাটিতে ‘ব্যাট স্পিকস্ এভরিথিং’, দুবাইয়ের বাইশ গজে টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি কিংবা সাম্প্রতিকতম ইতিহাসে বিশ্বকাপের মঞ্চে সেই ৫০তম ইনিংস, নেপথ্যে ভেসে আসছে হর্ষ ভোগলের কণ্ঠে একা দাঁড়িয়ে থাকার অঙ্গীকার। তবু তিনি চলে গেলেন। এবার আর ফিরবেন না। নিয়ে গেলেন আমাদের শৈশবটুকু। শচীনের বৃত্তের শুরুটুকু অজ্ঞাত ছিলাম, কিন্তু কোহলি উপসংহার দিয়ে গেলেন। আমাদের মতো বহু হতোদ্যম যুবককে লড়তে শিখিয়ে গেলেন। দাঁতে-দাঁত চেপে জবাবটুকু দেওয়ার সাহস দিয়ে গেলেন।
একাধারে তিনি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পঙক্তি যেন স্বীকার ও অস্বীকার করলেন। একাকী চলে গেলেন, অসময়ে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে নিয়েই গেলেন।