বদলাবার দায়
যেমন ডাক্তার জোচ্চোর জেনেও রোগী ওষুধ খেয়ে মনে করে, বাঃ, একটু ঠিক লাগছে তো, তেমনই ব্যাপারটা ভিত্তিহীন জেনেও নববর্ষের শুরুতে ক্যালেন্ডার-ভিত্তিক ফ্যান্টাসি ঝিলিক মারে: এবার ইমোজি-প্রতিম ঝলমলানি নামবে, চারপাশ হয়ে উঠবে সচেতন ও সদিচ্ছাময়। কিন্তু মূল মুশকিল হল, আচমকা অলৌকিক বিস্ফোরণ বা দেবতার আবির্ভাব তো অসম্ভব, মানুষকে স্রোত পাল্টাতে হয় ইচ্ছে ও ক্ষমতা দিয়ে। তার প্রথম শর্ত হল এটুকু বোঝা: বদল জরুরি। কিন্তু বাঙালি সমাজ-প্রধানদের মগজ থেকে সততা ও আত্মমূল্যায়নের ক্ষমতাটাই কেউ হরণ করে নিয়েছে। যদি কোনও জঘন্য ছাত্রকে ভাল হওয়ার পথে রওনা করতে হয়, তবে প্রথমে ছাত্রকে নিজের কাছে স্বীকার করতে হয়, সে ধেড়িয়ে একসা করছে এবং সুতরাং সংশোধন প্রয়োজন। সে যদি অবাধ্য ঘাড় ঝাঁকিয়ে সমানে বলে যায়, আমিই আশুতোষ মুখুজ্জে, তবে কে তার নয়া রুটিন আঁকবে কে দেবে স্কুলড্রেস গুঁজে?
এখন টেলিভিশনের নিত্য-সান্ধ্য আলোচনায় (যেখানে বাংলার আত্মা প্রতিষ্ঠিত) ঠোঁটকাটামি অনেক বেড়ে গেছে, লাঞ্ছনা-অনুমতিও বেড়েছে, ফলে প্রতিদিন একই মুখের একই কলহ দেখতে একঘেয়ে লাগে না, অধীর আগ্রহে আমরা পরবর্তী অসৌজন্যের অপেক্ষা করি। লোকে দিব্যি দেখে যায়, অমুক নেতা মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে কদর্য সাম্প্রদায়িক কথা, তমুক নেত্রী ব্যক্তিস্বাধীনতা-বিরোধী কথা, জমুক-যুবা শিক্ষা-ঘাতী কথা বলছেন— সঞ্চালক আপত্তি জানালেও দমছেন না। আবার সংকটকালে রক্ষার মূল দায়িত্ব যাঁর, তিনি ক্রমাগত অন্য প্রসঙ্গ পেড়ে বলতে থাকেন, যখন সদৃশ কাণ্ড ঘটেছিল অমুক রাজ্যে, কই তখন তো কিছু বলোনি? আর যাঁরা নিরপেক্ষ হিসেবে যুক্তি সাজিয়েছেন, তাঁরা চ্যানেলের অবস্থান তখন কোনদিকে বেঁকেছে, সেই অনুযায়ী হেলে পড়েন, অথবা চ্যানেল নিজ অবস্থান অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন করে।
আশ্চর্য, যদি ক্রিকেটার পাঁচ রান করে আউট হয়ে যান, তিনি তর্ক করতে পারেন না যে, আসলে তিনি সাতাত্তর করেছেন, বা, পাল্টা-প্রশ্ন বাগান না যে, অমুক যখন দুই করেছিল আপনারা তার জবাবদিহি করেননি কেন? যখন সিনেমা ফ্লপ করে, পরিচালক রেগে বলতে পারেন ‘ধুর, ছবিটা কেউ বোঝেনি’, কিন্তু একথা চিল্লাতে পারেন না যে, ফিল্মটা আসলে সুপারহিট। মানুষকে নিজের ব্যর্থতার দায় নিতে হয়। কিন্তু এই রাজনীতি এমন উদ্ভট একটা ক্ষেত্র, এখানে যে কোনও অপারগতা সকলের সামনে উদোম উন্মোচিত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ডেঁটে বলা যায়, আমি শ্রেষ্ঠ ও সক্ষম এবং সব সমালোচনাই আসলে উদ্দেশপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচার, সব দুর্দশাই অন্যের চক্রান্ত। এত নেতানেত্রী এল-গেল, আজ অবধি কেউ বলল না, এঃহে, এটা আমার ভুল। অন্তত প্রথমে বলল না। তারপর সন্দেহাতীতভাবে দুর্নীতি বা নির্বুদ্ধিতা প্রমাণিত হলে তখন বিড়বিড়োবে, হ্যাঁ সামান্য ত্রুটি ও চ্যুতি লক্ষিতে পারেন, সে তো অন্যের প্ররোচনায় করেছি। কেউ কখনও কোনও আলোচনায় আত্মসংশোধনের কথা বলেন না, দলের ভুল হয়ে গেছে স্বীকার যান না, শুধু দোষারোপের চেনা ছকে খেলতে থাকেন। এত দূর অপরিণত ও স্বতঃস্ফূর্ত মিথ্যাবাদী জাতের পরিশীলন তাই ভয়ানক অসম্ভব।
যদি কখনও কেউ মাথা নিচু করে বলেন, আমি দুঃখিত, অ্যাক্কেরে বুঝতে পারিনি ও বিবেচনায় ঝামেলা করে ফেলেছি, নিঃসন্দেহে বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে বলবেন, এক্ষুনি পদত্যাগ করো। হয়তো তা করতেও হবে। কিন্তু দলের ভাবমূর্তি তাতে মন্দ জায়গায় যাবে না, বরং ঈষৎ উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ এই আচম্বিত সততায় জনগণ কিছুটা ধাঁধা খেয়ে যাবে। এবং ক্রমে তাঁর প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা তৈরি হবে। ক্রমাগত চেঁচিয়ে মিথ্যে বলে যাওয়ার চলতি গৎ থেকে তিনি যে বেরিয়ে এসেছেন, এটা তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দেবে। এবং ভুল শোধরানোর প্রথম ধাপটায় তিনি দাঁড়াতে পেরেছেন (বা দল তা পেরে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছে প্রকাশ্যে এই কথা বলতে), তাতে লোকে এই ব্যক্তি ও তাঁর দলকে বাস্তববোধসম্পন্ন, সৎ ও স্বচ্ছতাকামী হিসেবে দেখতে শিখবে।
প্রকৃত মানুষের এক প্রধান অভিজ্ঞান: নিজের কাজের দায় নেওয়ার ক্ষমতা। যদি আমার কাজের সুফল হয়, তার বাহাদুরি নিতে আমি যেমন উন্মুখ, যদি কুফল ঘটে, তার দায়িত্ব নিতেও আমি পিছপা নই— এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে নীতিদৃঢ় করে। তার জ্যোতিও বাড়িয়ে দেয়। সত্যিকারের কাজ করতে গেলে হরদম ভুল হবে, তার চেয়ে ঠিক-এর সংখ্যা বেশি থাকলে তবে নিজেকে নিপুণ ভাবা যাবে, আমরা আত্মবিশ্বাসী, তাই ভুল স্বীকার করতে অসুবিধে কীসের— এই বিবৃতি যদি নড়ন-চড়নে ঠিকরোয়, সেই দলের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ে বই কমে না। শাসক হলে সে মার্জনা পায়, বিরোধী হলে তার সমর্থন বাড়ে। আসলে বঙ্গীয় রাজনীতিকগণের ভয় দ্বিবিধ: তাঁরা জানেন যে, তাঁরা পূর্ণ অপদার্থ, এবং এও জানেন যে, সাধারণ মানুষ তাঁদের যে-পরিমাণ ঘৃণা করেন— তাকে যদি তাল পাকানো যায়, তবে হিরোশিমার ওপর উদিত কালান্তক মেঘের প্রপিতামহ গজাবে। প্রকাণ্ড নিরাপত্তাহীনতা থেকে তাঁরা ‘দিদিমুনি, আমার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে কারণ ওই কাকটা কার্নিশে ডাকছিল’: মিথ্যে কাঁদুনি ও নালিশবাজিতে ঢুকে গেছেন।
যদি কখনও কেউ মাথা নিচু করে বলেন, আমি দুঃখিত, অ্যাক্কেরে বুঝতে পারিনি ও বিবেচনায় ঝামেলা করে ফেলেছি, নিঃসন্দেহে বিরোধীরা ঝাঁপিয়ে বলবেন, এক্ষুনি পদত্যাগ করো। হয়তো তা করতেও হবে। কিন্তু দলের ভাবমূর্তি তাতে মন্দ জায়গায় যাবে না, বরং ঈষৎ উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা। কারণ এই আচম্বিত সততায় জনগণ কিছুটা ধাঁধা খেয়ে যাবে। এবং ক্রমে তাঁর প্রতি কিছুটা সহমর্মিতা তৈরি হবে।
কিন্তু মহাসংকট থেকে মুক্তির জন্য মানুষকে ধারা বদলাতে হয়। যে বেতো রুগি, বাঘে তাড়া করলে সেও পোঁ-পাঁ ছুট দেয়। পরীক্ষার আগের দিন শ্রেষ্ঠ ফাঁকিবাজও রাত জেগে গাঁকগাঁক পড়ে। বিখ্যাত কোচ পিকে একটা ফুটবল দল সম্পর্কে বলেছিলেন, চচ্চড়ির মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রাঁধা যায় না। ঠিক। কিন্তু ভাল চচ্চড়ি অন্তত রাঁধা যায়। তা এমনভাবে পরিবেশন করা যায়, যাতে চুল উড়ে পড়েনি, বা পিঁপড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে না। আজ অতি বিপদের দিনে, যখন প্রায় কোনও জাগ্রত বাঙালি বিশ্বাস করে না যে বাংলার উত্থান ঘটবে, রাজনীতির লোকেরা নিজেদের বদলাবার অঙ্গীকার করতে পারেন— না, অকস্মাৎ বিবেক কামড়েছে বলে নয়— স্রেফ আত্ম-বাঁচনের কারণে। তাঁদের ধোঁকার টাটি এমনই স্পষ্ট, তাঁদের এই প্রতি-আলোচনায় মুখ দেখিয়ে অতি-প্রত্যাশিত ও সর্বমুখস্থ কিছু বুলি আওড়ে যাওয়ার তামাশায় মানুষ সামনা-উৎসাহী, কিন্তু ভেতর-ভেতর এত ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ, নিজেদের কেরিয়ারের স্বার্থেই তাঁদের অন্য অক্ষে ঝাঁপাতে হবে, বৈঠকে বসে ঠিক করতে হবে, সেরেফ ঔদ্ধত্য ও লাগাতার মিথ্যাচার দিয়ে ভোট ম্যানেজ হবে কি না। যেমন সিরিয়াল আর না চললে অন্য চরিত্র আমদানি করতে হয় বা কাউকে মেরে ফেলতে হয়, ক্রীড়া-দল ক্রমাগত হারলে কিছু খেলোয়াড় বাদ দিতে হয় ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রশিক্ষকের প্রবেশ ঘটে, তেমনই বাংলার পান্ডাদের এখন আত্মরক্ষার্থেই একটু সত্যের দিকে ঝুঁকতে হবে, তা ভেবে তাঁরা যতই অনভ্যাসে শিউরে উঠুন না কেন। মানুষ জানে, তাঁরা অশিক্ষিত, কুচুটে ও নীতিরহিত। তাঁরা এই ধারণার মোকাবিলা করতে গোঁয়ার্তুমি ও বেপরোয়া-পনার বর্ম পরেছেন। কিন্তু চোতা-হাতে ধরা-পড়ে-যাওয়া টুকলিবাজ যতই বলুক, এটা আমার ঠাকুরদার মন্ত্রঃপূত পুঁথি, ত্রাণ পাবে না।
নতুন বছরে অন্তত দেখনশোভা কিছু প্রতিজ্ঞা লোকে হৃদয়ে লেখে, দিনতিনেক বিশ্বাস করে, সে নির্ঘাত জগিং করতে যাবে, বা সিগারেট ছেড়ে লবঙ্গ চিবোবে। তেমন অঙ্গীকারের একটা চেষ্টায় যদি বাংলার রাজনীতির লোকেরা (এবং বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা নিজেদের দূর-বুদ্ধি রাজনৈতিক তরজায় নিবেদন করতে আকুল) নিজেদের অর্পণ করেন, তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার একটা প্রয়াস কিছু মর্কট নিতে পারে।
সং কি শোধনের দিকে যাবে?— এই হোক নববর্ষের উত্তপ্ত প্রশ্ন।