প্রলয়ন শানমুগাসুন্দরম চন্দ্রশেকরন। তামিলনাড়ু তথা দক্ষিণ ভারতের পথনাটক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নাম। একাধারে নাট্যশিক্ষক, অভিনেতা এবং ‘চেন্নাই কলাই কুড়ু’ নাট্যদলের কনভেনর এবং আর্টিস্টিক ডিরেক্টর। থিয়েটারের সঙ্গে সরাসরিভাবে যুক্ত প্রায় ৪০ বছর। তাঁর এই দীর্ঘ থিয়েটার যাপন নিয়ে ডাকবাংলা.কম-এর হয়ে কথা বললেন রাজর্ষি ধাড়া—
সফদর হাশমি যে নাট্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং আপনি যে চেন্নাই কলাই আন্দোলনের অংশ ছিলেন, তা প্রায় একই সময়েই ঘটেছিল…
আমাদের দলটি (চেন্নাই কলাই কুড়ু) ১৯৮৪ সালে পথচলা শুরু করে। যখন আমরা আমাদের দল শুরু করি, তখন এটি পথনাটকের দল ছিল না। আমরা প্রসেনিয়াম দিয়েই শুরু করি। আমাদের প্রথম দু’টি প্রযোজনা ছিল প্রসেনিয়াম নাট্য। তৃতীয় প্রযোজনা থেকে আমরা স্ট্রিট থিয়েটার শুরু করি। ধীরে ধীরে আমরা ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পথনাটকের দিকে ঝুঁকতে থাকি। ১৯৮৯ সাল থেকে আমরা প্রধানত পথনাটক পরিবেশনা শুরু করি।
আরও পড়ুন : সহজ বাংলায় অজন্তা-ইলোরা চিনিয়েছিলেন নারায়ণ সান্যাল!
লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক…
তাহলে সফদরের নাট্যধারা এবং আপনাদের থিয়েটারের চিন্তা, এই দু’টি আন্দোলন কীভাবে মিলিত হয়?
হ্যাঁ, আমরা একই আদর্শ, একই উদ্দেশ্য ভাগ করে নিচ্ছিলাম, তবে আমরা একে অপরকে মুখোমুখি চিনতাম না। আমি ব্যক্তিগতভাবে সফদর হাশমির সঙ্গে কখনও দেখা করিনি। কিন্তু আমি তাঁকে আমার থিয়েটারের কাজ শুরু করার আগে থেকে, আমাদের থিয়েটার দল তৈরির আগে থেকে ‘জন নাট্য মঞ্চ’-র পারফরমেন্সগুলির মাধ্যমে চিনতাম। আমি সিপিআইএম দলের হয়ে তাদের পরিবেশনার কিছু ভিডিও রেকর্ডিং দেখেছিলাম তখন। ১৯৮৬ সালে, আমরা জন নাট্য মঞ্চের (জনম) একটি পথনাটক পরিবেশন করি, ‘অওরত’। সেটি একটি তামিল প্রযোজনা ছিল, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ পথনাটক ছিল না। সেটি একটি আধা-পথনাটক ছিল, যা সম্পূর্ণরূপে রাস্তায় হয়নি। সেটি এমন একটি মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছিল, যা বাদল সরকারের অঙ্গন-মঞ্চের ধারণার অনেকটা কাছাকাছি ছিল। তারপর ১৯৮৭-তে আমি তিরুবনন্তপুরমে একমাসব্যাপী থিয়েটার কর্মশালায় যোগদান করি। এই কর্মশালা কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ আয়োজন করে। এই কর্মশালায় সারা ভারত থেকে অনেক পথনাটক কর্মী এসেছিলেন। এনএসডি থেকে পড়ালেখা করা দু’জন এই কর্মশালা পরিচালনা করেন। কর্মশালায় জননাট্য মঞ্চের একজন নাট্যবন্ধু অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমি এবং আমার সহকর্মী নাট্যকর্মী অ্যালেক্স, আমরা দু’জনে সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি এবং জন নাট্য মঞ্চের সেই ব্যক্তির কর্মশালাতেই আমাদের আলাপ হয়ে।
১৯৮৯ সালের পর, আমরা স্ট্রিট থিয়েটার সম্পর্কে বেশ কিছুটা বৈজ্ঞানিক ধারণা অর্জন করি। আমরা থিয়েটারের স্পেসগুলি বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের নিজস্ব স্পেস এবং আমাদের নিজস্ব নাট্যভাষা তৈরি করার চেষ্টা করি।
১৯৮৯ সালে, সফদর হাশমির হত্যার পর, জন নাট্য মঞ্চের কাজগুলি বৃহৎ পরিসরে প্রকাশ পায়। সফদরের বেশ কিছু লেখা ‘রাইট টু পারফর্ম’ নামে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
বাদল সরকার ১৯৮০ সালে চেন্নাইতে এসেছিলেন দশ দিনের একটি কর্মশালা পরিচালনা করার জন্য। আমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে কর্মশালায় যোগ দিতে পারিনি, তবুও যাঁরা থার্ড থিয়েটার সম্পর্কিত সেই কর্মশালাটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। অন্য ধারার থিয়েটার সম্পর্কে আমাদের ধারণা, ‘স্পেস’ কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আখ্যান কীভাবে উন্নত করতে হয়, সব ক্ষেত্রেই আমরা বাদল সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম।
এর আগে আমরা বাদল সরকারের নাট্যধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলাম। সফদরের বইটি পড়ার পর, থিয়েটার সম্পর্কে আমাদের ধারণা আমূল বদলে যায় এবং বিশেষভাবে আলোকিত হয়। বাদল সরকার ১৯৮০ সালে চেন্নাইতে এসেছিলেন দশ দিনের একটি কর্মশালা পরিচালনা করার জন্য। আমাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে কর্মশালায় যোগ দিতে পারিনি, তবুও যাঁরা থার্ড থিয়েটার সম্পর্কিত সেই কর্মশালাটিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছিলাম। অন্য ধারার থিয়েটার সম্পর্কে আমাদের ধারণা, ‘স্পেস’ কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আখ্যান কীভাবে উন্নত করতে হয়, সব ক্ষেত্রেই আমরা বাদল সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে আমরা দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পথনাট্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। এটি ‘সহমত’ (সফদর হাশমি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট) দ্বারা আয়োজিত হয়েছিল। সফদর হাশমির মৃত্যুর পর এই ট্রাস্টটি গঠিত হয়েছিল। এই আমন্ত্রণ আমাদের জন্য একটি ভাল সুযোগ ছিল, কারণ আমরা অন্যান্য রাজ্যের নাট্যদলের সঙ্গে, বিশেষ করে জননাট্য মঞ্চের সঙ্গে চিন্তা আদানপ্রদান করতে পেরেছিলাম। আমরা আমাদের সহ-নাট্যদলের পরিবেশনা মন দিয়ে লক্ষ করতাম।
এরপর জন নাট্য মঞ্চ এবং অন্যান্য নাট্যদলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ এবং সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালে ‘সহমত’ আয়োজিত ৪০ দিনের একটি নাট্যকর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। আমি সেই নাট্যকর্মশালায় যোগ দিয়েছিলাম। এম কে রায়না, প্রসন্ন প্রমুখ বিদগ্ধ নাট্যব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কর্মশালায় আমাদের নাট্যবোধ সমৃদ্ধ হয়েছিল।
আপনাদের থিয়েটারের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ কীরকম?
স্ট্রিট থিয়েটারের একটি ঐতিহাসিক পথ চলা রয়েছে। অনেকেই বিভিন্ন উপায়ে থিয়েটার করছেন। বিভিন্ন সরকারি স্ট্রিট থিয়েটার হচ্ছে, বিভিন্ন এনজিও তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যে স্ট্রিট থিয়েটার করছে। তাদের ব্যক্তিগত পদ্ধতিগুলিকে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। তবে আমাদের চিন্তা পৃথক ছিল। আমরা স্ট্রিট থিয়েটারের প্রতি আমাদের বিশ্বাস বজায় রাখতে চেয়েছিলাম। স্ট্রিট থিয়েটারের প্রতি একটি ঐতিহাসিক কর্তব্যবোধ থেকে যায়। স্ট্রিট থিয়েটার প্রতিবাদের একটি বিশেষ ভাষা। সফদর হাশমির একটি কথা থেকে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে, দক্ষিণ ভারতের কিছু শ্রমিক তাঁদের নিজস্ব জীবন-সংগ্রাম নিয়ে থিয়েটার করা শুরু করেছিলেন। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব জীবন-কাহিনি পরিবেশন করছিলেন থিয়েটারের মধ্য দিয়ে। এটা যেন ‘আমিই গায়ক, আমিই গান’-এর মতো ব্যাপার। শ্রমিকরাই অভিনয়শিল্পী, তারাই বিষয়। এছাড়াও আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্রিট থিয়েটার, মায়াকোভস্কি, মেয়ারহোল্ড প্রভৃতির বিষয়ে সচেতন ছিলাম।
আপনার মতে, ভারতে পথনাটক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী?
আমি আপনাকে এটি নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছি না। কিন্তু মানুষকে অথবা নির্দিষ্ট কোনও জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করার তাগিদে, স্ট্রিট থিয়েটার অতীতে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে কাজ করেছিল। পথনাটক এমন লোকেদের কাছেও থিয়েটার পৌঁছে দিত, যাদের থিয়েটার দেখার অভ্যাস অথবা দেখার সুযোগ, কোনওটাই ছিল না। পথ নাটকের আরও একটি উদ্দেশ্য হল, শিল্পকে তথা থিয়েটারকে রাস্তার মোড়ে, শ্রমজীবি মানুষদের কর্মক্ষেত্রে প্রভৃতি সাধারণ স্থানগুলিকে তুলে ধরা। এই সাধারণ স্থানগুলিই তখন হয়ে ওঠে থিয়েটারের স্পেস। স্ট্রিট থিয়েটারের মূল উদ্দেশ্য এইভাবে চরিতার্থ হয়। তাই আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে সচেতন করার জন্য, বাকি পৃথিবীর পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত করার জন্য স্ট্রিট থিয়েটার থেকে যাবে। স্ট্রিট থিয়েটার টিকে থাকবে গণ জমায়েতের মাধ্যমে, এর জন্য মানুষের একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। যতক্ষণ মানুষের জমায়েত সম্ভব, ততক্ষণ স্ট্রিট থিয়েটারও সম্ভব।