ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • শতবর্ষেও অগ্নিবর্ষী

    কোয়েল সাহা (January 25, 2025)
     

    ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়া কবিরাও বোধহয় ভাগাভাগি হয়ে থেকে যায়। ভাগাভাগি-বিচ্ছেদ-ব্যবধানে পুষ্ট জলবায়ুর গড়ণ আমাদের উত্তরাত্তর পেয়ে বসতে চায়। দুই ভিন্ন ব্যক্তিত্বের পরিসর নিয়ে বেড়ে ওঠা কবিরা কে বেশি বড় কিংবা ছোট— প্রতিযোগিতার এই প্রবণতায় কোনও খামতি রাখতে চাই না আমরা। ষড়যন্ত্রে ঠাসা বিচ্ছিন্ন করা ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতার বহরে আটকে রবীন্দ্রনাথ বনাম কাজী নজরুল ইসলাম, উন্মদনার এই কলরবে মেতে তাই দিব্যি ইতিহাস-রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠতে পারি। 

    স্কুল-কলেজের সিলেবাসে আলগোছে ঠাঁই পাওয়া কাজী নজরুল ইসলাম তাই একটু বেশিই ফিকে হয়ে যায় এদেশের মাটিতে। প্রাথমিক সরকারি স্কুলের ফিকে লাল ইলাস্ট্রেশনে আটের দশকে বেড়ে ওঠা ছোটদের কাছে কাজী নজরুলের ছেলেবেলা, আর্থিক সংকট ও চুঁড়ুলিয়া গ্রাম থেকে কবি হয়ে ওঠা পরিচয়ের সূক্ষ্মতা একটা সময় কাঁটাতারের গায়ে আটকে যায় ধর্ম-পরিচয়ে। ঠিক যেভাবে বাংলা ভাষায় অনুবাদ হওয়া কবি ওমর খৈয়াম কোন সুদূর মরুঝড়ে যেমন আড়াল হয়ে যান! কলকাতা শহরের আঁকে-বাঁকে গচ্ছিত থাকা মির্জা গালিব সাহেবের শব্দ-অনুভূতির মূর্চ্ছনা ক্রমাগত যানজট, ধোঁয়া-ধুলোয় চাপা পড়ে গেল।  

    আরও পড়ুন : ভূমেন্দ্র গুহকে অন্যভাবে চেনায় এই বই, লিখছেন আশিস পাঠক…

    গ্রামভারতের প্রতিনিধি, ধর্মে মুসলমান ছেলেটি  দশম শ্রেণির পরীক্ষার আগে, ১৯১৭ সালে লেখাপড়া ছেড়ে ১১ টাকা তনখা নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পেশাদার সৈনিক হয়ে লড়তে পৌঁছে গিয়েছিলেন অবিভক্ত দেশের করাচিতে। ১৯২০ সালে যুদ্ধ থেকে ফেরা কিশোর ছেলেটির কবি হয়ে ওঠা এদেশের মাটিতে কিছুটা হলেও বিরল। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে স্বাধীন, মুক্ত মন-মানসিকতার স্পর্ধা বাংলার জলবায়ুকে প্লাবিত করে তুলেছিল। ‘নবযুগ’, ‘ধুমকেতু’, ‘বাঙলার কথা’ একের পর এক পত্রিকায় ছাপা নজরুলের কবিতা বাঙালি শিক্ষিত মানুষের কাছে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা খওয়াবের সীমানা থেকে এ-দেশের মাটিতে রক্ত-ঘামে ভেজা শরীরে ধরা দিয়েছিল। সাহিত্য স্বাধীনতা-প্রসঙ্গকে কতটা বারুদের মতো ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, তার অন্যতম উদাহরণ, ১১ বছরের বালিকা লীলা মিত্রর প্রবন্ধ ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’। স্বাধীনতা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক উপলব্ধি সদ্য কিশোরীর কলমকেও ভাবিত করেছিল। অন্যদিকে পরাধীন দেশের শাসককে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। 

    ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা রাজরোষের মুখে পড়বে, এই ঘটনা স্বয়ং কাজী সাহেবের কাছেও হয়তো খুব আশ্চর্যের ছিল না। স্বাধীনতার তীব্রতা কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার বীজমন্ত্র হয়ে উঠেছিল। হয়তো সেই কারণেই ১১ নভেম্বর, ১৯২৪ সালে নিষিদ্ধ হওয়া ‘ভাঙার গান’ শহর-গ্রাম, দেশকালের সীমানা অতিক্রম করে বেঁচে থাকল, শ্বাস নিল লোকের মুখে মুখে। ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে শ্রুতিনির্ভর হয়ে থাকার পরম্পরা বহু প্রাচীন। রূপকথার গল্প থেকে বেদের শ্রুতি-সত্তার পরিচয় এ-দেশের মাটিতে জল-হাওয়ার মতো বয়ে চলা নদীর স্রোত। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক পঠনপাঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা, অর্থাৎ লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্কে থাকা বা না-থাকার কোনওরকম পাঁচিলের গ্রাহ্য করে না শ্রুতিনির্ভরতা। কানে শুনে তারপর বার্তাবাহকের মতো অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার শর্তহীন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার মতো সংবেদশীল এই চরাচরে কোনও স্বৈরাচারী শাসন, বলবৎ হতে পারেনি। 

    তরুণ বয়সে কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান

    ‘১.

    কারার ঐ লৌহ কপাট

    ভেঙে ফেল, কররে লোপাট

               রক্ত-জমাট

    শিকল-পুজোর পাষাণ বেদী

    ওরে ও তরুণ ঈশান!

    বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ!

                                          ধ্বংস-নিশান

                                উড়ুক প্রাচী’র প্রাচী’র ভেদি’।’ …

    খোলা আকাশের নিচে গণকন্ঠে স্বাধীনতার আহ্বান। নিচু স্বভাব, মনের বাঁধনে গাঁথা বাঙালি স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ উচ্চারণে, মাঝে থাকা জাতপাত-ধর্ম-লিঙ্গ ভেদাভেদের দেওয়াল বড় অবলীলায় ঝাপসা করে দিতে চাইল। চেপে বসা যুদ্ধের রক্ত-মৃত্যু-বিচ্ছেদ, পরাধীনতার যন্ত্রণায় আক্রান্ত সুদূর ফরাসি দেশের দার্শনিক সাঁত্রে, ক্ষমতা ও যুদ্ধের ধারাবাহিকতা ভেতরে পরাধীনতার শর্ত দেহ-মনের সর্বত্র যেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দি সৈনিক সাঁত্রে তাঁর স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষা, জনতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সমস্বরে উচ্চারণ করার জন্য জীবনের প্রথম নাটক লেখেন— ‘বারিওনা’।  সাহিত্য মুক্তি তথা স্বাধীনতার কন্ঠস্বরকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে এক স্বতন্ত্র পরিসর চিহ্নিত করে দিল। 

    সাহিত্য স্বাধীনতা-প্রসঙ্গকে কতটা বারুদের মতো ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল, তার অন্যতম উদাহরণ, ১১ বছরের বালিকা লীলা মিত্রর প্রবন্ধ ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’। স্বাধীনতা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক উপলব্ধি সদ্য কিশোরীর কলমকেও ভাবিত করেছিল। অন্যদিকে পরাধীন দেশের শাসককে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। 

    সমাজ-জীবন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। ভোগের স্বর্গ সুরক্ষিত করতে তামাম দুনিয়ার ক্ষমতা কায়েম হচ্ছে পরাধীন করে রাখার নিত্যনতুন কৌশলের মধ্য দিয়ে। আর অন্যদিকে স্বাধীনতা-সমতা-মর্যাদা এক সমবেত উচ্চারণ।

    আজকের সময় পর্যন্ত দ্বন্দ্বের এই ধারাবাহিকতা অটুট। স্বাধীন দেশের শাসক সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা খর্ব করতে ভুয়ো কেস সাজিয়ে জেলে পুরে দেওয়ার মতো একের পর এক কাণ্ড ঘটানোর রেওয়াজ চালাতে থাকে। ২০১৮-তে মহারাষ্ট্রর ভীমা কোরেগাঁও; ২০২০-তে দিল্লির দাঙ্গা যার অন্যতম। তামাম দেশের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কবি ভরাভরা রাও, অধ্যাপক-উকিল-ছাত্র, অশীতিপর বৃদ্ধ ফাদার স্ট্যান স্বামী, শরীরের নব্বই শতাংশ কাজ না করার কারণে হুইলচেয়ারে আটক কবি-অধ্যাপক জি এন সাইবাবা। কাউকেই যেন রেওয়াত করতে চায় না।  

    আজকের সময়েও জেলের বাইরে থাকা, অধিকার নিয়ে সরব থাকা মানুষের স্বাধীনতার দাবি প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার ‘ভাঙার গান’। যখনই রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবি সরব হয়েছে, অতীত ছুঁয়ে ‘ভাঙার গান’ দিয়েছে ভরসা। বাংলাদেশে সাম্প্রতিকতম চরম অস্থিরতায় নাকাল দেশবাসী ‘ভাঙার গান’-কে আশ্রয় করে গণস্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করতে চাইছেন।  

    ১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৪৯-এ ন্যাশনাল বুক এজেন্সি লিমিটিডের পক্ষ থেকে সুরেন দত্ত প্রকাশক হিসেবে ‘ভাঙার গান’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন এক টাকা বিনিময় মূল্যে। তারপর ৭৫ বছরে ‘ভাঙার গান’ বইটি প্রকাশ পেল না।  ২০২৫, ব্ল্যাকলেটার্স প্রকাশনা সংস্থা থেকে শতবার্ষিকী সংস্করণ  প্রকাশ পেল। দীর্ঘ ব্যবধান কেন, কী কারণে— তা নিয়ে উৎসাহী পাঠকদের ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে চর্চার দিকে কিছুটা হলেও যেন উৎসাহ জোগাবে এই প্রকাশ।  ১৯৪৯ সালের ন্যাশনাল বুক এজেন্সির দ্বিতীয় সংস্করণটিকে অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রকাশ করার উদ্যোগে দেখা গেল, কালো রঙের শক্ত বোর্ডের বাঁধুনিতে রুপোলি বর্ণবিন্যাস। সোনালি নয়। ধাতু বিচারে রুপো এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির। ধর্মের হিসেবে মুসলমানরা ঠিক যেমন দ্বিতীয়। প্রথম নয়। 

    প্রচ্ছদের ঘন কালোর ওপর টেক্সচারের তীব্রতা হাতে নিয়ে অতীত-স্পর্শের ঝোঁক বেড়ে যায়। প্রকাশক অর্ক দেব যত্নসহকারে উত্তরকথন পর্বে ‘ভাঙার গান’ ঘিরে থাকা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণকে বিভিন্ন দিক থেকে যেন উসকে দিতে চেয়েছেন। বইটি যত্ন নিয়ে সাজিয়েছেন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়। বই-টি স্বাধীনতার সাক্ষর ছুঁয়ে থাকা কালো অক্ষরের প্রবণতা ফিরিয়ে আনল যেন। অতীত খনন করে বর্তমানকে স্পষ্ট করে বুঝে নিতে ‘ভাঙার গান’ কোন পক্ষের, সেই দায় শেষ পর্যন্ত একান্তই পাঠকের।

    ‘শতবার্ষিক সংস্করণ: ভাঙার গান’

    কাজী নজরুল ইসলাম

    ব্ল্যাকলেটার্স। ২০০.০০

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook