চ্যাট-জিপিটি যে ভূতের রাজার এক নতুন অবতার, তাতে সন্দেহ নেই আমাদের। মাত্র তিন বর নয়, এর কাছে যা প্রার্থনা করা যাবে, তাই এসে উপস্থিত হবে আপনার কম্পিউটারের পর্দায়। তাকে হাতে পাবেন না অবিশ্যি। এ যেন এক ভার্চুয়াল বর দান। আপনার ইচ্ছে করছে, আপনার প্রেমিকা বা প্রেমিকের জন্য একখানা নতুন রবীন্দ্রসংগীত লিখে মাঝরাতে তাকে তাক লাগিয়ে দিতে? চ্যাট-জিপিটিকে বলুন, হে জিপিটিবাবা, আমায় রবীন্দ্রনাথের স্টাইলে একখান গান লিখে দিন। তাতে যেন আমার বান্ধবী শ্রীমতী পুঁটির নাম জ্বলজ্বল করে। জিপিটি অমনি হাতে কলম তুলে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে লিখে দিলেন সেই পরম প্রেমের রবীন্দ্রগান, শ্রীমতী পুঁটির নামসমেত। আবার ধরুন, আপনি একজন লেখক হওয়ার জন্য প্রবল চেষ্টা করছেন। অথচ একখানাও, কালের দাবি মেনে তন্ত্র-মন্ত্রর গন্ধ মাখা রোমহর্ষক ঐতিহাসিক থ্রিলার-টিলার লিখে উঠতে পারছেন না। প্রার্থনা করুন যে, সপ্তদশ শতকের পটভূমিকায় একখান জম্পেশ থ্রিলারের আইডিয়া দাও দেখি! তার মধ্যে একটু তিব্বতি তন্ত্র রাখতে ভুলো না যেন! ব্যস, প্লট এসে হাজির– চাইলে দশখানা অধ্যায়ে ভাগ করে বলেও দেবে, কীভাবে সাজাবেন ঘটনার ঘনঘটা।
কিন্তু চ্যাট-জিপিটির এই ‘সব পেয়েছির আসর’ বসানোর ক্ষমতা জন্মাল কোত্থেকে?এত জ্ঞান আসছেই বা কীভাবে?
এর উত্তর পাওয়ার জন্য জানতে হবে, এর নির্মাতা ওপেন এ-আই কোম্পানিকে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির উদ্দেশ্যই ছিল আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইন্টেলিজেন্স– যাকে বাংলায় বলা যায়, কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা। মানে কী এর? এতকাল, অর্থাৎ চ্যাট-জিপিটি অথবা তার নানাবিধ জাতভাইদের জন্মের আগে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ছিলো ভীষণভাবে বিষয়ভিত্তিক। মানে ধরা যাক, আপনি এমন একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম চান, যাকে আপেল বা কমলালেবুর ছবি দেখালে চিনে ফেলবে আপেলকে আপেল বলে আর কমলাকে কমলা বলে। আপনি নির্দিষ্ট মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম আর নানারকম আপেল এবং কমলার ছবি ব্যবহার করে এমন একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমান মডেল তৈরি করে ফেলতে পারেন খুব সহজে। কিন্তু এই মডেল কেবলমাত্র আপেল এবং কমলাই চিনবে। একে যদি ন্যাসপাতি দেখানো হয়, তবে তাকে সে হয় আপেল না হলে কমলা বলে ভুল করবে। ন্যাসপাতি আর পেয়ারার পার্থক্য করার জন্য তৈরি করতে হবে আলাদা একটা মডেল।
ওপেন এআই বলল, আমাদের মডেল নির্দিষ্ট কাজ বা বিষয়তে পারদর্শী আর অন্য কাজে লবডঙ্কা– এরকম হবে না। এ একেবারে সর্বকর্মা হবে। কতকটা মানুষের মতো। মানে ধরুন, যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। শুধু তাকে বলে দিতে হবে যে, কখন চুল বাঁধবে আর কখন রাঁধবে। চ্যাট-জিপিটিও সেরকম– তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ বা প্রম্পটের সাহায্যে বলে দিতে হবে আপনি তাকে কোন রূপে, কী কাজ করাতে চান। ব্যস, তা হলেই কেল্লা ফতে!
কিন্তু এখানে দুটো প্রশ্ন থেকে যায়। এক, চ্যাট-জিপিটি যে সঠিক বলবে, তার নিশ্চয়তা কী? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, এই যে চ্যাট-জিপিটি তথা সমগ্র জিপিটিকুল যে এত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠছে, তার এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ তথ্যভাণ্ডার– সেই বিপুল তথ্য আসছে কোথা থেকে? আর এই দ্বিতীয় প্রশ্নই ওপেন এআই-এর প্রতি নানাবিধ বিধিভঙ্গের অভিযোগের আঙুল তুলে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ওপেন এআই-এর প্রাক্তন কর্মচারী সুচির বালাজি-র সাম্প্রতিক রহস্যজনক মৃত্যু আরও বড় প্রশ্নচিহ্নর সামনে দাঁড় করিয়েছে এই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে।
আজকাল ব্যক্তিগত তথ্য সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করা তো খুবই সাধারণ একটা বিষয়। আমরা সকলেই কমবেশি নানারকম ছবি ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বন্ধুদের দেখানোর জন্য পোস্ট করেই থাকি। আবার যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার তাঁরা তো জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত– বাচ্চার ন্যাপি পাল্টানো থেকে দুপুরে কুমড়োসেদ্ধ না খেয়ে কেন আলু-বরবটির তরকারি খেলেন– এই সমস্ত তথ্যই দিয়ে যাচ্ছেন ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মগুলোতে। এর পরিবর্তে হয়তো পাচ্ছেন বেশ ভালরকম অর্থ। সে খুবই সুখের কথা। আপনি ভাবছেন, আমার বাচ্চার প্রতি মুহূর্তের কার্যকলাপের ছবি, অথবা আমার নিজের বা স্বামীর বা স্ত্রীয়ের রোজনামচা ভার্চুয়াল দুনিয়াতে রেখে দিলে ক্ষতি কী? বরং দু’পয়সা আসছে আর বুড়ো বয়সে এসব দেখে বেশ স্মৃতিমেদুর হওয়া-টওয়া যাবে। ক্ষতি এটাই যে, আপনার এইসব তথ্য আপনার বিরুদ্ধেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কীভাবে? এআই-এর সাহায্যে আপনার নিকটজন, যাঁর প্রতি মুহূর্তের খবরাখবর আপনি তুলে দিয়েছেন জনগণের কাছে, তাঁর গলার স্বর নকল করে ফোন আসছে আপনার কাছে। অথবা, তাঁর চেহারাও এআই-এর সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করে ভিডিও কল আসছে আপনার ফোনে। চাইছে সাহায্য। চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করেই আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন সাহায্য করতে– আর জালিয়াতির জালে জড়িয়ে পড়ছেন।
আমেরিকায় গত কয়েকমাসে এই নতুন স্ক্যাম বহু মানুষকে সর্বস্বান্ত করেছে। অতএব, সাধু সাবধান। আমাদের যা কিছু তথ্য, যা আমাদের স্বাতন্ত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখে, সেই সমস্ত কিছু না-ই বা দিলেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। থাক না, কিছু নিজেদের মধ্যে– একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে।
এ তো গেল তথ্যর অপব্যবহারকারী জালিয়াতদের কথা। ফেরা যাক, যে-কথা বলছিলাম, সেখানে। ওপেন এআই-এর কর্মচারী সুচির বালাজি গত অগাস্ট মাসে কোম্পানি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। এবং তারপরেই প্রথমে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ এবং পরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের কাছে ওপেন এআই-এর অনৈতিকভাবে ব্যক্তিগত তথ্যসংগ্রহ এবং সেই তথ্য ব্যবহার করে জিপিটি মডেলকে আরও শক্তিশালী করে তোলার কথা ফাঁস করেন। সুচিরের কথা অনুযায়ী, ওপেন এআই নাকি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করা আপনার ব্যক্তি-তথ্য সংগ্রহ করে তাদের মডেলকে তা দিয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে থাকে। তার ফলে এই উন্নততর মডেল লাভ করে আপনার কর্মদক্ষতাও। আর তাই দিয়ে অনায়াসেই আপনার কাজ নির্ভুল এবং অক্লান্তভাবে করে দিয়ে আপনাকে কর্মক্ষেত্র থেকে উৎখাত করাতে পারে।
সুচিরের দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল কপিরাইট সংক্রান্ত। জিপিটি-কে বিভিন্ন লেখকের স্টাইলে লিখতে বললে যে অবলীলায় লিখে দিচ্ছে, অথবা বিভিন্ন বইয়ের বিভিন্ন তথ্য যে তার যান্ত্রিক মগজে গিজগিজ করছে, তার জন্য সেই সমস্ত লেখকের সমস্ত বইপত্র গুলে খাওয়া তো দরকার। ওপেন এআই নাকি তা গুলে খাওয়াচ্ছে তাদের এআই মডেলদের। কিন্তু সেই সকল লেখকের কপিরাইট আছে নিজেদের সৃষ্টির ওপর। অনৈতিকভাবে তাকে লঙ্ঘন করা আইনের চোখে এক অপরাধ বইকি!
শুধু তাই নয়, চ্যাট-জিপিটির প্রদেয় উত্তরের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন সুচির। জিপিটি মডেলকে যদি তার জানা জিনিসের বাইরের কোনও জিনিস নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তাহলেও সে দমে না। এর এমনই অ্যালগরিদম যে সম্ভাবনা তত্ত্বের জটিল অঙ্ক কষে একটা উত্তর তৈরি করেই দেবে। সে ঠিক হোক বা বেঠিক। চ্যাট-জিপিটির উদ্দেশ্যই হল এমন এক উত্তর তৈরি করা, যা আপনার কাছে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে যে, আপনি তার যথার্থতা নিয়ে সন্দেহই করবেন না।
সুচিরের এই অভিযোগমালার ফল হিসেবে ওপেন এআই-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা তাদের কপিরাইট নেওয়া লেখা বা বই অনৈতিকভাবে ব্যবহার করার অভিযোগ জানিয়ে অনেকগুলো মামলা দায়ের করেছে আমেরিকার আদালতে। আর ঠিক এই সময়েই মাত্র ২৬ বছরের তরুণ সুচির বালাজির দেহ উদ্ধার হল তাঁর ঘর থেকে। পুলিশ আত্মহত্যা বলে দেগে দিলেও তাঁর নিকট-আত্মীয় এবং বন্ধুরা তা মেনে নিতে নারাজ। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর নেপথ্যে ওপেন এআই-এর হাত আছে বলেই সন্দেহ সকলের। সংস্থার অনৈতিকতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেই কি নিজের মৃত্যু ডেকে আনলেন সুচির?
সুচির বালাজির মৃত্যু যে ভাবেই হয়ে থাক না কেন, তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলে দিয়ে গেছেন, তা দুশ্চিন্তার। শুধু ওপেন এআই এর মতো সংস্থার অনৈতিকতাই নয়,আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও কি প্রচ্ছন্নভাবে এই এদের শক্তি সঞ্চয়ের অন্যতম উপকরণ নয়? মহাভারতের কালে ধর্মযুদ্ধ-টুদ্ধ হয়ে ন্যায়ের জয় হত। এখনকার দিনে জোর যার মুলুক তার। আর এই জোর আসে শুধু পয়সা থেকেই নয়, তথ্য থেকেও। যার হাতে যত তথ্য, তার জোর তত বেশী। আর তাই আরো বেশি তথ্য সংগ্রহ করার খেলায় মেতে আছে তাবড় টেক কোম্পানিকুল। মেটা (ফেসবুক), গুগল, মাইক্রোসফট সকলেই চায় আপনি আরও আরও তথ্য তুলে দিন তাদের হাতে। আপনি নিজের ব্যক্তিগত ছবি, আপনার আয়-ব্যয়ের হিসেব, আপনার চেনা-পরিচিত মানুষের তালিকা ইত্যাদি দিন নানা ছলে– আর বদলে তারা দেবে আপনাকে অর্থ, আপনার তথ্যর সুরক্ষা, আপনার হারানো বন্ধুর খোঁজ, অথবা ঘরে বসে ব্যবসা করার সুবিধা। সাময়িকভাবে লোকসান নেই আপনার– বরং লাভ।
কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনার শিশুসন্তানের প্রতি মুহূর্তের ছবি যখন ভার্চুয়াল মাধ্যমে দিয়ে চলেছেন, বড় হওয়ার পর সে যখন নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবে, তখন সে দেখবে তার সমস্ত আশৈশব তথ্য ধরা রয়েছে কোনও এক টেক কোম্পানির কোষাগারে। আর সেই সংস্থা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে অনায়াসে তার সমস্ত ভাবনাচিন্তা, পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক মত- সব জেনে বসে থাকবে। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রব্যবস্থা তা কীভাবে ব্যবহার করবে তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে, কিন্তু সাধারণভাবে ভাবলে একজন মানুষের জন্য কি তা একটুও সুখদায়ক হবে?
ভাবার সময় এখনও আছে। আসুন না,সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার আগে একটু ভাবি, এআই-এর হাতে নিজেদের সঁপে দেওয়ার আগে, একটু থমকে দাঁড়াই। গুপি তো সেই কবেই গেয়েছিল, নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র, আমি প্রাণী…