হরশঙ্কর – পাঁচ
কলকাতার অফিসে তেমন কাজের চাপ না থাকায় আজ একটু বেলাবেলিই বাড়ি ফিরেছে হরশঙ্কর। কিন্তু সদর দরজা দিয়ে, উঠোন পেরিয়ে, দালানঘরে ঢুকতেই হরু দেখল যে, কারা যেন বসে আছেন। দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন বয়স্থা মহিলাও এসেছেন। সাদাসিধে করে শাড়ি পরেই মাথায় ঘোমটা টানা। সিল্কের কাপড় এবং হাতে ধরা নক্সী-বটুয়াটি দেখেই বোঝা যায় যে তাঁরা বেশ অভিজাত। ঠোঁট এবং দাঁতে লাল ছোপ না থাকায় এ-ও আন্দাজ হল যে, পান-জর্দা খাওয়ার অভ্যেসও নেই; এইজন্যেই তাঁদের বেশ রুচিশীল-শিক্ষিত বলেও মনে হল হরুর। ওঁদের পাশ কাটিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগোতেই, হরুর দিকে তাকিয়ে মা বললেন, ‘এটি আমাদের বড় ছেলে হরশঙ্কর; কাগজের আপিসে চাকরি করে; এর বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেলেই, ছোটজনের বিয়েতে উদ্যোগ নেব আমরা।’ মায়ের কথার উত্তরে আর না থেমে, সোজা ওপরে চলে গেল হরশঙ্কর; বুঝতে পারল না যে, তার বিয়ের ব্যাপারেই এই তিনজন এসেছেন কি না! নিজের ঘরে এসে সে দেখল যে, বেশ পরিপাটি পোশাকে বসে আছে তার ভাই নিশি। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু আন্দাজ করতে না পেরে, নিজে থেকেই বলে উঠল, ‘তুই কি বিয়ে করবি না বলেই পণ করেছিস?’
‘কেন? আমার বিয়ের ব্যাপারে তোর কিসের মাথাব্যথা?’
‘মায়ের বয়স হচ্ছে; সংসারের হাল ধরতে তো লোক লাগবে!’
‘মায়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে, না কি তোর বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে?’
‘দেখছিস না ভূতোর কেমন বিয়ে হয়ে ছেলেপুলেও হয়ে গেল! সময় কি বসে আছে?’
‘সেটা বল যে, আমার বিয়ে না হলে তোর বিয়েটা আটকে যাচ্ছে!’
‘তরুবউদির বোনঝি; মায়ের বাপের বাড়ির গ্রাম আনুলিয়ায় বাড়ি; তোর কথা ভেবেই তরুবউদি যোগাযোগ করে দিয়েছে; কিন্তু ওঁরা একটু রং-ফর্সা পাত্র চান; আমাকে দেখেই তাই ওরা পছন্দ করেছেন।’
‘ওঁরা কি তোকে দেখেই জেনে গেলেন যে, আমার গায়ের রংটা তোর মতো ফিকে নয়?’
‘আমি কি তাই বলেছি! আমাকে দেখার পর জিজ্ঞেস করাতে বাবা বললেন যে, আমাদের বড় ছেলেটির রং একটু চাপা; বাবা তো বলেননি যে, তুই কালো।’
‘ঠিক আছে; মাকে বলে দেব যে, আমার জন্য যেন কালো মেয়েই খোঁজা হয়।’
হরশঙ্করের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে, সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিশিকান্ত। জামাকাপড় ছেড়ে, হাতে-মুখে জল দিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াতেই, হরু দেখল যে, গদগদ ভঙ্গিতে নিশি ওই তিনজন লোককে ঘোড়ার গাড়িতে তুলে রওনা করিয়ে দিচ্ছে। বাবা হয়তো দরজার কাছে ছিলেন, তাই জানলা থেকে তাঁকে আর দেখতে পেল না হরু।
পরদিন কলকাতার অফিসে গিয়ে কাজকর্ম সেরে, হরু গেল তরুবউদির ছোটকাকার খোঁজ করতে; এসপ্ল্যানেড অঞ্চল থেকে বেরিয়ে ডালহৌসির দিকে হাঁটলেই একটা সরকারি দপ্তরে তিনি কাজ করেন। ছুটির মুখে দুজনে হাঁটতে-হাঁটতে শেয়ালদা স্টেশন অবধি হেঁটে এসে, যে যার ট্রেন ধরেন। তরুবউদির এই ছোটকাকা এখন ইছাপুরে এক বাসায় ভাড়া থাকেন। হরশঙ্করের কাছে সব শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি জানতে চাইলেন যে, এখনই বিয়ে করতে সে রাজি কি না; কারণ তাঁর এক অবিবাহিতা শ্যালিকা আছে, মুখে সামান্য বসন্তের দাগ এবং গায়ের রং চাপা বলে বিয়ে হচ্ছে না; মেয়েটি ভাল এবং সংসারীও; হরু এককথায় রাজি হয়ে গিয়ে তাঁকে বলে দিল যে, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে নিতে। ছোটকাকা হরুকে অনুরোধ করলেন যে, নিজে গিয়ে একবার দেখে আসতে। হরু মাথা নেড়ে জানাল যে, বাবা দেখে এলেই হবে; তার ওপর মেয়েটি যখন এত পরিচিত যোগাযোগে আসছে, সেখানে আর দেখা-দেখাদেখির কী আছে! হরুর মনে হল, এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে সে যেন নিশিকে বেশ কড়া করে একটা ধমক দিতে পারল।
২
হরুর মন জুড়ে এখনও তো সেই বিরজাবালা; অমন বুদ্ধিদীপ্ত অথচ স্নিগ্ধ মেয়ে সে তো আর দুটি দেখল না। ভূতেশের বউয়ের মতো ডাকসাইটে সুন্দরী নয় ঠিকই, কিন্তু কী যে লাবণ্যময়ী তা বলে বোঝানো যায় না; আগে-আগে এ বাড়িতে তাদের মায়ের কাছে আসত। মা-ও খুব পছন্দ করেন তাঁকে; হরু কতবার ভেবেছে যে, বিধবা বিরজাবালাকে বিয়ে করে অন্য কোথাও গিয়ে সংসার পাতবে; কিন্তু তেমন জোর সে বিরজাবালার দিক থেকে কখনও পায়নি। ইদানীং তো পরিস্থিতি একেবারেই উলটে গেছে। বিরজাবালা একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে; জয়নারায়ণ পাড়া ছেড়ে চলে যাবার পরেও সে এমন ঘরবন্দি হয়ে যায়নি। পাড়ার মেয়েদের নিয়ে বাড়িতেই কেমন ইস্কুল করে পড়াত; আর স্বপ্ন দেখত নিবেদিতার মতো সেবাধর্ম নিয়ে থাকবে। মায়ের কাছেই হরু জানতে পারল যে, ভূতেশ বাড়ি থেকে দূরে থাকায় এবং তার মেজোবউদিও মেয়ে নিয়ে ভূতেশের কাছে চলে যাওয়ায়, হঠাৎ করেই ওই বাড়িটাতে বেশ একা হয়ে পড়ে বিরজাবালা; এই সুযোগে তাঁর ছোটবোনের বরের আসা-যাওয়াও নাকি একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেড়ে যায়। হরশঙ্করের মা নাকি কানাঘুসো কথায় জানতে পারেন যে, বিরজাবালা গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। ছোটবোন এবং তার বর, তাদেরই চেনা কোনও দাই দিয়ে তার গর্ভপাত করিয়ে, গোয়ালঘরের পিছনেই গর্ত করে, সেই মরা-ভ্রূণ পুঁতে দেয়; অপমানে, মানসিক কষ্টে এবং শারীরিক যন্ত্রণায় বেশ কয়েকমাস নাকি শয্যাশায়ী হয়েছিল বিরজাবালা।
হরুর মা এ-ও শুনেছেন যে, সকলেই জয়নারায়ণকে সন্দেহ করলেও, ভূতেশ নাকি প্রবল শাসিয়েছে তার ছোট ভগ্নীপতি বিপিনকে; মিরাট থেকে বিপিনকে লেখা ভূতেশের চিঠিখানি, তার বাবার ঠিকানায় আসায়, আরও কেউ সেই চিঠি পড়ে ফেলে। বিরজাবালার দেখভালের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর ভূতেশের বৃদ্ধ বাবা-মা তাঁদের অসহায় অবস্থার কথা চিঠি লিখে ভূতেশকে জানান; কারণ বিপিন নাকি চেষ্টায় ছিল, বিরজাবালাকে বাড়িছাড়া করে কাশী পাঠিয়ে দেবার; অমৃতবালারও সায় ছিল; কারণ এমন একটা ব্যবস্থায় সংসারটা তার হাতেই এসে পড়ত। বাবা-মাকে দেখাশোনার ছুতোয়, তার নিজের দুই ছেলেমেয়ে এবং বিপিনকে নিয়ে সংসারে জাঁকিয়ে বসত তারা। ভূতেশ তড়িঘড়ি ব্যবস্থা নিয়ে, মেজোবউদিকে বাড়ি পাঠায় এবং বিপিনকে নিষেধ করে তার সংসারে মাথা ঘামাতে। ভূতেশের বউ প্রভাকে পেয়ে আবার মনে বল পায় বিরজাবালা; সব ভুলে সংসারের হাল ধরতে শুরু করে সে। ভূতেশের শাসানিতে বিপিনের আসা-যাওয়ায় ভালই ভাটা পড়েছে। ওই বাড়িতে রাতে তার থাকা নাকি একেবারেই বন্ধ হয়েছে। সেই থেকে দুই বোনের কথা বলাবলিও বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বিরজাবালা নিজেকে একবারে বাড়িবন্দি করে ফেলেছে। পথেঘাটে, মন্দির বা গোয়াল কোথাওই তাকে আর দেখা যায় না।
হরুর মনে পড়ল জয়নারায়ণের কথা। সাবধানের মার নেই ভেবে তারা আর পরস্পরকে চিঠি লেখে না; কিন্তু মায়ের কাছে এসব ঘটনা জানার পর পরই লোক মারফত জয়নারায়ণ যোগাযোগ করে তার প্রাণের বন্ধু হরুর সঙ্গে; দেখা হয়েছিল তরুবউদির ছোটকাকার ইছাপুরের বাড়িতে। হরুকে একা পেয়ে শিশুর মতো কাঁদতে থাকে জয়নারায়ণ। অনেক চেষ্টা করেও বিরজাবালার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি সে; বিরজাবালাও মুখ খোলেনি কারোর কাছে। কিন্তু জয়নারায়ণের দৃঢ় ধারণা যে, এ-কাজ করেছে বিপিন; এটাও তার বিশ্বাস যে, বুদ্ধিমান ভূতেশ স্থির বুঝেছে, এ-কাজ করার স্পর্ধা বা সাহস, বিপিন ছাড়া আর কারোর পক্ষেই হবে না। জয়নারায়ণ নিশ্চিত যে বিরজাবালাকে একা পেয়ে, ওই বাড়িতেই বলাৎকার করেছে সে; এবং তা হয়তো একাধিকবারও। সেজন্যই সে নাকি নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার গর্ভমোচনের ব্যবস্থাও করেছে। নিজের আর্থিক অক্ষমতা এবং ভূতেশের ভয়টুকু ছিল বলেই এটুকু করেছে; না হলে ওই অবস্থাতেই কোথাও পাচার হয়ে যেত বিরজাবালা। লোকলজ্জার ভয়ে মুখে কুলুপ না এঁটে ভাগ্যিস তার বাবা ভূতেশকে সব জানিয়েছিলেন! জয়নারায়ণ তো খেপে উঠেছিল, বিপিনকে মেরে পাট করবার জন্য। অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে, তার গ্রামের বাড়িতে জয়নারায়ণকে পাঠিয়েছিল হরু। নিজেও ফিরেছিল ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। সেদিনের পর থেকে বিরজাবালাদের বাড়ির পথ আর মাড়ায়নি হরু। লজ্জা আর অসহায়তার গ্লানিতে জেরবার হয়ে হরশঙ্কর ভেবেছিল যে, একটা নিষ্পাপ মেয়েকে রক্ষা করার ক্ষমতাই যখন তাদের নেই, সেখানে একটা গোটা দেশকে তারা কী করে স্বাধীন করবে ইংরেজদের হাত থেকে! এত পরাধীন তারা! ইংরেজরা কি বিপিনের থেকেও ভয়ঙ্কর!
৩
পাঁজি দেখে, তিথি-নক্ষত্র মেনে, এবং রাশিচক্র মিলিয়ে একই দিনে বিয়ে হয়ে গেল হরশঙ্কর এবং নিশিকান্তর। একই দিনে ঘরে এল ফর্সা এবং কালো—এই দুই বউ। হরুর মা শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ভেবে মত দিয়েছিস তো হরু!’
আমি হরু বা হরশঙ্কর। ১৯১৪— আমার জীবনে এ-এক স্মরণীয় বছর বটে! ‘Tactician’ নামে মালবাহী জাহাজে করে আনা রড্ডা কোম্পানির অর্ডার দেওয়া গুলি-বন্দুক লুঠ করল কলকাতার ‘স্বদেশী ডাকাত’রা; ২৬ অগাস্ট এক মেঘলা সকালে, যখন বৃষ্টিও বারে বারেই ঝেঁপে আসছে। রড্ডা কোম্পানির ‘Jetty Clearing Clerk’শিরিষ মিত্তিরের সাহায্যে। আর এ-ও আশ্চর্য যে, কাকপক্ষীতে টের পেতে-পেতে কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। সাহেব পুলিশের চোখকে ধুলো দিয়ে, কাস্টমস অফিস থেকে ভ্যান্সিটার্ট রো-এর গোডাউনে আসার পথে একগাড়ি কার্তুজ এবং রিভলবার নিয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে যাওয়া, এ দেশে এই প্রথম ঘটল। তা-ও কোনও মোটর গাড়ি নয়; গরুর গাড়ি এবং ঘোড়ার গাড়িতেই কাজ হাসিল করল তারা; একেবারে যাকে বলে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং খাস ডালহৌসি পাড়ায়। টনক নড়তেই প্রমাদ গুনল পুলিশ দপ্তর। ডিটেকটিভ-প্রধান চার্লস টেগারট নিখুঁত জাল পেতে ধরপাকড় শুরু করলেন; উদ্ধার হল খোয়া যাওয়া কিছু-কিছু গুলি-বন্দুকও; কিন্তু ভয়ংকর ভয় পেয়ে গেল সারা দেশের পুলিশ ব্যবস্থা। গোলাগুলি চলল না, এমনকী বছর দু-তিন জেলে বন্দি করেও ছেড়ে দিতে হল ‘primary accused’ বলে যাদের ধরা হয়েছিল সেই ভূজঙ্গ, অনুকূল, গিরিন, কালিদাসদের সঙ্গে বাকি যারা ধরা পড়েছিল সেই তাদেরও। না দ্বীপান্তর, না ফাঁসি। সবাইকে না চিনলেও, এই চারজনের সঙ্গে তো আমার বেশ ভালই ওঠাবসা ছিল; মেসে থাকার প্রধান আকর্ষণই তো ছিল এরা। ওদের বাড়িগুলোতে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কি কম মিটিং করেছি! ধরা না পড়ে, শুধু নিখোঁজ হয়ে রইল সেই শিরিষ; চোখের ওপর ভাসে ওর ঝোড়া গোঁপ-সমেত মুখখানি। আমাদের কাছে ও ছিল মলঙ্গা লেনের ‘হাবু’। শুনেছি ওই রাতেই সে নাকি কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যায় রংপুর; সেখান থেকেও তাড়া খেতে-খেতে, পৌঁছে যায় আসামের গোয়ালপাড়ায়। শেষ তাকে নাকি সেখানেই দেখা গেছে। সেখানেই, রাভা উপজাতিদের মধ্যে মিশে থেকে হাবু শেষে পালাতে চেষ্টা করে চিনে। সন্দেহ যে, বর্ডার পার হতে গিয়ে চিনে-সৈন্যদের গুলিতেই তার নাকি প্রাণ যায়; সাধারণ লোকে বলছে, বাঘ-ভালুকের পেটে গেছে শিরিষ। ‘হাবু’র পরিণতি শুনে শিউরে উঠেছিলাম। আমার জীবনটাও তো ক্রমশ এইদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে আসাম ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি!
সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ থেকে কলকাতার প্রায় সমস্ত কাগজেই খবর হয়ে ছেপে বেরোল ওই রোমহর্ষক ডাকাতির খবর। সুরেন বাঁড়ুজ্জের কাগজ ‘Bengalee’ খুব বিশদে লিখল।
তবে ‘Calcutta Samachar and Marwari’ প্রকাশ্যে ধিক্কার জানিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, তারা সাহেবদের পক্ষে এবং স্বদেশিদের ঘোর বিরোধী; কারণ জি ডি বিড়লা এবং হনুমান প্রসাদ পোদ্দার নামে দুটি মাড়োয়ারি ছেলে এই ডাকাতিতে সক্রিয় সহায়তা করে জেলে গিয়েছিল।
খুব গর্ব হয়েছিল নিজের কাগজের হেডলাইন দেখে— “The Greatest Daylight Robbery”। টাকাপয়সা বা সোনাদানা নয়; দেশের কাজে প্রাণ বিপন্ন করেও একেবারে বন্দুক ডাকাতি। এমন এক সময়ে এই কাগজে জুড়ে থেকে কিছুটা ভাগীদার তো হতে পারলাম!
তবে মনখারাপ চেপে বসেছিল যখন বর্ধমান-নলহাটির বউ দুখারি বালার কথা জেনেছিলাম। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির প্রথম মহিলা শিষ্যা, যে গুলি বন্দুক ধরায় রীতিমতো ট্রেনিং নিয়েছিল। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় স্বদেশিদের লেখা কিছু চিঠিপত্র এবং খোয়া যাওয়া খান সাতেক সেই Mauser C96 বন্দুক ছাড়াও বেশ কয়েক ছড়া কার্তুজ; জেল তো হয়ই। কিন্তু জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তার স্বামী তাকে ত্যাগ দিয়েছে। শুনেছি যে নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে সে নাকি একাই দিন গুজরান করছে কোনওমতে।
দুখিরার কথা ভাবলেই মনে হয়, জয়নারায়ণের কথায় উৎসাহিত হয়ে বিরজাও যদি এরকম কোনও দলে যোগ দিয়ে জেলে যেত! সেও কি আর বাড়ি ফিরতে পারত কোনও দিন!
স্বদেশিদের প্রসঙ্গে সাহেবরা নাকি মন্তব্য করেছে, ‘They Lived Dangerously’।এইজন্যেই হয়তো, আমার বিয়ের কথা পাকা করবার আগে তনুদাকে মা অনুরোধ করেছিলেন যে, পুলিশের খাতায় সন্দেহভাজন বলে আমার নাম আছে কি না, সেটা যদি দেখে দিতে পারে; তনুদা সে কথা রেখেছিল। বলেছিল যে আমার নাম সেভাবে নেই; কিন্তু বউবাজার অঞ্চলের একগুচ্ছ নামের পরেও ‘and others’ বলে যে উল্লেখ আছে, সেখানে আমার মতো আরও অনেককে ঘিরেই সন্দেহ থেকেই যায়। ফলে বিয়ের ব্যাপারে ছাড়পত্র পেলেও, তরুবউদির ছোটকাকা কিন্তু সাবধান করে দিল আরও এক দিক থেকে। কাগজে লেখালিখির সূত্রে আমি যে সাহেবদের সরাসরি নজরদারিতে আছি, সেটাও যেন সবসময় মনে রাখি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে রাখব। আমার মতো করে আমি এটাই বুঝলাম যে, নিজের মনন এবং স্বাধীনতাকে যদি বজায় রাখতেই হয়, তবে একটু আলগা দিয়ে বাঁচতে হবে। আর সেটা তো আমার বেশ অভ্যেস হয়েই গেছে। কারণ আমি বুঝে গেছি যে, কোনওদিনই আমি ওই ‘Lived Dangerously’— এই দলে পড়তে পারব না। আমার মন মুক্ত, কিন্তু স্বভাব ভীরু।
বিয়ের পর বউ যে খুব অপছন্দের হল তা নয়। বেশ মিশুকে, হাসিখুশি এবং কী যেন নিয়ে সব সময় মেতে থাকে। মায়ের পর এ বাড়িতে আর কোনও মেয়ে না থাকায়, প্রথম-প্রথম একটু অসুবিধেই হত। প্রায় সমবয়সি দুটি মেয়ে সারাদিন ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে; এটা-ওটা করছে; আমাদের বাবা-মাকেই বাবা-মা বলে ডেকেও চলেছে! কেমন যেন ম্যাজিক মনে হত সব! এদের দেখতে-দেখতে ভাবতাম, বিরজাবালাও নিশ্চয় তার সংসারে এমনই এক বউ হয়ে গিয়েছিল! বিরজাবালাকে এখন আর তেমন ভাবি না। সে আমার সঙ্গিনী হতে পারলেও, বউ হয়তো হতে পারত না! আসলে বিরজা-জয়নারায়ণ আর আমি, তিনজনে একসঙ্গে থাকলেই সবথেকে ভাল থাকতাম; বিরজাবালা বিরজাবালাই; সে কারোর একার নয়।
একদিন তাকে হঠাৎই দেখলাম; ভর সন্ধেবেলা ছমছমে ঝুঁঝকো আলোয় তাদের বাগানের ভেতর দিয়ে গোয়ালঘরের দিকে যাচ্ছে। পরনের সাদা থানটা ঢেকে গেছে কালো অন্ধকারে। তার হাতে ধরা লম্পের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার চিবুক-গাল আর চোখ দুটো; ওইটুকু আলোতেই অন্ধকারকে মনে হচ্ছে শ্যাওলা রঙা সবুজ; বিরজার তেলতেলে মুখটা যেন ওই শ্যাওলার মতোই ভিজে-ভিজে; কী কোমল এক ছবি! তার চেহারায় বৈধব্যের ছাপ নেই; কালো অন্ধকারেও যেন এক সবুজ বনেশ্বরী। অন্ধকারকে আলো চেনাচ্ছে বিরজা। মোহময় এক সবুজ রঙের আলো।
এ কোন আলো আজ আমাকে দেখালে— বিরজাবালা! আমি যে আবার হারিয়ে ফেলছি নিজেকে!
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র