ঝাঁক ঝাঁক জ্যাক
হোয়াইটচ্যাপেল, পূর্ব লন্ডনের এ তল্লাটে ঐতিহাসিকভাবেই অভিবাসীদের ভিড়। উনিশ শতকের শেষের দিকে এ পাড়া ভরে থাকত রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিদের ভিড়ে। রাশিয়া বললে অবশ্য ভুল হবে, রাশিয়ার সম্রাটের অধীনস্থ ইউক্রেন এবং পোল্যান্ড থেকে। হাজার হাজার বছরের অত্যাচারের কলঙ্ক বজায় রেখে সে-সময় ফের চলছিল ইহুদি প্রহার, সময়বিশেষে হত্যাও। হোয়াইটচ্যাপেলের অলিতেগলিতে তখন উদ্বাস্তু ইহুদিদের বসতি। কোনও প্রকারে জীবনধারণের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠছে লন্ডনের কুখ্যাত ‘আন্ডারবেলি’, সেখানে ঠাঁই পাওয়ার জন্য ভিড় জমাচ্ছিলেন বহু দরিদ্র ব্রিটিশরাও। ড্রাগ-রাহাজানি-বেশ্যাবৃত্তির টাকাতেই হোয়াইটচ্যাপেল চলছে।
২০০৭ সালে এসে ছবিটা খুব বেশি বদলায়নি। হ্যাঁ, পূর্ব ইওরোপীয়দের তুলনায় হোয়াইটচ্যাপেলে এখন দক্ষিণ এশীয়দের ভিড় বেশি। অপরাধীদের মুক্তাঞ্চল বললেও ঠিক বলা হবে না; কিন্তু সে আব্রু টিকে আছে নেহাতই অপরাধী ও আইনরক্ষকদের মধ্যে হয়ে চলা নিরন্তর বোঝাপড়ার কারণে। উনিশ শতকের তুলনায় অপরাধ জগৎ এখন অনেক বেশি সংগঠিত, ঘৃণ্য অপরাধগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক মদতে গড়ে উঠেছে কিছু ছুটকোছাটকা, আপাতনির্দোষ অথচ বেআইনি ব্যবসা। যেমন বেআইনি ডিভিডির ব্যবসা। হোয়াইটচ্যাপেলের ফুটপাথ হোক বা মুদির দোকান, হলিউডি সিনেমার জাল ডিভিডি খুঁজলেই পাওয়া যাবে। ঊনত্রিশ বছর বয়সি সিয়াও মেই হোয়াইটচ্যাপেলের রাস্তায় এই জাল ডিভিডি বেচেই দিন গুজরান করেন। চাইলেও অবশ্য সিয়াও আর কোনও কাজ করতে পারবেন না। তাঁর স্বামী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে সুদিনের আশায় চিন থেকে বেআইনি ভাবে লন্ডনে এসে পৌঁছেছিলেন সিয়াও। যে অপরাধীরা তাঁদের সহায়তা করেছিল তাদেরই টাকা দেওয়ার জন্য এই কাজ, ঘটনাচক্রে এ কাজের সুলুকসন্ধানও সেই অপরাধীদের দেওয়া। সিয়াও-এর স্বামীই অবশ্য প্রথমে এই জাল ডিভিডি বেচতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু পুলিশ এসে তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। আইনের চোখ এড়িয়ে আসলে কেউই ঢুকতে পারে না, আইনের কাছে এঁরা বোড়ে বিশেষ। সময়মতো দাবার ছক থেকে টুক করে তুলে নিতে হবে। যাই হোক, পেট চালানোর জন্য তো বটেই, দেনা মেটাতেও সিয়াওকে এ কাজ করতেই হয়। সিয়াও হাসিমুখেই করেন অবশ্য, গায়ে না পড়েও খানিক ভাব জমানোর চেষ্টা করেন তাঁর খদ্দেরদের সঙ্গে। গোমড়া ডিভিডি বিক্রেতার থেকে কে-ই বা আর জাল ডিভিডি কিনতে চায়? তবে হাসিমুখে কাজ চালালেও বড় দাঁও মারার সুযোগ সিয়াওর-এর কাছে আদপেই আসে না। কিন্তু অগস্ট মাসের শেষে একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। ভারী চেহারার একটি লোক পিঠে ব্যাগ নিয়ে সিয়াও-এর ডিভিডিগুলো অনেকক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে দেখছিল। টুকটাক কথাও চলছিল কিছু। এ-কথা, সে-কথার পর লোকটি জানাল সিয়াও-এর থেকেই সে ডিভিডি কিনবে; কিন্তু এক-দুটো নয়, বরং একপেটি। সিয়াও কি কাছেই তার বাড়িতে একবার আসতে পারবে অর্ডার নিতে? বড় মুনাফার আশায় সিয়াও রাজি হলেন।
দেখা গেল বাড়ি খুব কাছেও না। টিউব ধরে যেতে হবে। কেন যে সিয়াও দূরত্ব দেখেও রাজি হলেন! হয়তো প্রস্তাবটি এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, এসব চিন্তাকে মাথায় ঠাঁই দিতে চাননি।
আপনাদের সবার আশঙ্কা সত্যি করে সিয়াও আর কোনও দিনই ফিরে আসেননি। তাঁকে আর একটিবারের জন্যও কেউ দেখতে পায়নি।
সিয়াও-এর অন্তর্ধানের তিন সপ্তাহ পর নিরুদ্দেশ হলেন বনি ব্যারেট। বনি উদ্বাস্তু নন, আবার উদ্বাস্তুও বটে! সিয়াও-এর মতন তকমা-মারা-উদ্বাস্তু নন, কারণ বনি ব্রিটিশ। অথচ বাস্তু বলে তাঁর কিছু নেই। অতি কম বয়সে ড্রাগের নেশায় পড়ে চালচুলো সবই গেছে বনির। রাস্তাতেই দিনরাত কেটে যায়। পেট চালানোর জন্য শরীরটুকুই যা সম্বল। আঠারো বছর হতে না হতেই বনির একটি পুত্রসন্তানও হয়। তাকে মা’র কাছে রেখে এসে বনি আবার জীবনযুদ্ধ শুরু করেন। বনির মতন মেয়েরা নিরুদ্দেশ হলে তা খবর হয় না। সাধারণ মানুষের তুলনায় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের খুন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১২ শতাংশ বেশি; কে জানে এ পরিসংখ্যান সবার ঠোঁটস্থ বলেই হয়তো বনিরা অনায়াসে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তবে সে ক্ষেত্রে বনির নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর বেরোল, খুব তাড়াতাড়ি নয় যদিও। খুব তাড়াতাড়ি হলে হয়তো বনিকে বাঁচানো যেত, কিন্তু খবরটুকু আসায় গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসলেন। তাঁদের কাছে সিয়াও-এর অন্তর্ধানের খবরও ততদিনে পৌঁছে গেছে।
পাঠক, আপনি যদি টানটান কোনও গোয়েন্দা-গল্পের প্রত্যাশা করেন তাহলে বলে দেওয়া ভাল যে, এ রহস্য উন্মোচনে থ্রিল বিশেষ নেই। গোয়েন্দারা হোয়াইটচ্যাপেল অঞ্চলের সিসিটিভি থেকে সিয়াও এবং তাঁর খদ্দেরের ছবি জোগাড় করলেন, সিসিটিভি থেকেই বার করে ফেললেন পূর্ব লন্ডনের কোন টিউবস্টেশনে তাঁদের শেষ দেখা গেছে। সে স্টেশন থেকে বেরিয়ে প্রথম দোকানটিতে ঢুকে প্রিন্টআউট দেখাতেই দোকানদার অম্লানবদনে বলে দিল, ‘একে তো চিনি। ওই তো, বাইরেই দাঁড়িয়ে’। হোয়াইটচ্যাপেলের গোয়েন্দারাও এত আশা করেননি। ধরা পড়লেন ডেরেক ব্রাউন।
প্রথমবার খানাতল্লাশি চালিয়ে কিছুই পাওয়া গেল না যদিও। পরের বার গোয়েন্দারা আলট্রাভায়োলেট লাইট এবং অন্যান্য প্রযুক্তি নিয়ে ডেরেকের ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। দেখা গেল ফ্ল্যাটের দেওয়াল জুড়ে রক্তের দাগ, একের পর এক। সিয়াও এবং বনির কোনও খোঁজ মিলল না যদিও। এক বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে গোয়েন্দারা আদালতে জানালেন ইয়র্কশায়ারের ট্রাক ড্রাইভার ডেরেক, সিয়াও এবং বনির শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে টেমস নদীর নীচে ফেলে দিয়েছে। এ অবশ্য গোয়েন্দাদের যুক্তিগ্রাহ্য অনুমান, নির্ভুল প্রমাণ তাঁরা যোগাড় করে উঠতে পারেননি। ডেরেক স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে একবারের জন্যও মুখ খোলেননি, কিন্তু আদালতে ফেঁদে বসেছিলেন এক দীর্ঘ গল্প। জানিয়েছিলেন বনি তো বটেই, সিয়াও-ও নিজে থেকেই তাকে যৌন আনন্দ দিতে চেয়েছিলেন টাকার বিনিময়ে। তার কোনও দোষই নেই, বরং সিয়াওর পরিচিত চিনা গুণ্ডারা এসে তাকে জবরদস্ত ভয় দেখিয়েছে। যাই হোক, জুরি সদস্যরা কেউই এসব গালগল্প বিশ্বাস করলেন না; নিহতদের শরীর পাওয়া না গেলেও, ডেরেকের ফ্ল্যাটে খুঁজে পাওয়া প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনানো হল।
এরকম অপরাধের নজির ব্রিটেন জুড়ে নেহাত কম নেই। কিন্তু ব্রিটিশ মিডিয়া তো বটেই, সারা দুনিয়ার মিডিয়াই ডেরেকের অপরাধ নিয়ে বিশেষ ভাবে মাথা ঘামাতে শুরু করল। কারণ? ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জানালেন ডেরেকের হিরো, আইডল, গুরু আর কেউ নয়, স্বয়ং জ্যাক দ্য রিপার! উনিশ শতকের শেষে যে আততায়ী একাধিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডর মাধ্যমে পৃথিবী জুড়ে চর্চায় চলে এসেছিল। এবং সে চর্চা এখনও অব্যাহত। জ্যাক দ্য রিপারকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে হাজার হাজার, লেখা হয়েছে অতীব জনপ্রিয় গ্রাফিক নভেল, ইন্টারনেট ফোরাম থেকে শুরু করে টিকটক-এর চ্যানেল জুড়ে আজও সেইসব সিরিয়াল কিলিং-এর রহস্যোদ্ঘাটনে ব্যস্ত শখের গোয়েন্দারা। কারণ পেশাদার গোয়েন্দারা বহু বছর আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কে ছিল জ্যাক দ্য রিপার, কেনই বা সে খুন করেছিল অতজন মহিলাকে, কেনই বা অতীব নির্মমতার পরিচয় দিয়ে তার শিকারদের শরীরকে তছনছ করেছিল— সে সবের নির্দিষ্ট উত্তর আজও অজানা। যদিও কোটি কোটি থিয়োরি আছে। জ্যাক দ্য রিপারের কীর্তিকলাপ আপনারা যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মনে পড়ে যাবে জ্যাকের করা খুনগুলোও হয়েছিল ওই হোয়াইটচ্যাপেল অঞ্চলেই। যে কারণে ২০০৭ সালে সারা পৃথিবীর কাগজ এবং টিভি চ্যানেল তাদের শিরোনামে জানাতে শুরু করল কপিক্যাট কিলারের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
‘কপিক্যাট’ শব্দটিই তৈরি হয়েছিল জ্যাক দ্য রিপারের হত্যাকাণ্ডর সূত্র ধরে। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯১, তিন বছরের মধ্যে মোট এগারোজন মহিলা এই হোয়াইটচ্যাপেল চত্বরে খুন হন। এই এগারোটি খুনের জন্যই জ্যাককে দায়ী করা হলেও, তৎকালীন গোয়েন্দা এবং বহু আধুনিক বিশেষজ্ঞর ধারণা আদি জ্যাক দ্য রিপার সবক’টি খুন করেননি। এগারোটি খুনের মধ্যে সর্বাধিক ছ’টি খুন করে থাকতে পারে কপিক্যাট খুনিরা, যারা জ্যাকের খুন করার পদ্ধতিটি তো বটেই, হয়তো মোটিভকেও সর্বান্তঃকরণে অনুকরণ করেছে। এবং সেখানেই শেষ নয়। কপিক্যাট খুনিরা শিকারদের প্রোফাইল অর্থাৎ চারিত্রিক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যর বিষয়েও জ্যাকের পথ অনুকরণ করে এসেছে। এবং এ ঘটনা ঘটেছে সারা পৃথিবী জুড়েই।
আদি জ্যাকের শিকারদের মধ্যে একজন ছিলেন এলিজাবেথ স্ট্রাইড। এলিজাবেথের জন্ম সুইডেনে, অভিবাসী হিসাবে ইংল্যান্ডে এসে আশ্রয় নেন। দেহব্যবসায় এলিজাবেথের হাতেখড়ি সুইডেনে থাকতে থাকতেই। ছিয়ানব্বই বছর পর এলিজাবেথের দেশ সুইডেনেই শোরগোল পড়ে যাবে আরেক অভিবাসী দেহোপজীবিনীর খুন নিয়ে। ১৯৮৪ সালের জুলাই এবং অগস্ট, দু’মাস ধরে স্টকহোমের উত্তর শহরতলিতে খুঁজে পাওয়া যাবে ক্যাটরিন ডা কোস্টার দেহাংশ। সাতাশ বছর বয়সি ক্যাটরিন জন্মেছিলেন পর্তুগালে। এলিজাবেথের মতন তিনিও অভিবাসী, দেহোপজীবিনী এবং ড্রাগ-আসক্ত। এলিজাবেথের সঙ্গে এক জায়গাতেই অমিল ছিল ক্যাটরিনের— এলিজাবেথের শরীরকে ছিন্নভিন্ন হতে হয়নি। রিপার-বিশেষজ্ঞ, যারা ‘রিপারোলজিস্ট’ নামে পরিচিত তাঁরা যদিও ক্যাটরিনের খুনিকে কপিক্যাট রিপার বলতে চান না, কারণ জ্যাক দ্য রিপার যে চাতুর্যের সঙ্গে নামমাত্র ক্লু রেখে গেছিল, সে রকম চতুরতা ক্যাটরিনের খুনি দেখাতে পারেনি। কিন্তু আর্থসামাজিক আঙ্গিক থেকে কোনও সন্দেহই নেই যে ক্যাটরিনের খুন একটি কপিক্যাট খুন। ক্যাটরিনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ দেহোপজীবিনী হিসাবে ক্যাটরিনকে সমাজ আগেই দুর্বল হিসাবে দাগিয়ে দিয়েছে; আর্থিকভাবে দুর্বল, সামাজিক সম্মানের নিরিখে দুর্বল। ক্যাটরিন বেঁচে থাকলেন, না মারা গেলেন এ বিষয়ে সমাজের আদৌ কি কিছু এসে যায়? জ্যাক দ্য রিপার ধাঁচের খুন যখনই ঘটেছে, নিহতদের শরীরের ওপর ঘটেছে প্রবল অত্যাচার। যেন এ শরীরের কোনও মূল্যই ধার্য হয় না, এ শরীরে যেমন খুশি বিকৃতি ঘটানো যায়। ক্যাটরিনের খুনের ঘটনাকে তাই সুইডিশ নারীবাদীরা বারংবার তুলে ধরেছেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখে weaker sex-এর জায়গা কোথায় তা বোঝানোর জন্য। এক সময় তাই ক্যাটরিন ডা কোস্টা লিঙ্গ রাজনীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। সুইডিশ লেখক স্টিগ লারসনের পৃথিবী বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ ‘মিলেনিয়াম’; যে সিরিজের প্রথম বই ‘দ্য গার্ল উইথ দ্য ড্র্যাগন ট্যাটু’, লেখা হয়েছিল ক্যাটরিনের খুনের কথা মাথায় রেখেই; যে কারণে এ সিরিজে বারেবারে দেখানো হয়েছে কী ভাবে প্রান্তিক নারীদের শরীরের উপর বারংবার ঘটে চলে প্রবল হিংসা। এই হিংসাকে অতি মুনশিয়ানার সঙ্গে অ্যালান মুর তুলে ধরেছিলেন তাঁর গ্রাফিক নভেল ‘দ্য হেল’-এ; প্রায় দেড় পাতা জুড়ে প্যানেলের পর প্যানেল ধরে দেখানো হয়েছিল কী অসীম নিস্পৃহতার সঙ্গে খুনি তার নিভৃত আশ্রয়ে শব ব্যবচ্ছেদ করে চলেছে! অন্যের শরীরের ওপর প্রবল অধিকারবোধ না থাকলে যে নিস্পৃহতা আসা অসম্ভব। সেই একই অধিকারবোধ, সেই একই নিস্পৃহতা নিয়ে তছনছ করা হয়েছিল হোয়াইটচ্যাপেলের গণিকাদের শরীর।
স্টকহোমের শহরতলিতে ক্যাটরিন খুন হওয়ার প্রায় এক দশক আগে উত্তর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারে আবির্ভূত হয় জ্যাক দ্য রিপারের আর এক কপিক্যাট, যাকে ব্রিটিশ মিডিয়া ডাকতেই শুরু করবে ‘ইয়র্কশায়ার রিপার’ নামে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০-র মধ্যে ইয়র্কশায়ার রিপার, যার আসল নাম পিটার সাটক্লিফ, খুন করবে তেরোজন মহিলাকে এবং গুরুতর জখম করবে আরও সাতজনকে। কুড়িজনের অধিকাংশই ছিলেন দেহোপজীবিনী, হাতেগোনা যে কয়েকজন দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁরা রাতে জনবিরল রাস্তায় একা হেঁটে ফিরছিলেন। ধরা পড়ার পর জেরার সময়ে পিটার সাটক্লিফ জানায় দেহোপজীবিনীদের বিষয়ে তো বটেই, এমনকী নিঃসঙ্গ মহিলাদের সুরক্ষা নিয়েও পুলিশের অসীম ঔদাসীন্য তাকে প্রভূত সুযোগ এনে দিয়েছিল। কিন্তু কেন এত খুন? তার উত্তরে পিটার সাটক্লিফ জানায় পৃথিবীর জঞ্জাল সরানোর দায় সে নিজেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। ঠিক এই একই উত্তর আমরা শুনি ২০২২-এর সাড়া জাগানো ইরানিয়ান সিনেমা ‘হোলি স্পাইডার’ এর অ্যান্টাগনিস্ট সৈয়দ আজিমির মুখে। আজিমির চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল ইরানি খুনি সৈয়দ হানাই এর ওপর; একুশ শতকের শুরুতে হানাই ইরানের মাশহদ শহরে ষোলোজন দেহোপজীবিনীকে খুন করে। ধরা পড়ার পর হানাই জানায় মাশহদ শহরের ‘নৈতিক চরিত্র’ বজায় রাখার জন্য তাকে খুনগুলি করতেই হত।
জ্যাক দ্য রিপার এবং তার নকলনবিশ খুনির দল বারেবারেই খুনের মোটিভ হিসাবে নৈতিক সংস্কারকে তুলে ধরে। কারা তাদের এই দায় নিতে বলেছে, শুধু দরিদ্র দেহব্যবসায়ীদের খুন করলেই সমাজ কেন শুধরে যাবে, এরকম কত প্রশ্নই তো তোলা যায়। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ হ্যালি রুবেনহোল্ড আরও মৌলিক এক প্রশ্ন তুলেছেন— যাঁদের দেহোপজীবিনী বলা হচ্ছে তাঁরা কি সত্যিই তাই? মনে রাখতে হবে ডেরেক ব্রাউন সিয়াও-কেও দেহোপজীবিনী বলে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও গোয়েন্দারা প্রথম থেকেই জানতেন সিয়াও শুধুমাত্রই জাল ডিভিডি বিক্রি করতেন। হ্যালি রুবেনহোল্ড ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফাইভ’ বইতে দেখালেন যে আদি জ্যাক দ্য রিপারের অন্তত তিনজন শিকার আদৌ দেহোপজীবিনী ছিলেন না। তাঁরা হোয়াইটচ্যাপেল চত্বরে অসম্ভব দারিদ্র্য এবং অন্যান্য প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে জীবনধারণ করার চেষ্টা করছিলেন। অনেক সময়েই সেই চেষ্টা খানিক গতি পেত কোনও পুরুষসঙ্গীর সান্নিধ্যে এসে। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায় জীবনযাপনের প্রক্রিয়াটি আরেকটু সহজ হত মাত্র। কিন্তু চার্চ কখনওই এহেন সম্পর্কগুলিকে স্বীকার করত না। পুরুষসঙ্গীটি বিপথগামী হলে এই মহিলারা সে সম্পর্ক তৎক্ষণাৎ শেষ করে দিতে দু’বার ভাবতেন না। রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজ সবসময় এই স্বল্পস্থায়ী সম্পর্কগুলিকে নৈতিক পদস্খলন বলে দাগিয়ে এসেছে, বারেবারে প্রশ্ন তুলেছে এরকম ভাবে চাইলেই সম্পর্ক শেষ করা যায় কি না। এবং যখন দেখেছে হোয়াইটচ্যাপেলের মহিলাদের সে বিতর্কে অংশ নেওয়ার আগ্রহ এবং সময় নেই, তখনই বলা হয়েছে এই মহিলারা নেহাতই গণিকা। জ্যাক দ্য রিপারের প্রথম শিকার পলি নিকোলস্ এক বিশিষ্ট উদাহরণ। পলির দুর্ভাগ্য শুরু হয় তিনি বিবাহবিচ্ছিন্না হওয়ার পর। ইংল্যান্ডে আইন থাকলেও পলির প্রাক্তন স্বামী ভরণপোষণের জন্য ভাতা দিতে অস্বীকার করেন; প্রশাসনের তরফে পলিকে যারা সাহায্য করতে পারতেন, তারাই উলটে পলিকে কড়া কড়া প্রশ্ন করতে শুরু করে্ যেন বিবাহবিচ্ছিন্না হওয়াটাই পলির অপরাধ। অতীব দুঃসময়ে পলি রাস্তায়-রাস্তায় ভবঘুরে হয়ে বেড়িয়েছেন, সস্তার মদ খেতে শিখেছেন, শিখেছেন জঙ্গলের আইনে কী ভাবে চুলোচুলি-চেঁচামেচি করে নিজের সামান্য আখেরটুকু গুছিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু দেহ নিয়ে ব্যবসা তিনি কোনও দিনই করেননি। এ কথা পলির পড়শি বা বন্ধুরা বারংবার গোয়েন্দাদের বলেছেন। এবং সত্যি বলতে পুলিশও পলিকে দেহোপজীবিনী হিসাবে শুরুতেই দাগিয়ে দেয়নি। সে কাজ করেছে তদানীন্তন ব্রিটেনের সমস্ত বড় বড় সংবাদপত্র। জ্যাক দ্য রিপার কেসের শুরু থেকেই ব্রিটিশ সংবাদপত্রগুলি যেন একটি নির্দিষ্ট অপরাধের ধারা তৈরি করে দিতে চেয়েছে— এক মিথিক্যাল খুনি, যে ধরাছোঁয়ার বাইরে, এবং সে বেছে বেছে খুন করছে শুধুমাত্র নষ্ট চরিত্রের মহিলাদের।
এই ঝাঁক ঝাঁক জ্যাক তৈরি করার পিছনেও যে মিডিয়ার একটি বড় ভূমিকা আছে সে কথা অনস্বীকার্য। ‘দ্য স্টার’ নামক সংবাদপত্র যেটি জ্যাক দ্য রিপার খুনের ঠিক আগেই স্থাপিত হয়েছিল, রিপার ম্যানিয়ার তুঙ্গ মুহূর্তে দৈনিক ২৩২,০০০ কপি ছাপাত! একটি নতুন সংবাদপত্রের এহেন সাফল্য সুনিশ্চিত করতে সাংবাদিকরা অফুরন্ত রসালো খবর পরিবেশন করে গেছেন, এবং বহু খবরের সত্যতা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ থেকে গেছে। আগের অনুচ্ছেদে এরকম অসত্য খবরের কিছু উদাহরণ আমরা দেখেছি। কিন্তু সবথেকে বড় সমস্যা হল এই লাখ-লাখ শব্দের কল্পনায় জ্যাক দ্য রিপারের একটি সুপারম্যান সুলভ ব্যক্তিত্ব, যা পুরোপুরি-ই কাল্পনিক, অনায়াসে তৈরি হয়ে গেল। যে ব্যক্তিত্ব একশো বছর ধরে বহু মানুষকে আকর্ষণ করেছে। একটি শিশু যেমন তার চারপাশে থাকা বড় মানুষদের মধ্যে কোনোজনকে রোল-মডেল করে নিয়ে জীবনে এগোতে চায়, ঠিক একই রকম ভাবে জ্যাক দ্য রিপার বহু বয়স্ক মানুষের রোল মডেল হয়ে উঠল। বহু মনস্তত্ত্ববিদ ‘সোশ্যাল লার্নিং’-এর থিয়োরি দিয়ে কপিক্যাট খুনের ব্যাখ্যা দেন, এবং দাবি করেন— যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এহেন রোল-মডেল বেছে নিচ্ছেন, মানসিকভাবে তাঁদের অনেকেই অপ্রাপ্তমনস্ক। এই নির্দিষ্ট দাবিটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও নকলনবিশিরা যে জ্যাকের ব্যক্তিত্বটিকে একটি পোষাকের মতন নিজেদের উপরে চাপিয়ে ফেলেন, সে নিয়ে সন্দেহের জায়গা নেই। মার্কিন লেখক লরেন কোলম্যান তাঁর ‘দ্য কপিক্যাট এফেক্ট’ বইতে দেখিয়েছেন Lone nut বা Lone wolf এর মতন আপাত-সাধারণ শব্দবন্ধও বহুবার ব্যবহৃত হতে হতে মানুষের মনে একটি সদর্থক শব্দ হিসাবে গেঁথে যায়। কপিক্যাট খুনিদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত জীবনে হয় অবসাদগ্রস্ত অথবা অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তাদের কাছে lone wolf-এর মতন শব্দবন্ধ বহুসময়েই চরম প্রশংসার সূচক হয়ে দাঁড়ায়। দুর্ভাগ্যবশত, এই একুশ শতকেও সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলগুলি শিকারের থেকে শিকারির উপর বেশি শব্দ, বেশি সময় ব্যয় করে। উপজীব্য বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় খুন হওয়া মানুষগুলি কী ভাবে মারা গেছেন; তাঁরা কী ভাবে বেঁচেছেন সে নিয়ে আদৌ কোনও আলোচনা হয় না। অথচ আদি জ্যাক দ্য রিপারের ঘটনা থেকেই আমরা দেখি নিহতদের জীবন-ইতিহাসের মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে বহু ক্লু, অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় সেসব সূত্রগুলি হারিয়ে যায় বলেই বহু জ্যাক ধরা পড়ে না। যে কারণে একটি মিথ উত্তীর্ণ হয় একটি সুপারমিথ-এ, আকৃষ্ট করতেই থাকে ছায়াজগতের দুঃস্বপ্ন-বিলাসীদের।