লিভারপুল নিজেদের মাঠে যেমন খেলছে, সেই ফর্মটাই ওদের ডুবিয়ে দিল। লিভারপুল ফ্যানেরা এবং বিশ্ব জুড়ে প্রিমিয়ার লিগ অনুসরণকারীরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, লেস্টার সিটির বিরুদ্ধে ম্যাচটাই হবে লিভারপুলের ঘুরে দাঁড়ানোর খেলা— বিশেষত যেখানে তারা এক গোলে এগিয়ে ছিল। লিভারপুল বেশ কিছু সময় জুড়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে, দেখে মনে হচ্ছিল যে তাদের পুরানো দাপট প্রায় ফিরে এসেছে। তারপর মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে, ম্যাডিসনের ফ্রি-কিক লিভারপুলের জালে জড়িয়ে গেল, অ্যালিসন এবং কাবাক নিজেদের ভুলের মাশুল দিলেন আরও একটি গোলে। এই সাত মিনিটের শেষে, লেস্টার সিটির বিধ্বংসী প্রত্যাবর্তনে লিভারপুল ৩-১ গোলে ম্যাচটা হারে। এই হার এই মুহূর্তে লিভারপুলের নড়বড়ে অবস্থাকেই তুলে ধরে। হতাশার সঙ্গেই বলছি, লিভারপুল যদি জেতে সেটাই হবে তাদের এখনকার ফর্ম আর চরিত্রের বিরুদ্ধে। যদিও দুমাস আগেই ব্যাপারটা উল্টো ছিল।
লিভারপুল সম্বন্ধে তত্ত্ব বদলাতে শুরু করেছে— এই নয় যে তারা একটা ভাল টিম যারা খারাপ খেলছে, বরং এই মুহূর্তের লিভারপুল একটা খারাপ দল। দুই ক্লাবের পয়েন্ট-তালিকায় অবস্থানের বিবেচনায়, লেস্টার সিটির সঙ্গে ম্যাচটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু লিভারপুলকে দেখে মনে হচ্ছিল তারা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। অ্যালিসন সদ্য পিতৃহারা হয়েছেন, এবং তাঁর সাম্প্রতিক পার্ফরম্যান্স যদি দেখা যায়, এই প্রশ্ন উঠবেই— উনি ঠিক কতটা চাপ নিয়ে খেলছেন? যদিও একমাত্র নয়, কিন্তু লিভারপুলের খারাপ খেলার কারণগুলোর মধ্যে এটা একটা।
এই মুহূর্তে একটা গর্তে পড়ে গেছে লিভারপুল, আর সেখান থেকে বেরোবার পথ বার করতেই হবে। এভার্টন-এর বিরুদ্ধে ম্যাচ এর প্রমাণ। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলাম, যতবার লিভারপুলের বিরুদ্ধে কোনও ইংরেজ গোলরক্ষক খেলেছেন, ততবার সেই গোলরক্ষক অসাধারণ খেলেছেন— যেমন লিভারপুল বনাম এভার্টনের দিন জর্ডান পিকফোর্ড। প্রতিপক্ষ হিসাবে, গোলরক্ষককে কিছুতেই পরাস্ত করতে না পারলে, সেটা কি খারাপ খেলার লক্ষণ, না অসামান্য গোল-কিপিং’এর? লিভারপুল-এভার্টন ডার্বির ক্ষেত্রে, পিকফোর্ড সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেছিলেন।
লিভারপুল এবার তাকিয়ে আছে শেফিল্ড ইউনাইটেড-এর সঙ্গে ম্যাচের দিকে, যারা প্রিমিয়ার লিগের একদম তলানিতে দাঁড়িয়ে আছে। মাস দুই-তিন আগে, এই ম্যাচের ফলাফল নিয়ে কারও কোনও সংশয়ই থাকত না। এমন নয় যে শেফিল্ড দারুণ খেলছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ম্যাচটাই লিভারপুলের পক্ষে হঠাৎ গোলমেলে হয়ে উঠেছে। জিততে হলে লিভারপুলকে হয় তাদের প্রশিক্ষণে আমূল বদল আনতে হবে– তারা কী ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেমন ভাবে নিচ্ছে, এমনকী কতটা নিচ্ছে। অধিক প্রস্তুতিতে ভালো ফল হয়, এই যুক্তি যেমন প্রযোজ্য, তেমন এর বিপরীত যুক্তি— কম ট্রেনিং-এ বেশি লাভ— সময়বিশেষে খাটে বইকি।
প্রিমিয়ার লিগ টেবিলের দিকে এখন তাকালে দেখা যাবে, এভার্টনের একটা খেলা বাকি, অ্যাস্টন ভিলার দুটো, টটেনহ্যামের একটা। শেষ দুটো টিম তো একটা করে ম্যাচ জিতলে লিভারপুলকে ছাড়িয়ে যাবে। লিভারপুল এরকম খেললে, পয়েন্ট-তালিকার মাঝামাঝি শেষ করবে, তার রীতিমতো সম্ভাবনা আছে। তারা চ্যাম্পিয়নস লিগে লিপজিগের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ জিতে গেছে বটে, আর সমর্থকরাও ভেবেছেন, যাক, ফর্ম ফিরে এসেছে আমাদের দলের, কিন্তু সেই ম্যাচে লিভারপুল খুব একটা ভাল খেলেনি, বরং লিপজিগ নিতান্ত সাদামাটা খেলেছিল। লিভারপুলকে এবার কিছু জিনিস বদলাতেই হবে, আর নতুন চিন্তাভাবনা করতে হবে।
ম্যাঞ্চেস্টার সিটির ভাগ্যে কী আছে? এখন তারা অসাধারণ খেলছে, টানা ১৯টি খেলায় অপরাজিত, এতগুলো প্রতিযোগিতা জুড়ে। গোড়ায়, স্পার্স-এর কাছে যখন ২-০ হেরেছিল, আমি সেই খেলায় ছিলাম, আর আমার সিটি-র জন্য খারাপ লাগছিল, কারণ স্পার্স খুব রক্ষণাত্মক খেলছিল এবং সিটিকে খুব একটা সুযোগই দিচ্ছিল না। কিন্তু তারপর থেকে সিটি একেবারে অপ্রতিরোধ্য একটা বিশাল যানের মতো সব কিছুকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, এবং স্পার্সকেও অনায়াসে ৩-০ হারাল। তারপর আর্সেনালকেও হারাল, আমি তো ভেবেছিলাম সেটা করতে বেশ বেগ পেতে হবে, যদিও ম্যাঞ্চেস্টার সিটির অনেক সমর্থকই বলবেন, ওই খেলায় তারা ৫-০ গোলে আর্সেনালকে হারাতে পারত। কিন্তু স্কোরের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, তাদের জেতার ধরন। খেলার শুরুতেই গোল দিয়ে দেওয়া এবং তারপর সেই লিড-টা ধরে রাখা। এটা বার্সেলোনার মধ্যে দেখেছি, ওরা হাফটাইমের আগেই খেলাটা জিতে নিতে পারে, আর তারপর দ্বিতীয়ার্ধে খেলাটাকে আর প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরতেই দেয় না। আর্সেনালের সঙ্গে ম্যাচটাও ছিল এরকমই, সিটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের রাশ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিল। এখন তো মনে হচ্ছে পেপ গুয়ার্দিওলা এমন ভাবে খেলাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি এখন খেলোয়াড়দের শক্তি সংরক্ষণ করছেন আগাম খেলাগুলোর জন্য, কারণ তিনি জানেন, চারটে ট্রফির লড়াই সামনে আছে। এই মুহূর্তে যে স্তরের খেলা ম্যাঞ্চেস্টার খেলছে, তা তুলনাহীন।
সামনের উইকএন্ডটাও জমে উঠবে, মানে প্রিমিয়ার লিগের দিক থেকে দেখলে। ওয়েস্ট হ্যাম যাচ্ছে ইটিহাডে। সত্যি বলতে ওয়েস্ট হ্যাম এখন যে দারুণ অবস্থায় আছে, আগে কখনও থাকেনি। অবশ্য সকলেই চায় সেরা দলের সঙ্গে সেরা দলের খেলা হোক, কিন্তু আমার মনের একটা অংশ চায়, ওয়েস্ট হ্যাম খুব ভাল খেলুক ম্যাঞ্চেস্টার সিটির সঙ্গে, দেখতে দারুণ লাগবে। ওয়েস্ট হ্যাম এখন যা ভাল খেলছে, আর যা দুরন্ত ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে, তা কেউই আশা করেনি, আর ডেভিড মোয়েস সেই কৃতিত্বটা দিব্যি উপভোগ করছেন। দেখতে হবে, তিনি সিটির সঙ্গে ম্যাচটায় কেমন পরিকল্পনা করেছেন। উনি কি টানা রক্ষণ করে যাবেন আর ড্র করতে চাইবেন, না কি জেতার জন্য ঝাঁপাবেন।