১৯শে নভেম্বর ২০২৩, রাত সাড়ে ন’টার কিছু বেশি। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপ ফাইনালের তখনও খানিকটা বাকি, তবে স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে খেলা ভারতের হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটু হতাশ হয়েই লিখলাম, ‘অস্ট্রেলিয়া আজ যে মানসিকতা নিয়ে ফিল্ডিং করল এবং রানের পর রান বাঁচাল, তার থেকেই বোঝা যায় আমরা ম্যাচটা কেন হারছি।’ স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেটপ্রেমিক বন্ধুরা আমার সেই লেখায় সহমর্মিতা জানাচ্ছেন, ভারতের দুর্বল ফিল্ডিং নিয়ে হতাশা এবং বিরক্তি প্রকাশ করছেন— এমন সময়ে এক ভদ্রমহিলা দুম করে সেখানে লিখলেন, ‘ভুল! আজ অস্ট্রেলিয়াকে জোর করে ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়া হল!’
সচরাচর এ ধরনের ভিত্তিহীন মন্তব্যের উত্তর দিই না; আমার কিশোর ছাত্রদের থেকে শিখেছি ‘internet troll’ (যারা অনলাইনে যুক্তি দিয়ে তর্ক করতে নয়, উটকো মন্তব্য করতে আসেন) দেখলে পাত্তা দিতে নেই। তাও কেন যেন মনে হল, একটু তলিয়ে দেখি। বিনীতভাবে জানালাম, আজ ভারতের চেয়ে অস্ট্রেলিয়া যে বেশি ভাল ক্রিকেট খেলেই জিতছে, এ তো স্পষ্ট বোঝাই যাচ্ছে। তা ছাড়া গোটা পৃথিবীর ক্রিকেটের উপর মাফিয়ার মতো শাসন করে বি সি সি আই— যেখানে নরেন্দ্র মোদীর নামাঙ্কিত মাঠে ভারত বিশ্বকাপ জিতলে ২০২৪ নির্বাচনে মোদীর বেশ সুবিধাই হয়, সেখানে হঠাৎ মোদী-ঘনিষ্ঠ এই বোর্ড অস্ট্রেলিয়াকে জিতিয়ে দেবে কেন? তিনি জবাবে বললেন, ‘অত জানি না, সারা টুর্নামেন্ট ভাল খেলে শেষে এইভাবে খেলছে? আপনার সন্দেহ হচ্ছে না? কে জিতবে, কে হারবে এগুলো আগে থেকেই মন্ত্রীদের সঙ্গে সেটিং করা থাকে।’ জানাতে বাধ্য হলাম, প্রথমত, ২০০২ ফুটবল বিশ্বকাপে জার্মানি থেকে ২০২২ বিশ্বকাপে ফ্রান্স— সারা টুর্নামেন্ট অপরাজিত থেকে ফাইনালে হেরে গিয়েছে, এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। খেলা জিনিসটাই এরকম। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রীরা সেটিং করে খেলা ঠিক করে দিচ্ছেন, এই তথ্যের কোনও সোর্স আছে আপনার?
তিনি আমাকে বললেন ‘ইনসাইড এজ’ নামে একটি সিরিজ দেখতে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, এই নামে একটি ড্রামা-সিরিজ আছে বটে, যেটি ক্রিকেট-দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে নির্মিত। তবে সে সিরিজ তো আর সাংবাদিকতা বা তথ্যচিত্র নয়, ঘোষিতভাবেই ফিকশন! সে কথা তাকে বলতে তিনি উত্তর দিলেন, ‘না, ওটাই বাস্তব।’ ফিকশন মানেই বাস্তব; এই গোত্রের বিশ্বাস একটি বিশ্বব্যাপী অসুখের উপসর্গ। এই অসুখটির পোশাকি নাম কন্সপিরেসি থিয়োরি।
কন্সপিরেসি থিয়োরি কথাটা আমরা অনেকেই শুনেছি। কিন্তু জিনিসটা ঠিক কী? সংজ্ঞা দিতে হলে বলব, কোনও ঘটনার যুক্তিপূর্ণ বা সম্ভাব্য কারণকে অগ্রাহ্য করে তার পিছনে কোনও একটি বিশেষ গোষ্ঠী অথবা ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের দাবি তোলাকেই কন্সপিরেসি থিয়োরি বলে। কন্সপিরেসি মানে কিন্তু ষড়যন্ত্র, অর্থাৎ যেখানে সত্যিই কোনও একটি গোষ্ঠীর চক্রান্তের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। যেমন, ব্রুটাস ও অন্য সেনেটরদের জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করার চক্রান্ত অথবা, ২০২১-এর নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে ভোটে হেরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকদের আমেরিকার ক্যাপিটল-এ হানা দেওয়ার চক্রান্ত। কিন্তু কোনও প্রমাণ এবং সম্ভাব্য কারণ ছাড়াই ‘এর পিছনে অমুকের হাত আছে, এ সব তমুকের দোষ’ ধারার উক্তির নামই কন্সপিরেসি থিয়োরি।
এই কন্সপিরেসি থিয়োরি অবশ্য নতুন জিনিস নয়। বহুযুগ ধরেই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নামে কুৎসা রটানোর জন্য, তাদের বিষয়ে মিথ্যা গুজবকে, জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই ছিল জনপ্রিয় হাতিয়ার। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতায় হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ও তাঁর ইয়ং বেঙ্গল দলের ছাত্রদের প্রগতিশীল আন্দোলনকে আঘাত করতে, তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ তাঁদের নামে ব্যাভিচার, ধর্মবিরোধিতা, এবং অশ্লীলতার অভিযোগ ছড়াতেন জেলেপাড়ার সঙ ভাড়া করে। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে, ক্যাথলিক চার্চের সাহায্যে হিটলারের নাৎসি-পার্টি জার্মানিতে দিনের পর দিন রটিয়ে গিয়েছে— ইহুদিরা জার্মানদের শত্রু, তারা জার্মানির সমস্ত অর্থ নিজেদের পকেটে পুরে সে দেশের সর্বনাশ করতে চায়। এ ধরনের কন্সপিরেসি থিয়োরি ছড়ানোর মূল লক্ষ্য ছিল, জনসাধারণের চোখে নিজের শত্রুকে সন্দেহভাজন করে তোলা, তাদের বিরুদ্ধে লোকের মন বিষিয়ে দেওয়া, যাতে এর পরে তাদের আক্রমণ করলে লোকে আর সেইভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ না পায়। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার অঙ্গ হিসেবেই এ ধারার কন্সপিরেসি থিয়োরির বাড়বাড়ন্ত।
তবে আধুনিক যুগে প্রোপাগান্ডা আর কন্সপিরেসি থিয়োরির একটি বিরাট ফারাক চোখে পড়ে; প্রোপাগান্ডার পিছনে রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা ব্যক্তির একটি স্পষ্ট নিমিত্ত ও তাগিদ পাওয়া যায়। নির্বাচনের আগে স্লোগান বা দেয়াল-লিখন, টিভি চ্যানেলে সরকারি মিডিয়া হাউজের বিপক্ষের নেতাদের বিষয়ে কটাক্ষ, এসব প্রোপাগান্ডারই উদাহরণ। কন্সপিরেসি থিয়োরি কিন্তু সমাজের বৃত্তে নিজের মতো করেই বাড়তে থাকে। হ্যাঁ, তাকে কোনও না কোনও গোষ্ঠী নিজের কাজে লাগায় বটে, তবে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের’ মতোই সে আসলে স্বতন্ত্র, তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না। সে ঢুকে পড়ে সমাজের ‘এ তো সবাই জানে’ গোত্রের সহজ বিশ্বাসের মধ্যে, এবং সেখানে বসে সে নিজের বিষ ছড়াতে থাকে। একটু অন্যভাবে বললে, প্রোপাগান্ডাকে আমরা আজও প্রোপাগান্ডা বলে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু কন্সপিরেসি থিয়োরি অনেকের জীবনেই নির্দ্বিধায় বাস করে common sense রূপে।
কমন সেন্স কথাটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম কারণ এই কথাটির দু’রকম অর্থ হয়, একটি বাহ্য, একটি উহ্য। উপরে উপরে কমন সেন্স বলতে আমরা বুঝি সর্বজনবিদিত সত্য, যা সবাই জানে এবং যাকে তলিয়ে দেখার প্রয়োজন দৈনন্দিন জীবনে নেই। যেমন, শীতকালে ঠান্ডা লাগে বা, চার দু’গুণে আট হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কমন সেন্সের অন্তর্নিহিত অর্থ (যাকে ইতালিয়ান তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামশি নিজের লেখায় ‘senso comune’ বলে সংজ্ঞায়িত করছেন) হল সেই ধারার ভাবনা বা তত্ত্ব, যা আমাদের বিনা প্রশ্নে তোতাপাখির মতো শিখিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় অর্থটি আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয় প্রথম অর্থের ছদ্মবেশে। আমরা দেখেছি, ছোটবেলা থেকেই স্কুলে, কলেজে, বাড়িতে, বন্ধুমহলে বার বার কোনও বিশেষ রাজনৈতিক বা নৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণীত তত্ত্বের এমন পুনরাবৃত্তি করানো হয় যে, শেষমেশ সেই তত্ত্বটিকে আমরা ‘হ্যাঁ, এ তো সবারই জানা কথা’ বলে কমন সেন্স হিসেবেই মেনে নিই। ধরুন, আমি একটি ধর্মীয়-রাষ্ট্র চালাতে চাই। এই উদ্দেশ্যে ছোটবেলা থেকেই আমার রাষ্ট্রের সমস্ত শিশুদের যদি আমি ‘ভিন্ন ধর্মের লোকেরা খুব খারাপ’ তত্ত্বটি স্কুলের পাঠ্যবই থেকে খবরের কাগজ সর্বত্রই গেলাতে থাকি, তখন আর এই উক্তির রাজনৈতিক শিকড়টি তাদের চোখে পড়ে না। তারা সেই তত্ত্বটিকেই বড় হয়ে ধ্রুবসত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এই পদ্ধতিতে ছড়ানো তত্ত্ব প্রোপাগান্ডা বলে আমাদের চোখে পড়ে না, পড়ে কমন সেন্স হয়েই।
কন্সপিরেসি থিয়োরি ঠিক এই কমন সেন্সের ছদ্মবেশটিই ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। সে ছদ্মবেশ কতটা সাফল্য পেয়েছে তা নির্ভর করেছে কোন দেশে, কোন সমাজে সে নিজের বিষ ছড়াচ্ছে তার উপর। সচরাচর যে সব দেশে শিক্ষা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সচেতনতার সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে জোরালো এবং, যেখানে ধর্মীয় বা সামাজিক গোঁড়ামি ততটা জাঁকিয়ে বসতে পারেনি, সে সব দেশে কন্সপিরেসি থিয়োরি খুব একটা কলকে পায় না। এমনকী যারা মনেপ্রাণে এইসব তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তারাও চট করে সবার সামনে এ বিষয়ে কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন, কারণ তারা জানেন প্রকাশ্যে তাদের উদ্ভট থিয়োরি প্রকাশ করলে লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কিছু মানুষ সত্যিই বিশ্বাস করেন যে, পৃথিবীটা আসলে গোল নয়, চ্যাপ্টা; নাসার মতো আন্তর্জাতিক কিছু সংস্থা মানুষকে ইচ্ছে করে ‘গোলাকার পৃথিবী’র মিথ্যে কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য করছেন। তবে Flat Earth Society নামে নিজেদের কিছু ছোট-ছোট বৃত্ত ছাড়া এদের দৃশ্যমানতা প্রায় নেই বললেই চলে। জনসমক্ষে যে এরা হাসিরই পাত্র, সে বিষয়ে এরা নিজেরাও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে এদের দৌড় এই পর্যন্ত থাকলে, কন্সপিরেসি থিয়োরিটা ঠাট্টা-তামাশার পর্যায়ে থাকে, তাতে বেশি ক্ষতি নেই।
ক্ষতিটা হয় সে সব দেশে, যেখানে কুসংস্কার বা ভুয়ো খবর ছড়ানোর সংস্কৃতি বিশেষভাবে সক্রিয়, এবং শিক্ষাব্যবস্থাও এক বা একাধিক কারণে দুর্বল ও আক্রান্ত। ভারতবর্ষ আর আমেরিকা এর দুটি বিরাট উদাহরণ; এবং এ কারণেই এই দুই দেশে কন্সপিরেসি থিয়োরি ঠাট্টা-তামাশার স্তরে থাকেনি, হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর সামাজিক অসুখ। এসব সমাজে আমরা বারবার দেখেছি, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অবান্তর বিশ্বাস বা তত্ত্ব বহু শিক্ষিত মানুষ, অধ্যাপক, শিক্ষক, এমনকী মন্ত্রী বা বিচারকেরাও অনায়াসে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন এবং ছড়াচ্ছেন অন্যদের মধ্যেও। একটি উদাহরণ দিই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের সময়ে ‘কিউ’ (Q/Q-Anon) নামে একটি কন্সপিরেসি থিয়োরির উত্থান হয় ট্রাম্পের সমর্থকদের হাত ধরে এবং প্রচ্ছন্ন সাহায্য পায় ট্রাম্পের নিজের থেকেও। এই তত্ত্ব দাবি করে, ট্রাম্পের বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটদের উচ্চপদস্থ নেতারা সবাই মিলে একটি গুপ্ত-সংস্থা চালান, যেখানে তাঁরা শয়তানের উপাসনা করেন এবং নিয়মিত শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন চালান। বোঝাই যাচ্ছে, এই ভয়ানক কুৎসা সরাসরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তৈরি। সত্যিকারের ভয়ের ব্যাপার যেটা সেটা হল, শেষ একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকার প্রায় ১৭% মানুষ, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মার্কিন নাগরিক এই কিউ-থিয়োরিতে কমবেশি বিশ্বাস করেন, যাদের মধ্যে লরেন বোবার্ট বা মার্জরি টেইলর গ্রিনের মতো নির্বাচিত সাংসদ এবং ব্রায়ান উইলিয়ামস বা ক্রিস হেইসের মতো জাতীয়-স্তরের সাংবাদিকেরাও আছেন। আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিপুল সংখ্যক মানুষ কিন্তু এই ধরনের আজগুবি কন্সপিরেসি থিয়োরি মানতে দ্বিধা করেন না।
মূল প্রশ্ন একটাই, কেন করেন না? তারা তো কেউ শিশু নন, প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা যাকে বলে তার মধ্যে দিয়েও গিয়েছেন এবং (অন্তত খাতায়-কলমে) শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আসলে, যে সব সমাজে বা দেশে, তলিয়ে ভাবা বা গঠনমূলক সমালোচনার সংস্কৃতিকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে, লালন-পালন করে রাখা হয়েছে কুসংস্কার এবং অন্ধ-বিশ্বাসকে, সে সব দেশে মানুষ নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে জোরালো করতে সুবিধামতো তথ্য বানিয়ে নিতে চান, দরকার হলে একটু বিকৃত করেই। অথচ সক্রেটিস থেকে চার্বাক, এ বিষয়ে গুরুস্থানীয় সবাই কিন্তু উল্টোটাই বলেছেন— নির্লিপ্তভাবে তথ্য সংগ্রহ করবে এবং, সেই তথ্য অনুযায়ী নিজের মত বা বিশ্বাস পাল্টাবে। এটাই সভ্য মগজের নিয়ম।
ক্রিকেটের কথা দিয়ে শুরু করলাম বটে, কিন্তু সমস্যাটা আরও অনেক, অনেক গভীর। যে ভদ্রমহিলা সেদিন আমার সঙ্গে ঝগড়া করলেন, যিনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ভারতকে কোনও এক বিরাট চক্রান্ত করে হারিয়ে দেওয়া হল, তাকে নিয়ে বিপদ একটাই। তিনি এই বিশ্বাসের মাধ্যমে যে মানসিক এবং বৌদ্ধিক অপক্কতার পরিচয় দিলেন, তার থেকে সন্দেহ হয় আগামিকাল তাকে ‘আপনার সময়টা খারাপ যাচ্ছে, একটা লাখ টাকার পান্নার আংটি কিনলেই সব ঠিক হয়ে যাবে,’ এবং পরশু ‘প্রত্যেক মুসলমান সন্ত্রাসবাদী’ বললে তিনি দুটি কথা-ই নির্দ্বিধায় মেনে নেবেন। আসলে কোনও কথা শুনে, তাকে তলিয়ে না ভেবে ‘কমন সেন্স’ বলে ধরে নেওয়াই মগজধোলাইয়ের সমগোত্রীয় ব্যবহার। যে যুগে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের চাঁদবদনটি ক্রমেই বিনা মুখোশেই ফ্যাসিস্ট-ফ্যাসিস্ট দেখাচ্ছে, এবং যে যুগে ‘ভারত কে হর বাচ্চা জয় শ্রীরাম বোলেগা’ গোত্রের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উক্তি অকাতরে গিলে নেওয়া হচ্ছে ‘কমন সেন্স’ হিসেবে, সেখানে আমাদের একটু ভাবা প্র্যাকটিস করার কথা ছিল। তার বদলে সেই প্র্যাকটিস করব না বলেই আমরা আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়ছি কন্সপিরেসি থিয়োরির দিকে। আজগুবি তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, এমন অনেকেই নিজেদের বাকিদের থেকে মহান ভাবেন। তাদের দাবি, ‘আমরা তোমাদের মতো ঝাঁকের কই না হয়ে একটু অন্যভাবে ভাবছি’। এই দাবি শুধু ভ্রান্ত-ই নয়, নির্বোধ। কন্সপিরেসি থিয়োরি মানে অন্যভাবে ভাবতে চাওয়া নয়, ভাবনার পরিশ্রমকে এড়িয়ে গিয়ে বিশ্বাসের বুফে-সিস্টেম থেকে যেটা খুশি প্লেটে তুলে নেওয়ার বৌদ্ধিক আলসেমি।
খুব বেশিদিন যদি এই প্রবণতা আমাদের বিষিয়ে দেয়, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা নিছক ক্রিকেট নিয়ে ঠাট্টা-তামাশায় আটকে থাকবে না। বরং একটু ভাবা এবং ভাবানো প্র্যাকটিস করা এখন আশু প্রয়োজন ।