সাইট অ্যান্ড সাউন্ড
গিরিশ ঘোষ যখন বলেছিলেন, ‘মনে হয়, থিয়েটারগুলো আর করা কেন’, ঠাকুরের কথায় উঠে এসেছিল ভবিষ্যতের সেই বহু-উদ্ধৃত জবাবটি— ‘না না, ও থাক, ওতে লোকশিক্ষা হবে।’ এর প্রায় পাঁচ দশক পর সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটেও যেন এই ভাবনারই প্রত্যক্ষ প্রয়োগ চোখে পড়ে। তবে, তা শুধু লোকশিক্ষা বিতরণের প্রচেষ্টা নয়; বরং আশ্চর্যজনকভাবে একইসঙ্গে বিদ্যায়তনিক শিক্ষাতেও ভিন্ন মাত্রা যোগের প্রয়াস।
গত শতকের তিনের দশকের শুরু। চলচ্চিত্র মাধ্যমটির বয়স তখন বেশি নয়, আর সবাক চলচ্চিত্র তো সবেমাত্র পথ চলা আরম্ভ করেছে। এইরকম একটা সন্ধিক্ষণে শিক্ষার হাতিয়ার হিসাবে চলচ্চিত্রচর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল লন্ডনের ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশ পাওয়া শুরুই হয় ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডাল্ট এজুকেশন-এর তরফ থেকে। একদিন যে-‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ বিশ্বচলচ্চিত্র নিয়ে বোঝাপড়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে, শুরুয়াতি পর্বে সেখানে অধিকাংশ লেখাপত্রের লক্ষ্যই ছিল মুখ্যত শিক্ষাবিস্তারের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সিনেমা ও তার প্রযুক্তিগত ব্যবহারকে ধরতে চাওয়া। ১৯৩২ সালের বসন্তে প্রকাশিত প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার মুখবন্ধে এ-কথা স্পষ্ট বুঝিয়েও দেওয়া হয়—
‘During the past eighteen months, signs have multiplied of a growing interest on the part of educators in the possibilities that lie before modern scientific inventions like the film, the wireless, the gramophone, the epidiascope and similar scientific apparatus, as instruments for use in our classrooms, laboratories, lecture-halls, institutes, churches and homes.’
শিল্পমাধ্যম হিসাবে যতটা-না গৃহীত, শব্দে-ছবিতে সিনেমা তখন তার চেয়ে ঢের বেশি প্রযুক্তির বিস্ময়! একইসঙ্গে তাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান বিরোধিতার বাতাস— নতুনতর যে-কোনও শিল্পমাধ্যমের জন্যই যা অপেক্ষা করে থাকে, টকির ক্ষেত্রেও তৎকালে এর ব্যতিক্রম হয়নি। আর সংকটের এই মূহূর্তেই যাত্রা শুরু ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর। বিরল না হলেও, যা ব্যতিক্রমী নিঃসন্দেহে। ১৯৮২ সালে, আত্মপ্রকাশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে সেই ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এমন কথাই লিখেছিলেন ‘Sight and Sound: A Fiftieth Anniversary Selection’-এর সম্পাদক ডেভিড উইলসন—
‘… by no means universally welcomed innovation, you could have counted the number of serious publications on film on the fingers of one hand. Films were for the masses, if not an opium then a harmless (to some minds a harmful) diversion; to take them seriously was an intellectual aberration.’
বিরোধিতার ধুলো গায়ে না মেখে, মাধ্যম হিসাবে সিনেমার অপার সম্ভাবনার দিকটি খুলে দিতে চাওয়াই প্রথম পর্যায়ে ছিল ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর উদ্দেশ্য। পত্রিকার নামকরণ থেকেই স্পষ্ট যে, দৃশ্য শুধু নয়, শ্রাব্যও তাদের কাছে হয়ে ওঠে সমান আগ্রহের বিষয়। সদ্যোজাত সবাক চলচ্চিত্রের চমকই সম্ভবত পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীকে তাড়িত করেছিল, এবং সেইসঙ্গে আশাবাদীও করে তুলেছিল। লক্ষ করলে দেখা যায়, শুরুর দিকের বেশ কয়েকটি সংখ্যায় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে শব্দের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলি। তা সে গ্রামোফোন হোক বা রেডিও, ধ্বনিবিজ্ঞান হোক বা সংগীত। এমনকী শুরুর সংখ্যাতেই ইংরেজি ফোনেটিক্সের উপরে নির্মিত প্রথম সবাক চলচ্চিত্রটির প্রসঙ্গ উঠে আসছে। ১৯৩১-’৩২ নাগাদ তৈরি মিনিট পাঁচেক দীর্ঘ এই ‘48 Paddington Street’ ছবিটিতে দেখানো হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের এক পড়ুয়ার যথাযথ ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে ইংরেজি উচ্চারণের জন্য কসরতের কাহিনি। ইংল্যান্ডে পাঠরত সিংহলি ছাত্রটির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এম. ডি. রত্নসূর্য। ঔপনিবেশিক প্রভুর দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা জাতিবিদ্বেষের গন্ধ হয়তো এই ছবিতে থাকতে পারে; কিন্তু চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে ধ্বনির কী অপরিসীম গুরুত্ব, শুরু থেকেই তা অনুধাবনে যে ভুল করেনি ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’, সে-কথা বুঝতে পারা যায়।
লক্ষ্যে অবিচল না থাকতে পারার ধারণাটি সাধারণত আমরা হীনার্থেই ব্যবহার করি। কিন্তু, ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ বার বার তার লক্ষ্য বদলেছে, প্রকাশভঙ্গি বদলেছে, দৃশ্যতও এক থাকেনি। তার নয় দশকের দীর্ঘ অতীতের দিকে তাকালে মনে হয়— এই ইতিহাস, পরিবর্তনের ইতিহাস। শুরুর দু-বছরের মধ্যে বদলেছে প্রকাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট। ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর দ্বিতীয় বর্ষ অষ্টম সংখ্যা থেকেই পরিচালনার দায়িত্ব চলে যায় এই নতুন সংস্থাটির হাতে। প্রতি সংখ্যার দাম এক শিলিং থেকে কমে হয় ছয় পেন্স। ক্রমে পরিবর্তন আসে বিষয়বিন্যাসেও। শিক্ষার হাতিয়ার থেকে স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার প্রবণতা প্রকট হয়। আরও সময় গেলে মূল ধারার ছবিও এর আলোচনার পরিধিতে কিছুটা ঢোকে। প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রধানত ত্রৈমাসিক হলেও, কখনও-বা স্বল্প সময়ের জন্য মাসিক পত্রিকা হিসাবে বেরিয়েছে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। আবার ছয় দশক পেরিয়ে, ১৯৯১ সাল থেকে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর মাসিক পত্রিকা ‘দ্য মান্থলি ফিল্ম বুলেটিন’-এর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ পেয়েছে। পত্রিকার নামলিপি কিংবা প্রচ্ছদের বিন্যাসও বদলেছে বহু বার।
পত্রিকার প্রাথমিক পর্বে পুরোপুরি নস্যাৎ করা না হলেও, হলিউডকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই মনে হয়। সমালোচনার তির অবশ্য কখনও তীক্ষ্ণতর হয়েছে। মস্কোর ‘কুলতুরা ই ঝিজন’ (সংস্কৃতি ও জীবন) পত্রিকার জন্য লেখা সের্গেই আইজেনস্টাইন-এর বিখ্যাত ‘Purveyors of Spiritual Poison’ রচনাটির তরজমা এখানে পুনর্মুদ্রিত হয়। ১৯৪৭ সালের শরৎ সংখ্যায় প্রকাশিত এই লেখায় তৎকালীন গড় মার্কিন চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থানকে তীব্রভাবে বেঁধেন আইজেনস্টাইন—
‘On the sets of Hollywood, towns, forests, or Egyptian scenes can be built in an instant. But this technically advanced cinema is used in the service of ideas only slightly in advance of the stone age. The statue of Liberty at the entry to New York port has long ceased to be a symbol of liberty even for the United States.’
কাউকে রেয়াত না করে আরও চোখা শব্দপ্রয়োগে প্রবৃত্ত হন তিনি—
‘The skill, inventiveness and technical mastery of the American cinema are used in the service of darkness and oppression— fundamental characteristic features of the cruelty and unjust system of imperialistic society… Thus the most vital of the arts— the cinema— is playing the most deadly and destructive role.’
কোনওরকম সম্পাদকীয় মন্তব্য ছাড়াই এ-লেখা প্রকাশ পায় ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এ। কালক্রমে অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়, হলিউডের অন্তর্ভুক্তি বাড়তে থাকে।
তিন ও চারের দশক ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল সময়কাল। জার্মানির ‘ব্লিৎজ’ হানার মধ্যে শুট হওয়া ‘Major Barbara’ ছবির সেটে উপস্থিত জর্জ বার্নার্ড শ হয়তো উঠে এসেছেন ১৯৪০-’৪১ সালের শীত সংখ্যার প্রচ্ছদে, কিংবা চার্লি চ্যাপলিনের ‘The Great Dictator’-এর রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে সযত্নে; এসব সত্ত্বেও ওই বিপন্ন সময়ে আরও সুস্পষ্ট স্বর থাকা উচিত ছিল এই পত্রিকার, মনে করেন চলচ্চিত্র ঐতিহাসিকদের একাংশ। অথচ চলচ্চিত্রের চর্চায় সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্ব দীর্ঘদিন ধরেই তুলে ধরতে চেয়েছে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। পিরিয়ড ছবিতে অলংকারের ব্যবহার নিয়ে কখনও কলম ধরেছেন রত্নবিশারদ এম. ডি. এস. লুইস, লিখেছেন ‘Jewellery and the Period Film’। আবার কখনও ফিলিপ ফ্রেঞ্চ-এর মতো চিত্রসমালোচকের সুখপাঠ্য ‘All the Better Books’ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে সিনেমার পর্দায় বইয়ের প্রসঙ্গ ঘুরে-ফিরে আসার বৃত্তান্ত।
সময়ের সঙ্গে চলচ্চিত্রচর্চার ভৌগোলিক পরিধিও ব্যাপ্ত করেছিল ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। ১৯৫৭ সালের বসন্ত সংখ্যায় বেরোয় মারি সেটান-এর ‘Journey Through India’, যেখানে তৎকালীন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ‘ইন্ডাস্ট্রি’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের কথা উঠে আসে। ওই সংখ্যাতেই সত্যজিৎ রায় লেখেন ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের বৃত্তান্ত— ‘A Long Time on the Little Road’। পরবর্তীকালে একাধিক বার সত্যজিতের সাক্ষাৎকারও প্রকাশিত হয় ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এ। ১৯৭০ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যার প্রধান আকর্ষণই ছিল সত্যজিতের সাত পাতাজোড়া সাক্ষাৎকার। তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৯২-এর আগস্ট সংখ্যায় দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেন সৈয়দ জাফরি। সংকলিত হয় সত্যজিতের চলচ্চিত্রপঞ্জি। ছাপা হয় তাঁকে নিয়ে রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র স্মৃতিকথন—
‘Like those few other giants whose names have become synonymous with cinema, he granted our industry its art form, but, he did more—he extended it into a world far removed from Europe and the west coast of America.’
১৯৮২ সালের গ্রীষ্ম সংখ্যায় চিত্রসমালোচক ও ঐতিহাসিক ডেরেক ম্যালকম লেখেন ঋত্বিক ঘটকের ছবি নিয়ে। সে-লেখার শিরোনাম হিসাবে দু-পাতা জুড়ে সুবিশাল হরফে ছাপা হয় একটিই শব্দ, অলক্যাপ— ‘TIGER’! ভারতীয় চলচ্চিত্রের সঙ্গে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’-এর সম্পর্ক ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত। কখনও এখানে কলম ধরেছেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত, কখনও ছাপা হয়েছে শ্যাম বেনেগালের ছবির বিজ্ঞাপন। সমালোচকদের চোখে বিশ্বের সর্বকালের সেরা দশটি ছবি বেছে নিতে ১৯৫২ থেকে দশ বছর অন্তর উদ্যোগ নিয়ে এসেছে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। ১৯৫২ সালে প্রথম স্থানটি পায় ডি সিকা-র ‘Bicycle Thieves’। ১৯৬২-তে অরসন ওয়েলস-এর ‘Citizen Kane’। কিন্তু কোনও ভারতীয় ছবি শুরুর চার দশকে প্রথম দশে ঠাঁই পায়নি। অবশেষে ১৯৯২ সালে এই তালিকায় জায়গা করে নেয় ‘পথের পাঁচালী’।
দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে, সিনেমা সংক্রান্ত গভীর চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ নাম হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’। এককালে সিনে ক্লাবগুলি কিংবা চলচ্চিত্র সমালোচকেরা ব্যক্তিগতভাবেও এই পত্রিকার গ্রাহক হতেন। আটের দশকের শুরু থেকে দশ-বারো বছর ধরে যেমন গ্রাহক ছিলেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসব সংখ্যা এখনও সযত্নে বাঁধিয়ে রাখা! এখানে প্রকাশিত লেখাপত্রের প্রসঙ্গ তখন নিয়মিত উঠে আসত তাঁদের চর্চার কেন্দ্রে। বিশ্বচলচ্চিত্রের বিবিধ তথ্যাদির জোগান মিলত, কখনও-বা ভাবনাচিন্তার অন্তর্জগৎও খুলে দিত বিশেষ কোনও একটা লেখা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই প্রবণতায় ভাটা পড়তে থাকে। বিশ্বায়নের প্রভাবে কালক্রমে আমাদের সিনেমা দেখার অভ্যাসের আমূল পরিবর্তন যেমন একটা কারণ, তেমনই ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের ক্ষয়িষ্ণু হালও এর নেপথ্যে আছে। শমীকবাবুর মতো অনেকেই আজ আর এই পত্রিকা নিয়ে ততটা আগ্রহী নন। বস্তুত গত দু-আড়াই দশকে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ নিজেও বদলেছে। এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হয়। কিন্তু এতটা পথ পেরিয়ে আসার পর চলচ্চিত্রের বিদ্যায়তনিক পরিসরের বাইরে থাকা বিশ্বসিনেমার দর্শকের কাছে কি তার সেই গুরুত্ব আর অটুট আছে?
ছবি সৌজন্যে : লেখক