ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • খুঁজে বেড়াই সুপারহিরো


    শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য (August 12, 2023)
     

    বাটারফ্লাই এফেক্ট। গুগল-অনুবাদে ‘প্রজাপতি প্রভাব’। বলা হয়ে থাকে আমাজনে প্রজাপতি ডানা ঝাপটালে তা টেক্সাসে টর্নেডোর কারণ হয়। থিওরি অফ কেয়স অনুযায়ী, সহজ করে বললে, ছোটখাটো কোনও ঘটনার পরিবর্তন পৃথিবীতে বড় মাপের রদবদল করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

    শেক্সপিয়র ‘টাইমন অব এথেন্স’-এ লিখলেন অমোঘ কথাগুলি, ‘সোনা! পীত, উজ্জ্বল, মহার্ঘ সোনা/ ওর একটুকুতেই কালোকে করে সাদা; মন্দকে ভালো; ভুলকে ঠিক; নীচকে মহৎ; বৃদ্ধকে যুবক, ভীরুকে বীর।’

    শেক্সপিয়র থেকে স্টেপ জাম্প করে এবার সোজা মিকেলেঞ্জেলো আন্তোনিওনি। ১৯৬১ সালে কান-এ চিত্র-সাংবাদিকরা তাঁকে সিনেমা সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে অনুরোধ করেছিলেন। আন্তোনিওনির সেই সময়ে করা উক্তির মর্মার্থ মোটামুটি দাঁড়ায়, সিনেমা করার গোড়ার সত্য হচ্ছে সততা। নিজের অনুভূতি এবং উপলব্ধির সৎ প্রকাশ। ক্যামেরায় যে মিথ্যে কথা বলার মারাত্মক ক্ষমতা আছে, তা রীতিমতো ভয়ংকর। কারণ মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে ক্যামেরা যতটা পারে, তত আর কিছুই পারে না।

    তা এই প্রজাপতি প্রভাব, শেক্সপিয়র আর সিনেমাকে কোনও যোগসূত্র ছাড়া একের পর এক মেলে ধরলে অনেকটা ‘ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’ গোছের শোনায়। লেখার শুরুতেই আরোপিত এই হযবরল ভাবটিকে মুছে ফেলে এবার তৈরি করে নেওয়া যাক এই আপাত-বিচ্ছিন্ন বিষয়গুলির মধ্যে স্পষ্ট এক আন্তঃসম্পর্ক।

    শেক্সপিয়রের সময়ের সোনা আজকের ডলার, ইউরো, ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিটকয়েন। কাস্টমারের পকেট থেকে ভল্টে, অ্যাকাউন্টে, ক্যাশবাক্সে জমা পড়ছে রাশি রাশি টাকা অফলাইন-অনলাইনে। টাকা কি গাছে ফলে? না। আয় করতে হয়। দিনরাত লাগাতার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হোক বা কারচুপি, ধান্দাবাজি, ছিনতাই, মায় গণহত্যা, টাকা ছাড়া পেট চলে না। এই বাস্তবতারই প্রতিফলন ঘটে সেলুলয়েডে। আইম্যাক্স ক্যামেরায়, ডলবি ডিটিএস শব্দে মানুষ দেখে টাকার জন্য অভূতপূর্ব স্মার্টনেসে মানুষ মারার নতুন সব উপায়, লোভ হিংসার বীভৎস প্রদর্শনী থ্রি-ডাইমেনশনাল স্পষ্টতায়। আর এই দেখার মুহূর্তগুলিতেই তৈরি হয় আরেক ধরনের প্রজাপতি প্রভাব।

    অনিবার্য কারণে এবার সিনেমার ফেলে আসা দুনিয়ায় চোখ না রাখলেই নয়!

    তখন সত্তরের দশক। আমেরিকা-রাশিয়া ঠান্ডা যুদ্ধের গ্লোবাল আমেজে ভারতে মুক্তি পেল সেলুলয়েডের হাতেগরম ছবি ‘দিওয়ার’। অজস্র সিনেমাটিক মশলা নিয়েও সেখানে নায়ক অমিতাভ বচ্চন একজন নাস্তিক শ্রমজীবী মানুষ। রুখে দাঁড়ালেন শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে। নায়কের মা ঘৃণা করেন অসৎ উপায়ে অর্জন করা ঐশ্বর্য, সম্পদ। চিত্রনাট্য, চরিত্র আলাদা হলেও বক্তব্যে, ভাবনায় অনেকটা একই ধরনের সিনেমা ১৯৭৮ সালের ‘ত্রিশূল’। দুই ক্ষেত্রেই নায়ক টাকাপয়সা অর্জনের দিকে ঝুঁকলেও খেটে খাওয়া মানুষ হিসেবে তাদের আসল সংগ্রাম কর্পোরেট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। নায়ক কিন্তু এখানে কোনও অতিমানব নন। তার রক্তের রং সবুজ নয়, ইচ্ছাশক্তির সুইচ টিপে তিনি উড়তে পারেন না, মুঠো থেকে মাকড়সার জাল টাল বেরিয়ে আসে না। ঠিক সেই বছরেই আবার সুদূর হলিউডে প্রথম সুপারম্যানের আবির্ভাব।

    সিনেমায় তার মা সুপারম্যানকে বলছেন, ‘তাদের নায়ক হও, ক্লার্ক। তাদের দেবদূত হও, তাদের স্মৃতিস্তম্ভ হও, তারা তোমাকে ঠিক যেমন দেখতে চায় ঠিক তাই হও… তা না হলে কিছুই হওয়ার দরকার নেই কারণ তোমার ওপর নেই জগতের ভার।’ এখানে ‘তাদের’ বলতে রাষ্ট্র ও ধনতন্ত্রের নেক্সাসে জেরবার অসহায়, বিভ্রান্ত আমেরিকার আমজনতার কথাই সুপারম্যানের মা বলতে চেয়েছেন, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না, কিন্তু একই সঙ্গে এ-কথাও পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে সুপারম্যানের অতিমানবিক শক্তি জাহির করার কোনও নির্দেশ নেই কারণ তার ওপর নেই সমাজ বদলে দেওয়ার দায়ভার। এখান থেকে উপসংহার করতে খুব অসুবিধা হয় না, খোদ সুপারম্যান, সেই সিনেমার প্রোডিউসার-ডিরেক্টর-ডিস্ট্রিবিউটর  অনেকদিনের পরিকল্পিত এক প্রোপাগান্ডার শরিক হয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, অন্নদাতা কৃষক, কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে আজকের সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বা আমাজন-সুইগি-জোমাটোর ডেলিভারি বয় ইত্যাদি মেহনতি মানুষেরা নয়, ইতিহাসের চালিকাশক্তি হল অতিমানবীয় ব্যক্তি-কাল্ট (individual cult)। এই যুক্তিকে আরও একটু জোরালো করে বলা যায়, সাধারণ মানুষ আসলে অসহায়, ক্ষমতাহীন, হাজার চেষ্টা করলেও তারা ক্রিপ্টন গ্রহের ডানপিটে ছেলেটির মতো ব্রাহ্মস মিসাইলের চেয়েও দ্রুত গতিতে উড়তে পারবে না, অতএব সুপারম্যানরাই তাদের ভরসা। এ-কথা কমবেশি বুঝে নেওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের সহজ আবেগের সঙ্গে সুপারম্যান জড়িয়ে গিয়েছিল কারণ তাদের আশপাশেই সে মধ্যবিত্ত চালে ঘুরে বেড়ায়, হাসে, দুঃখ পায়, প্রেম করে। অথচ প্রতিবেশীকে বিশাল বিপদ থেকে রক্ষা করার সময় ক্ষমতায়, শারীরিক কলা-কৌশলে সে আপাদমস্তক অতিলৌকিক। একটিমাত্র সুপারম্যান সটান আকাশে উড়ল,  সেলুলয়েডের প্রজাপতিটিও ডানা ঝাপটাল আর সেই প্রজাপতি প্রভাবে কয়েক লক্ষ আমজনতার কাছে জোট বেঁধে সমাজ বদলানোর চিন্তা হয়ে দাঁড়াল আকাশ-কুসুম, ইউটোপিক আর অন্যদিকে রক্ষাকর্তা হিসেবে অবাস্তব অতিমানব জনমানসে বাস্তবতার চেহারা নিয়ে অঙ্কুরিত হল। সিনেমার এই নতুন বাজারকে গরম রেখে কিছুকাল পরে অসংগঠিত অসংখ্য সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করল ব্যাটম্যান, আয়রনম্যান, মার্ভেল স্টুডিওর মস্তিষ্কপ্রসূত রংবেরঙের নিত্যনতুন বিচিত্র সুপারহিরোর ফ্যান্টাস্টিক সংগঠন। স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান নিজেদের পরিচয় লুকোতে বাস্তবে যেমন সাদামাটা মানুষ ছিলেন এরা আবার ঠিক তেমন নয়। ব্যাটম্যান, আয়রনম্যান বিল গেটস, ইলন মাস্কের মতোই বিচ্ছিরি রকমের বিপুল সম্পত্তির মালিক। ধনতন্ত্রের মারপ্যাঁচে তৈরি যাবতীয় সংকট, তা অর্থনীতিকে ঘিরেই হোক বা জলবায়ু বিপর্যয় বিষয়ক, পার্থিব অপার্থিব সকল প্রকার আক্রমণ থেকে এইসব ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরাই সাধারণ মানুষকে রক্ষা করবেন, এমনটাই ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ল জনমানসে। আশ্চর্যরকমের ভয়ংকর পরিহাস বটে!

    সেলুলয়েড-সংস্কৃতি এখানেই কিন্তু থেমে থাকল না। অতিমানুষদের লার্জার-দ্যান-লাইফ রেশ এসে পড়ল ভারতেও।

    প্রতিটি দর্শকের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া হয়, যেহেতু অর্থ ছাড়া মানুষ অর্থহীন, ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়িয়ে তোলার একমাত্রিক আকাঙ্ক্ষা পুষে রাখায় তাই কোনও পাপ নেই। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে লাগামছাড়া লোভ, নৃশংস অপরাধ, নির্মম হিংসার পক্ষ নেওয়া কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বরং এটাই আজকের যুগের দাবি, প্রাকৃতিক নিয়ম। ফলত পুষ্পা, রকিভাইরা প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকেন এই সময়ের কালচারাল আইকন।

    ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয়তম বলিউড নায়কের মা টাকা পয়সার অফুরান লোভ, ক্ষমতার মোহকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন। হলিউডে অতিমানুষের মা, কর্পোরেট পলিসিকে আদর করে হলেও, ছেলেকে দেবদূতের মতো নায়ক হতে বলেছেন আমজনতাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে। কিন্তু ২০১৮ সালে, দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমা ‘KGF’-এ নায়কের মায়ের কঠোর নির্দেশে যে অ্যাড্রিনালিন রাশ ধরা দেয় তা এতদিনের মায়েদের সিনেমাটিক ন্যারেটিভ থেকে একেবারেই আলাদা। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য তিনি ছেলেকে উসকে দিচ্ছেন। কারণ চূড়ান্ত যন্ত্রণায় ঠাসা যাপনের মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝেছেন, পৃথিবীতে টাকাপয়সাই সব। সে-কারণে দরকারে লোভ, হিংসা ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে ক্ষমতা, সম্পত্তির শীর্ষে  পৌঁছতে তিনি ছেলেকে আদেশ দেন। বস্তুত এই ন্যারেটিভ সত্তরের দশকের ন্যারেটিভের সম্পূর্ণ উল্টো। গোভিন্দ নিহালানির ‘আক্রোশ’, ‘অর্ধসত্য’, ‘পার্টি’ এইসব ছবির কথা নয় বাদ দিলাম, নাচে-গানে ভরপুর মনমাতানো আগাগোড়া বাণিজ্যিক ছবিতেও ধনী, ক্ষমতাবান মালিককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হত। ১৯৭৯ সালের ‘কালা পাত্থার’ ছবিটি কয়লাখনির মালিকের বিরুদ্ধে খনিশ্রমিকদের বিদ্রোহের বয়ান। নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন সৎ ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত খনি শ্রমিক আর মানবিক বোধে উজ্জ্বল দাগী এক আসামী। কিন্তু চল্লিশ বছর পরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অধ্যুষিত দুনিয়ায় সেলুলয়েডের মা চাইছেন, যেনতেন প্রকারেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী আর ক্ষমতাবান মালিক হয়ে উঠুক তার ছেলে। তেলেগু ব্লক-বাস্টার পুষ্পা থেকে ‘KGF’-এর রকিভাই, ডিজিটাল ভারতের নতুন এই হিরোদের অর্থের আকাঙ্ক্ষা এমন একটা উন্মাদ-উদ্দীপনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় যার সঙ্গে প্রতিশোধের সরাসরি কোনও যোগসূত্র নেই বরং অর্থের প্রতি উন্মাদনাই তাদের ভিতরের ইচ্ছা। শুধু তাই নয়, এই কুৎসিত অর্থলিপ্সা যেন খুব স্বাভাবিক, বারংবার তার পুনরাবৃত্তি করা যায় হাসিমুখে। লক্ষ্যে পৌঁছতে স্লো-মোশনে তীব্র স্টেরয়েড-গভীর শক্তিতে অবলীলায়, বিচিত্র কায়দায় ভাবলেশহীন অভিব্যক্তিতে হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলা যায়। পুরুষতন্ত্র, মাদার সেন্টিমেন্টের নেপথ্যে নারী বিদ্বেষ, মিসাইল-যুদ্ধকে ন্যায্যতা দেওয়া যায়। সারা ভারতের ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা করা, টিকটক ইনস্টাগ্রামে শোরগোল তোলা, তানজানিয়া থেকে ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব পর্যন্ত যে ছবির অনুরণন সেই ‘KGF: Chapter 2’-এর নায়ক রকি সাধারণ মানুষের হৃদয় কেড়ে নেওয়া ভঙ্গিতে বলছেন, ‘greed is good, greed is progress’। হিরোইজিমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পায়ের ওপর পা তুলে রকিভাইয়ের ডায়লগ, তিনি ইন্ডিয়ার সিইও, বসের বস। গণতন্ত্র-ফণতন্ত্র বলে কিছু হয় না, এতদিনের ইতিহাসে যা লেখা হয়েছে তা ভুল, কলার উঁচু করে দাপটের সঙ্গে সে এই কথাই বলে।  

    সম্প্রতি স্কুল সিলেবাস থেকে ডারউইন, গণতন্ত্র, মুঘল ইতিহাস ইত্যাদি ছেঁটে ফেলার সঙ্গে সেলুলয়েডের এই মেটাফোরিক ব্লকবাস্টারের মিল খুঁজে পেতেই পারেন সমাজ সচেতন কোনও এক মানুষ। কিংবা বার্গম্যান-গোদার-তারকোভস্কি-ঋত্বিককে শ্রদ্ধার চোখে দেখা জনৈক সিনেমাবোদ্ধা বলে উঠতেই পারেন, এই সিনেমা ফালতু, রাবিশ। কিন্তু সত্তর দশকের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নারী প্রধানমন্ত্রীর চোখের সামনে পার্লামেন্টে এ কে ফরটি সেভেন হাতে ঢুকে রকিভাইয়ের সাংসদকে গুলি করার দৃশ্য দেখে যে হাজার হাজার মানুষ ঠোঁটের ভিতর আঙুল চেপে তুমুল সিটি বাজিয়েছেন, কোনও এক বিশেষ পরিস্থিতিতে, রকিভাই-ভক্ত সেই সেনাবাহিনীর হাতে সিনেমাবোদ্ধা, সমাজসচেতন মানুষেরা লাঞ্ছিত হবেন না সে-কথা কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে! প্রজাপতি প্রভাবে এমনটাও যে আজকের দিনে সম্ভব!

    এক বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে এই ন্যারেটিভ নিঃসন্দেহে সিনেমা দেখতে আসা প্রত্যেকটি দর্শকের মনস্তত্ত্বে আগাম আঘাত। প্রতিটি দর্শকের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া হয়, যেহেতু অর্থ ছাড়া মানুষ অর্থহীন, ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়িয়ে তোলার একমাত্রিক আকাঙ্ক্ষা পুষে রাখায় তাই কোনও পাপ নেই। এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে লাগামছাড়া লোভ, নৃশংস অপরাধ, নির্মম হিংসার পক্ষ নেওয়া কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বরং এটাই আজকের যুগের দাবি, প্রাকৃতিক নিয়ম। ফলত পুষ্পা, রকিভাইরা প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্রমশ হয়ে উঠতে থাকেন এই সময়ের কালচারাল আইকন।

    সেলুলয়েডের মাধ্যমে এই কাজ যে তুড়ি মেরে করে ফেলা যায়, তা রাষ্ট্র-কর্পোরেট ইন্টেলিজেন্সিয়া অনেকদিন আগেই বুঝে ফেলেছেন। সিনেমার পর্দায় যখন শাহরুখ খান রোমান্সের আগে কোকাকোলায় চুমুক দেন, দীপিকা পাডুকোন বিশেষ ধাঁচের একটি পোশাকে হিরোকে আলিঙ্গন করেন, গোপনে সেলুলয়েডের প্রজাপতিটি ডানা ঝটপটায় আর গোটা ভারতে কোকাকোলা আর সেই বিশেষ ধাঁচের পোশাকটি কিনে ফেলার হিড়িক পড়ে যায়।  

    রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’তে চন্দ্রা যখন বলে, ‘ওদের সোনা তো অনেক জমল, আরও কি দরকার!’ বিশু উত্তরে বলে, ‘দরকার বলে পদার্থের শেষ আছে। খাওয়ার দরকার আছে, পেট ভরিয়ে তার শেষ পাওয়া যায়; নেশার দরকার নেই, তার শেষও নেই। ঐ সোনার তালগুলো যে মদ, আমাদের যক্ষরাজের নিরেট মদ।’ দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘রক্তকরবী’র যক্ষপুরীর যক্ষরাজের সঙ্গে রকিভাইয়ের বেশ খানিকটা মিল। একাধিক সোনার খনির মালিক সে। টনটন সোনার তাল তার জিম্মায় থাকলেও কয়েক গ্রাম সোনা ছিনিয়ে নিতে সে তুলকালাম কাণ্ড করতে পারে। বিরাট পরিমাণের বিলাসিতাকে আঁকড়ে ধরে নিখাদ শিল্পপতির মতো প্রাসাদপ্রমাণ বাড়িতে তার চলাচল। ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে সুদর্শন হেলিকপ্টার, আধুনিক অস্ত্রশোভিত বাহুবলি আর্মি। অথচ তার এই সম্পদ গড়ে তোলার মূল কারিগর, খনি-শ্রমিকদের থাকার জায়গাটি দেখতে অনেকটা ডিটেনশন ক্যাম্পের মতো। সেখানে আবার শিশুশ্রমিকও রয়েছে। তারা পড়াশোনা করে না, ঘুড়ি ওড়ায় না, রকিভাইয়ের জন্য শরীরে আবর্জনা মেখে সোনা তুলে আনে বুক ফুলিয়ে। সোনার খনির মালিক বলেই, দু’মুঠো খাবার আর মাথার ওপর ছাদের বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বলেই মাস-মার্ডারার রকিভাই সকল খনি শ্রমিকের সুলতান, ভগবান, মসিহা।

    এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, ভারতবর্ষে কি ‘KGF’-এর বিপরীত ন্যারেটিভে সিনেমা নির্মাণ করা হচ্ছে না যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সহযোগিতায়, নিবিড় বন্ধুতায় টানটান! আলবাত হচ্ছে। কিন্তু সেইসব সিনেমার গ্লোবাল গ্রাহ্যতা ‘KGF’-এর সামনে ধোপে টেকে না। সে-কারণেই এই ছবির নেতিবাচক দিকটিকে ষোলআনা ইতিবাচকে প্রতিস্থাপিত করে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি’ মানুষ নতুন চেতনায় আন্দোলিত হয় আর হৃদয়বান প্রকৃত প্রগতিশীল মানুষেরা কিছুটা হলেও ভয় পান, কারণ এই ধরনের ছবির সিক্যুয়েল মানুষের প্রাত্যহিকতায় লোভ-হিংসা ছড়িয়ে দেওয়ারই নামান্তর। বাস্তবে ‘KGF’-এর মতো সিনেমা আরও বেশি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনায় ভারতীয় সেলুলয়েড এখন পোয়াতি। KGF-3 দাঁত-নখ বার করে দরজায় কড়া নাড়ছে। এই বীভৎস মজার কাউন্টার-ন্যারেটিভের শিরদাঁড়াটাকে মজবুত করে তুলতে মানুষকে তাই এখন একটু বুঝে শুনেই পথ হাঁটতে হবে।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook