মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মধ্যে চোখের গুরুত্ব বড্ড বেশি । আমরা দেখতে সব থেকে বেশি পছন্দ করি; আর এটাও বিশ্বাস করি যে, দেখেছি মানে সেটাই সত্যি; seeing is believing. এই প্রবণতার কারণ কী? কেন চোখ বাকি সব ইন্দ্রিয়ের থেকে বেশি মূল্য পেল সে বিষয়ে পৃথিবীব্যাপী বহু পণ্ডিত, তাত্ত্বিক, লেখকরা অনেক গবেষণা করেছেন, আলোচনা করেছেন ; কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে দেখার জগৎ (World of vision) একটা বিশেষ অগ্রাধিকার পেল; স্বভাবতই শিল্প ও বিনোদন মাধ্যমে সিনেমা, টেলিভিশন থেকে শুরু করে ওটিটি মাধ্যমেও দৃশ্যের জন্ম আমাদের কাছে একটা প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠল ।
জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয় । মানবজাতিও ধীরে ধীরে দৃশ্যের শাসনে অভ্যস্ত হয়ে গেল । আমাদের ছোটবেলায় সিনেমা হলে নোংরা পর্দায় বেশ খারাপ মানের প্রজেকশনেও অনেক ছবি দেখে ফেলতাম বা দূরদর্শনে একটু ঝাপসা, কাঁপাকাঁপা ছবিতে তেমন কোনও সমস্যা হত না; কিন্তু আজ তা অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য । সবাই চায় ছবি আরো আরো বেশি স্বচ্ছ হবে, স্পষ্ট হবে; তাই ডিজিটাল জগতে আরো উন্নত প্রযুক্তি(SD-HD-2K-4K) তৈরি হল; দৃশ্যের মান হল আরো উন্নত, ঝকঝকে, চকচকে যাতে ছবির প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখা যায় । আমরা দেখলাম; আর তাগিদ তৈরি হল আরো বেশি করে দেখার । মার্শাল ম্যাকলুহান সেই কোন ষাটের দশকে ভবিষ্যতদ্রষ্টার মত তাঁর ‘দ্যা গুটেনবার্গ গ্যালাক্সি’ বইতে উল্লেখ করেছেন, পোষ্ট-লিটারেট সমাজের কথা । এ এক এমন সমাজ যেখানে মানুষ যে কোনও লিখিত বিষয়কে ছবি বা দৃশ্যে(Image or audio-visual) রূপান্তরিত না করা পর্যন্ত তা গ্রহণ করবে না । অবাক কাণ্ড হলেও সত্যি যে আমি এমন বহু মানুষকে চিনি যাঁরা কখনও ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়েননি, ফিল্ম দেখে জেনেছেন । ইউটিউবে এমন কনটেন্ট অনেক আছে যেখানে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন ক্লাসিক নাটকের চরিত্র ও বিশেষ বিশেষ নাটকীয় মুহূর্তের ছবি দিয়ে ব্যাখ্যা করে গল্পটা বলা হয় ।
আজকাল যেহেতু সবকিছুই একটা ইউনিভার্স হিসেবে দেখা হয়; সেই নিরিখে বাংলা সংস্কৃতিতে অবশ্যই যাঁর নিজের একটা অসীম বিশ্ব তৈরি হয়েই আছে, তিনি সত্যজিৎ রায় । অর্থাৎ আমাদের কাছে ‘রায়-ভার্স’ সবচেয়ে আপন ও কাছের । এই রায়-বিশ্বের নানান গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে ছোটগল্পের সাংঘাতিক প্রভাব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য । ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’, ‘অনাথবাবুর ভয়’, ‘বিপিন চৌধুরির স্মৃতিভ্রম’, ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘রতনবাবু ও সেই লোকটা’, ‘বারীণ ভৌমিকের ব্যারাম’, ‘গনেশ মুৎসুদ্দির পোট্রেট’, ‘ক্লাসফ্রেন্ড’, ‘ভক্ত’; এরকম আরো অজস্র, অনবদ্য ছোটগল্পের মায়াজালে আমাদের জীবন গিয়েছে চলে কত কুড়ি বছরের পার । তবে এই তালিকায় যে গল্পটা বারবার তাড়া করে বেড়িয়েছে আমায়; তা হল ‘খগম’ । যাঁরা পড়েছেন বুঝেই গেছেন কেন বলছি !
এ এক অদ্ভুৎ জগত । ভরতপুরের সার্কিট হাউসে, পেট্রোম্যাক্সের পেলব আলোয়, নিঝুম আঁধার রাতে, গল্পের প্যাঁটরা খুলে বেরিয়ে বেরিয়ে আসে ইমলিবাবা ও তার পোষা সাপের আখ্যান । এই গল্পটা পড়ার অনুভূতি বোঝানো খুব কঠিন । সারাক্ষণ একটা গা ছমছমে ব্যাপার; আস্তে আস্তে গল্প এক অপ্রত্যাশিত মোড় নেয় । যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা তো জানেনই; যাঁরা পড়েননি তাঁদের প্রথমবার পাঠের আনন্দটা মাটি করতে চাই না ।
বন্ধুবর শমীক চ্যাটার্জী, গ্রিনিং ট্রি ও সিঙ্গল শটের উদ্যোগে এই ‘খগম’ গল্পটা থেকে একটা গ্রাফিক নভেল তৈরি হয়েছে । দীর্ঘ বছর পাঁচেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল বাংলায় তৈরি এই গ্রাফিক নভেল, যার পেছনে শমীকের মূল ভাবনা ছিল তার মেয়ের প্রজন্মকে বাংলা পড়ায় আগ্রহী করে তোলা । আমার কাজ ছিল গল্প থেকে বিবরণ ও টুকরো-টুকরো সংলাপ লিপিবদ্ধ করা; যাকে বলা যায় দৃশ্যনাট্য। সে এক কঠিন কাজ । প্রথমত গ্রাফিক নভেল সম্পর্কে আমার ধারণা বিরাট কিছু নয়; দ্বিতীয়ত একটা লেখা গল্প থেকে কীভাবে গ্রাফিক নভেলের দৃশ্যনাট্য করতে হয় সে বিষয়ে আমার কোনও প্রথাগত শিক্ষা নেই । কিন্তু লোভ ষোলআনা; সত্যজিৎ রায়ের একটা লেখা থেকে নিজে কিছু করতে পারার যে কী লোভ, সে আর বলে বোঝানোর নয় । অকুতোভয় হয়ে কাজে লেগে পড়লাম । একটা বিরাট সুবিধে হল; সত্যজিৎ বাবু নিজে চিত্র-পরিচালক, চিত্রশিল্পী; অর্থাৎ মূলত দৃশ্য-মাধ্যমের মানুষ হওয়ার ফলে তাঁর সমস্ত লেখার মধ্যেই দৃশ্যপট রচনার উপাদান প্রচুর । তাঁর লেখাটা পড়তে পড়তে চোখ বুঝলেই একটা ছবি ভেসে ওঠে । এর সঙ্গে গ্রাফিক নভেলের জগতে ছবি আঁকার ক্ষেত্রে অনেক রকম আঙ্গিক প্রয়োগ করা যায় যা খানিকটা সিনেমার মতন । যেমন ধরা যাক লেন্সের ব্যাবহার । কোনও একটা জিনিসের গুরুত্ব বোঝাতে সিনেমায় যেমন খুব ক্লোস-আপ শট ব্যবহার করা হয়, এখানেও ঠিক সে-ভাবে বিষয়, চরিত্র, পরিবেশ, উপাদান বা অভিব্যক্তিকে প্রয়োজনমতো দূর থেকে বা কাছ থেকে আঁকা যায়; বিভিন্ন মাত্রা বা perspective তৈরি করা যায় । এদিকে গ্রাফিক নভেল ছবির মাধ্যমে গল্প বললেও, সিনেমার থেকে যেখানে আলাদা, তা হল এখানে শব্দ-প্রয়োগের কোনও সুযোগ নেই; কিন্তু অন্য উপায় আছে; কিছু বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ শব্দ মুহূর্তকে দৃশ্যের কাঠামোয় পরিবেশন করা যায় ।
লেখা শেষ হলে, ছবি আঁকা শুরু হল । একাধিক অঙ্কন পদ্ধতি চেষ্টা করা হল এবং সব ক্ষেত্রেই অবিভাবকের মত পাশে রইলেন সন্দীপ রায়; গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও সাংঘাতিক উৎসাহ দিলেন বিভিন্ন স্তরে, অক্লান্ত ভাবে। লুচি-সাদা আলুর তরকারি সহযোগে চলল আমাদের আলোচনা । অঙ্কনশিল্পী শুভব্রত বোস কাজ করলেন শমীক এবং অর্ক চক্রবর্তীর স্টোরিবোর্ডে; শিল্প পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেন শুভ সেনগুপ্ত, প্রণয় রায় এবং শমীক। ফিনিশিং আর্টিস্ট স্বর্ণাভ বেরা এবং প্রচ্ছদশিল্পী সৌরিন দাস এই গ্রাফিক নভেলের চূড়ান্ত রূপ সফল করে তুললেন।
এত কিছু করে, এত বছরের অধ্যাবসয়ের শেষে তৈরি হল বাংলা গল্পভিত্তিক একটি রূপন্যাস। আমাদের অগ্রজ-বন্ধু রঙ্গন চক্রবর্তী ঠাট্টার ছলে গ্রাফিক নভেলের বাংলা নাম দিয়েছেন রূপন্যাস… আমি নিশ্চিত, এত চমৎকার নাম আর হতে পারে না ।