ফ্রেম
একটা কার্ডবোর্ডের টুকরো কি খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? সামনে থেকে দেখলে মনে হবে, তার একটা পাশ আছে। পাশে গেলে কিছু নেই দেখে মুখ শুকিয়ে যাবে। তাও সে দিব্যি থাকে। ঝড়ে বেঁকে যেতে পারে। হাওয়া নেমে গেলে আবার সোজা। পড়বে না। কংক্রিটের এমন টেনসাইল স্ট্রেন্থ। সে নাকি রাবারের মতো ফ্লেক্সিবল। এরা অবশ্য বাড়ি নয়। টাওয়ার। একটু আগে এমন দুটো টাওয়ারের মধ্যে দিয়ে সূর্য উঠে পড়ার তাল করছিল। পারল না। ওখান থেকে একটা গোটানো কংক্রিটের কার্পেট আপনি-আপনি আনরোল করে উঠে গেল আকাশে। স্পেস ব্লক করে দিল। সূর্য ফেল মেরে গেল। যতই তেজ থাক, এত দূর থেকে সে কি আর করবে? টাওয়ারদের তেজ সাংঘাতিক। সারাদিন আকাশ দাপায়। রাতে রক্তচক্ষু দেখায় পিংপং গ্রহতারা, স্যাটেলাইট, রাতের ফ্লাইট, ব্ল্যাকহোল, উল্কা, ফ্যাতাড়ুদের। ধ্রুবতারা প্রশ্ন করে না। বেগতিক দেখে সূর্য ডায়াগনালি সরতে শুরু করল। শ্যামাপোকার মতো মুভমেন্ট। একটা টাওয়ার আর পিরামিডের মাঝখানে প্রথমে সরু, পরে চওড়া হয়ে যাওয়া পার্কিং স্পেসে ঢুকে পড়ল সুট করে। উঠতে শুরু করল আবার। দেখেও না দেখা এই ডিলে-টা কোনও পাঁজি বা মহাজাগতিক নথিতে আপডেটেড হল না। আমি চোখ কুঁচকে ভাবলাম, ‘আগামীকাল কী করবে?’
‘কী আর করবে? চিরকাল যা করে এসেছে তাই। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারার ধান্দা করবে।’ একটু থেমে, সামনের বাড়িগুলো সম্পর্কে, ‘পা থেকে মাথা অবধি সানগ্লাস। ভেতরে সবটাই ফ্রোজেন। ওখানে সেঁধোনোর মতলব। পারবে না। ভুঁড়ো সিকিউরিটিকে ফালতু রোয়াব দেখিয়ে গেট ক্র্যাশ, হবে না। ভেতরের লোক রাজি হলে, ক্যামেরা হ্যাঁ বললে, বায়োমেট্রিক টেস্টে পাশ করলে, গলায় ‘আমি টিকিট’ ঝুলিয়ে তবেই এগোতে পারবে। ওর ওসব নেই। ক-টা বড়ি আর ঘুঁটে শুকোনো ছাড়া কোনও কাজ নেই। হালে অবস্থা খুব খারাপ।’ হ্যা-হ্যা হাসি কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। একটা অবান্তর বিষয় মাথায় ঢুকলে পরেরটা আপনি এসে পড়ে। আগেরটা পিষে মেরে ফেললে রক্তবীজ অ্যাকটিভেটেড হয়। কনস্ট্রাকশনের ব্যাপারটা আমি ভাল করে দেখিনি কোনওদিন। নীল ধাতুর দেওয়ালের আড়ালে কত কী ঘটনা ঘটে! বিল্ডিং মেটিরিয়াল ঢোকে কড়া নিরাপত্তায়। শব্দ-কল্প-দ্রুম মেশিনে কংক্রিটের পায়েস জমে মিছরি হয় লোহার রড, পিলার, জয়েস্টকে গজা বানিয়ে। হলুদ হেলমেট পড়া লোক দোল খায় ঝোলানো দড়িতে। অনেক দূর থেকে দেখলে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। কাছে গেলে পাঁচিল প্রাচীর হয়ে ওঠে। দোকান দেওয়া, ঘর বাঁধার মতো ব্যাপার তো নয়! একতলা উঠলে তার ওপর চেপে বসে জিরাফ ক্রেন। সে তুলে আনে দোতলাকে। একই ভাবে তিনের ওপর চার, দশ, ছাব্বিশ, বেয়াল্লিশ। ‘ভেতরে ঢুকেছেন না কি?’ জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল ‘আপনি যা দেখতে চাইছেন সেটা এখানে পাবেন না। লেখাপড়া করেননি সে তো মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। সায়েন্স হজম করার আগে বুঝতে হবে দ্য আর্ট অফ লাইফ, বুঝলেন!’ কোথায় গেলে দেখতে পাব জানিয়ে লোকটা চলে গেল। দুপুরে যাব।
অনেক দূর। অথচ যেতে এত কম সময় লাগবে ভাবতে পারিনি। রাস্তা ফাঁকা। ইলেকট্রিক বাস। চলছে বোঝাই যায় না। যেখানে নামলাম সেখান থেকে একটু হেঁটে পৌঁছলাম একটা বিশাল বাড়ির সামনে। টাওয়ার নয়, দশাসই বাড়ি। যেন এক টুকরো জাহাজ। এরপর আর কিছু নেই, যতদূর দেখা যায় শুধু মাঠ। গেটে নাম-ঠিকানা লিখতে হল। ভেতরে ঢুকে বুঝলাম এটা আর্ট গ্যালারি। একটা প্রদর্শনী চলছে। নাম, ‘দ্য স্পেস বিটুইন আস অল।’ শিল্পীর নাম শুনিনি আগে। হলের মাঝখানে কিছু ধাতুর ভাস্কর্য। দেওয়ালে বড়-বড় ছবির ক্যানভাস। ফুটকির মতো এক-আধজন দর্শক। প্রথম ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে মন ভাল হয়ে গেল। আর্ট-কে আমি ভয় পাই। সে সম্মোহিত করে। ডেকে আনে। তারপর দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়। আমার দৌড় দেওয়ালে সাঁটা খবরের কাগজ অবধি। আর্ট বুঝতে ভুল হয়। ভুল বোঝায়। সবসময় মনে হয়, ঠকে গেলাম। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার, দেখে হয়তো কিছু মনে হল, একটু উত্তেজিত হলাম। তারপর আর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম ভুল বুঝেছি। ছবি মানেই ধাঁধা, যা আমি কোনওদিন সল্ভ করতে পারি না। শিল্পী হলেন সেই ঘুণপোকা, যিনি ছবির ফ্রেমের পিছনে লুকিয়ে হাসেন। কুটকুট আওয়াজ শোনা যায় তাঁর দাঁতের ঠোকাঠুকি থেকে। এখানে তেমন কিছু হল না। কোনও কিছুই মুস্কিলে ফেলল না। ফ্রেমের মধ্যে থই থই করছে মসলিনের মতো ফুলের পাপড়ি। থোকা-থোকা। একের মধ্যে দিয়ে অন্যদের দেখা যাচ্ছে। আমাদের শরীর এমন স্বচ্ছ হয় না কেন? মন তো দেখা যায় না। তাহলে তার মধ্যে লুক থ্রু করার রহস্যটা কী? কেউ-কেউ সেখানে ঢুকে পড়ে। কীভাবে? প্রায় সবাই অন্যের মন বুঝতে পারে না। আবার তাকালাম ছবিটার দিকে। পাপড়িদের স্তর পেরিয়ে দিব্যি এগোনো যাচ্ছে। ফুলবাগানের পর নরম সূর্য অপেক্ষা করছে। কোনও ফুল তার দিকে তাকিয়ে নেই। সূর্য আজ ফুলমুখী। পেলব দাবি। ডিমান্ড নেই। নিশ্চিন্তে পরের ছবির কাছে সরে এলাম।
এটাও ফুলের ছবি। এবারে অনেক পাতা। শালুকের মতো দেখতে। হাতের তালুর মতো ছড়ানো। মাঝখানে নিয়মমাফিক জল। জলের তলায় পত্রবিন্দু। সেখান থেকে কিছু শিরা ছড়িয়ে পড়েছে নানা দিকে। বহুমুখী প্রদীপের মতো। তার বাইরে আরও অনেক ছোট পাতা অপেক্ষা করছে। একটি সম্পন্ন পাতার কাছে তারা কি কিছু আশা করে? জলের অতিরিক্ত অংশ ভাগ করে নিতে চায়? সেখানেও অজস্র সূর্য। এমন সুন্দর আলোর বিন্দু, মাটিতে ফেলে না দিয়ে দান করলে ক্ষতি কি? আলোর ভিক্ষা, সূর্য নিজেও চায় কিছু। জ্বলেপুড়ে বেঁচে থাকে বেচারা। ফুলের আলোরা নিশ্চিন্তে জিরোয় শান্ত শীতল বাগানে। এর কিয়দংশ ফিরে পেতে চাওয়াটা কি দোষের? তাহলে বাধা কোথায়? ফ্রেমের মধ্যে আজ এই কথা বলছে সবাই। আমার অনুমান নির্ভুল। ছবিগুলো আসলে সূর্য আর ফুলেদের গল্প। কৃষ্ণ গোপিনীর মডেল। পরের ছবির কম্পোজিশন আগেরটার মতো। শুধু পাতায় ধরেছে আগুন রং। এদিকে নীল হয়ে গেছে সূর্য। কষ্টের বিষ কি মেরে ফেলবে ওকে? এমন হয় নাকি? অল্পবয়সি একজোড়া ছেলেমেয়ে ছবিটা দেখছে। দুজনেরই একরকম কালো জামা। ছেলেটা বলছিল, ‘খুব কষ্ট পেয়েছেন রেমব্রান্ট, সারা জীবন।’ আমি ওদের বাইপাস করে পরের ছবিতে না গিয়ে ঘরের মাঝখানে ভাস্কর্যগুলোর দিকে এগোলাম।
গলানো ধাতু জমিয়ে তৈরি অনেক মানুষের ভিড়। মাঝখানে যাওয়ার উপায় নেই, দূর থেকে দেখতে হবে। সেভাবেই সাজানো। ওখানকার স্কাল্পচারগুলোর মুখ আকাশের দিকে। নারী না পুরুষ তা স্পষ্ট নয়। বহির্বৃত্তের ফিগারগুলো তাকিয়ে আছে সোজাসুজি, চারপাশে, বিভিন্ন ছবির দিকে। বা শূন্য দিগন্তে। বেশির ভাগ মেয়ে। কারুর হাত কোমরে, কারুর গালে। যেন অপেক্ষা করছে। ছেলেদের ভঙ্গি কাঠ-কাঠ। সেপাইদের মতো। ধাতুর মূর্তিতে সাদার ওপর কালো চোখের মণি হয় না। যা হয় তাতে বিচিত্র দৃষ্টিবিভ্রম হতে থাকে। এখানে মেয়েদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ছেলেরা ভাবলেশহীন। কেউ নগ্ন নয়। আবার পোশাকও ঠাহর করা যাচ্ছে না। এমন একদল মেটাল মানুষকে পরিদর্শন করতে লাগলাম ঘুরে-ঘুরে, সাবধানে। নজরে এল একটি মেয়ের হাতে রয়েছে কুঠার। একজনের হাতে তারযন্ত্র। ভয় করছিল, যদি বেজে ওঠে! যদি হঠাৎ মূর্তির কুঠার নেমে আসে? ঠিক যেমন উঠে দাঁড়িয়েছিল একটা আস্ত বাড়ি! দুনিয়ার সাম্প্রতিকতম ট্রেন্ড হল লাইভ ইনস্টলেশন। শান্তিনিকেতনের নন্দনমেলায় দেখেছি এমন। সর্বাঙ্গে বোর্ড পিন লাগিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামান্য উঁচু বেদির ওপর। পাথরের মতো। কেউ এলে, চাইলে, সে আলিঙ্গন করতে পারে। কোণের একটা মূর্তির হাত তোলা, আঙুল নামানো। তার ডায়াগনালি উলটোদিকের মূর্তির আঙুল তোলা। নিশ্চিত সংকেত। একটি বলছে ছবি কোথা থেকে দেখতে শুরু করতে হবে। একটি বলছে, শেষ। আমি আবার ক্যানভাসের দিকে ফিরলাম। জমে উঠেছে ব্যাপারটা।
ছবি অবধি না গিয়ে দরজা পেরিয়ে লিফ্টে ঢুকলাম। ছাদে যেতে ইচ্ছে করছিল। লিফ্টের দেওয়ালটা স্টিলের। আলট্রা মসৃণ। তবে অদৃশ্য ঢেউ আছে। সামান্য নড়াচড়া করলে সেখানে নিজের ছায়া ছবি হয়ে যায়। জ্যান্ত মানুষ তার বিমূর্ত রূপের আভাস পেতে চাইলে এমন লিফ্টে কিছুক্ষণ ওঠানামা করতে পারে। কোনও শব্দ নেই। সুইচের লাল হৃৎপিণ্ড মৌন ইনফরমেশন দিচ্ছে আমার অবস্থান সম্পর্কে। দরজা খুলতেই দেখি পৌঁছে গেছি টেরাসে। ক্যাফেটেরিয়া। কফির গন্ধ। কেউ নেই। তিনদিকে কাচের জানলা। নীচে চেনা শহর। এক-একদিকে এক-এক রকম ফ্রেম। যেটা ফাঁকা মাঠ বলে মনে হয়েছিল, তা আসলে একটা গার্বেজ ডাম্প। ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত ট্রাক-বাস, এমনকী ক্রেনও পড়ে আছে। বলা যায় না, বাতিল জঞ্জালদের হয়তো সেই তুলে এনেছে। একমাত্র শববাহী। তারপর নিজেও ফুরিয়ে গেছে। একটা টিনের চালা ঘর। পায়ে চলা রাস্তার আভাস। কবর ফ্রেমের বাইরে আর একটা ফ্রেম। কালো পুকুর। গায়ে রুপোলি দিঘি, তেল ভাসছে। আর একদিকে, যেদিক থেকে আমি এসেছি, লাখো বাড়ি। বহুদূর অবধি। স্মগে আচ্ছন্ন। সেদিকে সূর্য ডোবানোর তোড়জোড় চলছে। সামনে চারতলা বাড়ির ছাদে ডজন-ডজন গাড়ির মাথা চকচক করছে। আর্টকে ধরে বেঁধে রাখা মস্ত যে-বাড়িটার ওপরে আমি এখন কফি খাচ্ছি, তার বাইরের সবটাই কি গ্যালারি? যা দেখছি সবই কি ইনস্টলেশন? ওই তো, সূর্যের কলসির তলায় ফুটো হয়ে গেছে। ঝুর ঝুর করে পড়ছে অজস্র গাড়ি। গড়িয়ে আসছে কমলা ফিতের মতো সরু রাস্তা দিয়ে। হারিয়ে যাচ্ছে কংক্রিটের মূর্তির আড়ালে। নির্বিঘ্নে সূর্যাস্ত হল। হবেই, তার আগেই আলো জ্বলে গেল সব বাড়িতে। রাত নামলে সবারই সাধ হয় সেজেগুজে দু’দণ্ড শান্তিতে বসতে। আমি আবার নামতে শুরু করলাম।
ছেলেমেয়ে দুটো প্রদর্শনীর প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। আমি আবার প্রথম থেকে শুরু করলাম। অনেকখানি নির্বিঘ্নে দেখা যাবে। আগে দেখে ফেলাগুলো একটু দ্রুত হল। নতুন ছবিতে পৌঁছে আন্দাজ করলাম আমার ঠিক পিছনের মূর্তিটা আমার ওপর নজর রাখছে। এবারের ছবিটা অস্বস্তিকর। শালুকের মতো ডাঁটা উঠে গিয়ে ঘুরে আবার নামতে শুরু করেছে; শেষে যথারীতি ফুল, ভারী ফুল, মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। ব্রেক হিসেবে অন্তত একটিও ওপরে তাকাতে পারত। নেই। ঘোলাটে গোলাপি আকাশ। সূর্য ফিরে গেছে। ফুলেরা মূর্ছা গেল না কি? একেবারে সামনের কয়েকটার নীচের মাটি যেন ভিজে-ভিজে। বিকেলের শিশির। একটু পরে মিশে যাবে। ছবির মধ্যিখানে প্রমাণ সাইজের দুটো পাপড়ি, পাতাও হতে পারে। হাওয়ায় ভাসছে। দীর্ঘ সহবাসের ফলে পরস্পরের চেহারায় অন্যের ছাপ পড়ে। সন্ধ্যা ওদের কাছে টেনে এনেছে। তাই গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে। সকালে, মুখ তোলার পর আবার একক, স্বাধীন হবে। স্পেস বাড়বে। অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না। সামনের পেটাল দুটো আমার মনকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল বার বার। এখানে কাউকে ডেকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না। লোক বলতে মূর্তিগুলো। ঘুরে দেখি সামনের মূর্তিটা পিছন ফিরে আছে। চারপাশে দেখলাম। আমার একটু টেনশন শুরু হল। পালিয়ে গেলাম পরের ক্যানভাসে।
যা যা মনে হচ্ছে, ভাবছি, আমি জানি, সবই মনের বিকার। এটুকু বুঝেছি যে, শিল্পী পুষ্পপ্রেমী। মহানন্দে তাদের শরীরের ছবি এঁকে গেছেন পরম আদরে। উনি মানুষকে দেখেছেন আগ্রহ নিয়ে। নিজের উপলব্ধিগুলো ধরে রেখেছেন। ওদের মানুষ করেছেন কাস্টিং করা স্কাল্পচারে। উলটোটা হতে পারত কি? না। মেটালের ফুল হয় না কি? জ্যান্ত মানুষ আবার ছবি হল কবে থেকে? যা মনে হচ্ছে, তা ঠিক কি না সে-নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। কেউ আমাকে পরীক্ষা করছে না। দেখছেও না। আমি আরামসে একের পর এক ফ্রেমে ঢুকছি, ফ্রেম পেরোচ্ছি। বেরোচ্ছি স্বাধীনভাবে। এই যে-ছবিটা, বালিয়াড়ির মতো ফুলের বেডে ঢেউ উঠেছে। আমার মনের কারা টুটছে। ওদের ওপর অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে সাদা বরফকুচি। অথবা কসমিক রেণু। কয়েকটা বেয়াদপ ফুলের ঝুঁটি, যাদের মাথার দিকে লাল আভা, তারা সদর্পে মাথা তুলেছে। কী মনে হল, একটু পিছিয়ে গেলাম। এখন অন্য রকম দেখাচ্ছে। অজস্র সবুজ মানুষের ভিড়ে যেন জেগে উঠেছে লাল নিশান। আরও দূরে চলে গেলে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে লাল রঙের ছিটে। কাছে ফিরে গেলে আবার ফুল, যে কে সেই। পরের ছবিও তাই। লালের দৌরাত্ম আরও বেশি। পরেরটাতে আরও। তার পরেরটায় সবুজ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। মিছিলটা কি এগিয়ে আসছে? আমি কি নিজে তার মধ্যে ঢুকে পড়েছি? নিশ্চয়ই তাই। এর পরের ছবিতে ফুলের নামগন্ধ নেই। খাঁ-খাঁ বেরঙিন আকাশ। ময়লাটে ধূসর ঘাসজমি। সারি-সারি ডাঁটি। তাদের ওপরে একটি-দুটি ফোটা ফুল ঘাড় নামিয়ে তাকিয়ে আছে দিগন্তের বিভাজনরেখার দিকে। কলকে ফুল না? মাঝখানের ডট-টা অবধি রয়েছে। জমিতে অজস্র ঝরা পাতা। এই অবধি দেখার পর আমি আর্টিস্টের আসল মতিগতি আবারও বুঝে ফেললাম। উনি দর্শকদের সমাবেশ শেষে ব্রিগেডের চেহারা দেখিয়েছেন। ছদ্মবেশে। খেলাটা ধরে ফেলেছি আমি। মাঝখানের মানুষগুলোকে উনি ফুটিয়ে রেখেছেন ফুলের মতো।
টুকটাক চাপা গলা শুনলাম। আরও দর্শক এসেছে। ছেলেটা, মেয়েটা এখনও বেরোয়নি। একটা ছবির সামনে দঁড়িয়ে দেখছে। সেখানে পৌঁছাতে আমার দেরি আছে। কিন্তু স্কিপ করে চলে গেলাম ওদের দিকে। অন্য কারণে। একবার মনে হয়েছিল একজন রয়েছে। তা নয়। ছেলেটা এখন মেয়েটার ঠিক পিছনে। ওরা মিশে গেছে। মাঝে মাঝে ওদের মাথাদুটো আলাদা হচ্ছে। আমার হাঁটাটা এই মুহূর্তে কিছুটা সাবধানী। দূর থেকে ঠিকই দেখেছিলাম। কাছে পৌঁছতে আরও পরিষ্কার হল। এতক্ষণ মেয়েটার কাঁধে হাত রেখেছিল ছেলেটা। চুল নিয়ে খেলা করছিল। এবারে পিঠে। তারপর কোমরে। এখন কোমরের তলায়। হাতটা স্লো-মোশনে ঘোরাফেরা করছে। ছবি থেকে ওরা চোখ সরাচ্ছে না। কথাও বলছে। কী বলছে জানার ইচ্ছে হল। আর একটু কাছে গেলাম। তারপর আর একটু। আমাকে খেয়াল করলেও সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। ওদের সামনে চালচিত্রের মতো ছবির অনেকটা দেখতে পাচ্ছি আমি। ওরা কি জানে যে, আমি ওদের প্রাইভেট স্পেসে ঢুকে পড়েছি? বেশ করেছি। আর্ট-ফার্ট নয়। ফ্লার্ট করতে এসেছ। বেশ করেছ। টিপে-টুপে দেখে নাও। বুঝে নাও। সুখ ঠিক কোনখানে, কোনখানে, কোনখানে। আমাকে নিয়ে আপত্তি থাকলেও কিছু করার নেই। এটা তো পাবলিক এরিয়া। কারুর হাত অন্যের যে-কোনও জায়গায় ঘুরতেই পারে। আমার চোখ-ও পারে। যে-ছবির সামনে এসব চলছে, সেটা ফুলেরই। একটিমাত্র কুঁড়ি। ফুটবে-ফুটবে করছে। জলপাই-রঙা স্কিনকে অনুরোধ করে অতি ধীরে বেরিয়ে আসছে ফ্যাকাসে গোলাপি পুষ্পবৃন্ত। চড়া গোলাপি ধরতে একটু সময় লাগবে। আশেপাশে আর একটিও ফুল নেই। ঘটনা ঘটছে পুষ্পচক্ষুর আড়ালে। নিভৃতে। লাভলি। আমাকে আরও কাছে পৌঁছতে হবে। দ্বিতীয় একজনের উপস্থিতি টের পাচ্ছি ছবির একটু ডান দিকে। কুয়াশার আবহ। স্পষ্ট নয়। আমি থামলাম। তৃতীয় ফুল নয়। মানুষ।
আমি এক দৃষ্টিতে ছবির দুই চরিত্রকে দেখে যাচ্ছিলাম। ছেলে-মেয়ে দুটোকেও। আমার আর ছবির মাঝখানে ওরা আর একটা লাইভ ফ্রেম। একটা আনক্যানি ফিলিং হল। পিছনে ঘুরে দেখি সামনের মূর্তিটা আমাকে দেখছে। আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই যে, সে হাসছে। ছেলে-মেয়ে দুটো অবস্থান পরিবর্তন করেনি। মেয়েটা নড়ছে না। ছেলেটা পিছনে কয়েক ইঞ্চি এদিক-ওদিক করছে। তার অ্যাকটিভ হাত এখন আলগাভাবে মেয়েটাকে পেঁচিয়ে ধরে আছে। অন্য হাত কথা বলছে ছবির সঙ্গে। আমি কথা শুনতে পাচ্ছি। ছেলেটাই যা বলার বলছে। আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রী হতে পারে। বা আমার মতো কেউ। ‘ভায়োলা’ নামে একটা সিনেমার কথা বলল। ওয়াইল্ড অর্কিড শব্দটা কানে এল। মেয়েটা হঠাৎ ঝলমল করে ঘুরে তাকাল আমার দিকে। হাসিমুখে। তারপর আমার মাথার ওপর দিয়ে অন্য কারুর দিকে। আমার পিছনে একটা জোরালো গলা শুনলাম, ‘কাট!’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র