ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বাংলা, মলিনবদনী


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (February 20, 2021)
     

    বাংলা ভাষা নিয়ে শৈশবে খুব যে ভেবেছি তা নয়, অনায়াসে এসেছিল সে। মায়ের চেয়ে যে বেশি ভালবাসে সে নাকি ডাইনি, সেই রকম কোনও ডাইনির মতোই বাংলা আমাকে মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সঙ্গে করে চলে গেছে দূর-দূরান্তে, তামাপাহাড়ের অধিত্যকায়, শালকিয়া বৈহারের চাঁদডোবা অন্ধকারে, পুকুরঘাটে অন্ধ বধূর পায়ের তলার নরম বকুলফুলের কাছে। যুক্তিহীন ভালবাসার শর্তে আবদ্ধ হয়েছি, আত্মহারা হয়েছি, পৃথিবী দেখবার চোখ বদলেছে। ভাষার পাটরানি হল সাহিত্য, তাকে ভালবাসলে ব্যাকরণও ভারি সন্তোষে-ঔৎসুক্যে বন্ধুর মতো পাশে এসে বসে, বসেছিল তাই। দেখিয়েছিল সে কেমন নিপাতনে সিদ্ধ হয়, নিমিত্তার্থে চতুর্থী হয়। অ্যামনিওটিক ফ্লুইডকে নিয়ে ভ্রূণ যেমন ভাবে না, আমিও ভাবিনি। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’, আমার কাছে ওই মা হচ্ছে বাংলা, আমার মাতৃভাষা। 

    নয়নজলে ভাসবার সময় এসেছিল পরে, ততদিনে শৈশব মুছে গেছে। ততদিনে হুমায়ুন আজাদের মতো করে আমিও যেন দেখেছি— আমার ভাষার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়ে রঙিন, স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো। কাব্য-ব্যতিরেকে তারা মারের দাগ নির্যাতনের চিহ্ন। তদ্দিনে বিজ্ঞাপনের আর ম্যাগাজিনের ভাষার গুরুচণ্ডালি ঢুকে পড়েছে বাংলায়। তদ্দিনে বাংলার শিক্ষক স্কুল-কলেজের সবচেয়ে জীর্ণ মানুষ— ভাষার ভালবাসা সংক্রমণের কোনও ক্ষমতাই তাঁর নেই, ভালবাসার জীবাণু তাঁর নিজদেহে মরে গেছে… ছড়াবে কেমন করে। বাংলা মিডিয়াম ইংরেজি মিডিয়ামের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে। বাণিজ্যে-পুঁজিতে ভাষার উপযোগিতা ইত্যাদি নিয়ে খুব জোর বিতর্ক চলছে, সেখানে নাছোড়বান্দা বাংলা মিডিয়াম শেষ পর্যন্ত নিজেকে তরিয়ে দেওয়ার তরী হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে— মাতৃভাষা যথেষ্ট না জানলে অন্য ভাষায় দখল-পত্তন সম্ভব নয়। অর্থাৎ, অন্য ভাষাটিই গন্তব্য। ভাষা যেন মুদ্রার মতো কিছু, ধাতবমূল্যের অধিক মূল্যমানসম্পন্ন উপযোগিতা-সর্বস্ব বস্তু।  বাংলা তখন ক্রমাগত হারছে। হারছে বিপণি-বিতানের নামে, হারছে প্রতিষ্ঠানে। আর হারছে উচ্চশিক্ষায়। অথচ ওই থতমত বাংলাই আমাদের বুকে গেঁথে দিয়েছিল কত দুর্দান্ত সব বৈজ্ঞানিক পারিভাষিক শব্দ— সংনম্যতা, স্থিতিস্থাপকতা, স্বতঃবাষ্পীভবন, গোলীয় অপেরণ। শুধু কি তা-ই, আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেক মানুষকে তার চিত্তহারী খেয়ালিপনা, তার জটিলতা, তার অর্থহীন অলঙ্কার দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল এই ভাষা। ভাষাকে যে শুধু ভাষার তরে ভালবাসা যায়, ভালবাসলে তাকে নিয়ে আরও কত খাটা যায়, তা বুকের রক্তে বাংলা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাঙালি জাতি স্বয়ং ভুলে গেল। আর উপযোগিতার কথাই যদি বলি, বাংলাকে কেউ সেভাবে পুঁছলই না আসলে, বাংলা-অসম-ত্রিপুরার মহান অধিপতিকে কেউ আশা-ভরসা দিল না, ‘সুযোগ পেলেই তারা এ’দেশ কেড়ে নেবে’-র ভাষা, রাজ্যত্যাগী বড়ভাইয়ের পাদুকার মতো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল। 

    আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেক মানুষকে তার চিত্তহারী খেয়ালিপনা, তার জটিলতা, তার অর্থহীন অলঙ্কার দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল এই ভাষা। ভাষাকে যে শুধু ভাষার তরে ভালবাসা যায়, ভালবাসলে তাকে নিয়ে আরও কত খাটা যায়, তা বুকের রক্তে বাংলা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাঙালি জাতি স্বয়ং ভুলে গেল।

    একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি, যে-সব গল্প বলা সহজ, সে-সব গল্পে। দেশ যখন ছাড়লাম, তখনও প্রদীপ্ত কক্ষের মতো বাংলাভাষা আমার মনে জ্বলছে, লাগেজে সম্বল একখানি গীতবিতান। হাড়কাঁপানো শীতে কাঁপতে কাঁপতে যেন স্বভাবদোষেই গুনগুন করি— অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল গুঞ্জন গুঞ্জে। কাঁপুনির সঙ্গে সেই অনুপ্রাস খুব যায়! পাবলিক লাইব্রেরিতে বই খুললেই গুণিজন একে অপরকে অভিবাদন জানাচ্ছেন— ভাগ্যিস প্রুস্ত এই ভাষায় লিখেছিলেন, আমাদের ভাগ্য নবোকভ ওই ভাষায় লিখেছিলেন। শুনে এক অব্যক্ত আলোড়ন অনুভব করি, বোতলবন্দি চিঠির মতো ভাষার মহাসমুদ্রে বাংলা ভাষা দুলছে, বাকি জলরাশি জানে না… হায় কেন জানে না! একটিমাত্র নোবেল পাওয়ার আনন্দে পরবর্তী এক শতাব্দী ঘুমিয়ে রইলাম? পাশে এসে বসে এক আইরিশ যুবক, ‘জানো, আমার না মা নেই’ মুখ করে বলে— ‘জানো, ইস্কুলে গেইলিক বললে আমাদের ইংরেজি শিক্ষকরা পেটাত! তাই আজ আমরা আর গেইলিক জানি না!’ আর আমি গর্ব করে বলি, ‘মার তো মার, আমরা মরে যাব তবু বাংলা ছাড়ব না এমন!’ সে আমাকে গেইলিকে, আর আমি তাকে বাংলায় সবচেয়ে প্রসিদ্ধ বাক্যগুলো বলি, ইংরেজদের ভুতুড়ে শহরে। 

    নয়নজলের তখনও বাকি ছিল হয়তো। পুরিয়ে গেল গেইলিক এবং বাংলার সংসারে এসে। যে-শিশুটি জন্মাল, তার বাপের আদিভাষা হারিয়ে গেছে, মায়ের ভাষা লাঞ্ছিত-মূর্ছিত, সে নিজে টলমল করে ভাসছে ইংরেজির মাতৃকায়, কারণ বাড়িতেও মাধ্যম ইংরেজি, শহরেও তাই (আমার আন্তরিক প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে শিশুপুত্রের পিতা বাংলায় কিছুই শেখেনি)। স্বভাবতই আমরা বাচ্চাটাকে একজন পশ্চিমের দিকে এবং একজন পুবে টানতে লাগলাম। 

    কিন্তু এ এক অসম যুদ্ধ। মায়ের বুকে শুয়ে শুয়ে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবার আগে সে খুবসে শিখছে— ‘মামি এল লাঠি নিয়ে, পালাই পালাই’, কিংবা আমি যখনই বলছি ‘ঘুমপাড়ানি’ সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছে ‘মাতিপিতি’, কিন্তু দিনের বেলা আমি  তাকে ইউটিউবে বাংলা অনুষ্ঠান খুলে দিয়ে সংসারের কাজ সামলাব এমন উপায় নেই, ‘গড়গড়ার মা লো’র যে ভয়াবহ ভিডিও তা দেখে সে ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে, আমিও কোমর বেঁধে ‘অতি মঞ্জুল’ কিছু খুঁজি বাংলায়। দেশ থেকে তার জন্য বইয়ের যে চালান এসেছে, সেগুলো আমি নিজে শৈশবে অনন্যোপায় হয়ে পড়েছি। সেসব বইয়ের অলঙ্করণ আমাদের চমকাত, মোহিত ঠিক করত না তো! মোহ ছাড়া কি আর উৎসুক হরিণছানা পায়ে পায়ে কাছে আসে? বাংলায় তখন চমৎকার সব চিনা আর রুশ গল্পের বই আসত, সেগুলো ছিল আমাদের শিশুবেলার আদরের ধন। এখন তাদের কোথায় পাই! 

    বাংলা যে সে শিখল না, সেটাকে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বলতে আমার গা চুলকোয় বলে, আমি বলতে চাই ‘সামষ্টিক প্রয়াসের অভাব’, বাংলায় কেন চোখ-জুড়নো মন-জুড়নো ভিডিও নেই, শিশুসাহিত্যের কেন এই দশা, অলঙ্করণ কেন এমন হবে, ইত্যাদি। ব্যক্তি যখন সমষ্টির হাতে পরাজিত হতে থাকে, ব্যক্তির জেদ চেপে যায়। আমরা স্কুলফেরতা গল্প করতে করতে যে মেটাফরগুলো বলে বসি, সেগুলো বাংলায় বলে দিই, সে তোতার মতো মুখে মুখে বলে, পরে ভুলে যায়। কিন্তু শুকবৃত্তির দৌড় আর কত! ভাষার স্যুপে হাতার মতো ডুবে না থাকলে ভাষাটা ঠিক করায়ত্ত করা সম্ভব হয় না। সে তো বাংলা শুনে শুনে শিখবার সুযোগই পায় না, তাকে দোষ দেব কী! তবু একদিন ছেলেকে ঘেঁটি ধরে বলে দিই, আবু সয়ীদ আইয়ুব ষোলো বছর বয়সে বাংলা শিখেছিলেন, অতএব তোকেও। সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘লোকটা কে?’ আমি বলি, ‘বড় জ্যাঠা, আমার দিকের।’ আমাদের বাড়িতে কিছু কিছু বাংলা বুঝে সে নিজেকে নিয়ে প্রীত হতে থাকে, এই যেমন ‘ফুলকপি এনে দে’, ‘চশমা কোথায়’, ‘এমন মার খাবি’ ইত্যাদি। নাম শেখে মনমোহিনীদের, এই যেমন রসগোল্লা, পাটিসাপটা, বিবিখানা, এমনকী লবঙ্গলতিকা। 

    শিশু-কিশোরদের শিক্ষাপ্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে আমাকে পড়তে হয়েছে, তখন সুযোগ এসেছিল আমার বাচ্চার স্কুলঘরে বসে বসে ক্লাস দেখবার। দেখলাম, এক রকমের অনুসন্ধিৎসু মন গড়ে দেবার জন্য এরা বিজ্ঞান পড়ায় বা অঙ্ক করায়। আমরা শিখেছি ‘কী করে সমাধা হয়’, ওরা আগে শেখে ‘কেন এমন হয়’। ক্লাস থ্রি-র আগে ইংরেজির (মাতৃভাষা) পাশাপাশি অন্য কোনও ভাষা শেখে না। আমার সামান্য হস্তিদর্শন-বিদ্যায় অন্ধ চোখ মেলে প্রাইমারি স্কুলে আমি যে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার ক্লাস দেখলাম, তা একেবারে মনোমুগ্ধকর। শিক্ষক কিছু ঘটনার ইন্ধন দিয়ে দিয়েছেন, ছাত্ররা নিজের মতো করে সেই লেশমাত্র ঘটনাকে বাড়িয়ে তুলবে। প্রতিটি বাক্যে শব্দের অন্বয় থাকবে। বাক্যবিন্যাস নিখুঁত হবে। শিক্ষক মুখে মুখে অজস্র প্রতিশব্দ বলবেন, যে যার পছন্দমতো তুলে নেবে। শুধু ব্যাকরণসম্মত নয়, ছাত্রের রচনার মূল গল্পটি হবে রীতিমতো চমকপ্রদ, সে সেই চমককে বাক্য গেঁথে গেঁথে নির্মাণ করবে। 

    আর রইল সেই পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষকদের কথা। যাঁরা বাংলা পড়ান, তাঁরা ওই রকম ভাষার ভালবাসায় ঝলমল করতে করতে কোনও দিন ক্লাসে এসেছেন বলে দেখিনি। দেখিনি সাহিত্যের শিক্ষককে একটি অন্তত সাহিত্যের ‘আউটবুক’ হাতে করে কি বগলে চেপে ক্লাসে আসতে। আমি দেখিনি মানে যে নেই, তা নয়, বরং ‘দেখিনি’ মানে এঁরা সংখ্যায় নগণ্য, প্রায় দুর্লভ। ফলে আমাদের ভাষা পাড়ার লন্ড্রির মতো হয়েছে, সেখানে ‘রং-রিপু-ধোলাই’ করা হয়। তবু হয়তো কোথাও আলো ক্রমে আসবার ফুটো আছে, যেখান দিয়ে ভাষা প্রবেশ করে এবং এখনও আমাদের স্পর্শ করে, আলোড়িত করে, আমাদের তুচ্ছ দৈনন্দিন থেকে আলো বিচ্ছুরিত করে। সেইটুকুতেই কেবল ভরসা না করে রাজ্য-রাষ্ট্র এগুলোকে পাশে পাওয়া গেলে, হয়তো আমাদের বাংলার অধোগতি রোধ করা যেত, মানুষ তাকে বুকে ফিরে পেত।


    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook