যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় অপর্ণা সেন-এর ছবি দেখে মনে হয়েছিল, ইনিই সেই ‘স্মার্ট’ সুন্দরী, যা আমি হতে চাই। ‘জয়জয়ন্তী’ আর ‘রাতের রজনীগন্ধা’, দুটো ছবিতেই আমার ওঁকে দারুণ স্মার্ট লেগেছিল। তার উপর যখন জানলাম উনি যেমন বাংলা বলেন, লেখেন, ইংরেজিতেও তেমনই পারদর্শী, তখন উনিই হয়ে উঠলেন আমার আইডল। ওঁকে ফলো করার জন্য তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না, খবরের কাগজেও সিনেমার অভিনেত্রীদের নিয়ে তেমন মাতামাতি ছিল না, বিশেষত যে সাহেবি ‘স্টেটসম্যান’ কাগজ আমরা নিতাম, তাতে তো নয়ই। কিন্তু বন্ধুবান্ধব, ‘উল্টোরথ’, ‘প্রসাদ’ এবং ‘জুনিয়র স্টেটসম্যান’ মারফত ওঁর সম্পর্কে জানতে পারতাম।
স্কুলের শেষের দিকে, ১৯৭৩-এ, শুনি ‘কলকাতার হ্যামলেট’ নাটকটির কথা। অসিত বসুর পরিচালনায় এই নাটকটিতে অভিনয় করেছিলেন অপর্ণা। আমি অনেক জেদাজেদি করা সত্ত্বেও এই নাটকটি দেখতে যেতে দেওয়া হয়নি। যে নকশালপন্থী মনোভাব ব্যক্ত হয়েছিল ওই নাটকে, তা আমাদের বাড়ির বড়রা আমার পঞ্চদশী মনের পক্ষে উপযুক্ত মনে করেননি। আমি নাটকটির বক্তব্য নিয়ে তেমন উত্তেজিত ছিলাম না, কিন্তু অপর্ণাকে চাক্ষুষ দেখার ইচ্ছে ছিল প্রবল। হল না।
কলেজে ইংরিজি নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। কলকাতায় তখন ইংরেজি নাটকের চর্চা বেশ জোরদার ছিল। জো ওর্টন এর ‘হোয়াট দ্য বাটলার স’ বা জন ওয়াইটিং এর ‘দ্য ডেভিলস’ নাটক আমরা মঞ্চস্থ করেছিলাম। দ্বিতীয়টির পরিচালক ছিলেন অভিজিৎ দত্ত, সেন্ট জেভিয়ার্স-এর কৃতী ও প্রগতিশীল ছাত্র। আমরা তখন মহলা দিচ্ছি, হঠাৎ একদিন গ্রুপে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। অপর্ণা সেন মহলা দেখতে আসছেন! অভিজিৎ ওঁকে রাজি করিয়েছে। আমরা বিশ্বাসই করতে পারিনি। হ্যাঁ উনি এসেছিলেন, বেশ কিছুক্ষণ দেখেওছিলেন রিহার্সাল, সবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক ‘হ্যালো’-ও করেছিলেন। অদ্ভুত ‘স্মার্ট’, প্রত্যয়ী এক তারকা। পোশাক-আশাক ক্যাজুয়াল, আড়ম্বরহীন অথচ একেবারে ‘শিক’ (chic)। চুলের স্টাইল; এবং প্রেজেন্স একেবারে সমকালীন। সেদিন অল্প দূর থেকে দেখে অনেক কথা বলার ইচ্ছে অনেক কষ্টে দমন করেছিলাম।
১৯৭৯ সালে কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে আমি ‘আন্তিগোনে’ নাটকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করি। এছাড়া ম্যাক্সমুলার ভবনে আমরা ক’জন মিলে ব্রাজিলের নৃত্যশিল্পী কার্মেন পাতের নস্ত্রো-র সঙ্গে গড়ে তুলি ক্যালকাটা ডান্স থিয়েটার। মহলা চলে নিয়মিত। ১৯৮০-র প্রথমদিকে হঠাৎ আবার চাঞ্চল্য আমাদের রিহার্সাল রুম-এ। অপর্ণা আসছেন আমাদের কাজ দেখতে। এই দ্বিতীয় বার দেখলাম সামনে থেকে। রিহার্সাল শেষে চা খেয়ে চলে গেলেন। পরে শুনলাম অপর্ণা ছবি করবেন নিজের পরিচালনায়। তাই এসেছিলেন কাস্টিং-এর জন্য। না, আমাদের মধ্যে কাউকে উনি বাছেননি। দেবশ্রী রায়ই হয়েছিলেন ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর নায়িকা।
‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’ মুক্তি পায় ১৯৮১-তে। আমরা সদলবলে দেখতে যাই। ছবিটা দু’বার দেখেছিলাম, একবার ডান্স গ্রুপের সঙ্গে, দ্বিতীয় বার এম.এ. ক্লাসের সঙ্গীদের সঙ্গে। ছবিটা দেখতে দেখতে বহুবার নিজেকে ‘নন্দিতা’র ভূমিকায় কল্পনা করতাম। তখন একদিকে থিয়েটার করছি, অপরদিকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু কোনও কিছুতেই তেমন রোজগার নেই। এক বন্ধুর সূত্রে জানতে পারলাম, ‘আজকাল’ পত্রিকায় ট্রেনি সাংবাদিক নেওয়া হচ্ছে। আমি জায়গা পেলাম নিউজ ডেস্কে। ৬০০ টাকা মাসিক বেতন। ১৯৮২ সাল। তখন ট্যাক্সি চড়তাম মাত্র ১.২৫ থেকে ২.৩০ টাকা ভাড়ায়। সালোয়ার-কুর্তা সুট কিনেছি ১০০ টাকায় নামী বুটিক থেকে। জিনস ‘জিন জাংশন’ থেকে ৭৫ টাকা থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। ‘খগেন ঘোষের’ সরভাজা ছিল ১.৫০ পয়সা পিস। মাইনের দিন সবাই খেতাম। এই ‘আজকাল’-এ এসে জীবনের অনেক দরজা খুলে গেল। সুমন চট্টোপাধ্যায়, পূষণ গুপ্ত, নাজেস আফরোজ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, অশোক দাশগুপ্ত এবং আমার সাংবাদিক জীবনের অন্যতম বড় প্রভাব: রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে আলাপ হল।
রঞ্জনদা আমাকে মৌলিক লেখার সুযোগ করে দেন ওঁর ‘আজকালের আয়না’ বিভাগে। এক একটা লেখা ছাপা হলে পেতাম ৩০ টাকা। তাই চেষ্টা করতাম অনেকেই, সপ্তাহে অন্তত একটা লেখা যেন ওই বিভাগে প্রকাশিত হয়। আমি ফ্যাশন, নাটক, বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে লিখতাম। পয়সা পেতাম, কিন্তু নাম যেত না। আর নামের নেশা তো বড় নেশা। রঞ্জনদাকে বললাম। রঞ্জনদা একটু ভেবে বললেন, চলো তোমাকে একটা সাক্ষাৎকার করতে দিই। কার সাক্ষাৎকার নিতে চাও বলো। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘অপর্ণা সেন’। আমাদের প্রজন্মের আইকন। রঞ্জনদা সাক্ষাৎকারের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিলেন। প্রশ্নপত্র তৈরি করে নিলাম ওঁর সঙ্গে বসে। তারপর নির্ধারিত দিনে রওনা হলাম অপর্ণার আলিপুরের বাড়ির উদ্দেশে। যাবার আগে রঞ্জনদাকে ফোন করলাম। বললেন, আমি যেন সাক্ষাৎকারটি নিতে থাকি, উনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছবেন বিশেষ কিছু প্রশ্ন নিয়ে। মানে আমাকে কথাবার্তা চালাতে হবে একা, অন্তত এক ঘণ্টা! প্রশ্নের ঝুলিতে ছিল একটি বিশেষ প্রশ্ন, ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন-এর নন্দিতা কি আপনি নিজে?’ রঞ্জনদা বলে দিয়েছিল, এটা শেষের দিকে করতে।
পৌঁছলাম ওঁর ন’তলার ফ্ল্যাটে। দারুণ সাজানো বসার ঘর। এক দেওয়াল জুড়ে বইয়ের তাক, যার মাঝেমধ্যে কিছু কিউরিও, যার অধিকাংশই ভারতীয়, তবে বই সারা বিশ্বের। আর দরজার বাইরে ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর পোস্টার। বসার ঘরে বড় চোঙ-ওয়ালা গ্রামোফোন। কিছু নামী শিল্পীর পেন্টিং। এসব যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, তারই মধ্যে মুকুল শর্মা এসে বললেন একটু অপেক্ষা করতে, অপর্ণা স্নান করে আসছেন। সৌজন্যমূলক প্রশ্ন, চা বা কফি খাব কি না। মুকুল চলে যেতে, হঠাৎ একটি ছোট্ট মেয়ে, দু-তিন বছর বয়স হবে, ছুটে এল ঘরে। এসেই ঝপ করে বসে পড়ল। মাথায় একঢাল কোঁকড়া চুল। বড় দুটি উজ্জ্বল চোখ। পেছন পেছন এলেন মুকুল। ‘দ্যাটস আওয়ার ডটার কোকো, মানে কঙ্কনা।’ পরের মিনিট দশেক ওদের সঙ্গেই কেটে গেল। বাবা আর মেয়ে দু’জনেই আমার ভিতরকার নার্ভাসনেস অনেকটাই কাটিয়ে দিল। মুকুল খুব সহজে মিশতে পারত। কঙ্কনা ও মুকুলের কথার ফাঁকেই ওকে বলে দিলাম, কলেজে থাকতে ওর কথা শুনেছিলাম আমার বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড ‘অ্যাশ’ বা অশ্বিনীর কাছে। মুকুল বলল, ‘তোমরা নিশ্চয়ই তখন আমার আর রিনার সম্পর্ক নিয়ে গসিপ করতে?’ মিনিট দশেক ফুৎকারে কেটে গেল, আর তারপরই ঘরে ঢুকলেন অপর্ণা। সদ্যস্নাতা। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। মেকআপ-হীন মুখ, অন্তত আমার অনভিজ্ঞ চোখে কোনও প্রসাধনই দৃশ্যমান ছিল না। অথচ ত্বক উজ্জ্বল, চোখ বাঙ্ময়। পরেছেন একটি সাধারণ তাঁতের শাড়ি, হালকা গয়না, একেবারে নিজস্ব ট্রেডমার্ক সাজ। সেই আড়ম্বরহীন সাজের মধ্যে যেটা লক্ষ করেছিলাম: তাঁর চুলের সিঁথি। কপালে মাঝের সিঁথির কাছে চুলটা কেমন নেমে এসে একটি ত্রিকোণ তৈরি করত। এটা পুরোপুরি স্বাভাবিক। ইংরেজিতে এ ধরনের সিঁথিকে বলে ‘উইডোজ পিক’। কেন জানি না। অপর্ণার কপালে চুলের এই বৈশিষ্ট্য ওঁর পানপাতা কাটিং-এর মুখশ্রীকে আরও আকর্ষক করে তুলত। ওঁকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। উনি কঙ্কনা ও মুকুলকে বললেন, এখন সাক্ষাৎকার হবে, তাই ওরা যদি একটু অন্য ঘরে যায়। কঙ্কনা অল্প অনীহা দেখালেও, মুকুল ওকে কানে কানে কিছু বলায় ও চলে গেল। এরপর শুরু হল আমার পরীক্ষা।
অত বড় ব্যক্তিত্বের সামনে বসে গলা শুকিয়ে আসছিল। আমার কাছে টেপ রেকর্ডার ছিল না। উত্তরটা মাথায় রেকর্ড করছি ও কিছু কিছু কথা খাতায় তুলে রাখছি। তারই মধ্যে অপর্ণা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’ দেখেছি কি না। বললাম, হ্যাঁ। উনি তখন বললেন আমাদের রিহার্সালে আসার কথা। আরও কত জায়গায় উনি নায়িকার খোঁজ করেছেন। শেষমেশ দেবশ্রীকেই নিলেন, কারণ ওর মধ্যে উনি পেয়েছিলেন ওই ছবির নায়িকার সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য। তবে দেবশ্রীকে সাজিয়েছিলেন উনি নিজেই। সাজিয়েছিলেন যে নিজের প্রতিচ্ছবি করে, সেটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ওই ছবি নিয়ে অনেক আলোচনা হল। অপর্ণা কেন দেবশ্রীর জন্য নিজে ‘ডাব’ করেছিলেন। এও বললেন, উৎপল দত্তের কথায়ই তিনি রাজি হয়েছিলেন জেনিফার কেন্ডলকে নিতে। জেনিফারের তখন বয়স বেশি ছিল না, কিন্তু চরিত্রটা করার জন্য জেনিফার নিজেই নিজের লুক সেট করে দেখান অপর্ণাকে। অপর্ণার একটাই দুঃখ ছিল, উনি সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার জিতলেও, জেনিফারের সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় খেতাবটা পাওয়া হল না। যেহেতু রঞ্জনদা প্রশ্নটা লিখে দিয়েছিলেন, তাই দুরুদুরু বুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মহিলা পরিচালক হয়ে, ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর মতো সাহসী, মানে বোল্ড… মানে…’, অপর্ণা কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বললেন, পরিচালক একটি ছবির চিন্তক ও নিয়ন্ত্রক। তাঁর কোনও জেন্ডার নেই। পরিচালক নারী না পুরুষ, এ নিয়ে অত ভাববার কিছু নেই। আর পরিচালক যদি মনের দিক থেকে বিশ্বাস করেন যে এই দৃশ্যটি এমন হওয়া উচিত এবং তাঁর যদি নিজের মনে কোনও অস্বস্তি না থাকে, তাহলে সেই ‘বোল্ড’ সিন দৃশ্যায়নে কোনও অসুবিধা হবে না।
শেষ প্রশ্নের দিকে যাচ্ছি, তখনও রঞ্জনদা পৌঁছননি। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, এই ছবিটার মধ্যে কি আত্মজীবনীমূলক কিছু আছে? আপনিই কি নন্দিতা? এক সেকেন্ড নীরবতা, তারপর উত্তর, যে উত্তর উনি বার বার, বহুবার দিয়েছেন। গল্পটা ওঁর মস্তিষ্ক-প্রসূত। নিশ্চয়ই জীবন থেকে বেশ কিছু রসদ নেওয়া হয়েছিল ওঁর গল্পে, তবে চরিত্রগুলি সবই যে উনি চাক্ষুষ করেছেন তা নয়, আর সত্যের সঙ্গে কল্পনার মাধুরী মিশিয়েই তো তৈরি হয় যে কোনও ক্রিয়েটিভ কাজ। সেক্ষেত্রে নন্দিতা উনি নিজে কি না এ নিয়ে জল্পনা হলে হবে, তবে উনি এটাকে বায়োগ্রাফিকাল আখ্যা দিতে রাজি নন। (পরে ‘পরমা’ ছবি নিয়েও একই প্রশ্ন ওঠে। তারপর অবশ্য ধীরে ধীরে এই ধরনের প্রশ্ন কমে গেছে)।
সাক্ষাৎকার শেষ, আমার প্রশ্নের ঝুলি শেষ। কিন্তু রঞ্জনদা এসে পৌঁছননি। কী আর করি, পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলাম। অফিসে এসে দেখি, রঞ্জনদা। আমি তো অবাক। বললাম, আপনি এলেন না? আমি তো খুব নার্ভাস ছিলাম, কী বলতে কী বলব। নোটস নেব, না ওঁর কথা শুনব? ওঁকে দেখব, না লিখব? লিখতে গিয়ে কিছু কথা হারিয়ে যাচ্ছিল, আপনি এলেন না… রঞ্জনদা শুধু মুচকি হেসে বললেন, ‘এবার ইন্টারভিউটা লিখে ফ্যালো, আমি বাংলাটা ঠিক করে দেব। একজন সাংবাদিককে চোখ, কান, নাক খুলে, খেতে খেতেও লিখতে হয়, মনের রেকর্ডার চালু রাখতে হয়।’ অপর্ণা সেনের সেই সাক্ষাৎকার ছিল আমার সাংবাদিক হওয়ার অন্যতম পদক্ষেপ। আর ওঁর সঙ্গে আলাপেরও শুরু।