২৭ এপ্রিল, ২০২৫। লিভারপুলের অ্যানফিল্ড স্টেডিয়াম ফেটে পড়েছে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে। মাঠের একপ্রান্তে জড়ো হয়েছেন লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের বর্তমান খেলোয়াড়রা, হেড কোচ আর্নে স্লট এবং দলের বিভিন্ন বিভাগের সহকারীরা। তাঁদের মুখ গ্যালারির অগুনতি সমর্থকদের দিকে। একটু দূরত্বেই, গ্যালারি থেকে প্রিয় দলকে অভিবাদন জানাচ্ছেন সমর্থকেরা। এর পরেই সেই মুহূর্ত। সকলে সমবেতভাবে গেয়ে উঠছেন ক্লাবের অ্যান্থেম— ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’। ২০তম লিগ বিজয়ের উৎসব মিলিয়ে দিচ্ছে সমর্থক, খেলোয়াড় এবং হেড কোচকে। তবে এ-ছবি নতুন নয়।
লিভারপুলের কিংবদন্তি প্রশিক্ষক বিল শ্যাঙ্কলি বলতেন, ফুটবলের ‘হোলি ট্রিনিটি’-র কথা। শুধুমাত্র সমর্থক, খেলোয়াড় এবং প্রশিক্ষকদের মধ্যেই এক পবিত্র সহাবস্থান সম্ভব। দলের মালিকের সেখানে কোনও স্থান নেই, কর্তাদের কাজ কেবলই চেকে সই করা। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী শ্যাঙ্কলি চাইতেন, দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে শ্রমিক সমর্থকদের যেন দূরত্ব না থাকে, মাঠের ভেতরের খেলোয়াড়দের থেকে মাঠের বাইরে প্রিয় দলের সমর্থনে গলা ফাটানো জনতার আর্থিক বৈষম্য যেন প্রকট না হয়। বস্তুত, এখনকার তুলনায় গত শতাব্দীর ছয় কিংবা সাতের দশকেও উপার্জনের অঙ্কে এত বিশাল পার্থক্য ছিল না। দলের তারকা খেলোয়াড়রা প্রায়শই ঘুরে বেড়াতেন শহরের মধ্যে, সমর্থকদের ভিড়েও দেখা যেত তাঁদের। শ্যাঙ্কলি ফিরতেন সমর্থকদের ঘাড়ে চড়ে, টিকিট জোগাড় করে বিলিয়েও দিতেন তাদের মধ্যে।
মার্গারেট থ্যাচারের জমানা থেকেই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল। বিশ্বায়নের আলিঙ্গনে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটল। শুধু যে বেতনের দিক থেকে পেশাদারি খেলোয়াড় কিংবা প্রশিক্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেন, তাই নয়, নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে থাকা ফুটবলাররা তখন থেকেই অনেক দূর আকাশের তারকা। আর ক্লাব নিয়ন্ত্রণে প্রধান ভূমিকা রইল ধনকুবের মালিকের বা কর্তাদের।
আরও পড়ুন : মধ্যবিত্তর হয়ে ব্যাট ধরেছিলেন বিরাট! লিখছেন স্বস্তিক চৌধুরী…
শ্যাঙ্কলির কোচিংয়ের প্রথম দিকেই লিভারপুলের সঙ্গে জুড়ে যায় ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’। অস্কার হ্যামারস্টাইন দ্য সেকেন্ড এবং রিচার্ড রজার্সের তৈরি করা এই গান ১৯৪৫-এ আমেরিকায় প্রকাশ পায়। এরপরে বিভিন্ন দেশেই এই গান কভার করতে থাকেন বিভিন্ন শিল্পীরা।
পাঁচের দশকের শেষ দিক থেকে লিভারপুল শহরে মার্সিবিটের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। ১৯৫৯ সালে ‘গেরি অ্যান্ড পেসমেকারস’ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৩-তে রেকর্ড করলে তাদের কণ্ঠে এই গান প্রবল জনপ্রিয় হয়। শোনা যায়, শ্যাঙ্কলির হাতে এই রেকর্ড এসে পৌঁছলে তিনি আপ্লুত হন। অচিরেই ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’ হয়ে ওঠে লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের গান। ঠিক কোন ম্যাচ থেকে লিভারপুল ক্লাব এই গানকে গ্রহণ করে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, ১৯৬৫ সালে এফএ কাপ ফাইনালে স্টেডিয়ামে সমর্থকদের কণ্ঠে এই গান শোনা যায়, যার রেকর্ডিং মেলে।
এর পর থেকে লিভারপুলের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থেকেছে এ গান। ১৯৮৯ সালে হিলসবোরো স্টেডিয়ামের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৯৭ জন সমর্থকের মৃত্যু ঘটে, ঠিকঠাক তদন্ত না করেই প্রাথমিকভাবে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় সমর্থকদের ওপরেই। নিহত-আহতদের পরিবার এবং লিভারপুল সমর্থকরা ন্যায়বিচার চেয়ে আন্দোলন গড়ে তুললে এই গান এক নতুন মাত্রা পায়। তেমনই ২০০৫ সালে ‘মিরাকল অফ ইস্তানবুল’-এর সঙ্গেও জুড়ে যায় এই গান। সেবার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে প্রবল শক্তিশালী এসি মিলানের বিপক্ষে লিভারপুল হাফটাইমেই পিছিয়ে ০-৩ গোলে, দৃশ্যত বিপর্যস্ত, মনোবল তলানিতে। অথচ বিরতিতে গ্যালারি থেকে প্রায় গর্জনের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই গান, সমর্থকদের মুখে মুখে। সমস্ত অসম্ভবকে সম্ভব করে সেই ম্যাচ জিতিয়ে আনেন অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড ও তাঁর সতীর্থরা। তৈরি হয় এক আশ্চর্য রূপকথা। নেপথ্যে এই গানের প্রভাব, বারবার স্বীকার করেছেন খেলোয়াড়রাও।
শ্যাঙ্কলির জমানা পেরিয়ে বব পেইজলির অবিস্মরণীয় অধ্যায়, তারপর জো ফাগান এবং কেনি ড্যাগলিশ— লিভারপুলের বিজয়রথ চলতেই থাকে, তারাই তখন ইংল্যান্ডের অবিসংবাদী রাজা, রেকর্ড ১৮টা লিগের মালিক তারা। ফলে, কেউ-ই ভাবতে পারেনি, ১৯৯০-এর পর থেকে এই ক্লাবের ভাগ্যে থাকবে শুধুই হতাশা। ১৯৯২-এ প্রিমিয়ারশিপ চালু হওয়ার পরে, লিগ কাঠামোয় বদল আসে। ধীরে ধীরে পরবর্তী এক দশকের মধ্যেই বিবিধ বাণিজ্যিক চুক্তি ও টেলিভিশন স্বত্বের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ডের লিগ ফুটবল— বিশ্বায়িত ও মিডিয়াচুম্বিত ইংলিশ ফুটবলের নতুন সেই সংস্করণে পোস্টার বয় হয়ে ওঠে স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। তাঁর অধীনেই এই পর্বে ১৩টা লিগ খেতাব আসে রেড ডেভিলস-দের দখলে, তৈরি হয় এক অনন্য নজির। বাণিজ্যিক ধারাবাহিকতায়ও বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে অনেক বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে তাদের সাফল্য।
২০০২ সালে এক ইন্টারভিউতে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন জানিয়েছিলেন, তাঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল চির-প্রতিদ্বন্দী লিভারপুলকে তাদের শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে দেওয়া। কথাটা বলার সময় ‘দ্য রেডস’-দের ন্যূনতম রেয়াত করেননি তিনি, রীতিমতো দম্ভের সঙ্গেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন কথাটা ছাপাতে।
কথাটা সত্যি হতেও বেশি সময় লাগেনি। ২০১১-তে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে লিভারপুলের ১৮টা লিগ খেতাবকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। আর ঠিক দু’বছর পরেই ২০তম শিরোপা আসে ‘রেড ডেভিলস’-দের ঘরে। ইউরোপীয় ট্রফিতে লিভারপুল এগিয়ে থাকলেও ঘরোয়া লিগের গুরুত্ব ইংল্যান্ডে অন্যরকম; ফলে, ইংল্যান্ডের সেরা ক্লাবের তাজ কার্যত চলে যায় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের দখলেই। লিভারপুল সমর্থকদের সঙ্গী তখন শুধুই হতাশা আর অবিশ্বাস। তাদের প্রিয় গানের সোনালি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন যেন শুধুই এক অলীক কল্পনা। অন্ধকার দিনের কোনও শেষ নেই।
ফার্গুসন প্রশিক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর দু’বছরের মধ্যে লিভারপুল ম্যানেজার হিসেবে নিয়ে এল ইউর্গেন ক্লপকে। নব্বইয়ের পর থেকে ২০১৫ অবধি লিভারপুলের ভাগ্যে বড় ট্রফি বলতে একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, একটা উয়েফা কাপ আর গোটা কয়েক এফএ কাপ। লিগ অধরা বহু বছর, হাতের কাছে এসেও ফসকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে কয়েকবার। ক্লপ এসেই অঙ্গীকার করলেন, চার বছরের মধ্যে একটা বড় ট্রফি দেওয়ার। শুধু তাই নয়, সমর্থকদের উদ্দেশে বার্তা দিলেন সংশয়ী থেকে বিশ্বাসী হয়ে ওঠার।
পাল্টে গেল লিভারপুল। ২০১৯-এ ফের ঘরে এল ইউরোপ-সেরার সম্মান। আর ঠিক পরের বছর বহু-প্রতীক্ষিত প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু একটা অপ্রাপ্তি রয়ে গেল। কোভিড মহামারীর পর্বে দর্শকশূন্য স্টেডিয়ামে জয় উদযাপন করেই ক্ষান্ত থাকতে হল লিভারপুলকে। এই পাল্টে যাওয়া লিভারপুলের সঙ্গেও কিন্তু জড়িয়ে রইল ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’। ক্লপ দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিয়নের সঙ্গে এক খেলায় অ্যানফিল্ডে একেবারে শেষ মুহূর্তে সমতা ফেরাল লিভারপুল। ম্যাচ না জিতলেও ক্লপ এবং খেলোয়াড়রা সকলে গিয়ে দর্শকদের আলাদা করে অভিবাদন জানালেন, ‘দ্য কপস’-এর কণ্ঠে তখন সেই গান। সম্ভবত সেই ম্যাচ থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে ক্লপ খেলোয়াড়দের সঙ্গে জুড়ে নিলেন প্রিয় সমর্থকদের। তেমনই ২০১৯-এ উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সেমিফাইনালের প্রথম পর্বে লিওনেল মেসির বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ০-৩ গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় পর্বে যখন লিভারপুল ঘরের মাঠে খেলতে নামল, তখন দলের অন্যতম প্রধান তারকা ফুটবলার মহম্মদ সালাহ চোটের কারণে মাঠের বাইরে। সেই ম্যাচ ৪-০ গোলে জিতে ফাইনালে উঠল লিভারপুল, দর্শকদের চিৎকার ও গানে গানে যে প্রভাব তৈরি হল অ্যানফিল্ড জুড়ে— তাতে বার্সেলোনা খানিক হতোদ্যম হয়ে গেল।
ক্লাবের পরিবেশ বদলে দিলেও ক্লপের সময়ও মাত্র একটাই লিগ এল ঝুলিতে। ১৯তম লিগ বিজয়ের আগে ও পরে মোট দু’বার মাত্র এক পয়েন্ট পিছনে থেকে লিভারপুল লিগ হারাল প্রবল শক্তিশালী ম্যাঞ্চেস্টার সিটির কাছে। তবে এর মধ্যে ইতিহাসের চাকা খানিকটা হলেও ঘুরে গেছে। ফার্গুসন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর থেকে কার্যত পতন শুরু হয়েছে তাদের। আর ততদিনে ইংল্যান্ডের ফুটবলে পরাক্রম দেখিয়ে উঠে এসেছে একই শহরের অন্য দল, সাম্প্রতিক অতীতে ধারাবাহিকতায় ‘সিটিজেনস’-রা পিছনে ফেলে দিয়েছে ‘রেড ডেভিলস’-দের। অন্যদিকে ক্লপের জমানায় ইউনাইটেডকে বেশ কয়েকবার হারালেও শেষ অবধি ২০তম লিগ খেতাব আসেনি। ক্লপ হঠাৎ করেই লিভারপুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানালেন ২০২৪-এ। পাল্টে যাওয়া লিভারপুলের জন্য রেখে গেলেন এক প্রতিশ্রুতিমান ভবিষ্যৎ। দায়িত্বে এলেন ডাচ কোচ আর্নে স্লট।
স্লটের প্রশিক্ষণে লিভারপুল যখন নতুন মরশুম শুরু করল, ফুটবল-বিশেষজ্ঞরা লিগ খেতাবের লড়াইয়ে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের তালিকায় লিভারপুলকে খুব একটা এগিয়ে রাখেননি। ২০২৩-’২৪ মরশুমে আর্সেনাল ভাল খেলে জায়গা করে নিয়েছে ক্লপের লিভারপুলের ওপরে। সেই সঙ্গে নতুন মরশুমে লিভারপুল একজন বাদে নতুন কোনও খেলোয়াড়কে দলে না নেওয়ায় বিশেষজ্ঞ এবং সমর্থকদের মধ্যেও দলের ভাল পারফরম্যান্স হওয়ার ব্যাপারে সংশয় ছিল। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে স্লটের লিভারপুল অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলল। ৩৮ ম্যাচের লম্বা লিগে চার ম্যাচ বাকি থাকতেই জয় নিশ্চিত হল। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের সঙ্গে সেই মুহূর্তে পয়েন্টের পার্থক্য ছিল ১৫। মহম্মদ সালাহ, ভ্যান ডাইক, অ্যালিসনদের ধারাবাহিকতা আর হার না-মানা জেদের কাছেই হয়তো পিছিয়ে পড়ল বাকিরা।
অনুশীলন থেকে বেরনোর সময়, বিভিন্ন ইভেন্টে কিংবা ক্লাব বা বাণিজ্যিক সংস্থার উদ্যোগে তৈরি ভিডিও শুটের বাইরে সমর্থকদের ভিড়ে তারকাদের দেখা পাওয়ার দিন এখন শুধুই অতীতের নস্ট্যালজিয়া। সামাজিক মাধ্যমে বরং দূর থেকে একধরনের আদানপ্রদানের সম্ভাবনা আছে। মাঠে আসা সমর্থকদের মধ্যেও শ্রেণি-চরিত্রের বিপুল পার্থক্য ঘটে গেছে।
লিগ বিজয়ের ম্যাচের আগে লিভারপুল শহরের ছবিটাই ছিল অন্যরকম। কাতারে কাতারে মানুষ প্রিয় দলের বাসের প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান। ২০২০ সালে দীর্ঘ ৩০ বছর পরে লিগ এলেও সেবার বাঁধনছাড়া উচ্ছ্বাসে মাতা যায়নি। এবার সময় এসেছে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের কাছে হারানো শীর্ষস্থান পুনর্দখলের। ‘দ্য রেডস’-দের লিগ বিজয় দেখার উদ্দীপনায় সারা শহর লালে লাল। প্রতিপক্ষ টটেনহ্যাম হটস্পার্সের বিরুদ্ধে শুরুতে ১ গোলে পিছিয়ে পড়লেও ম্যাচে জয় এল ৫-১ গোলে।
ম্যাচের কিছুদিন পরে জানা গেল এক চমকপ্রদ তথ্য। মিডফিল্ডার আলেক্সিস ম্যাকঅ্যালিস্টার যখন ২-১ গোলে এগিয়ে দেন লিভারপুলকে, সেই সময়ে মাঠের সমর্থকদের উত্তেজনার প্রভাবে দেখা যায় রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ১.৭৪, যা ছোটখাটো ভুমিকম্পের তুলনায় সামান্য কম! মাঠে উপস্থিত লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ল এই মাত্রা। ইংলিশ ফুটবলের শীর্ষস্থানে লিভারপুলের ফিরে আসার দিনে এমন কম্পন ঘটা কিছুটা যেন প্রত্যাশিতই।
প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে পাল্টে যাওয়া দুনিয়ায় লিভারপুলের দায়িত্ব নিয়ে ক্লপ শুরুটা করেছিলেন খানিক বিল শ্যাঙ্কলির ঢংয়েই। সমর্থক, প্রশিক্ষক এবং ফুটবলারদের মধ্যে বিশ্বাসের সেতু গড়ে তুলে।
তবে গোটা ব্যাপারটা তো আর একেবারেই আগের মতো নেই। অনুশীলন থেকে বেরনোর সময়, বিভিন্ন ইভেন্টে কিংবা ক্লাব বা বাণিজ্যিক সংস্থার উদ্যোগে তৈরি ভিডিও শুটের বাইরে সমর্থকদের ভিড়ে তারকাদের দেখা পাওয়ার দিন এখন শুধুই অতীতের নস্ট্যালজিয়া। সামাজিক মাধ্যমে বরং দূর থেকে একধরনের আদানপ্রদানের সম্ভাবনা আছে। মাঠে আসা সমর্থকদের মধ্যেও শ্রেণি-চরিত্রের বিপুল পার্থক্য ঘটে গেছে। এর মাঝে শুধু উজ্জ্বল হয়ে টিকে আছে একটাই গান। ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’। খানিকটা আবহমান ফুটবল-আচারের অংশ হিসেবে, খানিকটা সমষ্টিগত প্রেরণা জাগানো সংগীত হিসেবে এই গানের আবেশ ছড়িয়ে পড়ে লিভারপুলের খেলা থাকলেই। বিশেষ করে, ঘরের মাঠ অ্যানফিল্ডে। মাঝের দীর্ঘ হতাশার সময় পেরিয়ে আসা যেন গানে বর্ণিত ঝড়-বৃষ্টি-দুর্যোগের আঁধারের রাত অতিক্রম করার মতোই।
আজ ইংল্যান্ডের ফুটবলের তাজ ফিরে পেয়ে সোনালি আকাশের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল আগামীর স্বপ্নে বিভোর হতেই পারেন লিভারপুল সমর্থকরা। শ্যাঙ্কলি চলে যাওয়ার পরে বব পেইজলি দায়িত্ব নিয়ে লিভারপুলকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। ক্লপ চলে যাওয়ার পরে স্লট সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন কি না, তা সময়ই বলবে। তবে, এই যাত্রাতেও সকলে মিলে একসঙ্গে পথচলা যে থাকবেই— সে বিষয়ে সংশয়ের কোনও জায়গা নেই। লিভারপুলের এই কালজয়ী অ্যান্থেম-এর সূত্র ধরেই কেউ কখনও একা হাঁটবে না, এই প্রত্যয় নিয়েই সমর্থকরা স্বপ্ন দেখবেন নতুন দিনের।