ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বারীনকাকুর বউ-আন্টি

    দেব রায় (May 18, 2025)
     

    আমরা কোয়ার্টারে ওরকমই বলতাম। ইস্কুল লাগোয়া টিচার্স কোয়ার্টার। বিকেলে আমাকে আর দাদাকে চুল আঁচড়ে, কাজল পরিয়ে, আঙুল কামড়ে, থুতকুড়ি দিয়ে মা বেরতে দিত। দাদাটা বোকা, গাল ট্যাবা মতো ফোলা, দাঁত ফোকলা। আমি ফর্সা বলে সবাই গালটিপে আদর করত, আমি হাত দিয়ে আদর মুছে ফেলতাম। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে দাদা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকত। আমি টকাটক উত্তর দিতাম। সবাই বলাবলি করত, তপনবাবুর ছোটছেলের কী বুদ্ধি!

    আমরা পুকুরে রাজহাঁস দেখতাম, ফজুচাচা ফুলের বাগান করছে দেখতাম। তারপর সন্ধ্যে নামার আগেই, মিনতবাবু সাইকেল করে টিউশন বেরোলে বাড়ি ফিরে আসতাম। বাড়ি ফিরলে, মা হাত-পা ধুইয়ে জামাপ্যান্ট চেঞ্জ করিয়ে ঠাকুর নমো করতে বলত; আমরা নমো করতাম ক্যালেন্ডারের ছবির সামনে। মা শিখিয়ে দিয়েছিল, নমো করার সময় বলতে, হে ঠাকুর! সেজো-পিসির যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়। সেজো-পিসি আমাদের সঙ্গেই থাকত। সন্ধ্যেবেলায় মায়ের সঙ্গে কয়লার উনুনে রুটি বানাত, তরকারি কুটত। বেশিরভাগ সময় সেজো-পিসির মুড ভাল থাকত না। তখন বাড়ির কেউ তাকে ঘাঁটাত না। শুধু আমি ডট-পেন দিয়ে গোঁফ এঁকে দিলে রাগ করত না। মুড ভাল থাকলে সেজো-পিসি, ‘বুঝবে না, কেউ বুঝবে না এ মনের ব্যাথা’ গাইত। নাক থ্যাবড়া আর দাঁত উঁচু বলে সেজপিসির বিয়ে হচ্ছে না। 

    পড়ুন অরুণ করের গল্প, ‘জহুরি’…

    এরমধ্যে কোয়ার্টারের বাইরে ‘নররাক্ষস’ এল। আমাদের দেখতে দেওয়া হল না। সে নাকি জ্যান্ত মুরগি কচকচিয়ে খেয়েছে। ‘কী তামাশা দেখা গেল, সায়রা বানু চলে এল, ক্ষুদিরামের ফাঁসি হল, কুতুব মিনার চলে এল’, ঘুঙুর বাজিয়ে গান গেয়ে বায়োস্কোপ এল। আমাদের দেখতে দেওয়া হল না। আমরা কোয়ার্টারের দেওয়ালের খোপ-খোপ ফাঁক দিয়ে দেখলাম শম্ভু কল্পনারা দেখছে ‘রয়্যাল বেঙ্গল চলে এল কী তামাশা দেখা গেল’। 

    এত সব দুঃখের মাঝে সেজপিসির বিয়ে ঠিক হল। যে-লোকটা পিসেমশাই হবে, গুঁফো মতো; কলকাতার কোনও বড় ওষুধের দোকানে চাকরি করে। মা বলল, ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। বিয়ের রাতে আমার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল, মা মাছভাজা দিয়ে ভাত খাইয়ে দিয়েছিল। দাদা জেগেছিল অনেক রাত অবধি। আমাকে বলল, বরযাত্রী মেয়েগুলো সিগারেট খাচ্ছিল লুকিয়ে।

    মাঝে কোয়ার্টারের সরস্বতী পুজোতে আমি ‘সৎ পাত্র’ বলে সবার তাক লাগিয়ে দিলাম। মলিনাদিদি যেমন শিখিয়েছে, তেমন ভাবে হাত নাড়িয়ে গলা দুলিয়ে বলেছি। হাততালি দিল সবাই খুব। স্টেজ থেকে নামতে আদর আর থামেনা। গাল টেপা, চুমু খাওয়া। কত আর আদর মোছা যায়। দাদা ‘প্রশ্ন’ বলতে গিয়ে তিন জায়গায় হোঁচট খেয়েছে, ‘ব্যর্থ নমস্কারে’ হাত তুলে নমো করতে ভুলে গিয়েছে। বাড়িতে ফিরে মা সব বলতে বাবা গম্ভীর মুখে কাগজ পড়ছিল, আমাকে দেখে হাসি মুখে তাকিয়ে বলল, গুড বয়। দাদাকে বলল, পারিস না, নাম দিতে যাস কেন? আমি ‘হাসির অ্যাটম বম্ব’ নিয়ে শুতে গেলাম। আজ আর রাত জেগে বই পড়লে কেউ বকবে না।

    পরেরদিন বিকেলে বেরিয়েছি, দেখছি দোতলা কোয়ার্টারের ব্যালকনি থেকে বারীনকাকুর বউ-আন্টি ডাকছে।

    বারীনকাকু নতুন এসেছে, উঁচু ক্লাসের অঙ্ক পড়ায়; আমি আর দাদা গুটি-গুটি গেলাম। আমাদের দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে খুব মিষ্টি করে কথা বলল।

    কোন ক্লাসে পড়ি, বাবার নাম কী। আমার আবৃত্তির খুব প্রশংসা করল। দাদাকে আবার বলে, তুমি লজ্জা পেও না। চেষ্টা করছ, এটাই বড় ব্যাপার।

    ঠাকুর কী বুঝল, কে জানে, কিছুদিন পরে বাবা গিয়ে সেজপিসিকে নিয়ে এল। থ্যাবড়া নাকে ব্যান্ডেজ আর উঁচু দাঁত দুটো ফোকলা। শুনলাম এখন থেকে সেজপিসি আবার আমাদের সঙ্গে থাকবে। ওই লোকটার কার সঙ্গে নাকি ‘লাভ ম্যানেজ’ আছে। সেটা কি না বুঝলেও লোকটা যে ভাল না, বুঝতে পারলাম। সেজপিসি এবার আমাদের নিয়ে পড়ল। চান করানো, খাওয়ানো, ইস্কুলের জন্য রেডি করা। মা যেন কেমন তটস্থ হয়ে থাকত। 

    আমার পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু এত ভাল কেক আর সন্দেশ এল তারপর, আমি রাগ করতে পারলাম না। কী সুন্দর করে শাড়ি পরেছে এই নতুন আন্টি। মা, সেজপিসি যাকে ড্রেস দিয়ে পরা বলে। ঘরে আবার একটা গিটার আছে। আমি গিটার চিনি। উত্তরপাড়ার টাবলুমামা বাজায়।

    বাড়ি ফিরতে মা সব শুনে বলল, টাউনের মেয়ে। একটু দেমাকি। বিএ পাস বলে।

    আমরা হাত-পা ধুয়ে, ঠাকুর নমো করে পড়তে বসলাম। দাদা বলল, বয়ামে নাড়ু ছিল, দিতে পারত। আমি দাদার দিকে তাকালাম। দাদা বুঝল, আমি লোভিস্টি বলছি। চোখ ফিরিয়ে নিল।

    আমরা প্রায় বিকেলেই বারীনকাকুর বউ-আন্টির ডাকে দোতলার ঘরে যেতাম। আন্টি নিজের হাতে পুডিং, মিষ্টি-মিষ্টি ভেজিটেবল চপ বানিয়ে খাওয়াত। 

    মাঝে-মাঝে সন্ধেবেলা ফিরলে, মা আমাকে বলত সন্ধ্যা দিতে। আমি চটপট হাত-পা ধুয়ে ছালের কাপড় পরে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে, ধূপকাঠি জ্বালিয়ে শাঁখ বাজাতাম। দাদারও খুব ইচ্ছে শাঁখ বাজানোর। কিন্তু ও নাকি থুতু লাগিয়ে দেয়, তাই মা দাদাকে দেয় না। এরকম একদিন সন্ধ্যা দিয়ে মাকে বললাম, মা আমি না এখনও ভুল করে নমো করার সময় বলি ‘সেজপিসির বিয়ে হোক’। শুনে মা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল, খবরদার অলুক্ষুণে কথা মুখে আনবি না।

    ঠাকুর কী বুঝল, কে জানে, কিছুদিন পরে বাবা গিয়ে সেজপিসিকে নিয়ে এল। থ্যাবড়া নাকে ব্যান্ডেজ আর উঁচু দাঁত দুটো ফোকলা। শুনলাম এখন থেকে সেজপিসি আবার আমাদের সঙ্গে থাকবে। ওই লোকটার কার সঙ্গে নাকি ‘লাভ ম্যানেজ’ আছে। সেটা কি না বুঝলেও লোকটা যে ভাল না, বুঝতে পারলাম। সেজপিসি এবার আমাদের নিয়ে পড়ল। চান করানো, খাওয়ানো, ইস্কুলের জন্য রেডি করা। মা যেন কেমন তটস্থ হয়ে থাকত। 

    নতুন ক্লাসে উঠে আমার নীল রঙের একটা খুব সুন্দর সোয়েটার হল। বুকের কাছে খরগোশের ছবি দেওয়া। দাদারটা হলুদ রঙের, বুকে পালতোলা নৌকা। 

    নতুন সোয়েটার পরে যেদিন বেরলাম, বিকেলে আমাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। আন্টিরা, মলিনাদিদি, বাবলিদিদিরা। কেউ বলে রাজপুত্র, কেউ বলে সাহেবের বাচ্চা। দাদা গোঁজ মুখে আমার পিছু-পিছু হাঁটল। বারীনকাকুর বউ-আন্টির ওখানে লুচি-পায়েস হয়েছিল। দাদা দু’বার পায়েস নিল, পাঁচটা লুচি খেল। আমি তাকাতে চোখ ঘুরিয়ে নিল। বাড়ি ফিরে বুঝবে মজা। 

    রাতে খেয়ে উঠে বিছানায় লুকিয়ে ‘হানাগড়ের বিভীষিকা’ নিয়ে শুয়েছি, ওমনি দাদা উঠে বমি শুরু করল। অত লুচি-পায়েস খেয়ে তারপর রুটি, পেঁপে, আলু-কুমড়োর তরকারি, দুধ-কলা— সহ্য হয়?

    মা বাথরুমে দাদার দুই রগে হাত দিয়ে ধরে আছে। দাদা হড়হড় করে বমি করছে। আমি ওদিকে গেলাম না বাবা। তার মধ্যে শুনলাম বাবা দাদার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, হা-ঘরে একটা। হিসেব বুঝে খেতে পারিস না? আমি দেখি সেজপিসির চোখ জ্বলছে। বলল, বারীন মাস্টারের বউ বাঁজা মাগি, অনেক বছর বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয় না। নির্ঘাত বুবুল-টুটুলকে খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তুক করতে চাইছে! মায়ের মুখ ফ্যাকাশে। আমি ভাবলাম, সে তো আমিও খেয়েছি ওখানে। আমার তো কিছু হয়নি। কিন্তু চারপাশের অবস্থা দেখে কথা বাড়ালাম না। নাবিক হয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করার কথা ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

    জানি যাব না, তবু ওই কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে রোজ হেঁটে যেতাম। আর অপেক্ষা করতাম কখন ডাকবে। কীরকম একটা মজার খেলা ছিল। ডাকবে, যাব না। কিন্তু ডাকের অপেক্ষা করব। তারপর একদিন ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেল। আন্টি কিছু টের পেয়েছিল বোধহয়। তবুও আমরা দু’জনে ওখান দিয়ে বিকেলবেলায় হাঁটতাম। যদি ডাকে, এই আশায়।

    পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই দুধ-বাতাসা, ধূপকাঠি নিয়ে মা আর সেজপিসি দাদাকে নিয়ে রিক্সায় ছুটল পীরের থানে। জাগ্রত পীর। বাবা জিজ্ঞেস করল, তুই নিজে-নিজে রেডি হয়ে ইস্কুল যেতে পারবি? আমি নিজে স্নান করে চুল আঁচড়ে দুধ মুড়ি খেয়ে ইস্কুল চলে গেলাম। আজ শনিবার, হাফ ছুটি। 

    ফিরে দেখি, দাদার গলায় মাদুলি, হাতে তাবিজ বাঁধা। মাথায় কালো টিপ। তিন-দিন মোছা বারণ। আমার জন্যও একটা মাদুলি এনে মা মিন-মিন করে পরতে বলছিল, আমি বললাম, পরব না। সেজো-পিসি বলল, এখন থেকে বারীন মাস্টারের বউয়ের কাছে যাওয়া নিষেধ। আমার বয়ে গেছে। দাদা দেখি জুলজুল করে তাকিয়ে তাকিয়ে বোর্নভিটা খাচ্ছে। পীরের থান থেকে বলেছে দাদার নাকি রক্ত কমে গেছে।

    এরপর বিকেলে আমরা কম্পাউন্ডে বেরলে বারীনকাকুর দোতলার কোয়ার্টারের সামনে এলেই সাবধান হয়ে যেতাম। ওপর থেকে আন্টি ডাকত, কী বুবুল-টুটুল, ওপরে এসো। কেক বানিয়েছি তোমাদের জন্য। আমি ঘাড় গোঁজ করে ফিসফিসিয়ে বলতাম, দাদা ওপরে তাকাবি না। রক্ত চুষে নেবে কিন্তু।

    জানি যাব না, তবু ওই কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে রোজ হেঁটে যেতাম। আর অপেক্ষা করতাম কখন ডাকবে। কীরকম একটা মজার খেলা ছিল। ডাকবে, যাব না। কিন্তু ডাকের অপেক্ষা করব। তারপর একদিন ডাকাডাকি বন্ধ হয়ে গেল। আন্টি কিছু টের পেয়েছিল বোধহয়। তবুও আমরা দু’জনে ওখান দিয়ে বিকেলবেলায় হাঁটতাম। যদি ডাকে, এই আশায়।

    তারপর একদিন সকালে পুলিশ এল। সাদা-কাপড় ঢেকে বারীনকাকুর বউ-আন্টিকে নিয়ে গেল। মাকে বললে, মা বলল, দুষ্টু করেছিল, তাই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সন্ধেবেলা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে গিয়ে মা ঘন-ঘন ‘ঠাকুর, মঙ্গল করো’ বলে হাত জোড় করছিল। 

    সামনে সামার ভ্যাকেশন। এখন মর্নিং স্কুল। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আমি আর দাদা চোরকাঁটা ভরা একটা শর্টকাট ধরেছি, খেয়াল নেই বারীনকাকুর দোতলার কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। যদিও আন্টিকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বারীনকাকু চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। কোয়ার্টার বন্ধ থাকে।

    ওখান দিয়ে যেতে গিয়ে দাদা ঘড়ঘড় করে কী একটা বলল।

    ভাল করে শুনি বলছে, দোতলার বারান্দায় বারীনকাকুর বউ-আন্টি ডাকছে।

    বোকা কোথাকার! আন্টি কোথা থেকে আসবে? দুষ্টু করেছিল বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, মা বলেছে। তাও দাদা গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমি পষ্ট দেখেছি। মাইরি! অন্য সময় ‘মাইরি’ বললে মা বলেছে ঠোঁটে চিমটি কাটতে হয়। না হলে মা মরে যায়। কিন্তু এখন দাদাকে সামলানো দায়। সে দোতলার কোয়ার্টারে যাবে। 

    বাড়িতে হুলুস্থুল লেগে গেল। ওঝা-তান্ত্রিক-হরিনাম। মান্য চাঁড়াল এল চণ্ডাল হাড় চালিয়ে দোষ কাটাবে। এরপর দাদা দিনকে-দিন রোগা, কোলকুঁজো, হাবা মতো হয়ে গেল। সারা গায়ে কবচ তাবিজ-মাদুলি, শিকড়-বাকর। সেজপিসির শুচিবাই বেড়ে গেল মারাত্মক।

    আমি বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ভাল রেজাল্ট করে শহরের বড় স্কুলে পড়তে চলে এলাম হোস্টেলে। এরপর দাদা বা বারীনকাকুর বউ-আন্টির কথা ভাবার আর ফুরসত হয়নি আমার।

    অলংকরণ: সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook