তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার নিচু স্তরের কর্মীরা উবার শাটলে অফিস যান।ম্যানেজার, সিনিয়র ম্যানেজার, ডিরেক্টরদের নিজস্ব গাড়ি থাকে। কর্পোরেট হায়ারার্কির ওপরের সারির দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য প্রতিদিনের মতো বুধবারও অফিসে যান। প্রায় সকলেরই মতে, তিনি নাকি সকাল থেকেই স্বাভাবিকই ছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার চমৎকার বিল্ডিংগুলির অন্তরমহলে কারও হঠাৎ দু’কলি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ইচ্ছা করলে তিনি সহকর্মী এবং বসকে তোয়াক্কা না করে প্রাণ খুলে গেয়ে উঠবেন, মিহি স্বরে হলেও এমনটা কিন্তু কর্পোরেট এথিক্স এবং ওয়ার্ক কালচারে স্বাভাবিক বোঝায় না। স্বাভাবিক মানে ঘড়ির কাঁটা ধরে মিটিং, ত্রুটিহীন ডেলিভারি। সময়মতো সমস্ত ইমেল-এর উত্তর, বেস্ট প্র্যাকটিসের প্রতি নতজানু হওয়া। এবং ২০২৫ সালে হেলথ কেয়ার থেকে রিটেইল, ব্যাঙ্কিং থেকে ইনশিওরেন্স, মূলত ইউরো-মার্কিন ক্লায়েন্টদের খুশি করাই হল ‘গ্লোরিফায়েড স্লেভ’-দের জীবনের আসল সময়টুকুর সদ্ব্যবহার, সহজ স্বাভাবিকতা। হায়ারার্কির ওপরের সারিতে থাকলে খুশি করার এই প্যারামিটারগুলি ‘স্বাভাবিক’-এর তুলনায় অনেকটাই বেশি। অতএব এই যুক্তিতে দ্বৈপায়ন স্বাভাবিকই ছিলেন। দুপুরে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি মধ্যাহ্নভোজও সারেন।
কোভিড এবং তারপরেই সফটওয়্যার দুনিয়ায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কর্মীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এখন আরও অনেক গাঢ়, নির্মম। উবার শাটলে তাঁরা কারও সঙ্গে কথা বলেন না। প্রায় একাই, কোনওরকম কথাবার্তা ছাড়াই কাজ করেন, প্রায় একাই খান। যদিও বা সেখানে দু-চারজন কলিগ জুটেও যায়, আলোচনা মূলত বাজারি মিডিয়া যা দেখায়, তারই কমবেশি প্রতিফলন। সিংহভাগ সফটওয়্যার কর্মীর গড়পড়তা মানসিকতা বোঝাতে হলে বলা যায়, তারা আজকাল ‘সেকুলার’ শব্দটি ঠিক পছন্দ করছেন না। আইটি কর্মীদের উৎসাহে আরজি কর কাণ্ডে তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে অনেকেই মিছিলে হেঁটেছিলেন, এ-কথা সত্য। তবে সেই দাবি কী ধরনের শোষণ, কী সামাজিক ব্যবস্থা, কোন মতাদর্শের বিরুদ্ধে— সে বিষয় নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও মিছিল শেষে ডেডলাইন মেনে অ্যাসাইনমেন্টের কাজ তাঁরা তড়িঘড়ি শুরু করেছিলেন, সে-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়াই যায়। কুম্ভমেলা, পহেলগাঁও এবং প্রমোশন, স্যালারি হাইকের যুগলবন্দি মানসিকতায় দৈনিক গড়ে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজে বিভোর হয়ে যেতে হয় তাদের। আর দ্বৈপায়নদের মতো উচ্চপদস্থ কর্মী হলে শনি-রোববারেও ল্যাপটপে চোখ রাখতেই হয়, কারণ রেভিনিউ বাড়িয়ে তোলাতে সঠিক ভূমিকা না রাখতে পারলে, যে-কোনও মুহূর্তে আসতে পারে পিঙ্ক স্লিপ।
আরও পড়ুন : নির্দোষ এক অপরাধীই অনুপ্রাণিত করেছিল হিচকককে? লিখছেন অতনু ঘোষ…
বাইরে থেকে দেখতে সুন্দর এই শ্রম আপাদমস্তক বাধ্যতামূলক হলেও, কারণ শুধুমাত্র ‘পেটে চাই খাবার নয়তো দিন চলে না’ কিন্তু নয়। বস্তুত, এই প্রযুক্তি-সংস্কৃতির মোহিনী-চক্রে শ্রমিক যেন নিজেই তার শোষণকে গর্ব করে বরণ করে নেয়। আমি অমুক সফটওয়্যার কম্পানির সিনিয়র ডিরেক্টর, এ-কথা বলার মধ্যে যে বেশ একটা ‘ইয়ে’ আছে, তা ক’জন অস্বীকার করতে পারে!
কার্ল মার্কস বলেছিলেন, শ্রমিক তার শ্রম থেকে, উৎপাদন থেকে, সমাজ থেকে, প্রকৃতি থেকে, এবং নিজের থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সবে জয়েন করা ফ্রেশার থেকে দ্বৈপায়ন, সকলের ক্ষেত্রেই একথা শতভাগ সত্য।
এই বাস্তবতার শরিক দ্বৈপায়ন দুপুরের দিকে সকলের অলক্ষ্যে ছ’তলায় চলে যান। রোদ কাচের দেয়ালে ঝিকিমিকি তুলে তাঁকে কোনও সতর্কবার্তা পাঠায়নি। না, তাঁকে কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছিল না, মে দিবসের কথা— যা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নয়, শ্রমিকের অধিকার, নিরাপত্তার কথা বলে। ‘আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘণ্টা যা খুশি তাই’। এই দাবির ভেতরেই লুকিয়ে ছিল আগামীর এক সুস্থতর সভ্যতার স্বপ্ন। যেখানে শ্রমিক মানে শুধু কিবোর্ডে আটকে থাকা হাত, নিরন্তর উৎপাদনের যন্ত্র নয়। সে একজন রক্তমাংসের হৃদয়-সংবলিত জীবন্ত মানবসত্তা। সে সামাজিক, সন্তানের পিতা, নিজের সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গাটিতে পূর্ণাঙ্গ বিকাশের প্রকৃত দাবিদার। কিন্তু প্রশ্ন হল, পারফরম্যান্স রেটিং, টাইমশিট আর ক্যাফেটেরিয়ার উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া তাঁরই মতো ‘প্রোডাক্টিভ রিসোর্স’-দের মধ্যে কে বুঝিয়ে বলবে তাঁকে সে কথা!
মে দিবসের মূল চেতনা, শ্রমিকের জীবনের গৌরব হারিয়ে গেছে আইনি শব্দের জাগলারিতে। সুব্রহ্মণ্যম এবং নারায়ণমূর্তির প্রস্তাব বস্তুত ছদ্মবেশে একধরনের আত্মঘাতী দেশপ্রেমের পরামর্শ। যেখানে মানুষের ক্লান্তি নয়, শ্রমশক্তির নিংড়ে যাওয়াই হয়ে ওঠে এই সময়ের নাগরিকতার মাপকাঠি। এই ধারণা, আদতে, ‘শ্রম-জাতীয়তাবাদ’— যা রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থের বহুদিনের সর্বজনবিদিত নেক্সাস।
সে-কারণেই দ্বৈপায়নের অনুভবে তখন আর কোনও পরিবর্তন আসেনি। লাফিয়ে পড়তে সে নিজেকে আরও একটু বেশি প্রস্তুত করে।
২০২৩ সালে এলঅ্যান্ডটি-র চেয়ারম্যান এস এন সুব্রহ্মণ্যম এবং ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তি দুজনেই প্রস্তাব দেন, ভারতের তরুণদের সপ্তাহে ৭০ থেকে ৯০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত দেশের উন্নতির জন্য। সেই সময়, সাপ্তাহিক ৯০ ঘণ্টার এই দেশপ্রেমে দ্বৈপায়নের সমর্থন ছিল কি না, জানা নেই, কিন্তু মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে, জীবনের সমস্ত অতীত আবেগ, ভালবাসা, পবিত্র খুনসুটি, আকাঙ্ক্ষা আর যা কিছু নিয়ে মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে— তার কাছে সবটাই তখন এক বিষাক্ত ব্যাকরণ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। লাফ দেওয়ার আগে ভীষণ রকমের আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং একই সঙ্গে সামাজিকভাবে বিযুক্ত এই মানুষটির একা দাঁড়িয়ে থাকা, মারাত্মক নীরবতা, বেঁচে থাকা আর হারিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, যাকে ঘোরালে শুধু দিক বদলায়, বাস্তবতা নয়।
এই বাস্তবতা আসলে কী?
ভারতের সাম্প্রতিক শ্রম কোড সংস্কারে এমন সব ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা কার্যত শ্রমিকের সময়, অধিকার, ও নিরাপত্তাকে কমিয়ে আনে অতুলনীয় হারে। চারটি কোডের অন্তর্বস্তুতে (Code on Wages, Code on Social Security, Industrial Relations Code, এবং Occupational Safety Code) ১২ ঘণ্টার ওয়ার্কশিফট বৈধ হয়েছে, ‘ফ্লেক্সিবল কনট্র্যাক্ট’ ছড়িয়ে পড়েছে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির আনাচকানাচে। নেতিবাচক দিকটি এখানেই, এই ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’ আসলে ‘ডিফিকাল্টি অফ লিভিং ফর লেবার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুনাফার নামে কর্মী নয়, জীবনকেই ছাঁটাই করা হচ্ছে, আক্ষরিক ও রূপক— দু’ভাবেই।
মে দিবসের মূল চেতনা, শ্রমিকের জীবনের গৌরব হারিয়ে গেছে আইনি শব্দের জাগলারিতে। সুব্রহ্মণ্যম এবং নারায়ণমূর্তির প্রস্তাব বস্তুত ছদ্মবেশে একধরনের আত্মঘাতী দেশপ্রেমের পরামর্শ। যেখানে মানুষের ক্লান্তি নয়, শ্রমশক্তির নিংড়ে যাওয়াই হয়ে ওঠে এই সময়ের নাগরিকতার মাপকাঠি। এই ধারণা, আদতে, ‘শ্রম-জাতীয়তাবাদ’— যা রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থের বহুদিনের সর্বজনবিদিত নেক্সাস। এখানে ‘দেশ গঠনের’ নামে ব্যক্তিসত্তাকে ভাঙা হয়, তার জীবনের কোমলতা, অপরের প্রতি কর্তব্য, সহানুভূতি, তার একান্ত ব্যক্তিগত সময়কে প্রতিদিন অপমান করা হয়।
গুগল, অ্যামাজন, মেটা, মাইক্রোসফট— এইসব নাম আজকের সিংহভাগ সাধারণ মানুষের কাছে ঈশ্বরতুল্য। কিন্তু সেই মানুষের তৈরি ঈশ্বররাই মানুষকে তুড়ি মেরে ছাঁটাই করে যখনতখন।
২০২৩ সালের মধ্যেই গ্লোবাল টেক কোম্পানিগুলিতে ছাঁটাই হয়েছে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজারের বেশি কর্মী।
ভারতে, বিশেষ করে বেঙ্গালুরু ও হায়দরাবাদ এবং পশ্চিমবঙ্গেও বহু সফটওয়্যার কর্মী এখন ‘বেঞ্চ’-এ। অফিসে এসে নতুন প্রজেক্ট পাওয়ার জন্য এদিকসেদিক হাতড়ে বেড়াতে হয় তাদের। তবুও প্রজেক্ট মেলে না, কাজের না থাকার লজ্জা ঘন হয় আরও। প্রচুর টাকার ইএমআই, ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, বাড়তে থাকা মেডিকেল বিল— এইসব মাথায় নিয়ে এই ভয়ংকর অবস্থানে মানুষ নিজেকে ধীরে ধীরে অপসৃয়মান উদ্বৃত্ত ভাবতে বাধ্য হয়। এই হতাশা শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটা এক গূঢ় আত্মপরিচয়ের সংকট। ক্রমশ আরও বেশি অমানবিক হয়ে ওঠা এই ওয়ার্ক কালচারের বাস্তবতার ক্লিনিক্যাল সংস্করণে আমাদের চারপাশেই আমরা দেখতে পাই, দেহ-বিচ্ছিন্নতা, ওভারটাইমের নামে বন্ধুত্ব, সামাজিকতার পতন, কপি-পেস্ট জীবনের নামে সৃজনশীলতার মৃত্যু। এর কোনও প্রতিরোধ নেই। সামান্যতম তৈরি হলেও তা ধোপে টেকে না। আমরা জেনেছি।
অগত্যা ঝাঁপ দেয় দ্বৈপায়ন।
তারপর সমস্তরকম ফরমালিটি শেষ হয়ে গেলে এই ধরনের আত্মহত্যাকেই বলা হয় ‘ওভারস্ট্রেস’, ‘অপরিচিত মানসিক ভারসাম্যহীনতা’, ‘ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা’। মোদ্দা কথা হল, এই টিকে থাকার যুদ্ধে বছর পঞ্চাশের দ্বৈপায়ন হেরে গিয়েছে এবং হেরে যাওয়ার কোনও সামাজিক পোস্টমর্টেম হয় না।
দ্বৈপায়ন কিন্তু একা নন।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে গুগলের ৩১ বছর বয়সি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তাঁর নিউ ইয়র্ক অফিস থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
২০২৩ সালে ২৪ বছরের সফটওয়্যার কর্মী হায়দরাবাদে আত্মহত্যা করেন ‘অবসাদ ও কাজের চাপ’-এর কারণে।
আমাজন-এর অন্দরমহলের রিপোর্ট ফাঁস করেছে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যর মারাত্মক অবনতির কথা, অথচ কোনওকিছুই প্রকাশ্যে আনা হয় না।
কেবলমাত্র ওয়ার্ক কালচারের জন্যই এইসব মৃত্যু, এমন কথা যেমন সত্য নয়, আবার একই সঙ্গে, অফিস চত্বরের মধ্যে তো বটেই, এমনকী, নিজের ঘরে বা হাটেবাজারে হঠাৎ কোনও এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের হার্ট অ্যাটাকে অকাল-মৃত্যু হলে তার সঙ্গে এই পুঁজিবাদী ওয়ার্ক কালচারের কোনও সম্পর্কই নেই, এমন দাবিও ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাবা-মা, এমনকী, সন্তানের মৃত্যুতে প্রাপ্য ছুটি নিতে হলেও সফটওয়্যার কর্মীদের আজকাল দু-বার ভাবতে হয়। ছুটি মঞ্জুর হলেও প্রভাব পড়ে বছর শেষে পারফরম্যান্স রেটিং-এ। রেটিং খারাপ হলে বেঞ্চে চলে যাওয়ার, চাকরি হারানোর সম্ভাবনা বাড়ে। অতএব ঢোক গিলে, দমবন্ধ করা ইমোশনকে পিষে মেরে প্রফেশনালের নিখুঁত অভিনয় করে চলাটাও এখন বাজারচলতি অভ্যাস।
আজ আন্তর্জাতিক মে দিবস। এই দিনের তাৎপর্য কেবল অতীতের কোনও এক সফল আন্দোলনকে মনে করাই নয়। এই দিন অন্তর্জাগরণের, যা বারংবার প্রশ্ন তোলে, শ্রম বলতে আমরা কী বুঝি? প্রকৃত শ্রমিক হওয়ার অর্থই বা কী? আর মানুষ! তার ঠিক কেমন ভাবে বেঁচে থাকার কথা ছিল?
খেয়াল রাখতে হবে এই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি, প্রি-ওয়েডিং ফটোশুট, রিলস আর ফেক নিউজের ডিজিটাল ল্যান্ডস্লাইডে যেন চাপা না পড়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
Layoffs.fyi
India Today, Aug 2023
ProPublica leak, 2023
(লেখক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যর সহকর্মী ছিলেন)